Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

সম্পাদকীয়

 

১৬ অক্টোবর ২০২২ বিশ্ব খাদ্য দিবস। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) তার জন্মকাল ১৯৪৫ সাল থেকে ১৬ অক্টোবরকে বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। পৃথিবীর সব মানুষের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জোগান নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ এবং দরিদ্রতার মূলোৎপাটন করে ক্ষুধামুক্ত নির্মল পৃথিবী গড়ার কাজে ঋঅঙ নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতিপাদ্যভিত্তিক পালিত হয়ে আসছে। এ বছর পতিপাদ্য ‘Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life.’ এর ভাবার্থ ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’ যা সময়োপযোগী।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরবর্তী দেশ গঠনে এ উপলব্ধি করেছেন। জাতির পিতা প্রদর্শিত পথেই বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে কৃষি উন্নয়নে বাস্তবমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। ফলে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যের উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^র প্রথম ১০টি দেশের কাতারে রয়েছে। মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনেও দেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ সাফল্য এসেছে কৃষিক্ষেত্রে লাগসই জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও তার যথাযথ ব্যবহারে কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক, কৃষি সম্প্রসারণবিদ, সুশীল সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে। বৈশ্বিক মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নানাবিধ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনের কারণে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা প্রভাবিত হচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাফল্য অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও অধিক বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য।
প্রিয় পাঠক, কৃষি মন্ত্রণালয় ও এফএও বাংলাদেশের উদ্যোগে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২ উদ্যাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে মাসিক কৃষিকথার বিশেষ সংখ্যা মুদ্রণ করা হচ্ছে। কৃষিকথা বিশেষ সংখ্যায় দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে দিকনির্দেশনামূলক বাণী এবং মানসম্পন্ন ও তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ লেখা যারা দিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি তথ্য সংবলিত লেখাগুলো বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের সফল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব খাদ্য দিবস সফল হোক, সার্থক হোক এই কামনা। সবাইকে অফুরান শুভেচ্ছা।

বিস্তারিত
সূচিপত্র

নিবন্ধ
    
   কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন    ১৫    
     মোঃ সায়েদুল ইসলাম
   বিশ^ খাদ্য দিবস : বিএডিসি ও খাদ্যে স্বনির্ভর বাংলাদেশ     ১৭    
    এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
    টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা    ১৯    
    ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ড. সুস্মিতা দাস    
   বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর    ২১
    মোঃ বেনজীর আলম    
   সাম্প্রতিক বিশ^ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়    ২৩
    কৃষিবিদ ড. মো. হামিদুর রহমান
  নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য খাত    ২৫    
    খঃ মাহবুবুল হক
    উন্নত জীবন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব    ২৭
    ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা, ড. হোসেন মো: সেলিম
    নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান    ২৮
    ড. দেবাশীষ সরকার, ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
    জিংকসমৃদ্ধ ধান শরীরে জিংকের অভাব পূরণে টেকসই সমাধান    ৩০    
    ড. মো. শাহজাহান কবীর, ড. মো. আবদুল কাদের, কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
    বাংলাদেশে ধান ও চালের পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদতা    ৩২    
    প্রফেসর ড. মো: আব্দুল আলীম
    খাদ্য নিরাপত্তা : প্রয়োজন সমন্বিত সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা    ৩৪    
    ড. আবদুল্লাহ ইকবাল
    ফল ও সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে কৃষকের আয় বর্ধন    ৩৬    
    মো: মনজুরুল হান্নান, ড. মো: আতিকুর রহমান
    এফএও’র ঋড়ঁৎ ইবঃঃবৎং ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন    ৩৮    
    মোঃ এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি

নিয়মিত বিভাগ
   কার্তিক মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি    ৩৯    
    কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন    
   অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি (১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর)    ৪০
    কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম

 

বিস্তারিত
কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন

কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন
মোঃ সায়েদুল ইসলাম
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি ১৯৭৯ সাল থেকে তাদের এই প্রতিষ্ঠা দিবসকে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ হিসেবে উদযাপন শুরু করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’। চলমান বৈশ্বিক মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পণ্য মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ একাধিক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সাথে এ বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২ পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life.’ যার ভাবানুবাদ ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষক অন্তপ্রাণ। সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশ পুনর্গঠন করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশের সার্বিক উন্নয়নে কৃষির উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের, তাই তিনি সূচনা করেন সবুজ বিপ্লবের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি পূরণে কৃষিবিজ্ঞান, গবেষণা, সম্প্রসারণ, শিল্প ও বাজার উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি পেশায় আকৃষ্ট করতে কৃষিবিদদের সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কৃষির আধুনিকায়নের সূত্রপাত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই।
জাতির পিতার দর্শনকে অন্তরে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিবান্ধব নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন। কৃষির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বীজ, সারসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সহনশীল মূল্যে ক্রয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ বিস্তৃত করার পাশাপাশি কৃষকদের ঋণ সুবিধা প্রদান, নগদ আর্থিক ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, ফসলের সময়োপযোগী উপযুক্ত জাত ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  কৃষির অব্যাহত উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বর্তমান বিশে^ পাট রপ্তানিতে প্রথম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে একটানা চার বছর তৃতীয় অবস্থান, একইভাবে সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনেও তৃতীয়, আম ও আলু উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।
কোভিড-১৯সহ বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতিতেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ও কার্যকর পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের এক ইঞ্চি কৃষি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সে লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী  ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপির নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে ইউনিয়ন পর্যায়ে সবজি বাগান সৃজনসহ সমলয় চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। গবেষণা খাতে সরকারের অব্যাহত প্রণোদনা ও উৎসাহে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত, জিংকসমৃদ্ধ ধান, দেশের আবহাওয়া উপযোগী বিভিন্ন ফলের জাতসহ ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন। নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে সাফল্য এসেছে এবং আমদানি নির্ভরতা অনেক কমে এসেছে। দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে তিন বছরমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন না কমিয়েই আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে স্থানীয়ভাবে চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ তেল উৎপাদন করা হবে। ২০৫০ সালে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ‘ডাবলিং রাইস প্রোডাক্টিভিটি-ডিআরপি’ মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন রকম উদ্যান ফসল উৎপাদনে পাহাড়ি কৃষির এক বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উচ্চমূল্যের ফসল কাজুবাদাম ও কফি চাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর পদক্ষেপে শুধু খাদ্য উৎপাদনই বাড়ছে না, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এক সময় পাটই ছিল মূলত রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য। বর্তমানে পাট ছাড়াও ৭০টিরও বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আমরা ছাড়িয়ে গেছি ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক। বাংলাদেশের সুস্বাদু আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনসহ রপ্তানি বাড়াতে ‘বাংলাদেশ উত্তম কৃষি চর্চা নীতিমালা-২০২০ ’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ৭৫ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার জন্য কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও বিশ্বে চাহিদার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত তথাপি বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে পারছে না, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। কোভিড-১৯ মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান মূল্য এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ সমভাবে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। যদিও আমরা একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের মুখে অনেক দেশ পিছিয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জনসংখ্যা আরো বেশি আন্তঃসংযুক্ত হয়ে উঠেছে। কোন একটি দেশ পিছিয়ে থাকলে বৈশ্বিক উন্নয়নের শিকলটি ভেঙে যায়। বৈশ্বিক সংকটের মুখে, বৈশ্বিক সমাধান আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন। ভালো উৎপাদন, উত্তম পুষ্টি, একটি সুরক্ষিত পরিবেশ এবং একটি উন্নত জীবনের লক্ষ্য নিয়ে, আমরা দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৃহত্তর স্থিতিস্থাপকতা বিবেচনা করে একটি টেকসই ও সামগ্রিক সমাধান বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষি খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করতে এবং আরও ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। সে জন্য সবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপায়িত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনসহ রূপকল্প ২০৪১ অনুুযায়ী বাংলাদেশকে সুখীসমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ উন্নত দেশের অভিযাত্রায় সবার কার্যকর অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।

লেখক : সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়।www.moa.gov.bd

 

বিস্তারিত
বিশ্ব খাদ্য দিবস : বিএডিসি ও খাদ্যে স্বনির্ভর বাংলাদেশ

বিশ্ব খাদ্য দিবস : বিএডিসি ও খাদ্যে স্বনির্ভর বাংলাদেশ
এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
মানুষ ও পুরো প্রাণীজগতের টিকে থাকার জন্য অক্সিজেনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খাদ্য। খাদ্য আমাদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে, শারীরিকে শক্তি প্রদান করে এবং খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শারিরীক ও মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে অন্যান্য কার‌্যাবলি ও সেবাপ্রাপ্তিকে সুনিশ্চিত করে। এ জন্য আমাদের স্বাভাবিক আলোচনায় মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে সবার আগে স্থান পায় খাদ্য-তারপর বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা ও বিনোদন ইত্যাদি।
দুর্নীতি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য-একটি দেশ ও জাতির উন্নতির পথে প্রধান তিনটি অন্তরায়। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ (Zero tolerance) নীতি ঘোষণাপূর্বক দেশের কল্যাণমূলক নানা উদ্যোগ, কর্ম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তিনি কৃষক, মাঠ প্রশাসন ও কৃষি বিষয়ক মন্ত্রণলায়-দপ্তর-সংস্থাগুলোর ঐক্যবদ্ধ সমন্বয় ঘটিয়েছেন। খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যকে যুগপৎ একই ফ্রেমে রেখে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও বণ্টন প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অভাবনীয় উন্নয়ন কর্মকা-ের গর্বিত অংশীদার বিএডিসি।
এ বছর বিশ^ খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন (Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better lifব)। প্রতিপাদ্য থেকে এটি স্পষ্ট, আমাদের আজকের কর্মকা-ই যে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে সেটিকেই বোঝানো হয়েছে। একই সঙ্গে একটি টেকসই, কার্যকর, কল্যাণকর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শুধু উৎপাদন করলেই চলবেনা, উৎপাদন প্রক্রিয়া যেন প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য ইতিবাচক হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে। যদি আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ভালো হয় তবে আমাদের পরিবেশ উত্তম থাকবে, পরিবেশে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য থাকবে, বাস্তুসংস্থান সকল প্রাণের বেঁচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে এবং আমরা উত্তম ও পুষ্টিকর খাদ্য পাবো। আর প্রতিপাদ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবেনা’ এমন পরিণতি মানবজাতির খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং এ কারণেই সকলকে নিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ার আবশ্যকতা থেকে যায়। আমরা সবাই জানি ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ এবং এই কারণেই প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রাণপ্রকৃতিবান্ধব পরিবেশে উৎপাদিত পুষ্টিকর খাদ্য আমাদের সবার জন্য একটি উত্তম ও সুখী জীবনব্যবস্থা দিতে পারে। এভাবে এবারে বিশ^ খাদ্য দিবস সমষ্টিক শান্তি ও সুখ লাভের জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিগ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে উপস্থাপন করে।
কে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে বঙ্গবন্ধু কৃষিকে দিয়েছিলেন সর্বাধিক গুরুত্ব। সেই মূলমন্ত্র ধারণ করে কৃষি মন্ত্রণালয় তার সকল সংস্থা, দপ্তর নিয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী  ড. মোঃ আবদুর রাজ্জাক এমপি এর নির্দেশনায় বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশে বিএডিসি বাংলাদেশের খাদ্য লড়াইয়ের অন্যতম অগ্রসেনা হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অভিলক্ষ্য ‘ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ ফসল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক করা এবং জনসাধারণের পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিরাপদ ও পুষ্টিকর ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে চলেছে বিএডিসি।
বর্তমানে সর্বোচ্চ পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন এবং খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ধান, শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য ফসলের পোকা-রোগ দমনে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক এবং কাঁচা ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোপেন ও রাইপেন ব্যবহার করা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো  সবজি-ফল মাঠে থাকা অবস্থায় পোকা-রোগ দমনে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক, সংগ্রহোত্তর পাকার জন্য কার্বাইড এবং পচনরোধের জন্য ফরমালিন ব্যবহারের কারণে এসব ফসল বিষটোপে পরিণত হয়। তাই এগুলো খাওয়ার সঙ্গে কিছু পরিমাণ বিষ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
ভেজাল ও বিষযুক্ত খাদ্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। এ কারণে এসডিজি গ্রহণের দুই বছর পূর্বেই নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বণ্টনকে সুনিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে। এই আইন প্রয়োগ করার কারণে বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল, ভেজাল পণ্য সংরক্ষণে ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। এ আইনের সাফল্যকে আরো বেশি টেকসই ও বিস্তৃত করতে সরকার ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এ আইন অনুযায়ী ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠা করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ‘সফলভাবে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, গুদামজাতকরণ, বিতরণ এবং বিপণন প্রক্রিয়ায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন এবং বিক্রয় প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা প্রদান এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার কার‌্যাবলির সমন্বয় সাধন করে থাকে’ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট)।

নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের প্রতি শতভাগ মনোযোগী হয়ে স্বল্প জমিতে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনের মত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কৃষিতে বীজ, সার, সেচ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে চলেছে বিএডিসি। নিরাপদ খাদ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে নতুন, উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদনের পূর্বে বিএডিসি দীর্ঘ গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও ফল নিরীক্ষণ করে থাকে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে নিরাপদ কৃষির আওতায় এই দেশের ভূমির অনুকূল, অধিক উৎপাদনসক্ষম বীজ সরবরাহ করে বিএডিসি।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার রপ্তানিযোগ্য ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং কার্যকর বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের বিষয়টি অন্যান্য কৃষি উৎপাদনের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। সবজি ফসল বিভিন্ন রোগ ও কীট পতঙ্গ দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয়। তাই উৎপাদন পর্যায়ে কৃষক অতিমাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার এবং নিরাপদ সময়ের আগেই তা বাজারজাত করে। অনেক সবজিই কাঁচা বা অল্প রান্নায় খাওয়া হয় বলে মানবদেহে বিষাক্ত খাবারের প্রভাব পড়ে।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অতিবেগুনি রশ্মি, ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ হতে ফসলকে রক্ষা করে ড্রিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে সেচ এর ব্যবস্থা করে এবং সারা বছর অর্থাৎ ৩ (তিন) মৌসুমেই নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য সবজি ও ফুল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। পলি হাউজে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ফগার ইরিগেশনের মাধ্যমে সবজি ও ফুলের অতি ক্ষুদ্রাকারে (কুয়াশাসদৃশ্য) সেচ প্রয়োগে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে গুণগতমান অক্ষুন্ন রাখা হচ্ছে। ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহারে নিরাপদ সবজি ও ফুল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জৈবসারের ব্যবহার-কম্পোস্ট সার, কেঁচো কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট-সার ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া মাটি পরীক্ষা করে জমিতে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার নিয়ম মোতাবেক প্রয়োগ করা, ইউরিয়া সারের প্রয়োগ কমিয়ে ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়ানো, ফসল উৎপাদনে আইপিএম কৌশল-জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা-ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার, উপকারি পোকামাকড় সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিকরণ, আইল ফসল চাষাবাদ; বালাই সহনশীল জাত ব্যবহার করা; আধুনিক কৃষি চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা যেমন ভালো বীজ ব্যবহার, বীজ শোধন. আদর্শ বীজতলা তৈরি, মাটি শোধন করা. সেক্স ফেরোমন ট্রেপ ও বিষটোপ ব্যবহার, সার ব্যবস্থাপনা, আগাছা ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা, সঠিক সময়ে ফসল মাড়াই করা এসব; যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা যেমন হাত জাল, আলোক ফাঁদ এসব মেনে চলা, অবশেষে বালাইনাশকের যুক্তিসম্মত ব্যবহার অর্থাৎ সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বালাইনাশক স্প্রে করা উচিত। এতে ফসলে ক্ষতির রাসায়নিক সার/কীটনাশকের প্রভাব থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিএডিসি এ সকল কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করে আসছে, যা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোরালো ভূমিকা পালন করছে।
দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এবং রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিএডিসির কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষক পর্যায়ে মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায় সৌদি আরব, তিউনিশিয়া, মরক্কো, বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা হতে নন-নাইট্রোজেনাস সার আমদানি এবং সেচ এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে পতিত জমি আবাদি জমিতে রূপান্তরিত করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
এই করোনা মহামারীতে বিশে^র অনেক দেশ ও জাতি তার জনপদের খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ হয়েছে বা হিমশিম খেয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের বাইরে খাদ্য রপ্তানিও করেছে বাংলাদেশ। বিএডিসির ডায়মন্ড জাতের আলু রপ্তানি হচ্ছে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে। দেশ থেকে সবজি যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি’র নির্দেশে কৃষিখাতকে আধুনিকায়ন ও কৃষকপর্যায়ে কৃষিবিষয়ক উপকরণসমূহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর, সংস্থাগুলো দক্ষতার সঙ্গে পৌঁছে দেওয়ায় বদলে গেছে বাংলার কৃষির চেহারা। বাংলাদেশ তাই এখন দানাদার শস্য ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। প্রতিটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিধান, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিএডিসি’র আন্তরিক প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। বিশ্¦ খাদ্য দিবসে প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজ নিরলস শ্রম দিয়ে যাবে। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ হবে খাদ্যে পরিপূর্ণ আমাদের প্রিয় স্বদেশ, পরম ভালোবাসার জন্মভূমি।
 
লেখক : চেয়ারম্যান (গ্রেড-১), বিএডিসি। ফোন : ২২৩৩৮৪৩৫৮, ই-মেইল : chairman@badc.gov.bd

 

বিস্তারিত
টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা

টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার১ ড. সুস্মিতা দাস২
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে আমাদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি এমন এক পৃথিবী যেখানে থাকবেনা ক্ষুধা-দারিদ্র্য রোগ-শোক অভাব-অনটন। স্বপ্ন দেখি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত  এক আলোকিত পৃথিবীর। LEAVE NO ON BEHIND (LNOB) IS THE CENTRAL, TRANSFORMATIVE PROMISE OF THE 2030 AGENDA FOR SUSTAINABLE DEVELOPMENT-এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং ১৬৯টি সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা সমন্বিত অবিচ্ছেদ্য। এরই মধ্যে কখনোই বিশ্বনেতৃবৃন্দ এত ব্যাপক পরিসরে ও সর্বজনীন নীতি প্রক্রিয়ার সম্মিলিত কর্ম প্রচেষ্টার অঙ্গীকারবদ্ধ হননি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্তে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ উল্লেখযোগ্য এবং অত্যাবশ্যক। যার স্বপ্ন দেখতেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সেই সাথে এগিয়ে চলেছে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিতকরণের কার্যক্রম। তারই অংশ হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশও প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে খাদ্যের অপরিহার্যতার গুরুত্ব বিষয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যেই ১৬ অক্টোবর কে প্রতিবছর বিশ্ব খাদ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কেননা এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘের অন্যতম একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life’ এর ভাবার্থ ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে  নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’। যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও বৈশ্বিক খাদ্য পুষ্টি অর্জনে সময় উপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকের পুষ্টি উন্নয়নে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। যার  উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর এই কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে আজকের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছয় বছর আগের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট স্থির করার পর যে তিনটি দেশ আগের অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।জাতিসংঘের Sustainable development soolutions network report  ২০২১ সালের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলেছে এইচটিসি সূচকে বিশ্বের ১৬৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। চার বছর আগে ২০১৭ সালে সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে ১২০তম অবস্থান ছিল বাংলাদেশের। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ৬৩.৫। যা সত্যিই আমাদেরকে আশার আলো দেখায়।
এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সমন্বিত নীতি কাঠামো প্রণয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রধান কারণ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। একইসঙ্গে এসডিজিকে সমন্বিত করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) সাথে যা উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে সমাজের দারিদ্র্য, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে একীভূত করেছে। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণায় প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে যার ফলে জীবিকা নির্ভর কৃষি থেকে বাংলাদেশের কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
দেশের সার্বিক পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নেতৃত্বে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অসংখ্য লাগসই প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ফসলের জাত সার্বিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দেশের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে চলেছে। দেশে এক ও দুই ফসলি জমি অঞ্চল বর্তমানে ৪ ফসলের জমিতে পরিণত করা হয়েছে। ফসলের অধিকতর উৎপাদনের লক্ষ্যে এবং পুষ্টি নিরাপত্তা বিবেচনায় অঞ্চলভিত্তিক ফসল বিন্যাস এবং সে অনুযায়ী চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘ক্রপ জোনিং’ এর গুরুত্ব অপরিসীম। ক্রমবর্ধমান খাদ্য উৎপাদন চাহিদার বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্রপ জোনিংভিত্তিক ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এবং উৎপাদন কর্মসূচী গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসংগে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তারিখে বিএআরসি কর্তৃক প্রকাশিত ‘১০০ প্রযুক্তি এটলাস’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্রপ জোনিংয়ের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে এত্দবিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন। বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ক্রপ জোনিং প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এরই মধ্যে, ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৩০০টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং সম্পন্ন হয়েছে, অবশিষ্ট ১৯৫টি উপজেলার ক্রপ জোনিং কার্যক্রম চলমান। ফসল উপযোগিতা নিরূপণ ও ক্রপ জোনিংয়ের জন্য জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন ক্রপ জোনিং ইনফরমেশন সিস্টেম (CZIS) সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে (www.cropzoning.gov.bd)। বিএআরসি স্থানভিত্তিক উপযোগী ফসল ও ফসল বিন্যাস, ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আর্থিক লাভ বিষয়ক তথ্য এবং মাটির উর্বরতা অনুযায়ী ফসলভিত্তিক সার সুপারিশ কৃষক ও অন্যান্য উপকারভোগীর নিকট সরবরাহ করার লক্ষ্যে ‘খামারি’ নামে একটি মোবাইল আ্যপ প্রস্তুত করা হয়েছে। যা কৃষকদের সঠিক ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে ।
পুষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমূহের বিজ্ঞানীগণ তাদের ধারাবাহিক এবং নিরন্তর গবেষণার ফলে ধানসহ বিভিন্ন ফলদ শাকসবজির জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। ফলে সারা বছর শাকসবজি ও ফল ফলাদির চাষ হচ্ছে যা দেশের সার্বিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিট মানুষের উন্নত পুষ্টির জন্য কাজ করে আসছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্পের পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নে নার্স ইনস্টিটিউট বিসিএসআইআর, বিএফএসএ, বারটান এবং পুষ্টিতে নিয়োজিত সংস্থাগুলির সাথে গবেষণা কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে চলেছে। এছাড়াও পুষ্টি সংক্রান্ত নিয়মিত প্রশিক্ষণ, খাদ্যে ভেজাল বিষয়ক গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। শস্য পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক পুষ্টিসহ উন্নয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে নিয়মিত প্রযুক্তিগত পরামর্শ প্রদান করে আসছে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিট।
জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ ভাতের মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান (যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, মিনারেলস্সহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো) দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণ বৃদ্ধি এবং বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। জিংক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ শাকসবজি, ফলমূল, গম, তেল বীজ ফসল এবং ডালজাতীয় ফসলের বিভিন্ন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা আজ বহুলাংশে মিটানো সম্ভব হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশের আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দেশের বাস্তবিক ও বিজ্ঞানসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণসহ নানাবিধ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
১৫ বছর মেয়াদি জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প (NATP) কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সাল থেকে দেশব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পটি শিশু ও নারীদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে দেশের গম, ডাল, তেলবীজ, শাকসবজি, ফলমূল ও দুধ মাংস উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
কৃষি গবেষণাকে আরো যুগোপযোগী করে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় আরো বেশি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। কৃষি মন্ত্রণালেয়ের উদ্যোগে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সমন্বয়ে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ প্রণীত হয়েছে। এ নীতিতে কৃষিকে আরও আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চত করার লক্ষ্যে কৃষি নীতিতে নতুন করে ন্যানো প্রযুক্তির মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নের পথে হাটছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল অন্যান্য জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিগত দশকের অভূতপূর্ব উন্নয়নের উদীপ্ত কর্মফলের ধারাবাহিকতা আগামীতে চলমান রাখতে পারলে আমরা আশান্বিত হতেই পারি ২০৩০ সালের এসডিজি গন্তব্যে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর গর্বিত অংশীদার।

লেখক : ১নির্বাহী চেয়ারম্যান, ২প্রধান ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, মোবাইল : ০১৭১১১০২১৯৮, ই- মেইল :susmitabarc@gmail.com

 

বিস্তারিত
বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মোঃ বেনজীর আলম
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি, উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা-রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন। জাতির পিতার কৃষি বিপ্লবের সেই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং তখন থেকেই বাংলাদেশ সংস্থাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। জাতির পিতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষির উন্নয়ন করতে হবে। তাই তিনি সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষক ও শ্রমিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যখন সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন, তখন উন্নয়ন বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি কৃষির উন্নয়নে অনেক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশনায় প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে খাদ্য ও পুষ্টিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দুঃসময়ে দেশের হাল ধরে দূরদর্শী ও সাহসী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্ব দরবারে দেশকে এক বিশাল সফলতায় নিয়ে গেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই স্বল্পকালীন গত ১০-১২ বছরের শাসনের সাফল্যও অনেক। কৃষিতে সাফল্য বিবেচনায় প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের ২০০৯ সালের সাথে তুলনায় ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চালের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩%, গমের ৪৫%, ভুট্টার ৭৭৫%, আলুতে ১০১%, ডালে ৩৭৫%, তেলবীজে ৮১%, সবজির ক্ষেত্রে ৫৭৮% যা বিশ্বে অভাবনীয়। এ দেশে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
কৃষিবান্ধব নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ এখন দানাশস্য, সবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সারা বছর এখন শাকসবজি ফলমূল যে কোন মানুষের জন্য সহজলভ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল দপ্তর-সংস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে বিধায় দেশে এখন খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পর্যায়ে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম স্থান অর্জন করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক পদক্ষেপে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড বোরো উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ টন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এছাড়াও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এক বছরে ৭ লাখ টন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। করোনাকালের মাঝেও বাংলাদেশ বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life. এর ভাবানুবাদ “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন”। সময় বিবেচনায় উপযুক্ত প্রতিপাদ্য। বর্তমানে বিশ্ব এক ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসজনিত রোগের সম্মুখীন। এই মহামারি থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশও। চরম ক্রান্তিকাল ও সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খাদ্যের কোন অভাব না থাকলেও সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। মানুষের খাদ্যক্রয়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। পুষ্টিবিদরা সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণের কথা বলেন। সুষম খাদ্যের অর্থই হলো দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবেলায় খাদ্যের প্রত্যেকটি উপাদান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। আর এজন্য প্রয়োজন সফল উৎপাদন নিশ্চিতকরণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মিশন বা অভিলক্ষ্য হলো টেকসই ও লাভজনক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে দক্ষ, ফলপ্রসূ, বিকেন্দ্রীকৃত, এলাকানির্ভর, চাহিদাভিত্তিক এবং সমন্বিত কৃষি সম্পসারণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে সকল শ্রেণির            কৃষকের প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন দেশের সর্ববৃহৎ কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে দেশের কৃষির উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থাটি দলভিত্তিক সম্প্রসারণ সেবা প্রদান পদ্ধতির মাধ্যমে                কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত লাগসই সকল প্রযুক্তিসহ এই সময়ে ২০০টিরও বেশি ফসলের উৎপাদনে বীজ ব্যবস্থাপনা; মাটি, সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা; ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সহজলভ্যকরণ ও কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন দুর্যোগে কৃষকের পাশে থেকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এই অধিদপ্তর মাঠ ফসলের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন ফসলের এলাকাভিত্তিক অভিযোজন কলাকৌশলও মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করছে। এছাড়াও ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষ সম্প্রসারণ করে সবজি ও মসলা উৎপাদন বৃদ্ধি করার কাজ চলমান রয়েছে। প্রচলিত কৃষির পাশাপাশি উচ্চমূল্যের সবজি চাষ এবং অপ্রচলিত ও ট্রপিক্যাল অঞ্চলের বিদেশি ফলমূল জনপ্রিয় করাসহ এর উৎপাদন বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে। পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচকাজে ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সুসমন্বিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সংস্থাটির বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে দেশের কৃষি জমি চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। ফসল সংগ্রহ ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৫০-৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্র পরিচালনায় এসেই কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম শুরু করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ তার মধ্যে অন্যতম। জুলাই, ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার টিলারসহ মোট ৭৪৯৮০টি কৃষি যন্ত্রপাতি ডিএইর মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং লাগসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই কৃষিতে সাফল্য বয়ে আনছে ডিএই কর্মীরা। গবেষণা কার্যক্রম ও কৃষকের মধ্যে তারা যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রযুক্তিগতভাবে আরও দক্ষ করে তুলতে কাজ করছে সংস্থাটি। এতে যেমন কৃষকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়, তেমনি সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নও সহজ হয়।
কৃষি উন্নয়নে বাংলাদেশের সার্বিক সাফল্যে আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো এসডিজি বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার এবং জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি কর্তৃক ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের    স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) পদক প্রাপ্তি, যা কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি বড় অর্জন। এখানে কাজের অংশীদার হতে পেরে ডিএই পরিবার গর্বিত।
বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর জাতীয় উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার অনুসৃত নীতিমালার আলোকেই বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ ও সর্বোপরি দেশের সার্বিক সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দেশে বিদ্যমান যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আধুনিক, ব্যয় সাশ্রয়ী ও লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রণীত রোডম্যাপ কার্যকর করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষকের সাথে থেকে কাজ করে যাবে।


লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন: ০২৫৫০২৮৩৬৯, ইমেইল:dg@dae.gov.bd

 

বিস্তারিত
সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
কৃষিবিদ ড. মো. হামিদুর রহমান
সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের খাদ্য চাহিদা, চাহিদা পূরণের ভাবনা ও প্রচেষ্টা অন্য সব জীব থেকে আলাদা। মানুষের ৫টি মৌলিক চাহিদার শীর্ষে খাদ্যের অবস্থান। সময়, দেশ, জাতি, সংস্কৃতির প্রকারভেদে মানুষের খাদ্য দ্রব্যের ধরনে ভিন্নতা থাকলেও সুষম খাদ্যের অনিবার্য উপাদান বিচারে আধুনিক মানবসমাজ সর্বজনগ্রাহ্য এক ঐকমত্যে উপনীত হয়েছে। আর এ উপাদানগুলো হলো- শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। শারীরিক গঠন (ওজন ও উচ্চতা) ও বয়সভেদে মানুষে মানুষে এসব উপাদানের চাহিদার তারতম্য থাকলেও মানুষের খাদ্য চিন্তা এসব উপাদানের দৈনিন্দিন প্রাপ্যতার নিশ্চয়তা বিষয়ে আবর্তিত। বর্ণিত উপাদানগুলোর আদি ও চিরন্তন উৎস্য হচ্ছে প্রকৃতিপ্রদত্ত উদ্ভিদ, প্রাণি ও পানি। মানুষ এই প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের প্রয়োজনমত আয়ত্ব করার যে ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে তার নাম ‘আধুনিক কৃষি’। কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তনের মধ্যদিয়ে মানবসমাজ সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়েছে। এ কারণে কৃষি চর্চা মানুষের আদি ও অনন্তের পেশা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মানবসমাজ যতদিন ভূম-লে টিকে থাকবে সেই পর্যন্ত খাদ্যের জন্য তাদের কৃষি চর্চা করতে হবে। সে কারণে খাদ্য ও কৃষি একসূত্রে গাঁথা আর কৃষি চর্চা মানবসভ্যতার মহত্তম অর্জন।
‘খাদ্য নিরাপত্তা’ শব্দগুচ্ছ সাম্প্রতিক কালে বহুল উচ্চারিত ও আলোচিত। ‘নিরাপদ’ শব্দটি আপদ মুক্ত থাকার অভিপ্রায়জাত। ‘নিরাপত্তা’ বিষয়টি সাধারণত শারীরিকভাবে আক্রান্ত না হওয়া  বা বিপন্নতা মুক্ত থাকার উপায় হিসেবে বিবেচিত হতো। এই শব্দটি অধুনা মানবসভ্যতায় বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে খাদ্যের সাথে যুক্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে এবং মানবকল্যাণ তথা বৈশি^ক উন্নয়ন ভাবনার শীর্ষে অবস্থান নিয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে সহস্রাব্দের উন্নয়ন অভিলক্ষ্য (এমডিজি ২০০০-২০১৫) ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি ২০১৬-২০৩০) বাস্তবায়ন উদ্যোগের মাধ্যমে। এ দুটি অভিলক্ষ্যেই গুরুত্ব পেয়েছে ‘ক্ষুধার অবসান’। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল মানুষ চিরকালের জন্য ক্ষুধামুক্ত হবে- সর্বকালের সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। এই হচ্ছে আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ও কর্তব্য। খাদ্য নিরাপত্তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রাষ্ট্রীয় পরিসরে সকল নাগরিক যেন সব সময়ের জন্য তাদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণে অধিগম্যতা প্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে খাদ্যের জোগান ব্যবস্থা অটুট থাকা ও নাগরিকদের বাজার থেকে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য অর্জনই মূলকথা। খাদ্যের জোগান কেবল দেশজ উৎপাদন নির্ভর নয় অনেকাংশে বৈশি^ক বাজার ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। আর নাগরিকদের খাদ্য অধিগম্যতা তাদের নিজস্ব উৎপাদন কিংবা ক্রয় ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা এক ধরনের সামর্থ্য। এই অধিগম্যতার সাথে আরও দু’টি মানদ- নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত আর তা হলো- খাদ্যের পুষ্টিগুণ ও মানব শরীরের জন্য খাদ্য ক্ষতিকারক উপাদান মুক্ত কি না সে বিষয় নিশ্চিত হওয়া। এক কথায় রাষ্ট্রীয় পরিসরে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝবো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রতিবেলার প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর ও শরীরের জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হওয়া। কাজেই খাদ্যের জোগানের পর্যাপ্ততা, পুষ্টিগুণ, নিরাপদ হওয়া ও সকল নাগরিকের অধিগম্যতা- এই চারটি মাত্রার সমন্বয়ই হল খাদ্য নিরাপত্তা। তারপরও কথা থাকে- রন্ধন প্রণালি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশনের ক্ষেত্রেও খাদ্যের পুষ্টিমান, নিরাপদ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করাও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অপরিহার্য অঙ্গ।
বিশ^ পরিস্থিতি : বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতি সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত, যার প্রধান দু’টি উপাদান হল চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির ভুবনজোড়া ভয়াবহতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। এর বাইরে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতও একটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত বিষয় যা বিশ^ পরিসরে মানুষের জীবনযাপন বিশেষ করে খাদ্য পরিস্থিতির উপর নিরন্তর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এসব বিষয় সমৃদ্ধি ও শান্তিপ্রত্যাশী মানবসভ্যতার মর্মমূলে আঘাত হেনেছে। এই আঘাত প্রতিহত করাই এখন মানবসভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে মোকাবিলার সাথে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়টিও ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পাশাপাশি যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য গমজাত খাদ্যের বাজার ও পরিশোধিত তেলের বাজার অস্থিতিশীল রয়েছে। বহুদেশে এ দু’টি প্রধান খাদ্যের মূল্য বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সেই সাথে জ¦ালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে নানা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাস ও জ¦ালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ জন্য ভোক্তাদের ভোগ করতে হচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণা। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ডলার ও ইউরোর বিনিময় মূলবৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার উপর এর কুপ্রভাব পড়েছে ফলে গোটা মানবসভ্যতা এক ধরনের অস্বস্থি ও সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে।
কোভিড অতিমারি মানবদেহের রোগ প্রতিরাধ ক্ষমতা বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে সামনে এনেছে এবং এই ক্ষমতা অর্জনে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যে বিশ^মানবের অধিগম্যতাকে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই সাথে পরিবেশ প্রতিবেশ ও জীবনাচারের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য করণীয় হলো-
এক : যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং বিশ^শান্তির পক্ষে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা। যুদ্ধবন্ধে বিশ^ জনমত সৃষ্টি, যুদ্ধের অবসানের সকল রাষ্ট্রশক্তির ঐকমত্য সৃষ্টির উপায় অন্বেষণ ও তা ফলদায়ক করা। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
দুই : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবক কারণসমূহ দূরীকরণ বৈশি^ক উদ্যোগ জোরদার করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের সাথে খাপখাওয়ানোর উপযোগী উপায় অন্বেষণে গবেষণা ও গবেষণা জাত ফলাফল প্রয়োগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সম্ভব সকল কিছু করা। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি এবং সে কারণে এ বিষয়টি প্রত্যক্ষভাবে খাদ্য পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে।
তিন : জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় যত্নবান হওয়া। কেননা জীব-বৈচিত্র্যের সাথে মানবসমাজের খাদ্য নিরাপত্তা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। মানুষের খাদ্য আসে প্রাণি ও উদ্ভিদ থেকে। আর এই প্রাণি ও উদ্ভিদ তথা জীবজগতই হলো জীববৈচিত্র্যের প্রাণ। এ কারণে জীববৈচিত্র্যের সামান্য ক্ষতিও মানুষের জন্য খাদ্য ঝুঁকি।
চার : কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে নিরন্তর উদ্ভাবন- কৃষিই খাদ্যের আধার। তাই কৃষি ব্যবস্থার নিরন্তর উন্নয়ন আবশ্যক। আর এ উন্নয়ন সাধনে উত্তরোত্তর উচ্চতর গবেষণা ও নবনব উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। বৈশি^ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পুষ্টিকর নিরাপদ খাদ্যের জোগান বৃদ্ধির জন্য কৃষির উন্নয়ন একটি চিরন্তন প্রতিকার। উদ্ভিদ ও প্রাণির উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন, যন্ত্রের ব্যবহার, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির আধুনিকায়নে নিরন্তর উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি।
পাঁচ : নারী ও পুরুষের সমতা বিধান। এ বিষয়টি সভ্যতার বিকাশকেন্দিক সার্বিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ নারী মিলেই মানবসমাজ, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অগ্রায়ন অপরিহার্য। নারীরা জনগোষ্ঠীর অর্ধেক তাই তাদের মেধা, কর্মশক্তির সদব্যবহার বৃহৎ অর্থে মানব সভ্যতার অগ্রায়নেরই নামান্তর। বিশেষ করে মানুষের খাদ্য  সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীরা খাদ্য রন্ধন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশনের সাথে অধিকতর সম্পৃক্ত। এ কারণে নারীর পুষ্টিজ্ঞান ও নিরাপদ খাদ্যের জ্ঞান তার নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন দক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে। সেই সাথে নারীর উপার্জন ক্ষমতা পরিবারের খাদ্যে অধিগম্যতা অর্জনের সক্ষমতা সৃষ্টিতেও সহায়ক হতে পারে।
ছয় : বর্তমান বিশ^ পরিস্থিতিতে বহুদেশের মানুষের জন্য খাদ্য সঙ্কট নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতার পরিধি সম্প্রসারিত করতে হবে। দেয়া-নেয়ার সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। সেই সাথে দেশজ ও আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা কেবল ব্যবসাবান্ধব না রেখে মানববান্ধব করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সংশ্লিষ্ট সকলকে সক্রিয় ও ঐক্যবধদ্ধ করতে হবে।
সাত : এখনো আমরা অনেকেই খাদ্য বলতে ক্ষুধা নিবৃত্তি বা উদরপূর্তি বুঝি। পুষ্টির বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় থাকে না। সমাজের এক অংশ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খায় এবং অনেক খাদ্য অপচয় করে। আরেক অংশ পর্যাপ্ত খাদ্য বা পুষ্টিকর খাদ্য পায় না। এই অবস্থার অবসানে আপন আপন সামর্থ্যরে মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সচেতন ও দক্ষ করে তোলার জন্য পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টির বিপুল উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আট : খাদ্য নিরাপদ নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকালীন, বাজারজাতকালীন, প্রক্রিয়াজাতকালীন, রন্ধনকালীন ও পরিবেশনকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন রাখতে  করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় রীতিনীতি ও আইনের সংস্কার, উত্তম উপাদান ব্যবস্থা, উত্তম প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
নয় : জনগণের আয়বৃদ্ধি তথা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য ক্রয়ের সামর্থ্য সৃষ্টি খাদ্য নিরাপত্তার বলয়সৃষ্টির একটি অপরিহার্য শর্ত। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সেবা কার্যক্রমের পরিধি সম্প্রসারণ ইত্যাদির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান ও তথা জনগণের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যেন তারা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য কিনে খেতে পারে।
দশ : খাদ্যের চাহিদা অনুযায়ী দেশজ উপাদান এবং আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে থাকতে হবে। এ বিষয়টি নিরন্তর মনিটরিং করে খাদ্যের জোগান ব্যবস্থার পর্যাপ্ততা অটুট রাখতে হবে।
এগারো :    দুস্থ গরিব অহসায় মানুষের জন্য প্রাত্যাহিক খাদ্য সরবরাহের নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি ও সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ বিষয়টি অতীব জরুরি।
পৃথিবীজুড়ে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টির এজেন্ডাকে সবসময়ই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়েছে এবং সেই ভাবনার আলোকে প্রণীত হয়েছে হাজারো উদ্যোগ। সর্বশেষ বৈশি^ক উদ্যোগ হিসেবে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন অভিলক্ষ্য (এসডিজি-২০১৬-২০৩০) বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসডিজির ১৭টি অভিলক্ষ্যের মধ্যে এসডিজি-২ নম্বরে স্থান পেয়েছে ‘ক্ষুধার অবসান’। এ বিষয়টিই মূলত ভূম-লী পরিসরে খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনাই সমার্থক।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও আমাদের এই লক্ষ্য আজও পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত কমে যাওয়া জমি থেকে আমরা দানা জাতীয় খাদ্য উৎপাদন প্রায় চারগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষি উন্নয়নের যে কর্মধারার সূচনা করেছিলেন, সেই বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে তাঁরই আত্মজা ও সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য পরিস্থিতি অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। দানা জাতীয় খাদ্য, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, কলা, সবজি সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। প্রতি বছর বিশ^ খাদ্য দিবসের ভাবনায় ও তা প্রয়োগে আমরা এই অর্জন আরো বেগবান ও সংহত করার নব নব আয়োজন সম্পন্ন করে থাকি।’ যা এই দিবস পালনকে অর্থবহ করে তুলেছে।

লেখক : সদস্য, এপিএ পুল, কৃষি মন্ত্রণালয় ও সাবেক মহাপরিচালক, ডিএই। মোবাইল : ০১৭১১৮০৩৬৯৫ ই-মেইল :hamidur2152@gmail.com

বিস্তারিত
নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য খাত

নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টি সরবরাহে মৎস্য খাত
খঃ মাহবুবুল হক
বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি জীবের খাদ্যের প্রয়োজন। জাতিসংঘ প্রণয়নকৃত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যসহ সকল বৈষম্যের অবসান এবং টেকসই কৃষি। দারিদ্র্য নিরসনের পরই দ্বিতীয় এজেন্ডা হিসেবে যে কর্মপরিকল্পনা দেয়া হয়েছে তা খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টি নিশ্চিতকরণ। তাই ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন বলেছেন, শুধু খাদ্যের পর্যাপ্ততা কোন দেশ বা জাতিকে ক্ষুধামুক্ত করতে পারে না যতক্ষণ না সব জনগোষ্ঠীর জন্য সেই খাদ্যপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। খাদ্য শুধু পর্যাপ্ত হলে হবে না এটি সব মানুষের কাছে সহজলভ্য, নিরাপদ ও পুষ্টিকর হতে হবে।  টেকসই উন্নয়ন  অভীষ্ট বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাপী সকল ধরনের বৈষম্যের অবসানের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার কাজ নিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকা-ের মূলমন্ত্র- ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়’ নীতি অনুসরণ যা এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যের শুরুতেই বলা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার ছিচল্লিশ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছর হতে বাংলাদেশ চাহিদার বিপরীতে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সক্ষম হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের বাংলাদেশের এই সাফল্য আজ বিশ্ব পরিম-লে স্বীকৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ৩য়  স্থান ধরে রেখে বিগত ১০ বছরের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য় স্থানে উন্নীত হয়েছে। বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান গত ৬ বছরের মতো ধরে রেখেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে মানুষ ছিল প্রায় সাড়ে ৭ কোটি এবং মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ৮ লাখ মে. টন। বর্তমানে (২০২০-২১) দেশের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি এবং বর্তমানে মাছের উৎপাদন ৪৬.২১ লাখ মে.টন। অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তী মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ।
বাংলাদেশের খাদ্য  নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের খাদ্যে প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের অধিকাংশ জোগান দেয় মাছ। দেশের জিডিপির ৩.৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির এক-চতুর্থাংশের অধিক (২৬.৫০ শতাংশ) মৎস্যখাতের অবদান। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। এ ছাড়াও দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১.২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত হতে। মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি শতকরা ৫.৭৪ ভাগ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১)।
বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি সেক্টরে মৎস্য খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত থাকার ফলে মাছ উৎপাদন নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৎস্যবান্ধব সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ আজ ইলিশ আহরণে বিশ্বে ১ম, স্বাদুপানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য়, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বিশ্বে ৩য়, তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে ৫ম , সামুদ্রিক ও উপকূলীয় ক্রাস্টাশিয়া এবং ফিনফিস উৎপাদনে যথাক্রমে ৮ম ও ১২তম। এক কথায় বলা যায়, এটি এখন দেশের নিরাপদ পুষ্টি নিরাপত্তায় এক সম্ভাবনাময় সম্পদ।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় জাতীয় ও আন্তর্র্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা
জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্যখাতের অবদান বিবেচনায় মৎস্যসম্পদের স্থায়িত্বশীল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, মৎস্যচাষের নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও মাঠ পর্যায়ে হস্তান্তর, পল্লী অঞ্চলের বেকার ও ভূমিহীনদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ প্রসারিত করা এবং মৎস্যজীবীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, উন্নয়ন দর্শন রূপকল্প ২০৪১, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এ উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মৎস্য অধিদপ্তর নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর ১৪.২, ১৪.৪, ১৪.৬, ১৪.৭ ও ১৪.বি লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় লিড মিনিস্ট্রির পাশাপাশি ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসারে ২.৩, ২.৫ লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে কো-লিড হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও সুরক্ষিত পরিবেশ ও উন্নত জীবন নিশ্চিতের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সংশ্লিষ্ট ১.১, ১.২, ১.৩, ১.৫, ৬.৬, ৮.৮, ১০.২, ১১.৫, ১১,১৫.১, ১৫.৩ এবং ১৭.১৮ বাস্তবায়নে সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হওয়ায় ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিমি. এলাকায় মৎস্য আহরণে আইনগত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিশাল জলরাশি হতে স্থায়িত্বশীলভাবে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও আহরণে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা (plan of action) প্রণয়ন করা হয়। উক্ত কর্মপরিকল্পনা জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি-এর সাথে সমন্বয় করে ২০১৮-২০৩০ সাল পর্যন্ত হালনাগাদ করে বান্তবায়ন করা হচ্ছে।
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির জোগানে মাছ
মাছ একটি উচ্চ আমিষসমৃদ্ধ দামে সস্তা ও সহজ পাচ্য, কম চর্বি ও শ্বেতসার যুক্ত নিরাপদ খাদ্য। মানুষের দেহের জন্য একটি সুষম খাদ্যের উপাদানগুলো হলো- প্রোটিন, শ্বেতসার, লিপিড, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। পুষ্টিগত দিক থেকে মাছে উপরোক্ত সবগুলো উপাদানই বিদ্যমান। মাছে সাধারণত জলীয় অংশ ৬৫-৮০%, প্রোটিন ১৫-৩০%, ফ্যাট বা লিপিড ৫-২০% এবং ভিটামিন/মিনারেলসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান ০.৫-৩% পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। তাছাড়া শুঁটকি ও কিছু শুকনো মৎস্যজাত পণ্যে আমিষের পরিমাণ ৩৫-৫৫%। মাছে  খাদ্য উপাদানগুলো একটি সুষম মানে বিদ্যমান রয়েছে। মাছ সহজপ্রাচ্য হওয়ায় দ্রুততম সময়ে মানবদেহে শক্তি উৎপন্ন হয়।
উপকারি তেল
মানবদেহে সাধারণত তিন ধরনের চর্বি পাওয়া যায় এর মধ্যে অন্যতম হলো পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (PUFA) যেটি মানবদেহের জন্য উপকারী ও অত্যন্ত দরকারি অথচ দেহের ভেতরে তৈরি হয় না। বাইরের উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করলে এটি মানুষের শরীরে তৈরি হয়। মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ তেল রয়েছে যা করোনারি হৃদরোগ, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী একটি ব্যাপক আলোচিত উপাদান। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে রয়েছে দুইটি অত্যাবশ্যকীয় পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড যথা- ইকোসা পেন্টানোয়িক এসিড (EPA) ও  ডোকোসা হ্যাক্সানোয়িক এসিড (DHA); যেগুলো কেবল সামুদ্রিক মাছ ও ফাইটোপ্লাংকটনে সাধারণত দেখা যায়। এগুলোর অভাবে মানুষের মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিকাশে মারাত্মকভাবে ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়াও ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন (এ, ডি, ই ও কে) বহনে এইসব উপাদান অত্যন্ত জরুরি যার অভাব হলে দেহে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণত সামুদ্রিক মাছগুলোতে ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, স্যামন, টুনা, ম্যাকারেল, কড, ইলিশ জাতীয় মাছের অত্যাধিক পরিমাণ ওমেগা-৩ বিদ্যমান।
স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহে গৃহীত পদক্ষেপ
আইনি পরিকাঠামো তৈরি : জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি  নিশ্চিত করতে মৎস্য অধিদপ্তরে  আইনি কাঠামোর আওতায় প্রণীত হয়েছে আইন, বিধিমালা, নীতি ও গাইডলাইন এবং এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তন্মধ্যে মৎস্য হ্যাচারি আইন, ২০১০ ও মৎস্য হ্যাচারি বিধিমালা, ২০১১, মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ ও মৎস্য খাদ্য বিধিমালা, মৎস্য ও মৎস্যপণ্য (পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০২০ এবং মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও  মাননিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ১৯৯৭ মেডিসিনাল প্রোডাক্টস কন্ট্রোল গাইডলাইন্স ২০১৫, সামুদ্রিক মৎস্য (Marimc fisheries) আইন, ২০২০ ইত্যাদি ইত্যাদি অন্যতম।
উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনা : বাজারে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ/চিংড়ি সরবরাহের অন্যতম শর্ত হলো উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলনের পাশাপাশি উত্তম ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন। সঠিক উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি জৈব নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে খামার স্থাপন ও মজুদপূর্ব এবং মজুদকালীন ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে উত্তম চাষ ব্যবস্থা অনুসরণ করা প্রয়োজন।
ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান বাস্তবায়ন (NRCP) : ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান কার্যক্রমের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ভোক্তার জন্য বাংলাদেশি মৎস্যপণ্য নিরাপদ করা। এনআরসিপি কার্যক্রমের মাধ্যমে মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য হলো দূষণের সহনশীল সীমা ও সর্বোচ্চ অবশিষ্টাংশের সীমার জন্য নির্ধারিত সম্মত নীতির সামঞ্জস্যতা মূল্যায়ন করা, নিষিদ্ধ/অননুমোদিত পদার্থের অবৈধ ব্যবহার উদঘাটন করা এবং দূষণ অবশিষ্টাংশের উৎস নির্ণয় করা।
মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালনা : আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। মৎস্য ও মৎস্যজাতপণ্যের মাননিয়ন্ত্রনে সাফল্যের স্বীকৃতস্বরূপ ২০১৫ সালে EU-FVO (ইউরোপীয় ইউনিয়নেরFood and veterinary office) audit team এর সুপারিশে মৎস্যপণ্য রপ্তানিতে প্রতিটি কনসাইনমেন্টের সাথে টেস্ট রিপোর্ট পাঠানোর বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা হয়।  
জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা : জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার সাথে মৎস্য খাতের কর্মপরিকল্পনার প্রণয়ন করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনার আলোকে প্রকল্প প্রণয়ন, কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন সরাসরি মানব স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত তেমনি মানুষসহ সকল জীবের টিকে থাকা, নিরাপদ থাকা, সুরক্ষিত থাকা সুস্থ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। মৎস্য অধিদপ্তর আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাণিজ আমিষের চাহিদাপূরণে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ মাছ সরবরাহে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ফলে অর্জিত হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, বৃদ্ধি পাবে রপ্তানি আয় ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবন হবে সুরক্ষিত-উন্নত। বাস্তবায়িত হবে সরকারের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।

লেখক : মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ফোন : ২২৩৩৮২৮৬১; ই- মেইল : dg@fisharies.gov.bd

বিস্তারিত
উন্নত জীবন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব

উন্নত জীবন ও পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব
ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা১  ড. হোসেন মো: সেলিম২
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষি জমির উর্বরতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং স্মৃতিশক্তি বিকশিত মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য খাত হলো প্রাণিসম্পদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সূচিত পথ ধরে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিজ জিডিপিতে স্থিরমূল্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৬.৫২% এবং জাতীয় দেশজ উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১.৯০%। জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৭০-৭৫%  আমিষ এ প্রাণিসম্পদ খাত থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। সর্বোপরি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব প্রাণিজাত পণ্য উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নিম্নে দেশের আপামর জনগোষ্ঠির উন্নত জীবন যাপনে ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে প্রাণিজ আমিষের অপরিসীম গুরুত্ব উপস্থাপন করা হলো-
দুধের পুষ্টিগুণ : দুধ একটি সম্পূর্ণ ও আদর্শ খাদ্য এবং ইহা উৎকৃষ্ট আমিষের উৎস্য। আয়রন ছাড়া সকল প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস দুধে বিদ্যমান। দুধে এল-ট্রিপটোফেন নামক এমিনো এসিড থাকে বিধায় দুধ খেলে ভালো ঘুম হয়। দুধ থেকে তৈরি ইউগার্ট প্রবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা হজম শক্তি এবং শরীরের ইমিউন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এক কাপ দুধে প্রায় ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরী শক্তি, ৮-১০ মিলিগ্রাম মানসম্মত ফ্যাট, ৮-১০ মিলিগ্রাম উন্নত প্রোটিন, ১৩-১৫ মিলিগ্রাম শর্করা, ২৪-২৫ মিলিগ্রাম ঝুঁকিবিহীন কোলেস্টেরল, ৯৮-১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
ডিমের পুষ্টিগুণ : ডিম একটি সম্পূর্ণ নিউট্রিয়েন্ট পিল। ডিমের আয়রন হিম পদ্ধতিতে থাকে বিধায় মানব শরীরের রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে দ্রুত সহায়তা করে। ডিম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে ও শরীরের ওজন কমায় এবং বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করে। চামড়া মসৃন রাখে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ডিম খেলে  দৃষ্টি শক্তি এবং স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে। ডিমের স্যাটাইটি ভ্যালু বেশি বিধায় ডিম খেলে পরিতৃপ্তি নিশ্চিত হওয়ার কারণে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ কম হয়ে থাকে। একটি সম্পূর্ণ ডিমে প্রায় ৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৫ গ্রাম উন্নত ফ্যাটি এসিড, ৭০-৭৭ কিলোক্যালরী শক্তি, ১৭৫-২১০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ১০০-১৪০ মিলিগ্রাম কোলিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
মাংসের পুষ্টিগুণ : মাংস একটি উচ্চ আমিষের উৎস যেখানে সকল এমিনো এসিড বিদ্যমান। মাংস মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। প্রতি ১০০ গ্রাম মাংসে প্রায় ২২-২৬ গ্রাম মানসম্মত প্রোটিন, ৩-৪ গ্রাম উন্নত ফ্যাট, ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরী শক্তি, ৭০-৭৫ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল, ৫৫-৬০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ভিটামিন, মিনারেলস ও অন্যান্য পুষ্টি উপকরণ থাকে।
প্রাণিজ আমিষের উপযোগিতা : প্রাণিজ আমিষের (দুধ, ডিম ও মাংস) গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাণিজ আমিষ সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন ও মিনারেলস এর চাহিদা পূরণ করে। বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধ করে। স্ট্রোক, হৃদরোগ, আথ্রাইটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। মানব দেহের ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। রক্তের ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি হ্রাস করে। মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বৃদ্ধি করে। সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠনে সহায়তা করে।
দেশে বৈশ্বিক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর আপামর মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি উৎপাদন ও রপ্তানিতে এবং বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণীত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সরকারের রূপকল্প অনুযায়ী ২০৪১ সালে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানী আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং সুষ্ঠ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক : ১মহাপরিচালক, ২প্রাণিসম্পদ পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, প্রাণিসসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯৪৬৯৫২০১১, ই-মেইল : hmsalim@gmail.com

বিস্তারিত
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান

নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান : বাংলাদেশ
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান
ড. দেবাশীষ সরকার১ ড. বাবুল চন্দ্র সরকার২
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন”। সকল সময়ে সকল নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের প্রয়োজনে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাই বাংলাদেশ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহের সাথে মিল রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবসান, ক্ষুধা নিবৃত্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়া, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক পুষ্টি সম্মেলন কর্মকাঠামো বাস্তবায়নসহ বৈশ্বিক পুষ্টি কার্যক্রম প্রসার আন্দোলন (SUN Movement) এবং জাতিসংঘের অ্যাকশন অন নিউট্রিশন দশকের  সদস্যপদ বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি জনগণের জীবনমান উন্নতকরণের লক্ষ্যে সরকার প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নিয়মনীতি পালন করছে যেমন; জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি-২০২০। জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, বাংলাদেশ   বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপকে সন্নিবেশিত করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) দেশে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। অপ্রচলিত দানাজাতীয় শস্য, ফল, সবজি, কন্দাল ফসল, ডাল, তেলবীজ, মসলা ও অন্যান্য ফসলসহ ২১১টি ফসলের উপর গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ বৈচিত্র্যময় ফলের এক অফুরন্ত ভা-ার এবং প্রায় ৭৮ প্রজাতিরও অধিক বিভিন্ন সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় ফল এদেশে জন্মে, যার ক্ষুদ্র একটি অংশ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। ফলে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন, খনিজ লবণ, অর্গানিক এসিড, ডায়াটরি ফাইবার, ফলিক এসিড এবং প্রচুর উপকারী হরমোন ও ফাইটোকেমিক্যাল যা দেহের পুষ্টিচাহিদা পূরণ, শারীরিক বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধ, মেধা বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। ফলের উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আধুনিক জাত ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই উষ্ণ এবং অবউষ্ণম-লীয় ফলের উপর মৌলিক (basic), কৌশলগত (strategic), ফলিত (applied) এবং অভিযোজনমূলক (adaptive) গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে যা পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। তারই ধারাবাহিকতায় বিএআরআই কর্তৃক অদ্যাবধি ৩৮টি ফল প্রজাতি এবং সর্বমোট ৯৭টি জাত ও  সংশ্লিষ্ট ফলের ৭৬টি আধুনিক ও নিরাপদ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
সুস্থ সবল থাকতে ফলের পাশাপাশি দৈনিক ৩০০ গ্রাম (২০০ গ্রাম ফল জাতীয় ও ১০০ গ্রাম পাতা জাতীয়) সবজি গ্রহণ করতে হবে। যা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য অত্যাবশ্যক হিসেবে পুষ্টি বিজ্ঞানীগণ অভিমত দিয়েছেন এবং সেভাবেই জাতীয় চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের সবজি বিভাগ; সবজির আধুনিক কলাকৌশল (জাত, উপকরণ উন্নয়ন, ব্যবহার দক্ষতা ইত্যাদি) উদ্ভাবন ও উন্নয়নের জন্য ফসলভেদে নানাবিদ প্রজনন কৌশল অবলম্বন করা হয় এর ফলস্বরূপ এ পর্যন্ত ৩৪টি সবজি ফসলের মুক্ত পরাগায়িত, হাইব্রিড, জিএমওসহ মোট ১৩১টি জাত উদ্ভাবন করে। সবজির হাইব্রিড উদ্ভাবন চাহিদা পূরণে এ বিভাগ জনপ্রিয় সবজি ফসল সমূহের মোট ২৩টি হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছেন, তাছাড়া ৭৬ টিরও অধিক উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করা হয়েছে। এদের মধ্যে রেইজড বেড, সবজি গাছে ঠেকনা দেয়া, চারা উৎপাদনের জন্য সৌরায়নের মাধ্যমে মাটি শোধন, দুবার চারা রোপণ করে সুস্থসবল চারা উৎপাদন, সবজির জোড়কলম পদ্ধতির উদ্ভাবন, কপি গোত্রের সবজি বীজ উৎপাদন কৌশল, বালাই নিরোধী জালে সবজি উৎপাদন, বসতবাড়িতে সারা বছর সবজি চাষ কৌশল, বালাই প্রতিরোধী জাল ও ফাঁদ ফসল ব্যবহার করে জৈব উপায়ে সমাজভিত্তিক সবজি চাষ মডেল, মাটিবিহীন চাষ অন্যতম।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কন্দাল ফসলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ, কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জন, অধিক জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বিএআরআই এর কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র আলু, মিষ্টিআলু, মেটেআলু এবং বিভিন্ন প্রকার কচুর উপর বিস্তর গবেষণা করে আসছে।
কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই হতে উদ্ভাবিত ১০০টি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আলুর জাত এর মধ্যে ৩৩টি প্রক্রিয়াজাতকরণ উপযোগী যার মধ্যে বারি আলু-২৮ এবং বারি আলু-২৯ বাণিজ্যিকভাবে যথাক্রমে কাশেম ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং বোম্বে এগ্রো লিমিটেডে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাণ ফুড লিমিটেডও উল্লিখিত জাত দুটি বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যবহার করছে। এছাড়াও ১৮টি রপ্তানি উপযোগী জাত হিসেবে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্ত করা হয়েছে। কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ৭টি পানি কচু, ২টি মুখীকচু, ২টি ওলকচু এবং ১টি সাহেবী/মৌলভী কচুর জাত উদ্ভাবন করেছে। কচুতে ভিটামিন ‘এ’ এবং আয়রন প্রচুর পরিমাণে থাকে। কচু হজমযোগ্য আঁশের একটি খুব ভাল উৎস। আবার, মেটেআলু একটি প্রাচীন ফসল এটি মূলত বসতবাড়ির আশেপাশে ও পতিত জায়গায় চাষাবাদ করা হয়। মেটে আলু পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ও ফসফরাসের খুবই ভালো উৎস। ইউএসডিএ তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মেটে আলুতে আছে ৯ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৮১৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ২৮ গ্রাম শর্করা এবং ১.৫ গ্রাম আমিষ। কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই এ যাবৎ মেটে আলুর ৪টি জাত (মেটে আলু-১, মেটে আলু-২, মেটে আলু-৩, মেটে আলু-৪) অবমুক্ত করেছে।
উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ এ যাবৎ ভুট্টার ৯টি মুক্ত পরাগায়িত জাত এবং ১৮টি হাইব্রিড জাত অবমুক্ত করেছে। গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে পৃথক হয়ে নতুন ইনস্টিটিউট হিসাবে যাত্রা শুরু করায় বর্তমানে এ জাতগুলো বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন রয়েছে। এছাড়া বার্লির ৯টি, কাউনের ৪টি, চিনার ১টি, সরগমের ১টি, ওটের ১টি, রাঘী বা ফিংগার মিলেটের ১টি জাত অবমুক্ত করেছে। এ ফসলগুলোর ফলন সক্ষমতা (ণরবষফ ঢ়ড়ঃবহঃরধষরঃু) কম হলেও পুষ্টিগুণ ভরপুর এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। ডালের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিএআরআই এর ডাল গবেষণা কেন্দ্র ডালের ৪৩টি উন্নতজাত ও সংশ্লিষ্ট উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা যদি প্রতিদিন পুষ্টিসমৃদ্ধ ডাল বিশেষ করে আয়রন, জিংক ও সেলেনিয়াম সমৃদ্ধ মসুর ডাল খাই তাহলে আলাদা করে আয়রন ও জিংক ট্যাবলেট খাওয়া প্রয়োজন হবে না।
মানবদেহে পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভোজ্যতেল অপরিহার্য, কারণ মানবদেহে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড তৈরি হয় না বিধায় ভোজ্যতেল গ্রহণের মাধ্যমে তা পূরণ হয়। পুষ্টিবিদগণের মতে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য কমপক্ষে গড়ে দৈনিক ২০-৩০ গ্রাম দৃশ্যমান তেল খাওয়া প্রয়োজন। তাই বিশাল জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তেলবীজ গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক বিভিন্ন তেলবীজ ফসলের ৫১টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।খাদ্যে স্বাদ ও ঘ্রাণ আনয়ন করার জন্য মসলা গবেষণা কেন্দ্রটি ৪৮টি উচ্চফলনশীল জাত এবং ১৫৬টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে বাংলাদেশের মসলা চাষিদের ভাগ্যোন্নেয়নের দ্বার উন্মূক্ত করে দিয়েছে, সাথে সাথে দেশে মসলার মোট উৎপাদন ও ফলন উভয়ই বেড়েছে কয়েকগুণ।
নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য আমাদের প্রথমেই মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। ইতোমধ্যে বিএআরআই কর্তৃক সবজি, ফল ও মসলা জাতীয় ফসলের বিভিন্ন ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমনের প্রায় ৩০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে, এছাড়াও বিভাগের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডেটেড “পেস্টিসাইড এ্যানালাইটিক্যাল ল্যাবরেটরি” তে নিয়মিত বাজারজাতকৃত বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, শুঁটকি মাছ ইত্যাদিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নিরূপন, বাজারজাতকৃত বিভিন্ন কীটনাশকের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা এবং রপ্তানিযোগ্য বিভিন্ন পণ্যে (সবজি, ফল, পান, হিমায়িত মাছ ইত্যাদি) কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি নিরূপণপূর্বক সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। উক্ত ল্যাব হতে বিভিন্ন ফসলে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের পর সংগ্রহ-পূর্ব অপেক্ষমাণ সময় নির্ধারণ, বাজারজাতকৃত বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি হতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ নিরূপণ ও দূরীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনসহ আরও কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের জন্য কীটতত্ত্ব বিভাগ নিয়মিতভাবে কৃষক প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবসের আয়োজন করে থাকে। কীটতত্ত্ব বিভাগের উদ্ভাবিত জৈব বালাইনাশক প্রযুক্তিসমূহ কৃষকের মাঠে পরিবেশসম্মত উপায়ে ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগ উদ্ভাবিত জৈব বালাইনাশকভিত্তিক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিসমূহ ব্যবহারে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ কম খরচে কৃষকের আয় ২০-৩০% বৃদ্ধি করা সম্ভব । এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে পানির ঘাটতি মোকাবেলা করার জন্য, সেচের জন্য পানির সুবিবেচনামূলক ব্যবহার নিয়ে গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ তার গবেষণা কার্যক্রমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। এছাড়া ল্যাবরেটরি ও গ্রিনহাউজভিত্তিক মৌলিক গবেষণাও শক্তিশালী হয়েছে। পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমাদের অনুপ্রেরণা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী বর্তমান সরকার কর্তৃক সবার জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার লালিত স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক : ১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৭১৬০০৯৩১৯, ই-মেইল :bsarker _64@yahoo.com

বিস্তারিত
জিংকসমৃদ্ধ ধান শরীরে জিংকের অভাব পূরণে টেকসই সমাধান

জিংকসমৃদ্ধ ধান শরীরে জিংকের অভাব
পূরণে টেকসই সমাধান
ড. মো. শাহজাহান কবীর১ ড. মো. আবদুল কাদের২ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন৩
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। অন্য পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও এদেশের প্রায় সবাই প্রতিদিন কম-বেশি ভাত খেয়ে থাকে। প্রাত্যহিক চাহিদার শতকার ৭০-৭৫ ভাগ শর্করা, ৬০-৬৫ ভাগ প্রোটিন, ৮ ভাগ ফ্যাট, ৫.৮ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং ৯১.৬ ভাগ ফসফরাস চাল থেকে পাওয়া যায়। দেশে মাথাপিছু চালের গ্রহণ হার হিসেবে দৈনিক যে পরিমাণে পুষ্টি আমরা চাল বা ভাত থেকে পাই তা কোনভাবেই আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রতি ১০০ গ্রাম চাল থেকে আমরা মোটামুটি ১২৯ কিলোক্যালরি শক্তি, ৭৮.০৯ গ্রাম শর্করা, ৭.১২ গ্রাম প্রোটিন, ০.২৮ গ্রাম চর্বি, ১.৩০ গ্রাম আঁশ ০.০৭ মি. গ্রাম থায়ামিন, ০.০১৫ মি. গ্রাম রিবোফ্লাভিন, ১.০৯মি. গ্রাম জিংক, ২৮ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮০ মি. গ্রাম আয়রন, ২৫ মি. গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান পেয়ে থাকি। যদিও জাতভেদে এই পরিসংখ্যানের তারতম্য হতে পারে।
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের কাজ চলমান রয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট-এর অভাব অন্যতম। বাংলাদেশে ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর প্রায়            দু-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো মাত্রার অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রচিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকের পুষ্টি উন্নয়ন কে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭২ এর সংবিধানে উল্লেখ করা হয় “জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে”।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা এবং এসডিজির ২নং অভীষ্ট অর্জন কে সামনে রেখে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন- জিংক, আয়রন, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলসসহ শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের সর্বাধুনিক বায়োফর্টিফিকেশন ও জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কেননা দেশের সাধারণ মানুষ দুধ-ডিম, মাছ ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও তারা ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। এজন্য জিংক, আয়রন, প্রোটিন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গামা এমাইনো বিউটারিক এসিড (এআইএ) ও প্রো-ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস এবং স্বল্প জিআই সম্পন্ন ডায়াবেটিক ধানসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে ব্রি। এর মধ্যে জিংকসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে এমন বয়সী ৪৬ শতাংশ শিশু জিংক স্বল্পতায় ভুগছে। আবার বিভিন্ন বয়সী ৫৭ শতাংশ নারীর রয়েছে জিংক স্বল্পতা। নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ জিংকের অভাবে ভুগছে। এর সমাধান খুঁজতেই ভাতের মাধ্যমে জিংকের অভাব দূর করতে ৭টি জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত আরো ১৬টি বায়োফরটিফাইড জিংকসমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
ভাত মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ায় জিংকসমৃদ্ধ ধানের মাধ্যমে জিংকের অভাব পূরণ একটি টেকসই সমাধান। জিংকসমৃদ্ধ ধানের ভাত খেয়ে জিংকের দৈনিক চাহিদার ৫০-৭০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। কৃষকের মাঝে এ জাতগুলোর দ্রুত সম্প্রসারণ করা হলে এদেশের পুষ্টিহীনতা তথা জিংকের অভাব পূরণ সহজ ও টেকসই হবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাংলাদেশের উচ্চফলনশীল ধানের সঙ্গে পরাগায়ন ঘটিয়ে জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাতগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধান থেকে কৃষকরা নিজেরাই বীজ তৈরি করে রোপণ করতে পারবেন। অধিক পরিমাণে জিংক থাকা সত্ত্বেও এই ভাতের স্বাদ ও রঙয়ের কোনো তারতম্য হয় না।
জিংক মানুষের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান যা দেহে এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, শর্করার ভাঙন, দেহ কোষের বৃদ্ধিতে এবং পলিপেটাইড গঠনে, গ্যাসটিন নিঃসরণের মাধ্যমেই স্বাদের অনুভূতি তৈরি বা রুচি বাড়াতে ভূমিকা রাখে। হাড়ের বৃদ্ধির জন্য কেরোটিনয়েড তৈরি ও তার পরিপক্বতা, ইনসুলিন তৈরি, ত্বকের ক্ষত সারানো ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কাজে জিংকের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মানবদেহে ২০০ এরও বেশি এনজাইমের নিঃসরণে সহযোগিতা করে জিংক। যা দেহের অনেক বিপাকীয় কাজে এটি অংশ নেয়। জিংকের অভাবে মানুষের শরীরে নানাবিধ অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে খাটো বা বামন হওয়ার প্রবণতা, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা সৃষ্টি, ডায়রিয়া, এলার্জি, চুলপড়া, ক্লান্তি অনুভব হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে উঠার সময়ে জিংকের অভাব হলে শিশু-কিশোররা বেটে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু জিংক সমৃদ্ধ জাতের ভাত খেলে শরীরে জিংকের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটে যাবে এবং বেটে হবার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্রি উদ্ভাবিত জিংকসমৃদ্ধ ধানগুলোর বৈশিষ্ট্য সারণি দ্রষ্টব্য। বেসরকারি সংস্থা হারভেস্টপ্লাস (ঐধৎাবংঃ চষঁং) এর তথ্যানুযায়ী জিংকসমৃদ্ধ এসব ধানের আবাদ এলাকা ও উৎপাদন দুটোই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
জিংকসমৃদ্ধ চাল নিয়মিত গ্রহনের মাধ্যমে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের জিংক এর চাহিদা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব তার একটি হিসাব (দৈনিক গড়ে চাল গ্রহনের পরিমান ৩৬৭ গ্রাম হিসাবে) বিজ্ঞানীরা উপস্থাপন করেছেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে জিংকের দৈনিক চাহিদা ১১ মিলিগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর দৈনিক চাহিদা ৮ মিলিগ্রাম। ব্রি উদ্ভাবিত জিংক চালে জিংকের পরিমাণ ২৪ মি.গ্রা./কেজি বা তার অধিক। সুতরাং ৩৬৭ গ্রাম চালে জিংকের পরিমাণ হবে ৮.৮১ মি. গ্রা.। যার মধ্যে রান্নার সময় নষ্ট হয় ১১% এবং জিংকের ইরড়ধাধরষধনরষরঃু ৯১%। রান্না ও হজমের পর ৩৬৭ গ্রাম চাল হতে শরীর জিংক পায় ৭.১৪ মি. গ্রাম। অর্থাৎ মানুষের শরীরে জিংকের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে জিংক চাল গ্রহণের পরিমাণের তারতম্যের কথা বিবেচনা করে বলা যায় জিংকসমৃদ্ধ চাল নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে দৈনিক জিংকের চাহিদার প্রায় ৫০-৭০% পূরণ করা সম্ভব।
বাজারে জিংকসমৃদ্ধ চালের সরবরাহ বাড়াতে জিংকসমৃদ্ধ জাতসমূহ মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সম্প্রসারণ ও সরকারিভাবে উৎপাদিত জাতগুলোর ধান ক্রয় ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ব্রি সদর দপ্তর ও ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে কৃষকের মাঠে প্রদর্শনী স্থাপন করে বীজের প্রাপ্যতা সহজলভ্য করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ টিএলএস উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে সরাসরি বিতরণ করতে হবে। ব্রিডার বীজ উৎপাদন করে বিএডিসি ও বিভিন্ন বীজ কোম্পানিকে বিতরণ এবং তাদের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ইফরি-র অর্থায়নে পরিচালিত হারভেস্ট প্লাস প্রকল্পের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে বিনামূল্যে কৃষকের মাঝে সরাসরি বিতরণ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষকের মাঠে বীজ উৎপাদন করে প্রতিবেশী কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্য গ্রহণে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। জিংকসহ অন্যান্য পুষ্টিকর চালের ভাত গ্রহণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রাম যেমন- OMS,BGF,BGD, Social Networkঙগঝ, ইএঋ, ইএউ, ঝড়পরধষ ঘবঃড়িৎশ  ইত্যাদি এর মাধ্যমে দুস্থ ও গরিবদের মাঝে জিংকসমৃদ্ধ ধানের চাল বিতরণ করা হলে খাদ্য চাহিদা ও জিংকের ঘাটতিজনিত পুষ্টির অভাব পূরণ হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

লেখক: ১মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং ৩ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, ইমেইল-smmomin80@gmail.com

বিস্তারিত
বাংলাদেশে ধান ও চালের পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদতা

বাংলাদেশে ধান ও চালের পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদতা
প্রফেসর ড. মো: আব্দুল আলীম
বাংলাদেশে সিরিয়াল জাতীয় শস্যের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে বিশেষ করে ধান উৎপাদন। ১৯৭১ সালে ধানের উৎপাদন ছিল ১০৯ লক্ষ মেট্রিক টন, যা বেড়ে হয়েছে ২০২১ সালে ৫৬৪.১৫ লক্ষ মেট্রিক টন (উঅঊ এর রিপোর্ট অনুসারে)। বর্তমানে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। বাংলাদেশে মোট ৮৫০০ জাতের ধান যা জার্মপ্লাজমে সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১০৭টি জাতের ধান, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২৫টি জাতের ধান এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি জাতের ধান অবমুক্ত করেছে। ইহা ছাড়াও বাংলাদেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।
রাইস কার্নেল কম্পোজিশন
রাইস কার্নেলে ২০% হাস্ক বা হাল থাকে। ৮-১২% থাকে রাইস ব্রান এবং ৬৮-৭২% থাকে হোয়াইট রাইস বা মিলড রাইস। রাইস কার্নেলের বাইরের অংশকে হাস্ক বা হাল বলে। তারপর রাইস ব্রান থাকে। রাইস ব্রানের ৩টি অংশ থাকে। বাইরের অংশকে পেরিকার্প, মাঝের অংশকে সিডকোট এবং ভেতরের অংশকে নিউসেলার টিস্যু বলে। রাইস ব্রানের পরেই রয়েছে এন্ডোস্পার্ম। এন্ডোস্পার্ম এর রয়েছে দুটি অংশ এলিউরোন সেললেয়ার এবং স্টার্চ গ্যানিউলস। আরো রয়েছে জার্ম/এমব্রায়ও। রাইস কার্নেলের কেন্দ্র থেকে বাইরের অংশে অর্থাৎ হাস্কের পরেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টি থাকে যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলস। রাইস কার্নেলের ভেতরে শুধু থাকে স্টার্চ। অতিরিক্ত পলিশিং এর ফলে তাই চালের পুষ্টি উপাদান কমতে থাকে।
চাল উৎপাদন
রাইস কার্নেলের কম্পোজিশন অনুসারে মিলড রাইস পাওয়ার কথা ১০০ কেজি ধানের জাতভেদে  ৬৮-৭২ কেজি চাল বা ৪০ কেজি ধানে ২৮ কেজি চাল। সেই হিসাবে আমাদের দেশে চাল উৎপাদন হওয়ার কথা ৩৭.৬১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। কিন্তু অতিরিক্ত পলিশিং এর কারণে আমাদের দেশে ৪০ কেজি ধান থেকে ২৩ কেজি চাল উৎপাদিত হচ্ছে। সেই হিসাবে মোট চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩২.৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অর্থাৎ মোট লস হচ্ছে ৫.১৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন যা পশু খাদ্য বা মাছের খাদ্যরূপে অন্যত্র ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পশুখাদ্য রপ্তানি হচ্ছে। আমরা যদি এই পশু খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করতে পারি এবং পলিশিং কমিয়ে অর্ধেকে আনতে পারি তাহলেও আমাদের চালের উৎপাদন অনেকটাই বৃদ্ধি করতে পারি।
বাজারজাতকৃত চালের সর্বাধিক ব্র্যান্ড
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পরিধান ইউনিট (এফপিএমইউ) বাংলাদেশে সর্বাধিক ধান উৎপন্ন হয় এমন ১৮টি জেলাতে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। সমীক্ষাধীন ১৮টি জেলার প্রায় সকল জেলায় বাজারজাতকৃত চালের সর্বাধিক ব্র্যান্ড হিসাবে ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯, মিনিকেট, নাজিরশাইল, স্বর্ণা নামে চাল বাজারজাত করা হচ্ছে। বিআর২৮ কে ২৮নং হাসকি, ২৮ স্পেশাল, ২৮নং মিনিকেট, লিচু ২৮, থ্রিস্টার ২৮, হামিদ ২৮ নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। ব্রি ধান২৯  কে  ২৯ স্পেশাল, ২৯নং মিনিকেট, লিচু ২৯, থ্রিস্টার ২৯, হামিদ ২৯ নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। মিনিকেট চালকেও স্থান এবং চালকল ভেদে বিভিন্ন নাম দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে যেমন  জেড মিনিকেট, মিনার  মিনিকেট, গরুর গাড়ি মিনিকেট, ২৮ মিনিকেট, জোড়া কবুতর মিনিকেট, হরিণ মিনিকেট, হ্যান্ডশেক মিনিকেট, দেশ বন্ধু মিনিকেট, টাইগার মিনিকেট, আনারস মিনিকেট, তারা মিনিকেট ইত্যাদি বহু ধরনের নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল চালকে নাজির, কাটারি নাজির, হাসকি নাজির, নাজিরশাইল নামে বিক্রি করা হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধীদপ্তরের প্রতিনিধি এবং জেলা বিপণন কর্মকর্তাদের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক সমীক্ষাধীন জেলাসমূহে মিনিকেট নামে কোন ধানের আবাদ নেই। দেশের উত্তরাঞ্চলে জিরাশাইল নামে এক ধরনের ধান থেকেই বেশিরভাগ মিনিকেট নামে চাল উৎপন্ন হচ্ছে। এছাড়া, ব্রি ধান৫২, সুবললতা, জিরা নামক ধান থেকেও এ চাল উৎপাদিত হচ্ছে। কারো কারো মতে যে কোন প্রকারের চিকন/সরু ধানের দুই সিদ্ধ চালকে মিনিকেট চাল নামে রূপান্তর করা হচ্ছে। রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা অঞ্চলের কৃষকদের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক কোন কোন এলাকায় এক ধরনের উৎপাদিত চিকন জাতের ধানকে স্থানীয়ভাবে মিনিকেট নাম দেয়া হয়েছে। ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুর অঞ্চলের কতিপয় কৃষক মিনিকেট নামক ধানের আবাদ হয় বলে জানালেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বিপণন কর্মকর্তার প্রতিনিধি জানান যে, মিনিকেট নামে কোন ধানের আবাদ নাই। অন্যদিকে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া এবং যশোর অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক ঐ সব জেলার কোন কোন কৃষক ভারতীয় জাতের তথাকথিত মিনিকেট ধানের আবাদ করে থাকে। ঐসব ধান থেকেও উৎপন্ন চালকে মিনিকেট নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। সমীক্ষার প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক নাজিরশাইল চালও তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের ধান থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাটারি, সম্পাকাটারি ব্রি ধান২৮, ব্রিধান২৯, নাজিরশাইল ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে উল্লেখিত জেলাসমূহে নাজিরশাইল বা নাজির নামক ধানের উৎপাদন হয় এমন কোন জোরাল তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পলিশডকৃত চালের সর্বোচ্চ পুষ্টিমান
বাংলাদেশ অটো রাইস মিলগুলোতে প্রক্রিয়াকৃত বা পলিশড চালে বর্তমানে পুষ্টিমান কতটুকু রয়েছে, চালের পুষ্টিগুণ অক্ষুণœ রাখার লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কি কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এবং কি উপায়ে চাল প্রক্রিয়াজাত করলে চালের সর্বোচ্চ পুষ্টিমান বজায় থাকতে পারে সে বিষয়ে যাচাই ও সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। কমিটি কর্তৃক চালের পলিশিং নিয়ে গবেষণা প্রক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা করেন এবং ব্রাউন রাইস, ৫% পলিশড ও ১০% পলিশড (ব্রি ধান২৮) পারবয়েলড ও আন-পারবয়েলড অবস্থায় প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেড, ভিটামিন ই১, ভিটামিন ই২, ভিটামিন ই৩, ভিটামিন ই৬ এবং ভিটামিন ই৯ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর থেকে এবং ফেরাস, ম্যাংগানিজ, জিংক, ক্যালসিয়াম, ম্যানেসিয়াম এবং ফসফরাস বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিশ্লে­ষণ করা হয়। বিশ্লেষণের তথ্য সারণি-১ ও সারণি-২ দ্রষ্টব্য।
বিশ্লেষণের তথ্য অনুযায়ী প্রতীয়মাণ হয় যে ব্রাউন রাইস থেকে পলিশিং যত বাড়বে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ইত্যাদি তত দ্রুত গতিতে কমতে থাকবে। শুধু মাত্র কার্বোহাইড্রেট বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশ অটোরাইস মিলগুলোতে অতিরিক্ত পলিশিং এর ফলে বিভিন্ন অনুপুষ্টির পরিমাণের একটি বড় অংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাধারণত অনুপুষ্টির ঘাটতিতে ভোগে, বিশেষত জিংক এবং আয়রন এর ঘাটতি এ দেশে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ জনগোষ্ঠী নিজেদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভাতের উপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে চালের পলিশিং কমিয়ে আনা গেলে অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৮% এ নিয়ে আসা হলে এ জনগোষ্ঠীর পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা অনেকাংশে সম্ভব হবে। এ ছাড়াও আরো উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত পলিশিং এর ফলে চালের মোট উৎপাদন কমে যায়। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে কমিটি নিম্নোক্ত সুপারিশমালা প্রদান করেন।  
১। পলিশডকৃত চালের সর্বোচ্চ পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য করণীয় : (ক) ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণের জন্য মোড়কের গায়ে চালের জাতের নাম উল্লেখ করতে হবে। এক বা একাধিক জাতের চাল মিশ্রিত থাকলে মোড়কের গায়ে “মিশ্রিত চাল” কথাটি উল্লেখ করতে হবে। (খ) যে কোনো জাতের চাল শুধুমাত্র পূর্ণসিদ্ধ অথবা আতপ অবস্থা ব্যতীত বাজারজাত করা যাবে না। কেননা, কোনো কোনো চালের ক্ষেত্রে তা আধাসিদ্ধ অবস্থায় বাজারজাত করা হয়। আধাসিদ্ধ চাল দ্রুত নষ্ট হয় বলে তা বেশিদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। (গ) যে কোনো চালের পলিশিং কোনভাবেই তা ৮% এর অধিক করা যাবে না। (ঘ) চালে পানির পরিমাণ সর্বোচ্চ ১১% রাখতে হবে। (ঙ) স্বীকৃত ধানের জাত ব্যতীত অন্য কোনো নামে চাল বাজারজাত করা যাবে না (যেমন: মিনিকেট, নাজিরশাইল)।
(২) চালের পলিশিং বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ : (ক) গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৮% পলিশিং করা যাবে তা আইন/বিধি-প্রবিধি বা নীতিমালা দ্বারা নির্ধারণ করে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। (খ) অতিরিক্ত পলিশড চালের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।
(গ) অতিরিক্ত ছাঁটাইকৃত চাল স্বাস্থ্যসম্মত নয় এ বিষয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার করা যেতে পারে। (ঘ) এছাড়াও চালের traceability নিশ্চিত করার জন্য মিলার কর্তৃক চাল ক্রয়ের সময় কি জাতের ধান কেনা হলো তা উল্লেখপূর্বক একটি রেজিস্টার মেইনটেইন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।
(৩) চালের পলিশিং বিষয়ে আইন/বিধি প্রণয়নের পর মনিটরিং কার্যক্রম গ্রহণ :
(ক) চালে সর্বোচ্চ ৮% পলিশিং প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা সেটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মনিটরিং করার লক্ষ্যে চালের আকার-আকৃতি এবং ১০০০ চালের কার্নেলের ওজন পরিমাপ করে একই জাতের ধানের গড় কার্নেলের ওজনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। (খ) DNA- based অথবা non DNA-based পদ্ধতির মাধ্যমে ধানের জাত চিহ্নিতকরণ করা যেতে পারে।DNA-based পদ্ধতিতে মলিকুলার মার্কারের মাধ্যমে জাত শনাক্ত করা যেতে পারে। আবার চালের physico-chemical analysis করেও জাত শনাক্ত করা যেতে পারে। (গ) যেসব প্রতিষ্ঠান ৮% এর নিম্নে পলিশ করে চাল বাজারজাত করবে তাদের প্রণোদনা/স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রনালয়, মোবাইল : ০১৭৩২২৫২২২৯, ই-মেইল :  maalim07@yahoo.com

বিস্তারিত
খাদ্য নিরাপত্তা : প্রয়োজন সমন্বিত সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা

খাদ্য নিরাপত্তা : প্রয়োজন সমন্বিত সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা
ড. আবদুল্লাহ ইকবাল
কথায় আছে পশুপাখী-প্রাণী খাওয়ার জন্য বাঁচে, আর মানুষ বাঁচার জন্য খায়! সত্যিই তাই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক অধিকার বা উপাদানসমূহের মাঝে অন্যতম একটি হলো ‘খাদ্য’। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের দৈনন্দিন কার‌্যাবলী সম্পন্ন করার শক্তি জোগানোর পাশাপাশি দেহকে সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম রাখতে প্রতিনিয়তই খাদ্যের জোগান জরুরি ও অপরিহার্য। স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্নতা থাকলেও এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি, যাদের সকলের জন্য খাদ্যের জোগান পর্যাপ্ত ছিল না। ক্ষুধা-মঙ্গা লেগেই থাকত। অথচ আজ প্রায় ৫ দশক পর সে অবস্থাটি প্রায় অভাবনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। চাষের জমি কমে গেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রতিনিয়ত বর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদার সাথে তালমিলাতে গিয়ে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে  সক্ষম হয়েছেন এদেশের কৃষক-কৃষিবিজ্ঞানী-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ ধারাবাহিক ও সমন্বিত প্রয়াসে। ইতোমধ্যে খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসমূহের তালিকায় নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
শুধু ধান বা চাল নয়, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল যেমন-আলু, সবজি ও ফল উৎপাদনেও সাফল্য লাভ করতে পেরেছে। কৃষিপণ্য রফতানির তালিকায় সম্ভাবনাময় পণ্য হিসেবে আলু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। শুধু  কৃষিপণ্যই নয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনেও বাংলাদেশ সফলতার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশই জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। বিশাল জনগোষ্ঠীর পাহাড়সম আয়-বৈষম্য, উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীর যথাযথ সংরক্ষণ ও সুষম সরবরাহ-বণ্টনের অভাবই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। আর এখানেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সাথে সাথে এসে যায় ‘খাদ্য নিরাপত্তা’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়টি।    
‘খাদ্য নিরাপত্তা’ বলতে বোঝায় দেশের সকল মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সুস্থ-সবলভাবে জীবনধারণের জন্য চাহিদা ও পছন্দ মোতাবেক সব সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকা। তার মানে-খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোর সাথে সাথে নিরাপদ ও পুষ্টির ব্যাপারটি চিন্তা করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত অগ্রগতি ও সফলতার ফলে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি বর্তমানে সন্তোষজনক হলেও ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার চাপ (যা প্রতি বছর ১% হারে কমছে এবং এই অবস্থা চলমান থাকলে আগামী ১০০ বছর পর বাংলাদেশে কোন চাষযোগ্য জমিই থাকবে না) সামলানো অধিকতর কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আগামী দিনের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দরকার কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ের আধুনিকায়ন। উৎপাদন বাড়ানো, কৃষিজমি/চাষযোগ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি উৎপাদিত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের বিষয়েও যথেষ্ট নজর দিতে হবে। দেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় সেগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিজাত বা কৃষিজ উপজাত (by products) এবং কৃষিবর্জ্যকে (wastes) অনায়াসেই মূল্যবান খাদ্যপণ্যে রূপান্তর করাসহ পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।
কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ প্রায় সকল গরিব ও প্রান্তিক কৃষকের! এই অভিযোগ সকল পচনশীল কৃষিপণ্যের বেলায় বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পচনশীল কৃষিপণ্য (যেমন-বিভিন্ন জাতীয় শাকসবজি, আলু, টমেটো, বেগুনসহ অন্যান্য মৌসুমি সবজি-ফলমূল) গাছ বা জমি থেকে  আহরণ করার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায় বা পচে যায়, যাকে বলা হয় ‘খাদ্যের অপচয়’। এসব পণ্যসমূহ যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে মৌসুম শেষ হওয়ার ১ মাস বা দুই মাস পরেই বর্তমান মূল্যের কয়েকগুণ বেশি মূল্যে বিক্রি করতে পারতেন। কৃষক পেতেন উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য, জুটত মানসিক প্রশান্তি ও আর্থিক সচ্ছলতা। এসকল দ্রুত পচনশীল কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্য দরকার স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণাগার, হিমাগার বা ঈড়ষফ ঝঃড়ৎধমব, যেগুলো বছরব্যাপী পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ‘হিমাগার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, উদ্দোক্তাদেরকে সরকার স্বল্পসুদে ঋন দেওয়ার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সেইসাথে লক্ষ্য রাখতে হবে হিমাগারে পণ্য রাখার জন্য ধার্যকৃত চার্জ বা খরচ যেন কৃষকের নাগালের বাইরে না হয় বা অতিমাত্রায় বেশি না হয়। পাশাপাশি তদারকির জন্য অন্যান্য সরকারি পদক্ষেপও থাকতে হবে।
অন্যদিকে, মৌসুমি শাকসবজি-ফলমূল বা অনুরূপ কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মূল্যসংযোজন (value addition) করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নির্দিষ্ট পরিমাণ টমেটো থেকে কেচাপ (ketchup) বানানোর মাধ্যমে কয়েকগুণ বেশি মূল্য আয় করা যেতে পারে। বর্তমানে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় টমেটো কেচাপ  প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক দেশ এবং এ খাত থেকে চীনের বার্ষিক রপ্তানি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আমাদের দেশে কাঁঠাল একটি অতি জনপ্রিয় ফল। বিশেষ কিছু এলাকায় এর বাম্পার ফলন প্রায় প্রতি বছরই দৃশ্যমান হয়। এসব এলাকায় কাঁঠাল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের মাঝারি আকারের একটি কাঁঠাল (যার বাজার মূল্য ১০০ টাকা বা ১২০ টাকা) চীনে প্রায় দশগুণ বা আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। অনুরূপভাবে, আমাদের দেশে উৎপাদিত আরো অনেক ফল ও সবজি যেমন-আনারস, লেবু, শসা, তরমুজ, আম, আমড়া, তেতুল, মূলা, গাজর, কলা, জলপাই, আমলকী, কামরাঙ্গা, বেল, পেয়ারা ইত্যাদি যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য করে দেশীয় আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজনাতিরিক্ত পণ্যের অপচয় রোধ করা যাবে। মোটকথা রপ্তানি যোগ্য মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রবেশের দ্বার আমাদের নিজেদেরকেই উন্মোচিত করতে হবে।
সরকারিভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে এলাকায় যে ধরনের ফসল/ফল/সবজি অধিক পরিমাণে জন্মায় সেই এলাকায় ঐ নির্দিষ্ট ফসল/ফল/সবজিগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে। পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য রেশনের সাথে, ভিজিএফ ও ভিজিডি কার্ডধারীদের মাঝে বা সরকারীভাবে খোলা বাজারে (যেমনটি করা হয়ে থাকে রমজান বা অন্যান্য বিশেষ বিশেষ সময়ে) বিক্রির ব্যবস্থা  করতে পারলে কৃষক যেমন লাভবান হবে তেমনি ভোক্তাগণও মানসম্মত পণ্য পাবেন। সৃষ্টি হবে অসংখ্য শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থানের। অনুরূপভাবে ঐ এলাকার উদ্ধৃত বা প্রয়োজন অতিরিক্ত ফসল/ফল/সবজিগুলোর কিছু অংশ অন্যান্য এলাকায় (যে সকল এলাকায় এগুলোর অপ্রতুলতা আছে) সরকারিভাবে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট সকলেই উপকৃত হবে। এই পদক্ষেপগুলো সঠিক ও অর্থবহ করে তুলতে হলে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। বিদ্যমান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে অনুযায়ী খাদ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ নামে একটি শাখা/উইং বাড়ানো যেতে পারে। যেখানে দক্ষ খাদ্য প্রযুক্তিবিদ/খাদ্য প্রকৌশলী/খাদ্য বিজ্ঞানী বা অনুরূপ গ্রাজুয়েটগণকে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং বাজারজাতকরণের জন্য কৃষি অর্থনীতিবিদগণ বা বাজারজাতকরণ সম্পর্কে দক্ষ গ্রাজুয়েটগণকে নিয়োগ দিয়ে কৃষক ও কৃষিকে লাভজনক করে তুলা যেতে পারে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যামে পণ্যের যে মূল্যসংযোজন করা যাবে তার থেকে অর্জিত করের (value added tax, ev vat) মাধ্যমেই বেতনভাতা বা অবকাঠামোর সংস্থান করা সম্ভব হবে। এতে করে একদিকে যেমন নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যাবে তেমনি কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তিও নিশ্চিত হবে। সেই সাথে বেকার সমস্যার আংশিক সমাধানও সম্ভব হবে ।   
সর্বোপরি, ভৌত অবকাঠামো এবং পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের দেশের খাদ্য পরিবহন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। রাস্তাঘাট ভাল না হলে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যায়, ফলে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাস্তাঘাটে নিরাপদে ও নির্বিঘেœ পণ্য পরিবহনে পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়ন হবে। দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে।

লেখক : প্রফেসর, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২। ই-মেইল :iqbal21155@bau.edu.bd মোবাইল :০১৭১২-৫৫৫৪৮৫

বিস্তারিত
ফল ও সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে কৃষকের আয় বর্ধন

ফল ও সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে
কৃষকের আয় বর্ধন
মো: মনজুরুল হান্নান১  ড. মো: আতিকুর রহমান২
উদ্যানতাত্ত্বিক বিভিন্ন ফসলের মধ্যে ফল ও সবজি হলো অত্যন্ত পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত অর্থকরী ফসল। এগুলো ভিটামিন, খনিজ দ্রব্য ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের অন্যতম উৎস, যা মানবদেহে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে বছরব্যাপী প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজি উৎপাদিত হচ্ছে এবং উৎপাদনের এই মাত্রা প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু উৎপাদিত ফল ও সবজির প্রায় ৩০% বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায় যথাযথভাবে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হচ্ছে, যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা এবং আর্থিক বিবেচনায় অত্যন্ত ব্যাপক। উন্নত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ব্যবহার ও উত্তম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্যের এই বিশাল ক্ষতি কমিয়ে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো যাবে এবং অধিক মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যাবে। পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমবে, বছরব্যাপী পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটবে এবং আয় বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পরিবেশ, জলবায়ু, পানি ও ভূমি সম্পদের উপর চাপও বহুলাংশে কমে আসবে। কাজেই ফল ও সবজি ফসলের জন্য প্যাকহাউজ ভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর ভ্যালু চেইনের উন্নয়নের মাধ্যমে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমিয়ে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখা সম্ভব হবে।
ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) তথ্যানুযায়ী সারাবিশ্বে উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ কোন না কোনভাবে ক্ষতি বা অপচয় হয়, যার পরিমাণ প্রায় ১৩০ কোটি টন এবং মূল্য প্রায় এক ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। বিশ্বে প্রতি বছর উৎপাদিত ফলমূল ও শাকসবজির প্রায় ৪০-৫০% ক্ষতি ও অপচয় হয়ে থাকে (ঋঅঙ, ২০১৫)। এই ক্ষতির পরিমাণ সারাবিশ্বে শস্য উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ পানি, জমি, পেস্টিসাইড ও সার ব্যবহার করা হয় তার প্রায় ১/৪ অংশ। উপরন্তÍ এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হয়, যা বিশ্বের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করে।
উল্লেখ্য যে, এসডিজির  লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের দেশের খাদ্যের অপচয় ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ৫০% কমিয়ে আনতে হবে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ চারটি পর্যায়ে ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। খাদ্যের প্রাপ্তি ও সহজলভ্যতা; জনগণের খাদ্য ক্রয়ের ক্ষমতা; খাদ্যের ব্যবহার; সব সময় খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা।
সংগ্রহোত্তর ক্ষতির প্রধান কারণসমূহ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে প্রধান কয়েকটি ফল ও সবজি যেমন-টমেটো, বেগুন, করলা, শসা, ফুলকপি, পেঁপে, আম, কলা ইত্যাদির সংগ্রোহত্তর ক্ষতির পরিমাণ ২২-৩৫%। সংগ্রহোত্তর ক্ষতির অন্যতম কারণসমূহ হলো-
ফসলের উপযুক্ত পরিপক্বতা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব; সর্টিং এবং গ্রেডিংয়ের প্রতি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অনীহা; পরিষ্কার পানি দ্বারা ফল ও সবজি ধোয়ার সুযোগ-সুবিধার অভাব; চটের বস্তায় অনুপোযুক্ত বাল্ক প্যাকেজিং; রূক্ষভাবে পণ্য হ্যান্ডিলিং ও পরিবহনে উঠানামা করা; পরিবহনে মাত্রারিরিক্ত পণ্য বোঝাইকরণ দেশে ফল ও সবজির উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণের জন্য প্যাকহাউজ ও কোল্ডস্টোরেজের অভাব, সর্বোপরি দুর্বল বাজার ব্যবস্থার কারণে ভ্যালু চেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক কিংবা ব্যাপারিগণের উন্নত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি অনাগ্রহ।
ডোবার অপরিষ্কার পানিতে সবজি ধৌতকরণ যাতে খুব সহজেই সবজি জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়, চটের বস্তায় অনুপোযুক্ত বড় প্যাকেজিং এবং ট্রাকের উপর গাদাগাদি করে মাত্রাতিরিক্ত সবজি বোঝাই করে দূরবর্তী বাজারে পরিবহন ইত্যাদি কারণে সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
ফল ও সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর উপায়
উন্নত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ব্যবহার ও ভ্যালু চেইন উন্নয়নের মাধ্যমে ফল ও সবজির গুণমান বজায় রেখে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো যায়। ফসলের ধরনের উপর ভিত্তি করে সংগ্রহকৃত ফল ও সবজি মাঠেই সর্টিং করে স্থানীয় কালেকশন সেন্টার কিংবা প্যাকহাউজ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফসলের গুণগতমান পর্যবেক্ষণসহ গ্রেডিং, ধৌতকরণ, প্রি-কুলিং এবং ফাইনাল প্যাকেজিং করে বাজারজাত করা হয়। কাজেই গুণমান বজায় রেখে সতেজ ফল ও সবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে কৃষকের আয় বাড়ানোর জন্য প্রধান তিনটি উপায় হলো- ১। উপযুক্ত পরিপক্বতার পর্যায়ে মাঠ থেকে ফল ও সবজি আহরণ। ২। উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন- সর্টিং,  গ্রেডিং, ওয়াশিং, প্যাকেজিং ও উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে সতেজ ফল ও সবজি বাজারজাতকরণ। ৩। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ফল ও সবজিতে মূল্য সংযোজন।
ফল ও সবজি সংগ্রহের সঠিক পদ্ধতি ও সময়
সঠিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ না করলে ফল ও সবজি ফেটে বা থেঁতলিয়ে যেতে পারে যার ফলে সেগুলোর বাজারমূল্য কমে যায়। কাজেই ফল ও শাকসবজি উপযুক্ত পরিপক্ব অবস্থায় ভোর বেলায় ঠা-া ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ধারালো কাঁচি বা চাকুর সাহায্যে বোঁটাসহ সাবধানতার সহিত সংগ্রহ করতে হবে। বেগুন, ঢেঁড়স, করলা, লাউ, কুমড়া, শসা ইত্যাদি ফল এমনভাবে টেনে ছেঁড়া যাবে না যাতে করে কা-ের বাকলসহ ছিঁড়ে আসে। ফল টেনে ছিঁড়লে অনেক সময় ফলবৃন্ত উঠে আসে এবং মাতৃগাছের বাকল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরবর্তীতে গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সংগ্রহকৃত ফল বা সবজিগুলো একটি পরিষ্কার পাত্র যেমন, মসৃণ তলাবিশিষ্ট প্লাস্কিক বালতি বা প্লাস্টিক ক্রেটে রাখতে হবে। সংগ্রহকৃত ফল বা সবজিকে কোনভাবেই সরাসরি খোলা সূর্যের আলোতে কিংবা মাটির সংস্পর্শে রাখা যাবে না। কারণ এতে পণ্যের মান কমে যাবে, জীবাণু দ্বারা ফল আক্রান্ত হবে এবং ফলের গায়ে ধুলো-মাটি লেগে যাবে। সংগ্রহ করার পর পরই ফসলকে ছায়াযুক্ত স্থানে নিয়ে যেতে হবে যাতে করে সেগুলোর তাপমাত্রা না বাড়ে এবং পানির অপচয় কম হয়।
সর্টিং ও গ্রেডিং
সর্টিং এর মাধ্যমে ক্ষত, রোগাক্রান্ত বা নিম্নমানের পণ্যকে সরিয়ে ফেলা হয়। মূলত: প্যাকহাউজ বা সিসিএমসি কার্যক্রমের প্রথম ধাপই হচ্ছে সর্টিং। সর্টিং ও গ্রেডিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ফল ও সবজিতে ৪০% পর্যন্ত মূল্য সংযোজন করা সম্ভব। বিশেষ করে  গ্রেডিংকৃত পণ্য বেশি দামে বিক্রি করা যায়। ফসলের পরিপক্বতা, আকার ও ওজনের উপর ভিত্তি করে  গ্রেডিং বা শ্রেণীকরণ করা হয়। সর্টিং এবং  গ্রেডিং এর কাজ টেবিলের উপর রেখে করতে হবে।
ফল ও সবজি পরিষ্কার ও ধৌতকরণ
মাঠ থেকে সংগ্রহের সময় অনেক ক্ষেত্রে এতে ফল বা সবজির গায়ে মাটি লেগে থাকার কারণে অনেক সময় মাটি থেকে রোগজীবাণু ফলের গায়ে লেগে যায়, যা পরবর্তীতে ফসলের পচন ঘটায়। এক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানির সহিত ২০ গ্রাম সোডিয়াম বাই-কার্বোনেট (২% সক্রিয় উপাদান) ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সকল ফল বা সবজি ধোয়া যাবে না। এছাড়া স্ক্যালোপ পাউডার যা ক্যালসিনেটেড ক্যালসিয়াম নামক এক ধরনের পাউডার প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে ব্যবহার করলেও ভাল ফল পাওয়া যাবে। ধোয়ার পর পণ্যের গায়ের পানি ভালভাবে শুকালে তারপর প্যাকেটজাত করতে হবে। এভাবে পরিষ্কার করার ফলে পণ্যের গায়ে লেগে থাকা ময়লা ও রোগজীবাণু দূর হয়ে যায়, পচনের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং সংরক্ষণকাল বেশি হয়।
প্যাকেজিং
প্যাকহাউজ বা সিসিএমসির অন্যতম প্রধান কাজ হল পণ্যকে ভালোভাবে প্যাকেজিং করা। ইহা সতেজ পণ্যকে ক্ষত হওয়া ও বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। ফসলের প্রকৃতি, বাজারের দূরত্ব, যানবাহনের ধরন এবং রাস্তার অবস্থার উপর নির্ভর করে প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল কেমন হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাঠ থেকে শুরু করে দেশে অভ্যন্তরীণ বাজারে সতেজ ফল ও সবজি পরিবহনের জন্য প্লাস্টিক ক্রেটস-ই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ ও উপযুক্ত প্যাকেজিং কন্টেইনার। বাজারজাতকরণের সময় ফলমূল ও শাকসবজি প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে চটের বস্তা কিংবা বাঁশের ঝুড়ির পরিবর্তে শুধুমাত্র প্লাস্টিক ক্রেটস ব্যবহারের দ্বারাই ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ৫০% এর অধিক কমিয়ে আনা সম্ভব। উন্নত সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি ও উপযুক্ত প্যাকেজিং কন্টেইনার ব্যবহারের ফলাফল সারণি দ্রষ্টব্য।
বি.দ্র: খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ভাল বেগুনের মূল্য ৪০ টাকা এবং চাপ খাওয়া বেগুনের মূল্য ৩০ টাকা হিসেবে
পার্থক্য ৩৮৭০ - ২২৪৫= ১৬২৫ টাকা/১০০ কেজি। সুতরাং, প্রতি ১০০০ কেজিতে লাভ = ১৬,২৫০ টাকা।
প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধা
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে ট্রিটমেন্টের সাহায্যে বিশেষ করে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যের জীবাণুগুলোকে মেরে ফেলা হয়, এনজাইমেটিক কার‌্যাবলি বন্ধ করা হয় এবং এর পচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করা হয়, কিন্তু খাদ্যের গুণমান বজায় থাকে। কাজেই প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সর্বোচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উপযুক্ত পরিপক্ব অবস্থায় গাছ থেকে ফল-সবজি সংগ্রহ করতে হবে। ফলমূল ও শাকসবজির ক্ষতরি পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়; প্রক্রিয়াকৃত পণ্য দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়; বছরব্যাপী পুষ্টির জোগান নিশ্চিত হয়; সহজে পরিবহন ও গুদামজাত করা যায়; দেশে ও বিদেশের বাজারে সরবরাহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়; কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন প্রকার প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি
ফল ও সবজিকে ভিবিন্ন উপায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যায়। যেমন- শুকিয়ে সংরক্ষণ;চিনি এবং এসিড সংযোজন করে (জ্যাম, জেলি ও মোরব্বা ইত্যাদি) সংরক্ষণ; আচার, চাটনি ও সস তৈরি করে সংরক্ষণ; তাপ প্রয়োগ করে লবণ ও চিনি দ্রবণে (বোতল এবং টিনের পাত্রে) সংরক্ষণ; চিপস তৈরি করে সংরক্ষণ।
ফল ও সবজিতে শতকরা ৮৫-৯৫ ভাগ পর্যন্ত পানি থাকে এবং এগুলো পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ হওয়ায় খুব সহজেই রোগ-পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং পচে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় ফল ও সবজি উৎপাদন এলাকায় স্থানীয় বড় বাজারে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন প্যাকহাউজ স্থাপন করা অত্যাবশ্যক। সতেজ ফল ও সবজি প্যাজিংয়ের জন্য দেশে উন্নতমানের প্লাস্টিক ক্রেট উৎপাদন এবং সুলভ মূল্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে সেগুলির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকসহ ভ্যালু চেইনে কর্মরত সকল শ্রেণীর কর্মীদেরকে ফসলের উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
কাজেই উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এগুলোর সংগ্রহোত্তর ক্ষতি বহুলাংশে হ্রাসকরণের মাধ্যমে কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব।

লেখক : ১ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, ২প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএআরআই ও পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট, এনএটিপি-২ প্রকল্প, হর্টেক্স ফাউন্ডেশন, সেচ ভবন, ২২ মানিক মিয়া এভিনিউ, শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭।  মোবাইল: ০১৭৪৩১৩৪৫৮৪, E-mail: dratiqbari@gmail.com

বিস্তারিত
এফএও’র Four Betters ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন

এফএও’র Four Betters
ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন
মোঃ এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি
উন্নয়নের সবধরনের মাপকাঠিতে কিছুদিন আগেও মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাপূরণকে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য ছিল, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত একটি দেশ বিনির্মাণ। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২২ সালের বাংলাদেশ ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে এগিয়েছে, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রধান দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সেকারণেই মৌলিক চাহিদা হিসেবে সবার জন্য খাদ্য সংস্থানের পাশাপাশি, সবার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর, গুণগত  মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন আরও বেশি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম অভীষ্টসমূহ হলো কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাউকে পশ্চাতে না রেখে  সবার জন্য সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমতার ভিত্তিতে সকলের জন্য খাদ্য সহজলভ্য করা ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্ট, ২০২২ অনুযায়ী চলতি বছরের শেষে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। এই অতিরিক্ত  জনসংখ্যার সাথে খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে বহুগুণ। সেই সাথে সবার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ আর পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডঋচ) এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৯-২০২২ এই তিন বছরে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের শিকার মানুষের সংখ্যা ২১০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩৪৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। প্রতিদিন প্রায় ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় রাতে ঘুমাতে যায়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারীর প্রকোপে, মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসমতা (ক্রমবর্ধমান বৈষম্য), লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এবং নানাবিধ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বেড়েছে খাদ্য ও পুষ্টি সংকট এবং কমছে উর্বর কৃষি জমির পরিমাণ, সেই সাথে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
বিগত তিন বছরে (২০১৯-২০২২) বিশ্বব্যাপী অপুষ্টির শিকার জনসংখ্যা ৮৩ কোটিতে উন্নীত হয়েছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় এক দশমাংশ। এশিয়া মহাদেশে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবের সম্মুখীন। এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতি বছর জন্ম নেয়া প্রতি ছয়জন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এক চতুর্থাংশ শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে সঠিক দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে বলা যেতে পারে, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন বর্তমানে সবচেয়ে বড় এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের খাদ্য মূল্যসুচক গত বছরের তুলনায় ১৩.১ শতাংশ বেড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়েছে জ্বালানী মূল্য, সারের মূল্য যার ধারাবাহিকতায় বেড়েছে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয়। ফলস্বরূপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য মূল্য প্রায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিগত দশ বছরের খাদ্যদ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান ব্যাখ্যাতীতভাবে নির্দেশ করে যে, উৎপাদনশীলতা বহুগুণবৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ এখনো পুষ্টিকর খাদ্যের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন বর্তমান সময়ের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের অন্যতম একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ইতালির লিনসেই একাডেমি আয়োজিত এক সেমিনারে মূল আলোচক হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিবৃত্তির লক্ষ্যে   কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ব্যাপক রূপান্তরের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এ আলোচনায় তিনি খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনার কৌশলগত রূপরেখা- এফএও’র ফোর বেটারস (ঋড়ঁৎ ইবঃঃবৎং) এর কথা উল্লেখ করেন যার মূল উদ্দেশ্য (ভালো উৎপাদনের মাধ্যমে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন নিশ্চিতকরার মাধ্যমে) ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। সেই লক্ষ্য অর্জনে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হল , “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়: ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন”। এই মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির মৌলিক চাহিদা পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এফএও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এমএমআই (গরংংরহম গরফফষব ওহরঃরধঃরাব) প্রকল্প, টেলিফুডের আওতায় বরিশালে ক্ষুদ্র পরিসরে সেচকাজ, কক্সবাজারে ডিজিটাল ভিলেজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এফএও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রযুক্তি, বাজার এবং অর্থায়নের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণসহ জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা প্রদান করে যাচ্ছে।
“বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২” উদযাপন উপলক্ষ্যে নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্যকে লালন করে সকলকে একত্রে নিয়ে কাজ করে যেতে হবে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।  

লেখক : ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। মোবাইল : ০১৮৪২২৫৯২৪৮, ই-মেইল : md.ullahrafi@fao.org 

 

বিস্তারিত
কার্তিক মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি

কার্তিক মাসের কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন
আমন ধান
   আমন ধান পেকে গেলে রোদেলা দিন দেখে রিপার/কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে কম খরচে, স্বল্প সময়ে ধান সংগ্রহ করুন।
    বীজ ধানের জন্য সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করুন। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকিয়ে ছায়ায় রেখে ঠা-া করে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
    বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের উপর না রেখে পাটাতনের উপর রাখুন।
    পোকার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে মিশিয়ে দিন।
গম
    কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে গম বীজ বপনের প্রস্তুতি নিন।
    অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিত জাত যেমন- বারি গম-২৪, বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-৩০, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩ অথবা ডব্লিউএমআরআই গম-১, ডব্লিউএমআরআই গম-২, ডব্লিউএমআরআই গম-৩ আবাদ করুন।
    খরচ ও সময় কমাতে বেড প্লান্টারের মাধ্যমে বীজ বপন করুন।
    বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে নিন।
    বীজ বপনের ১৩-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ প্রয়োজন এবং এরপর প্রতি ৩০-৩৫ দিন পর ২ বার সেচ দিলে খুব ভাল ফলন পাওয়া যায়।
আখ
    আখ রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৯০ সেমি. থেকে ১২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬০ সে.মি রাখুন। এতে বিঘাপ্রতি ২২০০-২৫০০টি চারার প্রয়োজন হয়।
ভুট্টা
    অধিক ফলনের জন্য বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৭ আবাদ করুন। বীজ বপনে বেড প্লান্টার ব্যবহার করুন।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
    সরিষার প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৩, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৭, বারি সরিষা-১৮, বারি সরিষা-১৯, বিনাসরিষা-৪. বিনাসরিষা-৭, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১০ ও বিনাসরিষা-১১ উল্লেখযোগ্য।
    বিঘাপ্রতি ৩৩-৩৭ কেজি ইউরিয়া, ২২-২৪ কেজি টিএসপি, ১১-১৩ কেজি এমওপি, ২০-২৪ কেজি জিপসার ও ১ কেজি দস্তা সারের প্রয়োজন হয়।
    সরিষা ছাড়াও অন্যান্য তেল ফসল যেমন- তিল, তিসি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী এ সময় চাষ করা যায়।
আলু
    রপ্তানি উপযোগী আলু যেমন সানসাইন, প্রাডো, সান্তানা, কুইন এ্যানি, কুম্বিকা, ডোনাটা, ডায়ামন্ট, প্রানোলা, বারিআলু-৬২, মিউজিকা, বারি আলু-৯০ এসব আবাদ করুন, অধিক লাভবান হোন।
    এক একর জমিতে আলু আবদ করতে ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৯০ কেজি টিএসপি, ১০০ কেজি এমওপি, ৬০ কেজি জিপসাম এবং ৬ কেজি দস্তা সার প্রয়োজন হয়। তবে এ সারের পরিমাণ জমির অবস্থাভেদে কমবেশি হতে পারে। তাছাড়া একরপ্রতি ৪-৫ টন জৈবসার ব্যবহার করলে ফলন অনেক বেশি পাওয়া যায়।
    আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরি প্রয়োগ, মাটি অলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যকীয় কাজ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বিনা চাষে মালচিং দিয়ে আলু আবাদ করা যায়।
মিষ্টিআলু
    নদীর ধারে পলি মাটিযুক্ত জমি এবং বেলে দো-আঁশ প্রকৃতির মাটিতে মিষ্টিআলু ভাল ফলন দেয়।
    বারি মিষ্টিআলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-১২, বারি মিষ্টি আলু-১৩, বারি মিষ্টিআলু-১৪, বারি মিষ্টিআলু-১৫, বারি মিষ্টি আলু-১৬, বারি মিষ্টি আলু-১৭ আধুনিক মিষ্টিআলুর জাত।
    প্রতি বিঘা জমির জন্য তিন গিটযুক্ত ২২৫০-২৫০০ খ- লতা পর্যাপ্ত।
    বিঘাপ্রতি ৪-৫টন গোবর/জৈবসার, ১৬ কেজি ইউরিয়া, ৪০ কেজি টিএসপি, ৬০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।
ডাল ফসল
    মুসুর, মুগ, মাষকলাই, খেসারি, ফেলন, অড়হর, সয়াবিন, ছোলাসহ অন্যান্য ডাল এসময় চাষ করতে পারেন। এজন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন, সময়মতো বীজ বপন, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, পরিচর্যা, সেচ, বালাই ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে।
শাকসবজি
    বীজতলায় উন্নতজাতের দেশী-বিদেশী ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, বাটিশাক, টমাটো, বেগুন, গাজর, মটরশুঁটির এসবের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করুন।
    গত মাসে চারা উৎপাদন করে থাকলে মাটিতে জোঁ আসার সাথে সাথে মূল জমিতে চারা রোপণ করুন। এ মাসে হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপণকৃত শাকসবজির চারা নষ্ট হতে পারে। এ জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন। রোপণের পর আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ, সেচ নিকাশসহ প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করুন।
    স্বল্প সময়ে ফলন পেতে লালশাক, মুলাশাক, পালংশাক, লেটুস, ধনিয়া এসবের বীজ বপন করুন।
 বিবিধ
    অধিক লাভবান হতে উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করুন ।
    স্বল্পকালীন ও উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচন করুন অধিক ফসল ঘরে তুলুন।
    শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে আবাদ করুন।

লেখক : তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১১০১৯৬১০, ই-মেইল : manzur_1980@yahoo.com

বিস্তারিত
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি ১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর

অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি
১৬ নভেম্বর-১৫ ডিসেম্বর
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
অগ্রহায়ণ হেমন্তের দ্বিতীয় মাস। নবান্ন উৎসবের সময়। উৎসমুখর পরিবেশের সমান্তরালে বীর কৃষিজীবী ভাইবোনেরা ব্যস্ত থাকেন নিরাপদ ও পুষ্টি খাদ্য সরবরাহে। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে প্রায় আমন ধান পেকে যাবে। তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলা ভালো। শ্রম, সময় ও খরচ সাশ্রয়ে প্রয়োজনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে সুস্থ সবল ভালো ফসল কেটে, মাড়াইঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করে এবং ছায়ায় রেখে ঠা-া করতে হয়। পরিষ্কার ঠা-া ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বোরো ধান
বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়। যেসব এলাকায় ঠা-ার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। বোরো মওসুমের পানি সাশ্রয়ী জিংকসমৃদ্ধ জাত ছাড়াও এলাকাভিত্তিক আধুনিক উচ্চফলনশীল ও ব্রি হাইব্রিড ধানের জাত নির্বাচন করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য  ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল গমের জাত বপন করতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে এলাকাভিত্তিক ও ঘাতসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের বীজ বপন করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন।
আলু
উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যত্ন নিতে হবে।
শাকসবজি
ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স    ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হয়। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা প্রয়োজন।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়া যেতে পারে।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোল্ট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এজন্য সতর্কতা দরকার। গবাদিপ্রাণির রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
এ সময় বার বার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষি উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য।


লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা। টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪, ই-মেইল : editor@ais.gov.bd

বিস্তারিত