Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রফেসর ড. এম এ রহিম*

ফল বলতে আমরা নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বককেই বুঝি। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারিকেল, লেবু ও কুল এ ১০টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। কেননা চোখের সামনে প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। অনেকেই হয়তো চিনি আরও কিছু অপ্রধান ও স্বল্পভাবে চাষকৃত ফল যেমন- সফেদা, কামরাঙা, লটকন, বিলাতি আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, পেয়ারা এসব ফলকে। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অপ্রচলিত শব্দটির অর্থ হচ্ছে যার প্রচলন নেই অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম,  এগুলো অনেকে বনে জঙ্গলে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায়  বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এগুলো পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিরামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণরাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না বলে এগুলো অপ্রচলিত।


দেশি  ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল এক রকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো জন্মে। সাধারণত এসব ফলের গাছে তেমন কোনো সার দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড় বাতাস কিংবা বন্যা খরাতেও এ ফলের গাছকে মারতে পারে না। এ ফলের ব্যাপকভাবে খাপখাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা। এ ফলের আর একটা সুবিধা হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফলগাছের মতো এসব ফল বা ফলগাছে অত বেশি রোগপোকারও আক্রমণ হয় না। দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার (বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট  (বারি) ও সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বারি ও বিনায় দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে কার্যক্রম নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
 

বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার
১৯৯১ সাল থেকে তরুণ, মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার  ফলে সর্বমোট ৬৮টি বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত বের করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২১টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৪টি, জাম্বুরার ৫টি, লিচুর ৪টি, তেঁতুুলর ১টি, কামরাঙা ৩টি, জলপাই, লটকন, আমলকী, মালটা, অরবরই, স্ট্রবেরি, কদবেল, কাঁঠাল, আমড়া, ও কাজুবাদাম এর ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি জাত।


বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের অর্থায়নে ইন্টার কোঅপারেশন এগ্রো ফরেস্ট্রি ইমপ্রুভমেন্ট পার্টনারশিপের ব্যবস্থাপনায় এ ফল সেন্টারটির গোড়াপত্তন হয় ১৯৯১ সালে। তখন প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ, পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয়, ফলগাছ উন্নয়ন প্রকল্প, এখন এটাকে ফলদ বৃক্ষের জার্মপ্লাজম সেন্টার বলা হয়। ১৯৯১ সালে প্রকল্পটি মাত্র এক একর জায়গা নিয়ে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে কর্মমুখর হয়ে ওঠে, যার ফলাফল ক্রমেই ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। বর্তমানে এর আয়তন ৩২ একর। বনবাদাড়, পাহাড় পর্বত চষে বেড়ান এ প্রকল্পের কর্মীরা। শুরু হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দেশের প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় ফলের গাছ সংগ্রহ। দেশীয় আবহাওয়ায় উপযোগী ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ফলের জাত উদ্ভাবনে ব্রত হন।
ময়মনসিংহ শহরের দক্ষিণে আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এ প্রকল্পের অবস্থান। ৩২ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সেন্টারটি। এ সেন্টারটিতে রয়েছে ১৮১ প্রজাতির প্রায় ১৩ হাজার দেশি-বিদেশি বিরল ফলের মাতৃগাছ। এর মধ্যে ৩০১ রকমের আম, ৫৭ রকমের পেয়ারা, ২৩ রকমের লিচু, ৮৭ রকমের লেবু, ৯৪ রকমের কাঁঠাল, ৬৭ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, ৬৮ প্রজাতির ফলদ ঔষধি গাছ। ৩২ একর রাজ্যে পুরোটা জুড়ে শুধু গাছ আর ফল, স্বপ্নমাখা সবুজের মধ্যে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। মূল ফটক থেকে সেন্টারের ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন রাস্তার দুই সারিতে বিভিন্ন রকমের জামরুল, জলপাই আর পেয়ারার সারি, রাস্তা ধরে ভেতরে প্রবেশ করলে ডান দিকে চোখে পড়বে আমের রাজ্য। এখানে খুব ছোট ছোট গাছে রঙ-বেরঙের ফুলফলে সাজানো গাছের দিকে তাকালে মন ভরে যাবে। একটু সামনে গেলে একটি সাদা রঙের ভবন চোখে পড়বে। এটাই এই সেন্টারের অফিস। এখান থেকেই সব কিছু মনিটরিং করা হয়। অফিস রুমের সামনে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে বিভিন্ন প্রজাতির ফল। যার কোনোটি টবে, কোনোটি অর্ধড্রামে আবার কোনোটি মাটিতে পোঁতা। জ্যৈষ্ঠ মাসে এ বামন গাছগুলোতে ঝুলে থাকে অসংখ্য কাঁচা-পাকা আম। ভবনের উত্তর পাশে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির লেবু-পেয়ারা ও বারোমাসি আমড়া। বর্তমান সময়ে এ দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাউকুল, আপেল কুল, তাইওয়ান কুল, ঢাকা-৯০, নারিকেলি কুল, বারিকুল, নাবিকুল, হাজারীকুল, চাইনিজ কুলসহ অনেক  দেশিকুল। আর পেয়ারা? বিচিত্র তার আকার, পাতা ও স্বাদ। কোনোটি মিষ্টি, কোনোটি টক, কোনোটি মচমচে আবার কোনোটি রঙিন, লাল শাঁস, সাদা শাঁস কোনোটিই বাদ যায়নি। বাগানে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আদা লেবু, কাটা লেবু, শাঁসনি লেবু, সাতকড়া, দার্জিলিং, ভ্যালেন্সিয়া, মনিপুরী এবং মোসাম্বি কমলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির লেবু। আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন আকারের এবং স্বাদের বাতাবিলেবু তো আছেই।


অফিসের ঠিক পূর্ব দিকে রয়েছে এ দেশের বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, সবুজপাতা ছাপিয়ে থোকায় ঝুলছে বেঁটে সফেদা, কালোপাতি সফেদা, বাদামি সফেদা, লাল টকটকে আপেল জামরুল, গোলাপি রঙের নাশপাতি জামরুল, সবুজ জামরুল, বামন জলপাই, মিষ্টি ও হাইব্রিড কামরাঙা, বৈচি, লুকলুকি, পানিয়ালা, খিরনি, হরীতকী, বহেড়া, বন কাঁঠাল,  ফলসা, স্টার আপেল, লোকাট, চেরি, করমচা, অরবরই, মহুয়া, আমলকী, বেল, কিন্তু অনেকেই চিনি না লুকলুকি, ডেউয়া, ডেফল, করমচা, জঙ্গিবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, পানিজাম, কালোজাম, তুঁত, তিনকরা, তাবা, ত্রিপত্রিক লেবু, জামির, মনফল, আঁশফল, তারকা ফল, দেশি গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, গুটি জাম, খেজুর, জাম, জামরুল, চেস্টনাট, তরমুজ ডালিম, টক লেবু, চালতা, ডুমুর, টক আতা, তেঁতুল, পানি ফল, সিঙ্গাড়া ফল, দেশি আমড়া, বন্য ডুমুর, বাঙি, চাপালিশ, জিলাপি ফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটি ফল, বকুল, ফলসা, ট্যাংফল, চুকুর, রাম কলা, কেন ফল, চিনার, রক্ত গোটা, চিকান, পানকি, চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, আমরুল, পেয়ালাগোটা, চিনাডুলি, লতা ডুমুর, বুদুমচোরা, টমিটমি, কোয়াগোলা, গুটগুটি, বিলিম্বি, কেক ফল, অমৃত ফল, চাউর, আলুবোখড়া, চেরি, খিরনি, বকুল, মহুয়া ও আঁশ ফল যা হাজার বছরেরর ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে । এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছ, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য একেক ফলে এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে। এ ফলগুলো বিদেশি ফলের আগ্রাসনে এবং উদ্ভাবিত নতুন জাতের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছিল। বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার উপরোল্লিখিত বিলুপ্তপ্রায় সব ফলগুলো বন, জঙ্গল, পাহাড়, বসতভিটাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং এর ওপর নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জার্মপ্লাজম সেন্টার এ সব দেশীয় ফলকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে। বর্তমানে এ জার্মপ্লাজম সেন্টারটি বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা। এ যেন এক জীবন্ত ফলের জাদুঘর। সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা প্রকৃতির কন্যার অলংকার এ জার্মপ্লাজম সেন্টারটি। এটি বাংলাদেশ কৃষি  বিশ্ববিদ্যালয়ের অহংকার। অহংকার এ দেশের মানুষের। বেঁচে থাক এ সেন্টারটি । এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে।


 বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)
দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট  (বারি) । এ পর্যন্ত  এ ইনস্টিটিউট থেকে  আমের ১১টি, কাঁঠালের ৩টি, পেয়ারার ২টি, বাতাবিলেবুর ৩টি, লেবুর ৩টি, আমলকির ১টি, বিলাতিগাবের ১টি, সফেদার ১টি, কুলের ৪টি, আঁশ ফলের ১টি, কামরাঙ্গার ১টি, তেঁতুলের ১টি, লিচুর ৫টি, জামরুলের ২টি, মিষ্টিলেবুর ১টি, জলপাইয়ের ১টি ও কদবেলের ১টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ফলগুলোকে কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের জন্য সম্প্রসারিত করা হয়েছে। অনেক ফলের জাত ভালো জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে।


বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুরে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন  হিসেবে দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য এ ইনস্টিটিউট জৈন্তাপুরে লেবুজাতীয় ফসল, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে যেমন- জামালপুর, ঈশ্বরদী, খয়েরতলা (যশোর), হাটহাজারী (চট্টগ্রাম), রহমতপুর (বরিশাল), আকবরপুর (মৌলভীবাজার) ও বুড়িহাট ফার্ম (রংপুর) আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। এ আঞ্চলিক ইনস্টিটিউটগুলোতে নিবিড় গবেষণাসহ দেশীয় ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করা হচ্ছে।


বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা (বিনা) পরমাণু শক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে দেশি ফলের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, অচিরেই এ ইনস্টিটিউট  থেকে ভালো কিছু দেশি ফলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে। এ ইনস্টিটিউট  অবশ্য অনেক দেশি ফলের জাত সংরক্ষণও করছে।

ড. মো. শামছুল আলম মিঠু**
*পরিচালক, **সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ

 

বিস্তারিত
ফল উৎপাদন পরিস্থিতি এবং আবাদ বৃদ্ধিতে করণীয়

মানব দেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। কথায় বলে ‘ফলই বল’, ফলে ভেজাল নেই, রান্নার ঝামেলা নেই। তাই পুষ্টিতে বিশেষ করে ভিটামিন ও খনিজ ভরপুর খাদ্য হিসেবে ফলের বিকল্প নেই। অন্য খাদ্যের মতো আহারে রান্নার প্রয়োজন না হওয়ায় ফলের সব খাদ্য উপাদান পুরোটাই দেহের প্রয়োজনে আসে, কোনো রকমেই অপচয় হয় না। পুষ্টিবিদদের মতে, পূর্ণ বয়স্কদের মাথাপিছু দৈনিক ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। তবে বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় তা বড় জোর ৫০%। অধিকন্তু, এ দেশে যে ফলগুলো উৎপাদন হয় তার প্রায় ৬০% পাওয়া যায় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, মাত্র চার মাসে। শীত মৌসুমে ফল প্রাপ্তির সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম। কাজেই পুষ্টি ঘাটতির পরিমাণ শীত মৌসুমে বেশি হয়, বিশেষ করে গ্রামীণ মা ও শিশুদের অপুষ্টিজনিত রোগ এ সময় বেশি দেখা যায়। বিকল্প খাদ্য হিসেবে ও সুষম খাবার গ্রহণে ফলের অবদান অতুলনীয়। ফলের এসব গুরুত্বপূর্ণ দিকসহ বাড়তি খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি জনগণের টেকটসই পুষ্টি নিরাপত্তার লক্ষ্যে ফলের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে প্রকল্পের আওতায় প্রচলিত অপ্রচলিত এবং অন্যান্য দেশি-বিদেশি সম্ভাবনাময় সব ধরনের ফলের চাষাবাদ বাড়িয়ে সারা বছর সমানভাবে চাহিদামাফিক ফলের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া অত্যাবশ্যক।


বিভিন্ন ফসল ও ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেক সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ধান উৎপাদনে এ দেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয় ও পেয়ারা, আখ, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং আম উৎপাদনে অষ্টম স্থান অর্জন করেছে। এ দেশে উপকূলীয় ও হাওর এলাকায় ভাসমান সবজি উৎপাদন প্রযুক্তি জনপ্রিয় করার এ দেশের উদ্যোগটা বিশ্বে বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেছে। বর্তমানে চর এলাকায়  যেভাবে বাঙি/চিনাইল, লালিমা এবং দক্ষিণাঞ্চলের এলাকা, বিশেষে করে পতিত জমিতে যে হারে উন্নত জাতের তরমুজ আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এ দেশে মৌসুমি ফল উৎপাদনে সফলতার নতুন গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ হবে।


একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ ও নগরায়নের প্রভাবে আবাদি জমি প্রতিনিয়তই কমে  যাচ্ছে। তথাপি নতুন ভাবে ফল চাষ সম্প্রসারণের সুবিধা এখনও প্রচুর রয়েছে। অন্য ফসলের তুলনায় ফল চাষ লাভজনক। এমনকি অভিজ্ঞ ফল চাষির কাছে এটি অতি লাভজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের জেলা বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর  ও রংপুরের তিস্তা বেল্টে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এসব এলাকায় শস্য বিন্যাস যথেষ্ট পরিবর্তন আসছে। এসব এলাকায় বোরো আবাদের পরিবর্তে আউশ ধান, ভুট্টা, তিল, ডাল, তেলবীজ জাতীয় ফসলের পাশাপাশি প্রচুর নতুন ফল বাগান  সৃষ্টির দিকে কৃষকের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ফল চাষে কিছুসংখ্যক সফল অভিজ্ঞ ফলচাষি দীর্ঘমেয়াদি (৫-১০ বছর) জমি লিজ নিয়ে ফল উৎপাদনে সফলতার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে। যেসব ফল সম্প্রসারণ তাদের কাছে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে তার মধ্যে বারোমাসি থাই পেয়ারা, আপেল কুল-থাইকুল, বারোমাসি কাগজিলেবু, মাল্টা, কমলা, ড্রাগন ফল, লিচু এবং আ¤্রপালি জাতের আম অন্যতম।


ফল চাষ সম্ভাবনাময় অঞ্চল
দেশের কিছু এলাকা ব্যাপক হারে ফল চাষ সম্প্রসারণ সম্ভাবনা খুব বেশি বিরাজ করছে। এগুলোর মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোসহ উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু ও কম খাঁড়া পাহাড়ি (মধুপুর, হালুয়াঘাট, ঝিনাইগাতী, গাজীপুর, নরসিংদী, সিলেট, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সীতাকু-ু ইত্যাদি) ভাবাপন্ন অংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য তিনটি জেলায় ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা বিরাজ করছে। ফল চাষে গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকার বড় জোর ১০% জমি এ পর্যন্ত ফল চাষ আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট প্রায় ৯০% ফল চাষ সম্ভাবনার ‘সোনার খনি’ এখনও অব্যবহৃত (টহ-ঃড়ঁপযবফ) রয়ে গেছে। পাহাড় অঞ্চলের সম্ভাবনাময় এ অংশকে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষের আওতায় আনা হলে দেশের ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর চাহিদা জোগানের সহায়ক হবে। পরিতাপের বিষয় কিছুসংখ্যক ভূমি লোভী/দখলকারী ব্যক্তি রাবার, পাম অয়েল, চা বাগান ও ফল বাগান সৃষ্টির নামে এ পার্বত্য জেলার যথেষ্ট পরিমাণ জমি সংগ্রহ/দখলে রেখেছে। তাদের সংগৃহীত গুরুত্বপূর্ণ জমির সুনির্দিষ্ট বাগান সৃষ্টিতে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।  


পাহাড়ি এলাকায় ফল চাষে প্রধান অন্তরায় পানি সেচ সংকট। একই কারণে পানি সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায়ে (ক্রিক ড্যাম, বিভিন্ন প্রকার রিজারভার সৃষ্টি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ) কৌশল অবলম্বনে ন্যূনতম সেচের উৎস সৃষ্টি করা অতীব জরুরি। এছাড়া এ পানি  সংকট এলাকা ব্যবহারে মিতব্যয়ী বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক।


পাহাড়ি এলাকায় চাষ উপযোগী ফল  
পানি সংকটের কারণে এসব এলাকায় কেবল মাত্র যেসব ফলের কিছুটা খরা সহিষ্ণুতা গুণাগুণ আছে তা আবাদে  প্রধান্য দেয়া দরকার। মাটিতে রস কম থাকলেও প্রতিকূল অবস্থায় কিছু ফলগাছ ন্যূনতম ফল দানে সক্ষম। এ ধরনের উপযোগী ফল  গাছের মধ্যে পেঁপে, কলা (চম্পা, বাংলা, তরকারি কলা, বিচি কলা) আনারস, লেবু, কমলা, মাল্টা, বাতাবি, কাজু বাদাম, কুল,  লিচু, আম, কাঁঠাল অন্যতম। এসব ফল গাছ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়।
প্রযুক্তি অবলম্বন : এলাকায় ফল গাছ রোপণে যেসব প্রযুক্তি অনুসরণ করা দরকার তা হলো-


ক. ঢালে বা স্লোপে ফল গাছের চারা-কলম লাগাতে হলে কন্টুর পদ্ধতি অবলম্বন করে নির্দিষ্ট সারিতে গাছ রোপণ করতে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত তৈরি করে তাতে প্রচুর জৈবসার ও পরিমাণমতো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা প্রয়োজন হবে। জৈবসারের অভাব থাকলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ কেবল মাত্র উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) দিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে গাছ রোপণ করতে হবে। সেচ সুবিধা না থাকলে জুন মাসে কিছুটা বড় আকারের ফলগাছ রোপণ করা উচিত হবে।
খ. গাছ রোপণকালে স্বাভাবিকের চেয়ে গাছের চারা/কলম ২০ থেকে ৩০ সে.মিটার গভীরে নিচু করে গাছ রোপণ করতে হবে। তাতে শিকড় মাটির  যেতে সহজ হবে। প্রতি গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত  জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। তাতে প্রতিকূল অবস্থায় মাটিতে রসের অভাব থাকলেও গাছ বৃদ্ধিতে তা সহায়ক হবে।
-  রোপিত গাছের ঢালের নিচু অংশে ‘হাফমুন টেরাস’ পদ্ধতি অবলম্বনে গোড়া থেকে ৫০ থেকে ৬০ সেমি. দূরত্বে হালকা উঁচু করে বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।  
- গাছ রোপণের সঙ্গে সঙ্গে শক্ত বাঁশের কাঠি দিয়ে গাছকে বেঁধে সোজা রাখার ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে।
- রোপিত গাছের পাতায় ও গোড়ায় সকাল-বিকেল দুই-তিনবার কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হালকা পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
গ. মালচিং : খড়কুটো, কচুরিপানা, তুষ, নারিকেলের ছোবড়া, লতা-পাতা এসব দিয়ে রোপিত গাছের চারধারে ৫০ থেকে ৭০ সে.মিটার দূর পর্যন্ত মালচিং দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। শুকনা মৌসুমে এ মালচিং ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন তা ৫ থেকে ১০ সে.মিটার গাছের গোড়া ছেড়ে তা দেয়া হয়। বর্ষাকালে মালচিং দেয়া না হলেও চলবে। মালচিং ব্যবস্থায় গাছের গোড়ার চারধারের মাটি ঠা-া থাকে, মাটিতে রস সংরক্ষিত থাকে। বেশি সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। পরে এগুলো পচে জৈবসার হিসেবে কাজ করে। মাটির ক্ষয়রোধ হয়।
ঘ. ফলগাছের ট্রেনিং প্রুনিং : প্রথম অবস্থায় (২-৩ বছর পর্যন্ত ) গাছের পার্শ্বে  অতিরিক্ত গজানো ডাল ১.০০ থেকে ১.৫০ মিটার পর্যন্ত কা- রেখে অতিরিক্ত গজানো ডাল ছাঁটাই করে গোড়ার কাঠামো বা কা- গঠন করে নেয়া প্রয়োজন। এছাড়াও মরা, রোগাক্রান্ত দুর্বল গজানো ডাল নিয়মিত ছেঁটে দিতে হবে। পরবর্তীতে গাছ বড় হয়ে ফল ধরা আরম্ভ করলে ভেতরের অফলন্ত ডালপালা ছেঁটে আলো বাতাস প্রবেশের সুবিধা করে দিতে হবে। এ ব্যবস্থায় রোগপোকার হাত থেকে গাছকে অনেকটা নিরাপদ রাখা যাবে। প্রথম দুইবছর গাছে কোনো প্রকার ফুল/ফল রাখা যাবে না। ফুল আসার শুরুতেই তা  ভেঙে দিয়ে গাছকে বাড়তে দিতে হবে।
দক্ষিণাঞ্চলে ফল চাষ সম্প্রসারণ
পার্বত্য জেলাগুলোর মতো উপকূলীয় জেলাগুলো বিশেষ ধরনের ফল চাষ সম্প্রসারণ উপযোগী বিস্তর এলাকা রয়েছে। তবে দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোর পরিস্থিতি ভিন্নতর। ঘূর্ণিঝড়, জোয়ারের তীব্রতা, মাটির লবণাক্ততা, সেচের কাজে মাটির নিচের পানি ব্যবহার অন্তরায়, মিঠা পানি প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এসব এলাকায় ব্যাপক হারে ফল বাগান সম্প্রসারণে যথেষ্ট অন্তরায়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব এলাকায় যেসব ফল গাছের কিছুটা হলেও লবণাক্তসহিষ্ণু গুণ আছে কেবল সেসব ফল এ বিশাল এলাকায় ব্যাপক হারে সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে উৎপাদিত ফল বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এখানের উঁচু/মাঝারি উঁচু জমি চিহ্নিত করে উপজেলাওয়ারি সেগুলোর লবণাক্ততা মাত্রা নির্ণয় করে, কোনো ধরনের জমি, কোন ফল চাষ সম্প্রসারণ গুরুত্ব দেয়া যাবে তার একটা সুপরিকল্পিত তালিকা তৈরি করে নিয়ে পরবর্তীতে তা অনুসরণে ফল চাষ সম্প্রসারণ পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্প্রতি দক্ষিণ এলাকায় বসতবাড়ি ও তদসংলগ্ন পতিত জমিতে (আধা বিঘা) আম বাগান স্থাপন করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে দলগতভাবে সার্বজনীন স্থানে বাগান কারার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।


বিশেষ নারিকেল চাষ কর্মসূচি  
নারিকেল গাছের লবণাক্তসহিষ্ণু গুণ অন্যান্য ফলের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বর্তমানে যেসব লম্বা জাতের নারিকেল চাষের প্রচলন আছে সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ও উপকূলীয় ঝড়ো হাওয়া সহনশীলতা কম। কাজেই তা নিরসনে ও উপযুক্ততা বিবেচনায় এনে উপকূলীয় এলাকায় উন্নতমানের বিদেশি খাটো (ওপি) জাতের নারিকেল চারা  সংগ্রহ ও বিতরণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি নারিকেল চারা  রোপণের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশে ৭১০ কিলোমিটার লম্বা উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে, যা ১৯টা জেলার ১৫৩টা উপজেলায় বিরাজিত। এর মধ্যে ৫১টা উপজেলা সমুদ্রের সন্নিকটে উন্মুক্ত অবস্থায় আছে। এ অংশে চলতি বছরে ৬০ হাজার এবং আগামী বছরে ১ লাখ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত (ভারত-ভিয়েতনাম) খাটো উন্নত জাতের নারিকেল চারা রোপণ ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থা নিয়ে চাষিদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ও পরিবেশের প্রতিকূলতা এড়ানোর অন্যতম উদ্যোগ গ্রহণ করা অব্যাহত রয়েছে। এ কর্মসূচিকে বেগবান করে ৪ থেকে ৫ কোটি নারিকেল চারা রোপণের  মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার জনপদের সচ্ছলতা আনা সহজতর হবে।  


বসতবাড়িতে ফল উৎপাদন
এ দেশে বসতবাড়ির সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এ সব বসতবাড়ি সব শ্রেণির কৃষকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছুসংখ্যক ফল গাছ সুশৃংখলভাবে লাগানো হলেও অধিকাংশ আপনা থেকে গজানো ফলের চারা ও বনজ গাছের সমারোহ বেশি দেখা যায়। পরিকল্পিতভাবে এ বসতবাড়িগুলোতে কম দরকারি কিছু গাছ নির্বাচন করে অন্যত্র সরিয়ে সেখানে নির্বাচিত উন্নত জাতের ৫ থেকে ৭টা করে ফল গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নেয়া হলে সেক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ কোটি বাড়তি ফলগাছ সম্প্রসারণ খুবই সহজ। এ ব্যবস্থায় গ্রাম পর্যায়ে পুষ্টি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব পড়বে। বসতবাড়িতে রোপণের জন্য যেসব ফলগাছ বেশি উপযোগী সেগুলো হলো-
কলা (আনাজিসহ খাটো জাত) পেঁপে, আনারস (ছায়া অংশে) শরিফা, আতা, ড্রাগন ফল, আমড়া (বারোমাসি), বেল, কদবেল, জলপাই, লটকন, আম (খাটো জাত), কাঁঠাল (বারোমাসি), পেয়ারা, কুল, কাগজি লেবু (বারোমাসি), বাতাবি (বারোমাসি), মাল্টা, কমলা, ডালিম, নারিকেল, সুপারি, সফেদা, কামরাঙা, আমলকী, অরবরই, বিলিম্বি, ডুমুর, থাই জামরুল, করমচা, ফলসা, জাবাটিকা অন্যতম।


বসতবাড়ি এলাকায় ফলচাষ সম্প্রসারণে যেসব দিকগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো-
বসতবাড়ির আকার বিবেচনায় এনে সেখানে কত সংখ্যক, কি ধরনের গাছ (বড়, মাঝারি, ছোট আকার বিশিষ্ট মিলে) রোপণ করা যাবে তা নির্ণয় করা।
পরিবারে সদস্যদের যেসব ফল গাছ লাগাতে আগ্রহী তা বিবেচনায় নির্বাচান উদ্যোগ নেয়া।
পুষ্টিতে সমৃদ্ধ ও অসময়ে (বছরব্যাপী) ফল প্রাপ্তি বিবেচনায় নেয়া। সর্বোপরি এলাকা ও অবস্থান বিবেচনায় এনে চূড়ান্ত সংখ্যা চারা/কলম রোপণ প্লানিং নির্ধারণ। রোপণযোগ্য নির্বাচিত ফলগাছ কখন, কোন জাতের, কোথা থেকে সংগ্রহীত হবে তার পরিকল্পনা প্রণয়ন (নির্ভরযোগ্য উৎসের কাক্সিক্ষত জাতের হতে হবে) করে নিতে হবে।
সর্বোপরি শুধু গাছ লাগিয়েই দায়িত্ব সম্পূর্ণ করা ঠিক হবে না। রোপিত গাছগুলো থেকে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল পাওয়া যায় এজন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং প্রুনিং, পানি সেচ নিষ্কাশন, সার প্রয়োগ ও রোগবালাই দমনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এম এনামুল হক*
*মহাপরিচালক (অব.), ডিএই

বিস্তারিত
শ্রাবণ মাসের কৃষি

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শ্রাবণের অথৈ পানিতে খালবিল, নদীনাল, পুকুর ডোবা ভরে যায়, ভাসিয়ে দেয় মাঠঘাট, প্রান্তর এমনকি আমাদের বসতবাড়ির আঙিনা। তিল তিল করে বিনিয়োগ করা কষ্টের কৃষি তলিয়ে যেতে পারে সর্বনাশা পানির নিচে। প্রকৃতি সদয় থাকলে ভাটির টানে এ পানির সিংহভাগ চলে যায় সমুদ্রে। কৃষি কাজে ফিরে আসে ব্যস্ততা। আর এ প্রসঙ্গে জেনে নেবো কৃষির বৃহত্তর ভুবনে কোন কোন কাজগুলো করতে হবে আমাদের।
আউশ  
এ সময় আউশ ধান পাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পাকা আউশ ধান কেটে মাড়াইঝাড়াই করে শুকিয়ে নিতে হবে।
বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বীজ ধান হিসেবে সংরক্ষণ করতে হলে লাগসই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে ভবিষ্যৎ ভালো বীজ পাওয়া যাবে।
আমন ধান
শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। চারার বয়স ৩০ থেকে ৪০ দিন হলে জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপা আমনের আধুনিক এবং উন্নত জাতগুলো হলো বিআর৩, বিআর৮, বিআর৫, বিআর১০, বিআর২২, বিআর২৩, বিআর২৫, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, বিনাশাইল, নাইজারশাইল, বিনাধান৪ এসব।
উপকূলীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উপযোগী উফশী জাতের (ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২ এসব) চাষ করতে পারেন।
খরা প্রকোপ এলাকায় নাবি রোপা আমনের পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমন (ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪) চাষ করতে পারেন। সে সঙ্গে জমির এক কোণে গর্ত করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন। আমন ধানের ক্ষেতে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য জমির উর্বরতা অনুসারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণের ১২ থেকে ১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার ক্ষেতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রথম উপরিপ্রয়োগের ১৫ থেকে ২০ দিন পর দ্বিতীয়বার এবং তার ১৫ থেকে ২০ দিন পর তৃতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে চারা লাগানোর ১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গুছির জন্য ১৮ গ্রামের ১টি গুটি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য চারা লাইনে রোপণ করতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ধানের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পুঁতে দিতে পারেন যাতে পাখি বসতে পারে এবং এসব পাখি পোকা ধরে খেতে পারে।
পাট
ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি পাট গাছে ফুল আসলে পাট কাটতে হবে। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও ভালো পাওয়া যায়।
পাট পচানোর জন্য আঁটি বেঁধে পাতা ঝড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে তারপর জাগ দিতে হবে।
ইতোমধ্যে পাট পচে গেলে তা আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভালো করে ধোয়ার পর ৪০ লিটার পানিতে এককেজি তেঁতুল গুলে তাতে আঁশ ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, এতে উজ্জ্বল বর্ণের পাট পাওয়া যায়।
যেসব জায়গায় জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে পাট কাটার সঙ্গে সঙ্গে ছালকরণ করতে হবে, তা না হলে পরবর্তীতে রৌদ্রে পাটগাছ শুকিয়ে গেলে ছালকরণে সমস্যা হবে।
বন্যার কারণে অনেক সময় সরাসরি পাটগাছ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পাটের ডগা বা কা- কেটে উঁচু জায়গায় লাগিয়ে তা থেকে খুব সহজেই বীজ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে আগাম শীত আসে, সে জন্য এসব অঞ্চলে এ মাসের মধ্যে তুলার বীজ বপন করতে হবে।
শাকসবজি
বর্ষাকালে শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স এমনকি পলিথিন ব্যাগে সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ মাসে সবজি বাগানে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় পানি জমতে না দেয়া, মরা বা হলুদ পাতা কেটে ফেলা, প্রয়োজনে সারের উপরিপ্রয়োগ করা।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতা গাছের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। গত মাসে শিম ও লাউয়ের চারা রোপণের ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। বর্ষায় পানি যেন মাদার কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সম্ভব হলে মাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছপালা
এখন সারা দেশে গাছ রোপণের কাজ চলছে। ফলদ, বনজ এবং ঔষধি বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা বা কলম রোপণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একহাত চওড়া এবং একহাত গভীর গর্ত করে অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক জৈবসারের সঙ্গে ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সার ও মাটির এ মিশ্রণ গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। দিন দশেক পরে গর্তে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে।
ভালো জাতের সুস্থ্য স্বাস্থ্যবান চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং খুঁটির সাথে সোজা করে বেঁধে দিতে হবে।
গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করা চারার চারপাশে বেড়া দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রির রোগবালাই বেড়ে যায়। তাই সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে খামার জীবাণুমুক্তকরণ, ভ্যাকসিন প্রয়োগ, বায়োসিকিউরিটি এসব কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। বায়োসিকিউরিটির জন্য খামারকর্মীদের জীবাণুমুক্ত জুতা ও এপ্রোন পরে খামারে ঢোকা, কমবয়সী বাচ্চার বেশি যতœ নেয়া, শেডে জীবাণুনাশক পানি স্প্রে করা, মুরগির বিষ্ঠা ও মৃত মুরগি খামার থেকে দূরে মাটিতে পুঁতে ফেলা, পোলট্রি শেডের ঘরের মেঝে কস্টিক সোডার পানির দ্রবণ দিয়ে ভিজিয়ে পরিষ্কার করা। আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রি ফিডগুলো অনেক সময়ই জমাট বেঁধে যায়। সেজন্য পোলট্রি ফিডগুলো মাঝে মাঝে রোদ দিতে হবে।
বর্ষাকালে হাঁস মুরগিতে আফলাটক্সিন এর প্রকোপ বাড়ে। এতে হাঁস মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্য সূর্যমুখীর খৈল, সয়াবিন মিল, মেইজ গ্লুটেন মিল, সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া এসব ব্যবহার করা ভালো। গবাদিপশুকে পানি খাওয়ানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ দূষিত পানি খাওয়ালে নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
ক্ষুরা, বাদলা, তড়কা, গলাফুলা রোগের প্রতিষেধক দিতে হবে। গোখাদ্যের জন্য রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে বা পতিত জায়গায় ডালজাতীয় শস্যের আবাদ করতে হবে। গরু, মহিষ ও ছাগল ভেড়াকে যতটা সম্ভব উঁচু জায়গায় রাখতে হবে।
গর্ভবর্তী গাভী ও বাছুরের বিশেষ যতœ নিতে হবে। বাছুরের পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এজন্য নিয়মিত দুধ ও মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি খাওয়াতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
চারা পুকুরের মাছ ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার পরিমাণ বড় হলে মজুদ পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে গত বছর মজুদ পুকুরে ছাড়া মাছ বিক্রি করে দিতে হবে।
পানি বৃদ্ধির কারণে পুকুর থেকে মাছ যাতে বেরিয়ে না যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য পুকুরের পাড় বেঁধে উঁচু করে দিতে হবে অথবা জাল দিয়ে মাছ আটকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
পানি বেড়ে গেলে মাছের খাদ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় পুকুরে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাস আমাদের কৃষির জন্য হুমকির মাস। এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমাদের সবার সম্মিলিত, আন্তরিক ও কার্যকরী সতর্কতা এবং যথোপযুক্ত কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। কৃষিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আধুনিক কৃষি কৌশল যেমন অবলম্বন করতে হবে তেমনি সব কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। আর কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
বারো মাস ফল উৎপাদন

যদি ভালো থাকতে চাই রোজ আমাদের প্রত্যেকের অন্তত একটি ফল খেতে হবে। সেটা কলা হোক আর আমই হোক। আমাদের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য যেসব অনুখাদ্য উপাদান বিশেষ করে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের দরকার হয় তার একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস হলো ফল অথবা শাকসবজি। একেক ফলে রয়েছে একেক উপাদান।  সেজন্য বিদেশিরা কখন একটি মাত্র ফল খায় না, একাধিক ফল টুকরো করে কেটে একবারে মিশিয়ে তা খায়। হিন্দুধর্মে দেব-দেবীর পূজার অর্ঘ্য হিসেবে পঞ্চ ফল নিবেদন করেন। এর অর্থ দেব-দেবীরাও পাঁচ রকম ফল পেলে তুষ্ট থাকেন। একেক দেবতার আবার একেক ফলে বিশেষ তুষ্টি আসে। যেমন বেল ছাড়া শিব পূজা চলে না, মঙ্গল ঘটে ডাব ছাড়া কোনো পূজাই হয় না। ডাব তথা নারিকেল হলো জীবন রক্ষাকারী ফল। কেননা, ডাবের পানিতে যথেষ্ট সোডিয়াম রয়েছে যা আমাদের সংবেদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ঘাটতি হলেই সাড়া ঠিকমতো মস্তিষ্কে পৌঁছায় না, আমরা কোনো কিছুতে ঠিকমতো সাড়া দিতে পারি না, ভুলে যাই, অবসতা চলে আসে, এমনকি মানুষ কোমায় পর্যন্ত চলে যায়। যেটাকে অনেক সময় স্ট্রোক বলে ভুল করি। কাজেই দেহকে সচল ও সবল রাখতে হলে প্রতিদিন ফল খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, বারো মাসের ৩৬৫ দিনের রোজ যে ফল খাব, পাব কোথায়? রোজ রোজ কি ফলই বা খাব? বাজার থেকে যেসব ফল কিনে খাচ্ছি, সেসব ফল দেহের জন্য কতটা নিরাপদ? তাহলে করবটা কি?
রোজ ফল খাবো কেন?
দেহ সুস্থ-সবল রাখতে যেসব পুষ্টি উপাদানের দরকার তার প্রায় সবই ফলে আছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের আধার হলো ফল। ফল পটাশিয়ামের একটি উত্তম উৎস যা সচরাচর অন্য খাদ্যে কম পাওয়া যায়। পটাশিয়াম কিডনিতে পাথর হওয়া ও হাঁড় ক্ষয় কমায়। ফলের ফলিক এসিড রক্তকণা গঠনে সাহায্য করে। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষায় ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে ফল অদ্বিতীয়। তাদের দেহের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ফলেট বা ফলিক এসিড দরকার হয়। প্রতিদিন ফল খেলে স্ট্রোক, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। কিছু কিছু ফল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
রোজ কতটুকু ফল খেতে হবে?
রোজ অন্তত একটা হলেও ফল খেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এটা একদম সত্যি কথা। চিকিৎসকরা রোজ একজন ব্যক্তিকে তার দেহের ওজন অনুসারে প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য দিনে ০.৮ গ্রাম ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পুষ্টিবিদদের মতে, রোজ একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের কমপক্ষে ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। তার মানে পাঁচজনের একটি পরিবারে রোজ ১ কেজি ফল লাগবে। এ পরিমাণ কলা, পেঁপে, কুল, আম ইত্যাদি ফল পাওয়া সম্ভব। দেশীয় ফলের মতো পুষ্টিকর ও সস্তা ফল আর হয় না। কিন্তু রোজ ২০০ গ্রাম ফল যে খাবো তা জোগাবে কে? এ দেশে বর্তমান ফলের যে উৎপাদন তা আমাদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। তাই বিদেশ থেকে আঙুর, আপেল, কমলা, নাশপাতির মতো অনেক ফলে এখন দেশের বাজার ভরে গেছে। বেশি দাম দিয়ে কেনা সেসব ফল থেকে কিন্তু আমরা খুব কম পুষ্টিই পাই। আর সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এসব ফল আমরা যখন বাজার থেকে কিনি তা কখনই টাটকা থাকে না, অনেক দিন আগে গাছ থেকে পেড়ে নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দেশের বাজারে আসে। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর থেকেই পুষ্টি কমতে থাকে, পুষ্টি উপাদানের পরিবর্তন হতে থাকে। তাছাড়া বেশির ভাগ ফলই বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয় যাতে ফল না পচে। এজন্য এসব ফল দেহের জন্য ততটা নিরাপদ ও পুষ্টিকর নয়।
অতীতে একটা কথা চালু ছিল, ‘যদি বাঁচতে চাও, যত পার সবজি আর ফল খাও’। কিন্তু এই যত পার মানে কি? পর্যাপ্ত ফল বলতে কি রোজ দশটা আম, কুড়িটা কুল না পাঁচ ঝুড়ি ফল খাবো? এ পরিমাণের কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না। রোজ কে কতটুকু ফল খাবে তা আসলে লিঙ্গ, বয়স, কাজের ধরন ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যারা দৈহিক পরিশ্রম কম করেন, তাদের জন্য ফল খাওয়ার পরিমাণ হবে এক রকম, যারা বেশি করেন তাদের জন্য ফল খাওয়ার পরিমাণ হবে আর এক রকম।
রোজ রোজ ফল পাবো কোথায়?
রোজ ফল খেতে হবে ভালো কথা। কিন্তু তা পাবো কোথায়? সহজ উত্তর হলো, বাজার থেকে কিনে খাবো। বাজারে প্রায় সব সময় বিদেশি ফল পাওয়া যায়, কিন্তু দেশি ফল পাওয়া যায় না। কেননা, যেসব ফল এ দেশে উৎপন্ন হয় তার উৎপাদনও সারা বছর ধরে সুষমভাবে বণ্টিত নয়। এ দেশে যত ফল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর, এ ৪ মাসের মধ্যে। অর্থাৎ গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল হলো এ দেশে ফলের রাজমৌসুম। তাহলে বাকি ৮ মাস আমাদের চলবে কি করে? এজন্য পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য হলেও প্রতিটি বসতবাড়িতে এমনভাবে পরিকল্পনা করে ফলগাছ লাগতে হবে, যা থেকে আমরা সারা বছর, মাসের ৩০টা দিন ফল পেতে পারি। পারলে গোটা পাড়া বা গ্রামকে এ পরিকল্পনার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। এতে সুবিধা হবে, পাড়া বা গ্রামের কোনো না কোনো বাড়িতে রোজ কিছু না কিছু ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যেসব বাড়ির ফলবাগান থেকে যেদিন কোনো ফল পাওয়া যাবে না তারা ও সব বাড়ি থেকে সংগৃহীত ফল পাড়া বা গ্রামের নিজেরা কিনে খেতে পারবে। এতে প্রতিটি বাড়িতে রোজ ফল খাওয়ার অভ্যেস গড়ে উঠবে, নিরাপদ ফল পাওয়া সম্ভব হবে ও উৎপাদিত ফল বিক্রি কোনো সমস্যা হবে না।
বারো মাসের ফল
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রায় ১৩০ প্রজাতির ফল জন্মে এ দেশে। এর মধ্যে ৬০টি হলো বুনো ফল, বনে জন্মে। প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ ফল উৎপাদিত হয় গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে। ফলের প্রধান উৎপাদন মাস হলো জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাস। বেশি উৎপাদনের কারণে একদিকে ফলের প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। মানুষ কম দামে বেশি ফল কিনতে পারে। এজন্য খুশি থাকে। কিন্তু উৎপাদনকারী চাষিদের মনে সুখ কম থাকে কম দামের কারণে। এ দুই মাস বেশি ফল খেতে পারলেও বাকি দশ মাসে ফল কমে যায়। শীতকালে কমলা আর কুল ছাড়া অন্য ফল পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। অবশ্য কলা ও পেঁপে বারো মাসই উৎপাদিত হচ্ছে। এমনকি গবেষণার সুবাদে এখনে বছরে সাত মাস আম পাওয়া যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি তথা হরমোন ব্যবস্থা করে বারো মাস এখন আনারস উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। প্রধান উৎপাদন মৌসুমের বাইরে অন্যান্য মৌসুমে বা মাসে ফল উৎপাদন করতে পারলে তা ফলের বাড়তি উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষকদের অধিক লাভবান করতে পারে। বারো মাস থাই পেয়ারা উৎপাদন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এজন্য ফল চাষি ও বাড়ির গৃহস্থদের একটু পরিকল্পনা করে ফল চাষ শুরু করতে হবে যাতে বারো মাসই সেখান থেকে কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। একই ফলের বিভিন্ন জাত লাগিয়েও কয়েক মাস ধরে ফল পাওয়া যায়। যেমনÑ পরিকল্পনা করে বিভিন্ন জাতের আম লাগিয়ে বছরের প্রায় সাত মাস ধরে আম পাওয়া যায়। কোন মাসে কোন ফল উৎপাদন করা সম্ভব তা তালিকা-১ এ উল্লেখ করা হলো।
বারো মাসের বারোটি ফলের গাছ নির্বাচন
বসতবাড়ির আঙিনায় থাকুক অন্তত বারো মাসের বারোটি ফলের গাছ। এজন্য প্রথমে পরিকল্পনা করতে হবে। তালিকা ১ থেকে বেছে নিতে হবে পছন্দের ফলের গাছ। বাড়িতে যেসব ফলের গাছ আছে সেগুলোর একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। ওপরের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে বাড়িতে থাকা সেসব ফলের গাছ থেকে কোন কোন মাসে ফল পাওয়া যায়।  যেসব মাসে বাড়ির বাগান থেকে কোনো ফল পাওয়া যায় না সেসব মাসে ফলের প্রাপ্যতা ও পছন্দ অনুসারে ফলগাছ বেছে নিতে হবে। ফলগাছ নির্বাচনের সময় অবশ্যই কৃষি জলবায়ু অর্থাৎ বাড়ির অঞ্চলে কোন কোন ফলের গাছ ভালো হয়, সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। যেমন- উপকূলীয় অঞ্চলে ভালো হয় নারিকেল, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, সফেদা, চালতা, কদবেল, অরবরই, আমড়া, চুকুর, ক্ষুদিজাম, তরমুজ, আমরুল, বিলাতি গাব, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, কেওড়া, গোলফল, তাল, পানিফল, বৈঁচি, তেঁতুল ইত্যাদি। উত্তরাঞ্চলে ভালো হয় আম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, আলুবোখারা, পিচফল ইত্যাদি। মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ভালো হয় আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, কলা, বেল, আনারস, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, খেজুর, ডেউয়া, চালতা, জলপাই, পানিফল, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি। পূর্বাঞ্চলে ভালো হয় আনারস, লেবু, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, ডেফল, তৈকর, ডেউয়া, কুল, কামরাঙা, অরবরই, বিলিম্বি ইত্যাদি। পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো হয় আনারস, কাঁঠাল, মাল্টা, আ¤্রপালি ও রাঙ্গোয়াই আম, বিলিম্বি, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, লুকলুকি, গুটগুইট্টা, চুকুর বা আমিলা, চিনার, মারফা, বেল, মাল্টা, কমলালেবু, লেবু, তেঁতুল ইত্যাদি। এসব ফলের মধ্য থেকে সাধারণভাবে বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য মাল্টা (জানুয়ারি), কুল (ফেব্রুয়ারি), বেল (মার্চ), তরমুজ (এপ্রিল), জাম (মে), আম, লিচু (জুন), কাঁঠাল (জুলাই), পেয়ারা (আগস্ট), আমড়া (সেপ্টেম্বর), জলপাই (অক্টোবর), ডালিম (নভেম্বর), কমলালেবু (ডিসেম্বর) নির্বাচন করা যেতে পারে। বছরের যে কোনো সময় ফল পাওয়ার জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে নারিকেল, পেঁপে, কলা, আনারস, সফেদা ইত্যাদি ফল। এখন পেয়ারাও বারোমাস ধরছে। জাত বুঝে গাছ লাগাতে পারলে আমও ৭ মাস ধরে পাওয়া সম্ভব।
বারো মাস ফলের উৎপাদন কৌশল
পরিকল্পনা করে ফলগাছ অবশ্যই লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে আধুনিক চাষাবাদের সব নিয়ম মানতে হবে। বসতবাড়িতে নিরাপদ ফল উৎপাদনের সব প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। এর মধ্যে জৈব সার ব্যবহার, সুপারিশকৃত মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, বালাইনাশক ও পাকানোর জন্য কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করা ইত্যাদি অন্যতম। তালিকা ২-এ সংক্ষেপে বারো মাসে বারোটি ফলের উৎপাদন কলাকৌশল দেয়া হলো।
তালিকা-২ : বারো মাসের প্রধান ১৫টি ফলের উৎপাদন প্রযুক্তি
বড় আকৃতিবিশিষ্ট গাছের (আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি)  জন্য সবদিকে ১ মিটার মাপের গর্ত তৈরি করতে হবে। মধ্যম আকৃতির গাছের (কুল, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি) জন্য সবদিকে ৬০-৭৫ সেন্টিমিটার মাপের গর্ত করতে হবে। ছোট গাছের জন্য (কলা, পেঁপে, ডালিম ইত্যাদি) সবদিকে ৫০ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত করতে হবে।
চারা বা কলম লাগানোর কমপক্ষে ১৫ দিন আগে গর্ত করতে হবে। গর্তের মাটির সঙ্গে পরিমাণমতো গোবর সার ও অন্যান্য সার মিশিয়ে গর্ত ভরতে হবে। গর্তের মাঝখানে চারা কলম লাগিয়ে গোড়ার মাটি ভালো করে চেপে দিতে হবে। কাঠি পুঁতে ও ঘেরা দিয়ে চারা রক্ষা করতে হবে। লাগানোর পর সেচ দিতে হবে। নিচের ছকে উল্লেখিত পরিমাণে সার দিতে হবে। বছরে দুইবার সার দিতে হবে- বর্ষার আগে একবার ও বর্ষাকালের পরে আর একবার সার দিতে হবে। প্রতি বছর গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ঠিকমতো ডালপালা ছাঁটাই ও বালাই ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

মৃত্যুঞ্জয় রায়*
*উপ-প্রকল্প পরিচালক, সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্ট, ডিএই, খামারবাড়ি, ঢাকা

 

বিস্তারিত
প্রশ্নোত্তর ১৪২৩

মো. আব্দুল ওহাব
চর যাদবপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা

প্রশ্ন : বাড়িতে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, কিন্তু কাঁঠাল পাকার আগে ফেটে যায় এবং কোষগুলোর গোড়ার দিকে শলার মতো, রস কম। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : কাঁঠাল গাছটিতে ইউরিয়া ও ফসফেট সার প্রয়োগ বন্ধ রাখুন। এর পরিবর্তে প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে ৩০ কেজি হারে জৈবসার, ২৫০ গ্রাম হারে এমপি সার, ২০ গ্রাম হারে জিংক সালফেট (মনো) সার এবং ৪০ গ্রাম হারে বরিক এসিড সার প্রয়োগ করুন।
মো. রুহুল আমিন
পূর্ব সুখাতি, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম

প্রশ্ন : কাঠের গাছে সার প্রয়োগ নিয়মাবলি জানতে চাই।
উত্তর : কাঠের গাছে সার প্রয়োগ নির্ভর করে মাটির প্রকৃতি বা গঠন, গাছের প্রজাতি ও বয়সের ওপর। জৈবসার গাছের গোড়ার চারদিকে ছিটিয়ে হালকা করে কুপিয়ে মিশিয়ে দিতে হয়। আধা পচা কম্পোস্ট গাছের গোড়ায় মালচ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। অন্যান্য সার মাটির ওপর ছিটিয়ে দিয়ে হালকা করে কুপিয়ে দিতে হয়। বাড়ন্ত গাছের বেলায় গাছের গোড়া থেকে ৫০ থেকে ১৫০ সেমি. দূরে ১৫ সেমি. গভীর করে মাটি খুঁড়ে সার প্রয়োগ করে আবার তা ভরাট করে দিতে হয়। সাধারণভাবে প্রতিটি মেহগনি গাছে গোবর বা কম্পোস্ট সার ১৫ থেকে ২০ কেজি, ইউরিয়া ১৫০ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি বা পটাশ ১০০ গ্রাম এবং ছাট ৫০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি বছর গাছের বৃদ্ধির ধরন অনুযায়ী ২৫ থেকে ৫০ গ্রাম হারে রাসায়নিক সারের পরিমাণ বাড়াতে হয়। এরপর  হালকা সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে গাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈবসার বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা হলে রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে না। বছরে দুইবার কাঠের গাছে সার দিতে পারলে ভালো হয়।                                        
রুবেল আকন
বাবুগঞ্জ, বরিশাল

প্রশ্ন : লতাজাতীয় গাছে ফলন্ত অবস্থায় কোন সার, কী পরিমাণে এবং কীভাবে দিতে হয় জানালে উপকৃত হব।
উত্তর : লতাজাতীয় গাছ মাটিতে থাকলে ১৫ দিন বয়সে গাছের গোড়া থেকে ১ হাত দূর দিয়ে ৪ ইঞ্চি গভীর বৃত্তাকার নালা করে ২০ গ্রাম ডিএপি এবং ৫ গ্রাম এমওপি সার দেয়া যাবে। গাছের বয়স ৬০ দিন হলে ১৫ দিন পর পর ৫ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছ টবে থাকলে গাছের গোড়ায় কোনো রাসায়নিক সার দেয়া যাবে না এবং গাছের বয়স ১৫ দিন হলে প্রতি লিটার পানিতে ৪ মিলিলিটার হারে ভক্সল সুপার অথবা এক্সেল গোল্ড অথবা বেফোলান অথবা বায়োফার্টি মিশিয়ে ২১ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
আমজাদ হোসেন
নিরালা, খুলনা

প্রশ্ন : আমার পেঁপে গাছের পেঁপের আকারে বিকৃতি দেখা যায়। প্রতিকারের উপায় জানাবেন।
উত্তর : মূলত বোরনের অভাবে স্ত্রী ও উভয়লিঙ্গ গাছের পেঁপের আকারে বিকৃতি দেখা যায়। পেঁপের ফুল লিঙ্গভেদে ছয় প্রকার। যথাযথ লিঙ্গ ধারণ না করলে পরাগায়নের ত্রুটির কারণে পেঁপে ফলধারণে অসুবিধা ও আকারে বিকৃতি দেখা যেতে পারে। যে কারণেই হোক না কেন, ছোট ফলে আকারে বিকৃতি দেখা গেলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলিলিটার হারে লিবরেল বোরন অথবা ২.৫ গ্রাম হারে বোরিক এসিড পাউডার মিশিয়ে ৭ দিন পর পর দুইবার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ১ ফোঁটা লিটোসেন নামক জৈবউজ্জীবক মিশিয়ে ২১ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ছোটন
ঢাকাইপাড়া, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়

প্রশ্ন : সুপারি গাছের ওপরের পাতাগুলো আগে হালকা হলদে ভাব হয় পরে আস্তে আস্তে শুকিয়ে গাছ মারা যায়। কী করণীয়।
উত্তর : এটি সুপারি গাছের কুঁড়ি পচা রোগ। আক্রান্ত গাছকে অধিকাংশ সময় বাঁচানো যায় না। তবে অন্য গাছকে এ রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হলে আক্রান্ত গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং অন্য গাছে কপারযুক্ত ছত্রাকনাশক (কুপ্রাভিট) স্প্রে করতে হবে। কপারজাতীয় ছত্রাকনাশক হিসেবে বোর্দোমিশ্রণ স্প্রে করা যেতে পারে।
আমানত উল্লাহ
বড়বালা, মিঠাপুকুর, রংপুর

প্রশ্ন : আখের মাথা শুকিয়ে যাচ্ছে। কাণ্ডে ছিদ্র এবং ভেতরে হলুদ গুঁড়া গুঁড়া দেখা যায়। কী করণীয়।
উত্তর : আখে মাজরা পোকার আক্রমণে এমন হয়। এজন্য-

  • আক্রান্ত গাছ কেটে ধ্বংস করতে হবে।
  • আলোক ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
  • আক্রমণ বেশি হলে করটাপ ৪জি, ডায়াজিনন বা লেবাসিড ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
  • পরবর্তীতে মুড়ি আখ চাষ না করা এবং জমি চাষ দিয়ে ফেলে রাখতে হবে।

রতন মিয়া
গ্রাম : কাঁঠালী

উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : সিলভার কার্প ও কাতলা মাছের মাথা মোটা এবং লেজ চিকন হয়ে আসে, করণীয় কী?
উত্তর : পুকুরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব হলে এমন হয়। পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য প্রতি সপ্তাহে শতাংশপ্রতি গোবর ৪ কেজি, ইউরিয়া ৫০ গ্রাম এবং টিএসপি ২৫ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিদিন সম্পূরক খাদ্য হিসেবে চালের কুঁড়া, খৈল, ভুসি ভিটামিন ইত্যাদি একত্রে মিশ্রিত করে মাছের ওজনের ৫% হারে সকালে ও বিকালে নির্দিষ্ট হারে পুকুরে দিতে হবে।
উসমান আলী
গ্রাম : নাজিরপুর

উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন :  কোন ধরনের মাছ কোন পুকুরে ছাড়া লাভজনক?
উত্তর : ১০ শতকের বেশি আয়তনের পুকুর কাতলা, সিলভার কার্প, রুই, সরপুঁটি, কমনকার্প, মৃগেল ও গ্রাসকার্প ছাড়া যায়। পুকুর ১০ শতকের কম হলে এবং ৬ থেকে ৭ মাস পানি থাকলে সরপুঁটি সিলভার কার্প ও নাইলোটিকা মাছ ছাড়া লাভজনক। নতুন চাষি হলে কার্পজাতীয় মাছ চাষ করবেন। দ্বিতীয় বছর সে অন্য মাছ চাষ করবেন। পুরাতন অভিজ্ঞ চাষির জন্য মনোসেক্স তেলাপিয়া বা পাঙ্গাশ মাছ চাষ করা বাঞ্ছনীয়।
জাহাঙ্গীর
গ্রাম : ঝুড়ঝুড়ি, থানা : তারাশ
জেলা : সিরাজগঞ্জ

প্রশ্ন : গরুর বদহজমে করণীয় কী?
উত্তর : বদহজম হলে গরু বা গাভী দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা করবে। এক্ষেত্রে ১০০ কেজি ওজনের জন্য কসভেট ২টি ট্যাবলেট একত্রে একবার করে তিন দিন এবং জাইমোভেট সকালে ও প্যাগেট বিকেলে ২০ গ্রাম করে ৩ দিন খাওয়াতে হবে।
শামীম
গ্রাম : সকদিরামপুর, উপজেলা : ফরিদগঞ্জ
জেলা : চাঁদপুর

প্রশ্ন : গরুর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট। কী করলে এ কষ্ট লাঘব হবে?
উত্তর :
Inj. Penicilin ৪০ লাখ রোজ ১ বার ৪ থেকে ৫ দিন মাংসে পুশ করতে হবে।
-
Inj. Histavet ৫ মিলি করে রোজ ১ বার ৪ থেকে ৫ দিন মাংসে পুশ করতে হবে।
রবিউল
গ্রাম : তারাকান্দা, উপজেলা : মুক্তাগাছা
জেলা : ময়মনসিংহ

প্রশ্ন : গরুর ডায়রিয়া। ব্যবস্থাপত্র দিলে খুশি হবো।
উত্তর : ট্যাবলেট সালফা প্লাস ৪০ কেজি ওজনের জন্য ১টি, দ্বিতীয় ডোজ প্রথম ডোজের অর্ধেক দিনে ৩ বার, যতক্ষণ নিয়ন্ত্রণ না হয়।
- ভ্যাটেরিনারী স্যালাইন দিনে ১টা ৩ দিন খাওয়াতে হবে।

কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
* সহকারী তথ্য অফিসার (শ.উ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
অর্থ পুষ্টি স্বাস্থ্য চান দেশি ফল বেশি খান

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, ‘দেশকে উন্নত করতে হলে নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে’। আমরা জানি সুস্বাস্থ্যের জন্য, দেহকে সুস্থ-সবল রাখতে ফলের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক মোট খাদ্যশক্তি চাহিদা ২৪৩০ কিলোক্যালরি। এর মধ্যে কমপক্ষে ২.৫% ফল থেকে আসা উচিত। কিন্তু আমরা গড়ে ফল থেকে পাচ্ছি মাত্র ১%।
বাংলাদেশে পেটে ক্ষুধা নিয়ে এখন আর কোনো মানুষ রাতে ঘুমাতে যায় না। বর্তমান সরকারের সময়োচিত সঠিক পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে দানাজাতীয় খাদ্যে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে, দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। এভাবে সব ধরনের ভিটামিনেরই ঘাটতি চিত্র ফুটে উঠেছে। এর ফলে এখনও পাঁচ বছর বয়সের নিচের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৩ জন, নিম্ন ওজনসম্পন্ন শিশুর হার ৩৬.৪ শতাংশ এবং মাতৃ মৃত্যুর হার শতকরা ১.৯৪ শতাংশ। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। খর্বকায় শিশুর হার ৩৬% এবং কৃশকায় শিশুর হারও ১৪%। ধারাবাহিকভাবে তীব্র অপুষ্টির শিকার হলে বয়সের তুলনায় শিশুরা খর্বকায় হয়। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা নয়। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে বিভিন্ন রকম শাকসবজি ও ফলমূলের সরবরাহ আছে। যা দ্বারা সব ধরনের পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব। এসব ফসলের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সক্ষমতাও আছে উৎপাদন বাড়ানোর। তাইতো  প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে উল্লিখিত পুষ্টিহীনতার কারণ কি? মূল সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা হলো আমাদের খাদ্য গ্রহণ অভ্যাসের। আমাদের পুষ্টি সচেতনতার অভাব। শুধু ভাত আর একটু তরিতরকারি হলেই আমরা খুশি। এই মানসিকতার জন্যই আমরা আজ পুষ্টিহীনতার শিকার, অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের কারণে আমরা স্থূলকায় ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি। এ অভিমত চিকিৎসকদের। দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস রোগী এখন শতকরা ৭.৯ ভাগ এবং স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা শতকরা ৩৯ ভাগ। এ দুরাবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ক্যালরি হিসাব করে খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা অনেকেই জানি না যে, আমাদের কত ক্যালরি খাবার খেতে হবে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বাংলাদেশের একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন ২৪৩০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ২০০০ কিলোক্যালরি। তবে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসে ১৫০ এবং পরের ৩ মাসে আরও ৩০০ কিলোক্যালরি করে খাবার বৃদ্ধি করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হবে।
আমরা অনেকেই জানি না যে, একটা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের সময় হলো ৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এই সময়ে যদি শিশুদের সঠিক পরিমাণে সুষম খাবার না দেয়া হয় তবে তাদের পুষ্টি ঘাটতির ফলে কম মেধা নিয়ে তারা বেড়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে আমাদের পরিবার বা জাতীয় পর্যায়ে তার অবদান রাখার ক্ষমতা কমে যায় এবং এ ঘাটতি আজও আমরা বয়ে চলেছি। এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায় হলো জাতিকে পুষ্টি শিক্ষাসহ সুশিক্ষিত করা। এ কাজটি কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীরাই করতে পারি। কারণ আমরাই সব ধরনের খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এবং এ খাতে নিয়োজিত শ্রম শক্তি এখনও ৪৫.১%। এ ৪৫% জনশক্তি, গ্রামীণ মহিলা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের যদি সঠিকভাবে পুষ্টি শিক্ষা দেয়া যায় তবে আমাদের দেশের জনগণের পুষ্টিহীনতা দূর হতে বেশি সময় লাগবে না। যে তিন শ্রেণীর মানুষের কথা বলা হলো এরা সবাই কিন্তু আমাদের সীমার মধ্যেই থাকে। সবার পক্ষে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকতা করা সম্ভব না। কিন্তু স্কুল প্রাঙ্গণে শাকসবজি, ফল চাষের যে কোনো মডেলের একটা প্রদর্শনী দিয়ে শিক্ষক ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পুষ্টি শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। উপজেলায় যে প্রশিক্ষণগুলো হয় সেগুলোর স্থান ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায়।
উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকার এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বারটান) কার্যক্রমে ব্যাপক বিস্তৃতি সাধন ও গতি সঞ্চারের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি ও পুষ্টি সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলার এক মহতী কর্মকা- হাতে নিয়েছে।
এছাড়াও ডিএই’র মাধ্যমে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য-
১.    ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প;
২.    দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্প;
৩.    ইন্টগ্রেটেড এ এগ্রিকালচার প্রডাক্টিভিটি প্রকল্প;
৪.    পূর্বাঞ্চলীয় সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প;
৫.    সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প;
৬.    সমন্বিত কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্প;
৭.     সিলেট অঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প;
৮.     মুজিবনগর সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প;
৯.    ‘পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলায় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে আধুনিক কলাকৌশল হস্তান্তর’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
অধিকন্তু ‘সমম্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা’ (আইপিএম) কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে ফল উপাদনে জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
দেশে দারিদ্র্য হার কমতির দিকে এবং এ হার ২০০৫ সালে ছিল ৪০ শতাংশ, সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ ও জনগণের পরিশ্রমে এ হার এখন ২৪.৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। যদি অন্য দিক দিয়ে বলি, তাহলে বলা যায় যে, ৭৫.৫৩ ভাগ মানুষ আর দরিদ্র নেই অর্থাৎ তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মতো ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এখন ৭৫ শতাংশের বেশি।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন করে পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটের প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়। এ খাতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী কিন্তু আমাদের মধ্যেই থাকে। তাদের সঠিক প্রযুক্তি দিয়ে কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা গেলে পুষ্টিমান বাড়ানো সম্ভব হবে। এসব খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকারি পদক্ষেপের কোনো ঘাটতি নেই। পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল চাষ উৎসাহিত করার জন্য কৃষি ঋণ বিতরণের গত বছর লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে, যেখানে আমাদের আরও বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত থেকে ঋণ বিতরণ ও তার সঠিক ব্যবহার উৎসাহিত করার সুযোগ ছিল। এখানে আমাদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার প্রদত্ত ৯০০০ কোটি টাকার ভর্তুকির উপকরণ যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয় তার নিশ্চয়তার জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে কৃষিভিত্তিক কাঁচামালের সরবরাহও বাড়বে। প্রক্রিয়াজাত পণ্য সহজলভ্য হলে বিদেশি পানীয়সহ অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতপণ্য আমদানি কমবে, ব্যবহার কমবে এবং গুণগতমানসম্পন্ন দেশীয় পণ্যের সহজলভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তার পরিমাণও বাড়বে, যা পুষ্টিহীনতা দূর করতে সহায়তা করবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এর ২ ও ৩ নং ক্রমিকে ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জন ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা চালু এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সের সবার কল্যাণে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংকল্পবদ্ধ। এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী  সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে প্রতিদিন সুষম খাবার খেতে হবে। আমাদের দেশে সব মৌসুমে কোনো না কোনো ফলের উৎপাদন হয়ই। এসব ফল পুষ্টিসমৃদ্ধ। বিদেশি ফলের চেয়ে এসব দেশি ফলের দামও কম। সরকার এরই মধ্যে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বছরব্যাপী দেশি ফলের জোগান নিশ্চিত করা। প্রতিটি বসতবাড়ি এবং বাড়ির  ছাদে দেশি ফলের ভাণ্ডার গড়ে তোলা এবং জনগণের মধ্যে নিয়মিত এবং পরিমাণমতো দেশি ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করা। এসব ফল চাষ করে একদিকে যেমন দেশে বসবাসকারী জনসাধারণের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা যায়, আবার বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়। দেশি ফলের মধ্যে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কাগজিলেবু বাড়ির আঙিনায় চাষ করা যায় এবং সারা বছর ফল পাওয়া যায়। আম, আনারস, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, জাম, জামরুল, সফেদা, আমড়া, কামরাঙা, বাতাবিলেবু, বেল, কদবেল, আমলকী, তাল, খেজুর, চালতা, ডেউয়া, কাউফল, গাব, বেতফল প্রভৃতি ফল এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। পুষ্টি ঘাটতি পূরণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় দুটির জন্যই মানসম্পন্ন ফল উৎপাদন করতে হবে। অপুষ্ট ফল কোনো অবস্থাতেই আহরণ করে বাজারজাত করা যাবে না। দেশি ফল বেশি করে চাষ করতে হবে। নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে সরকার বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশের চাহিদা মোতাবেক মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনের  জন্য সরকারের দেয়া দায়িত্বগুলো পরিপূর্ণভাবে পালনে সচেষ্ট আছে এবং থাকবে।
পরিসংখ্যানের উৎস
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫, এফএও, HIES (Household Income and Expenditure Survey) ২০১৪, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যমেয়াদি মূল্যায়ন ২০১৫, ইউএনডিপি বাংলাদেশ ২০১৪, জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) প্রকাশিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপ ২০১৪, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১১, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ২০১১, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪।

কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান*
*মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

বিস্তারিত
বাংলাদেশে ফল উন্নয়ন গবেষণা

আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, এ দেশের জলবায়ুতে ফলছে নানা রকম ফল ফলাদি। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়, ক্ষেতের আইলে, নদ-নদী, খাল-বিলের পাড়ে পতিত জমিতে সর্বত্রই রয়েছে নানা রকম ফল গাছ। তাছাড়া পরিকল্পিতভাবে এখন মানুষ গড়ে তুলছে নানা রকম ফলের বাগান। এখন আর কেবল শখের বিষয় নয় ফলের আবাদ। রীতিমতো বাণিজ্যিকভিত্তিতে দেশের নানা স্থানে আবাদ করা হচ্ছে নানা রকম ফল বৃক্ষ। বাংলাদেশের প্রধান ফল ফসল হলো আম, কাঁঠাল, কলা, আনারস, লিচু, পেয়ারা, লেবু, কুল ইত্যাদি। সমভূমি এলাকায় এসব ফল ফসলের আবাদ প্রায় সারা দেশেই বিস্তৃত। দেশের পাহাড়ি জেলাগুলোতে আনারস, পেঁপে, লিচু, কলা, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের ভালো বৈচিত্র্য রয়েছে। ইদানীং পার্বত্য জেলায় লিচু, আম, জাম্বুরা, বেল, আমড়া ইত্যাদি ফল আবাদের বিস্তৃতি ঘটছে। যদিও আম, কাঁঠাল ও আনারস দেশের কোনো কোনো এলাকায় অত্যন্ত ভালো জন্মে থাকে বলে এসব ফলের সঙ্গে কোনো কোনো এলাকার নামও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কলা, পেঁপে, আনারস, তরমুজ ও ফুটি অল্প সময়ের মধ্যে এদের ফল আহরণ করা যায় এবং এ দেশে এর ফলনও বেশ আশাব্যঞ্জক। এসবের বাইরে এ দেশে রয়েছে অন্যান্য নানা রকম দেশি-বিদেশি ফলও। এর কোনো কোনোটা প্রচলিত তো কোনো কোনোটা আবার অপ্রচলিত।
ফল নিয়ে এ দেশে গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে কম। এ দেশের নানা অঞ্চলে এখন আবাদ করা হচ্ছে কমছে কম ষাট-সত্তর রকমের ফল ফসল। বড় অনুসন্ধানী এ দেশের কৃষক। বড় বিজ্ঞানমনস্কও তারা। নতুন কিছু দেখলে তা রক্ষা করেন সযতেœ। ফলে বেশ কিছু সংখ্যক ফল ফসলের বৈচিত্র্যময় নানা রকম জাত তারা বাছাই করে নিয়েছেন প্রকৃতির ভা-ার থেকে। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপে ফল তো পরপরাগী স্বভাবের। এর অর্থ হচ্ছে অন্য জাতের ফুলের পরাগরেণু উড়ে এসে নিষেক ঘটায় আরেক জাতের ডিম্বকোষে। এভাবে তৈরি হয় প্রকৃতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব গাছ। বিচিত্র এ উদ্ভিদ সম্ভার থেকে আমাদের কৃষকরা নিজেদের মতো করে বাছাই করে নেন নানা রকম জাত। এভাবেই আম আর কাঁঠালে সৃষ্টি হয়েছে কত কত শত দেশ জুড়ে। এসব শত শত জাত কিন্তু বিজ্ঞানীদের সৃষ্ট জাত নয়। প্রকৃতির আপন নিয়মে এরা উদ্ভাবিত হয়েছে। কৃষকগণ এদের রক্ষা করেছেন, মমতা দিয়ে যতœ করেছেন। এ নিয়েই তৈরি হয়েছে আমাদের ফলের জীববৈচিত্র্য। এদের বৈচিত্র্য আমাদের সত্যিসত্যি অবাক করে। এখনও দিন দিন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন রকমের ফল আর ফলো জাত কোনো কোনো অঞ্চলে।
কৃষকের সংরক্ষিত ফলের বৈচিত্র্যপূর্ণ এসব জাত সংগ্রহ করা হলো এ দেশের ফল বিজ্ঞানীদের প্রধান কাজ। দেশি সব ফলজাত সংগ্রহ করে চলে এদের মূল্যায়ন। অনেক জাতের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সফল একে নতুন নাম দিয়ে নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। বড় আদিম প্রকৃতির ফসল উন্নয়ন কর্মকা- এটি। ফলের যেসব জাত আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদের সংগ্রহ করে উত্তমটিকে সহজে জাত হিসেবে অবমুক্ত করা। যে কৃষক এই জাতটি সংরক্ষণ করছেন যুগ যুগ ধরে তার কোনো স্বীকৃতি কিন্তু দেয়া হয় না।
এটি মন্দ নয় যে, বিজ্ঞানীদের যাচাই-বাছাই কর্মকা- ও উত্তম ফল জাতের চারা সুলভ হওয়ায় অপরিচিত একটি ফল জাত এভাবে সবার কাছে পরিচিতি পাচ্ছে। এর মাধ্যমে ফল জাতগুলো আগ্রহী অন্যান্য কৃষকও আবাদ করতে পারছেন। উত্তম জাতের চারা গাছ তৈরি করে বিক্রি করে দুই পয়সার মুখ দেখছে নার্সারির মালিকরা। যিনি এ কৌলিসম্পদটিকে যতœ করে এতদিন আগলে রেখেছেন সে কৃষক পেলেন না সরাসরি কিছুই। বড় অনৈতিক ঠেকে এ বিষয়টি। এটি নিয়ে আমাদের খানিকটা ভাবা দরকার। কৃষকের নামটি জাত অবমুক্তির সঙ্গে জড়িত করে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে অন্তত একটি কৃতজ্ঞতাপত্র দেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার।
ফল উন্নয়ন কার্যক্রম বড় ঢিলেঢালা আমাদের। মূলত দুটি কারণ রয়েছে এর পেছনে। এক. যারা ফল উন্নয়ন কার্যক্রমের দায়িত্ব পেয়েছে তাদের অনেকেই জীবের বংশগতিবিদ্যা, জীবমিতি আর ফসল উন্নয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ঠিক ওয়াকিবহাল নয়। দুই. ফল উন্নয়ন কর্মকা- একটু দীর্ঘমেয়াদি বলে সে পথে না গিয়ে সহজ ও সরল পথ ধরে জাত অবমুক্তকরণ কাজটাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সারা দেশে মূলত দুটি প্রতিষ্ঠানে চলছে ফল জাত অবমুক্তকরণের কর্মকা-। একটি হলো বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল গবেষণা বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এবং আম গবেষণা কেন্দ্র আর অন্যটি হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের জাত অবমুক্তকরণ কর্মকা-। এখানে একটি পরিসংখ্যান নিয়ে এলে আমাদের ফল ফসল উন্নয়ন গবেষণার বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশে এ যাবত বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য অবমুক্ত করা ফল জাতের সংখ্যা ১৪১টি। এদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জাত ছাড়করণ করেছে মোট ৬৬টি। এর ৫৩টি হলো এ দেশের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ফল জাত, যা কেবল মূল্যায়ন করে জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। এসব জাত প্রাকৃতিক সংকরায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং এসব জাত সংরক্ষণ করছেন মাঠে আমাদের কৃষকগণ। আর ১১টি জাত বিদেশ থেকে প্রবর্তন করে অভিযোজন ও মূল্যায়ন শেষে জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়েছে। তিনটি ফল জাত অবমুক্ত করা হয়েছে প্রকৃত প্রজনন কর্মসূচি থেকে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে গত ৭ বছরে অবমুক্ত করা হয়েছে ৭৫টি ফল জাত। গড়ে প্রতি বছর ১০টির অধিক জাত অবমুক্ত করা হয়েছে এ সেন্টার থেকে। এর মধ্যে ৪০টি জাতই অবমুক্ত করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত জাত মূল্যায়ন করে। এসব ফলের জাতও কৃষকের সংরক্ষিত জাতই। আর ৩৫টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে বিদেশ থেকে বিভিন্ন জাত এদেশে প্রবর্তন ও অভিযোজন করার মাধ্যমে। বিদেশ থেকে প্রবর্তিত এবং অবমুক্ত ফলগুলো হলো রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, আঁশফল, ড্রাগন ফল, জামরুল ফল ইত্যাদি। বিএইউ থেকে অবমুক্ত ২১টি আমজাতের মধ্যে বিদেশ থেকে প্রবর্তিত আম জাত ৮টি। এ কেন্দ্র থেকে ছাড়কৃত ১০টি পেয়ারার মধ্যে ৭টি পেয়ারাই বিদেশ থেকে প্রবর্তিত।
এসব পরিসংখ্যান থেকে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। এক. আমাদের দেশে ফলের বৈচিত্র্য বিশাল। গ্রামগঞ্জে পাহাড়ে পর্বতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রকম স্থানীয় ফল জাত। ফল বিজ্ঞানীগণ মূলত এসব ফলজাত সংগ্রহ করে নতুন নামে দ্রুত জাত অবমুক্তকরণের দিকে অধিক আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। দুই. বিদেশ থেকে ফল বীজ নিয়ে এসে এদেশে যাচাই-বাছাই করে ফল জাত ছাড়করণও তুলনামূলকভাবে বেশ সহজ। শুধু বীজ সংগ্রহ করে আনার দিকে মনোযোগী কোনো বিজ্ঞানীকে এ কাজে নিযুক্ত করলে তা থেকে অনেক জাত পাওয়া সম্ভব। তিন. আমাদের দেশে ফল প্রজননের কাজ শুরু হয়নি সহজে এভাবে জাত অবমুক্ত করা যাচ্ছে বলে। তাছাড়া ফল নিয়ে সংকরায়ন করে জাত সৃষ্টি, পলিপ্লয়েড জাত সৃষ্টি, অ্যানিউপ্লয়েড জাত সৃষ্টি, মিউটেশন করে জাত সৃষ্টির কর্মকা-ই শুরু হয়নি।
বিএআরআই বিজ্ঞানীগণ অবশ্য দুই-তিনটি ফল ফসলের সংকরায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। আমে সংকরায়ন করে ইতোমধ্যে দুই তিনটি হাইব্রিড আম জাত অবমুক্ত করেছে বিএআরআই। স্ট্রবেরির ক্ষেত্রেও সংকরায়ন করে নতুন জাত সৃষ্টির কর্মকা- চলছে। ফসল উন্নয়ন গবেষণায় উদ্ভিদ প্রজননবিদদের অংশগ্রহণ করার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি করা গেলে ফল ফসল উন্নয়ন গবেষণা যে নতুন মাত্রা পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফল উন্নয়ন গবেষণার সঙ্গে জড়িত ফল বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদ প্রজনন সহায়ক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ফল ফসল উন্নয়নের প্রধান বাধা।
হিসাব-নিকাশ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃত অর্থে এ দেশে বহু ফল ফসলের কোনো নিজস্ব প্রজনন কর্মসূচিই শুরু করা হয়নি। আমরা অবশ্য এ দেশের মুখ্য ফল গবেষণার কথাই বলছি। ফল গবেষণার একটি বড় সমস্যা হলো গবেষণার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার বিষয়টি। অনেক গাছেই ফলধারণ একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে সব ফল গাছেই তা এক রকম দীর্ঘ অপেক্ষার বিষয় তা কিন্তু নয়। কলা এক বছরেই কিন্তু ফলন দেয়। কলার খানিক বৈচিত্র্যও আমাদের রয়েছে। অথচ কলার জাত উন্নয়ন কর্মকা- সংগ্রহ আর জাত অবমুক্তকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কলার কোনো সংকরায়ন কর্মসূচি এ দেশে নেয়াই হয়নি। লিচু, আম এসব ফল বৃক্ষ উন্নয়ন কর্মসূচির সুবিধা এই যে, একবার ভালো একটি জাত বাছাই করতে পারলে তা অঙ্গজ উপায়ে বংশবিস্তার করা যায় বলে সহজেই এর গুণাগুণ রক্ষা করা চলে। সংকরায়ন থেকে ফল ধারণ পর্যন্ত এদের সময় কয়েক বছর লাগে বটে তবে একবার একটি ভালো জাত পেয়ে গেলে আর বিশুদ্ধ লাইন পাওয়ার জন্য মাঠ ফসলের মতো এদের প্রতি বছর জন্মানোর প্রয়োজন হয় না। ভালো ফল সম্পন্ন একটি গাছ পেলেই যথেষ্ঠ। সে কারণে এসব ফসলে সংকরায়ন কর্মকা- শুরু করা দরকার। কুল গবেষণার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। আমরা আমাদের কোনো কোনো কুল কিন্তু সংকরায়নে ব্যবহারই করতে পারি। পেয়ারার কোনো কোনো জাত আজ বিলুপ্তই হচ্ছে। লৌহজাত খনিজ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ লাল মাংসল পেয়ারা আজ খুঁজে পাওয়াই ভার। এসব জিন সম্পদ হারিয়ে গেলে আগামী দিনে অবশ্যই ব্যাহত হবে ফল উন্নয়ন গবেষণা। সে কারণে বহুবর্ষজীবী ফলের জাতগুলো দেশের নির্দিষ্ট কতগুলো স্থানে মাঠ পর্যায়ে সংরক্ষণ করার কথা এখন ভাবা অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বহুবর্ষজীবী ফলের কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ একটি অতি জরুরি বিষয়। বিএআরআই দেশের দুই-চারটি গবেষণা খামারে এরকম কৌলিসম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যা আরও বিস্তৃত করা সুযোগ রয়েছে।
আমাদের দেশে পেঁপে নিয়ে খানিক গবেষণা পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগে। পেঁপের একটি চমৎকার জাত উদ্ভাবন করেছেন সেখানকার গবেষকরা। পেঁপে নিয়ে নিয়মিত গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ রয়েছে। পেঁপের ভিন্নবাসী এবং স্ত্রী লিঙ্গকে উভয় প্রকার জাত সৃষ্টির জন্য গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব। পেঁপের যেহেতু তিন রকম লিঙ্গরূপ রয়েছে ফলে ব্রিডারদের অংশগ্রহণ ছাড়া এদের বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং নতুন জাত উদ্ভাবন প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফল গবেষণার সঙ্গে ব্রিডার জড়িত নয় বলে এক্ষেত্রে আমরা ভীষণ রকম পিছিয়ে রয়েছি। বাইরে থেকে প্রবর্তিত জাতের ওপরই আমাদের যা কিছু ভরসা।
লেবুজাতীয় ফসলে আমরা কিন্তু বেশ সমৃদ্ধশালী। আর হবে না বা কেন। লেবুজাতীয় বেশ কিছু ফলের উৎপত্তি স্থলইতো বঙ্গ-ভারত। এখানে নানা রকম লেবু যেমন- বড় লেবু, সাধারণ লেবু, কাগজিলেবু, জামির বা জাম্বুরিসহ বাতাবিলেবু ও কমলা ভালোই জন্মে। এর মধ্যে দেশজুড়ে কোনো কোনোটার বৈচিত্র্যও চমৎকার। এমনকি পাহাড়ি এলাকায় কোনো কোনো বিরল সব লেবুর জাত রয়েছে। রয়েছে এমনকি বীজহীন মাঝারি আকৃতির লেবুও। এর জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আমাদের উদ্যোগী হওয়া উচিত।
কাঁঠালের জাত বৈচিত্র্য এ দেশে প্রচুর। আকার আকৃতি, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ও কোষের গুণে মানে এ বৈচিত্র্য তুলনাহীন। এর জীববৈচিত্র্য নিয়ে একটি বিশদ গবেষণা হতেই পারে। এদের নানা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণিভুক্ত করা একান্ত জরুরি। উত্তম জাতগুলো যেন যথাযথ মনোযোগ পায় এবং এদের বংশবৃদ্ধি করার মাধ্যমে মানুষের কাছে সেরা জাতের কাঁঠাল যেন পৌঁছে দেয়া যায় সেরকম প্রকল্প আমাদের থাকতেই পারে। তাছাড়া কাঁঠালের চমৎকার সব কৌলিসম্পদের একটি মাঠ জিন ব্যাংক স্থাপন করা এবং দেশের নানা অঞ্চল থেকে মূল্যবান কৌলিসম্পদ এনে জিন ভা-ার গড়ে তোলাও প্রয়োজন। বছরে দুইবার কাঁঠাল ধরে এরকম জাতগুলোও আমাদের সংগ্রহ করা প্রয়োজন। ভোক্তার কাছে অসময়ের কাঁঠালের একটি বাড়তি আকর্ষণ রয়েছে।
ফল উন্নয়ন গবেষণার পাশাপাশি ফল চাষাবাদ, ফলের বংশবিস্তার, ফলের প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানা বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া নতুন নতুন ফল এ দেশে প্রবর্তন করে এদের উপযোগিতা যাচাই করার কর্মকা- তো চলছেই। চলছে এদের এ দেশে জাত হিসেবে অবমুক্তির কর্মকা-ও। তবে এদের গুণমান ও পাশাপাশি এদের চাহিদার বিষয়টি অবশ্যই সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশি ফলকে উপেক্ষা করে বিদেশি ফলকে অধিক গুরুত্ব দেয়া যৌক্তিক নয় বলেই মনে হয়। দেশে যেসব ফল ফলাদি ভালো জন্মে এবং যাদের পুষ্টিমান উত্তম সেসব ফল গবেষণার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়া আশু প্রয়োজন।

ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*
*প্রফেসর, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং বিভাগ এবং প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭

 

বিস্তারিত
অধিক ফল উৎপাদনে লাগসই তথ্যপ্রযুক্তি

ফলের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের আছে ১৩০টির বেশি ফল। এসব ফল পুষ্টিতে মিষ্টিতে তুষ্টিতে স্বাদে গন্ধে তুলনাহীন। কিন্তু হলে কি হবে আমরা এখনও পরিকল্পিতভাবে ফলের বাগান প্রতিষ্ঠা বা বাগান ব্যবস্থাপনা করি না। এ কারণে কাক্সিক্ষত ফলনও পাই না। এসব ফলের উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে হাজারো সমস্যা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলের কিছু জরুরি ফল তথ্য, প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা জানার জন্য দেয়া হলো।
ফ্রুট ব্যাগিং বা ফল ঢেকে দেয়া : আম ও পেয়ারা ছোট অবস্থাতেই ব্যাগিং করলে রোগ, পোকামাকড়, পাখি, বাদুড়, কাঠবিড়ালি এসব থেকে সহজেই রক্ষা করা যায়। ব্যাগিং করা ফল অপেক্ষাকৃত বড় আকারের এবং আকর্ষণীয় রঙের হয়। ব্যাগিং সাদা কাগজ, বাদামি কাগজ বা ছোট ছিদ্রযুক্ত পলিথিন দিয়ে করা যেতে পারে। ব্যাগিং করলে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে প্রতিহত হয় বলে কোষ বিভাজন বেশি হয় এবং ফল আকারে  বড় হয়। ব্যাগিং করার আগে অবশ্যই প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ০.৫ মিলিলিটার হারে টিল্ট ২৫০ ইসি মিশিয়ে পুরো ফল ভালোভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফ্রুটব্যাগিং আরো অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রেও দারুণ ভালো ফল দিচ্ছে।
শাখা-প্রশাখা বাঁকানো পদ্ধতি : পেঁয়ারার ডাল বাঁকালেই প্রায় দশগুণ বেশি ফলন হয়। তাছাড়া একই প্রযুক্তিতে বছরের বারো মাসই ফল ধরানো সম্ভব হয়। ফলের মৌসুমে গাছের ফুল ছিঁড়ে দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে আরও প্রভাবিত করা যায়, যার ফলে সারা বছরই ফলের মৌসুমের তুলনায় কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি ফল ধরবে। বছরে দুইবার অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে এবং হেমন্তকালে শাখা প্রশাখার নিয়ন্ত্রিত বিন্যাসের মাধ্যমে সারা বছর পেয়ারার ফুল ও ফলধারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গাছের বয়স দেড় থেকে দুই বছর হলেই এ পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং ৫ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো সম্ভব। ডাল বাঁকানোর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে গাছের গোড়ায় সার ও পানি দিতে হয়। ডাল বাঁকানোর সময় প্রতিটি শাখার অগ্রভাগের প্রায় এক থেকে দেড় ফুট অঞ্চলের পাতা ও ফুলফল রেখে বাকি অংশ ছেঁটে দিতে হয়। এরপর ডালগুলোকে সুতা দিয়ে বেঁধে তা বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি করে সঙ্গে অথবা খুঁটির মাধ্যমে মাটিতে বেঁধে দিতে হয়। গ্রীষ্মকালে মাত্র ১০ থেকে ১২ দিন পরেই নতুন ডাল গজানো শুরু হয়। নতুন ডাল ১ সেন্টিমিটার লম্বা হলে বাঁধন খুলে দেয়া হয়। আর হেমন্তকালে নতুন ডাল গজাতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। ডাল বাঁকানোর ৪৫ থেকে ৬০ দিন পরে ফুল ধরা শুরু হয়। এভাবে গজানো প্রায় প্রতি পাতার কোণেই ফুল আসে। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই ফলন পাওয়া যায়।
শিকড় উন্মুক্তকরণ পদ্ধতি : পেয়ারা গাছের গোড়ার মাটি তুলে বা আলগা করে দিতে হবে। মাটি তুলে দিয়ে গাছের শিকড়গুলো বের করে নাড়াচাড়া দিতে হবে। গাছের গোড়া থেকে ০১ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত মাটি কোদাল, শাবল বা নিড়ানি দ্বারা খুব ভালোভাবে সাবধানতার সঙ্গে মাটি তুলে দিতে হবে। মাটি তুলে দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন গাছের শিকড়গুলো কেটে না যায়। বিশেষ করে গাছের আসল মূল কাটা ও উৎপাটন করা যাবে না। গাছ নাড়ানো যাবে না। সাধারণত যে কোনো বয়সের পেয়ারা গাছে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। গোড়ার মাটি খুলে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ দিন পর পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যাকালে পরিমাণমতো সার প্রয়োগ ও সেচ প্রদান ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ পদ্ধতিতে গাছের পাতা লাল হয়ে ঝরে যেতে পারে। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাসে পেয়ারা গাছে শিকড় উন্মুক্ত করতে হয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করলে পেয়ারা গাছে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফল ধারণ করে।
গরম পানিতে আম শোধন ও পাকানো : গরম পানিতে পরিপক্ব কাঁচা আম শোধন করা হলে আমের গায়ের রঙ সুন্দর ও মসৃণ হবে। আমের গায়ে লেগে থাকা রোগজীবাণু ও পোকামুক্ত হবে। ভোক্তাদের নিকট অশোধিত আমের তুলনায় এ শোধিত আমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে, বাজারমূল্য বেশি হবে। মৌসুমে পরিপক্ব পুষ্ট কাঁচা আম গাছ থেকে সাবধানে পেড়ে তা আগে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর কোনো পাত্রে ৫২-৫৫ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি (পানিতে হাত ডুবালে সহনীয়মাত্রায়) গরম হলে তাতে পানিতে পরিষ্কার করা আমগুলো ঠিক ৫ মিনিট রেখে এক সঙ্গে উঠিয়ে নিতে হবে। আমের গা থেকে পানি ঝরা শেষে শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে আমগুলো প্যাকিং করে বাজারজাত করতে হবে। এ ব্যবস্থায় আমের জাতের প্রকারভেদে সাধারণ আমের চেয়ে গরম পানিতে শোধন করা আমের আয়ু ১০ থেকে ১৫ দিন বেড়ে যাবে। এ ব্যবস্থায় আর রাসায়নিক ব্যবহার প্রয়োজন হবে না, জনসাধারণ বিশুদ্ধ আমের স্বাদ পাবে। দূর-দূরান্তে দেশ-বিদেশে এভাবে গরম পানিতে শোধিত আম বাজারজাত করা যাবে, স্বাদ আর মান সঠিক রেখে আম থেকে বেশি মুনাফা হবে।
আনারসে হরমোন ব্যবহার : সম্ভাবনাময় ফল আনারসের কথা চিন্তা করে আমাদের উদ্যান বিজ্ঞানীরা হরমোন প্রয়োগে সারা বছর আনারস উৎপাদনের কৌশল সাফল্যজনকভাবে আবিষ্কার করছেন। এ পদ্ধতি অনুসরণে এ দেশের মানুষ সারা বছরই আনারসের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। অর্থাৎ বলা যায় আনারসও বারোমাসি ফলের গর্বিত স্থান দখল করতে পারবে। আনারস উৎপাদনে প্রধান সমস্যার মধ্যে রয়েছে গাছে ফুল আসতে ১৫ থেকে ১৬ মাস এবং আনারস পাকতে ২১ থেকে ২২ মাস সময় লেগে যায়। এতে ফলের জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা জমিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বিশ্বে আনারস উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশ যেমন- মালয়েশিয়া, হাওয়াই, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভারত, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশ বহুকাল আগে থেকেই হরমোন প্রয়োগ করে আনারসের উৎপাদন করা হচ্ছে। হরমোন প্রয়োগে আনারস উৎপাদনের সুবিধার কথা জেনে আনারস চাষি উৎসাহিত হবেন এবং জাতীয় সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবেন। হরমোন প্রয়োগের কারণে কম সময়ে আনারস পাওয়া; এক সঙ্গে বা কাক্সিক্ষত সময়ে আনারস পাওয়া যায়; ইচ্ছে অনুযায়ী বছরের যে কোনো সময়ে অনায়াসে আনারস পাকানো যায়; অমৌসুমে আনারস বিক্রি করে দ্বিগুণ, তিনগুণ বহুগুণ দাম পাওয়া যায়; কম খরচে বেশি লাভ করা যায়Ñ হরমোন প্রয়োগে আনারস প্রতি খরচ মাত্র ২০ পয়সা থেকে ২৫ পয়সা আর আনারস প্রতি বাড়তি লাভ ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা; সারা বছর ফলানো যাবে বলে উৎপাদনের এবং সরবরাহের বছরব্যাপী নিশ্চয়তা পাওয়া যায় আর সে কারণে দেশে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে; পচনশীলতার কারণে পচে যায় না, বর্ষা মৌসুমে পরিবহন, স্তূপিকীকরণ সমস্যাজনিত অপচয় মোটেই হবে না; বাগানে অতিরিক্ত উৎপাদন সম্ভব হবে। কেননা, হরমোন প্রয়োগে ৮০ থেকে ৯০% গাছে ফল ধারণ করে হরমোন ব্যতিরেকে গড়ে ৫০ থেকে ৬০% গাছে ফল ধরে।
হরমোন গাছ থেকে উৎপাদিত একপ্রকার রাসায়নিক দ্রব্য। আনারসের ক্ষেত্রে সাধারণত ১. ইথ্রেল ২. ন্যাপথলিন এসিটিক এসিড, ফুল আনতে সাহায্য করে। ইথ্রেল ৫০০ পিপিএম দ্রবণ তৈরির জন্য প্রতি লিটার পরিষ্কার পানিতে ১.৩ মিলিলিটার তরল ইথ্রেল (৩৯% ইথাফন) মিশিয়ে নিতে হবে। হরমোন দ্রবণ প্রতিদিন ভোরবেলায় (সকাল ৬-৮টা) ৯ থেকে ১৩ মাস বয়সের (৩০ থেকে ৪০ পাতাবিশিষ্ট) প্রতি গাছে ৫০ মিলিলিটার হরমোন দ্রবণ গাছের ডগায় ঢেলে দিতে হবে। হিসাব করে দেখা গেছে ১ লিটার হরমোন দ্রবণ দিয়ে ২০টি গাছে প্রয়োগ করা যায়। বৃষ্টি বাদলার দিনে হরমোন প্রয়োগ করলে কার্যকারিতা থাকে না বা কম হয়। প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন বৃষ্টি না হয় এ চিন্তা মাথায় রেখে দ্রবণ প্রয়োগ করতে হবে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিডিউল করে হরমোন প্রয়োগ করলে কাক্সিক্ষত সময়ে অর্থাৎ অমৌসুমে আনারস পাওয়া যায়। হরমোন মানুষের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই। কিন্তু ব্যবহারকালীন সাবধানতা অবলম্বন বেশি জরুরি। ব্যবহারকালে শরীরে, কাপড়ে যেন না লাগে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। লাগলে নষ্ট হয়ে যাবে। প্রতিকার হিসেবে তাৎক্ষণিক বেশি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। দ্রবণ তৈরি এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পানিজনিত বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। একটু সাবধান হলে কোনো সমস্যা থাকে না। আনারস উপাদেয় ফল। আমাদের দেশে বলতে গেলে খরচবিহীন বা কম খরচে আনারস উৎপাদন করা হয়। আমাদের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আনারসের এ হরমোন ব্যবস্থাপনা আনারসকে বর্তমানের চেয়েও অধিকতর দামি আলোকিত ভুবনে নিয়ে আসতে পারে।
ছাদ বা বারান্দা এবং ড্রাম বা টবে ফলের চাষ : জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরে বাড়িঘরের ঘনত্বও বেড়ে গেছে। তাই অনেকেরই বাড়িতে ফুল ফলের বাগান করার মতো বাড়তি জায়গা পাওয়া যায় না। তাই বলে তো বাগান করার সখ থাকবে না এমন হতে পারে না। ইদানীং শহরে এমন অনেক শৌখিন মানুষই বাড়ির ছাদ ও বারান্দায় ফুল ও ফলের চাষ করছেন। কাটা ড্রাম বা সিমেন্টের বড় টবে ফলের চাষ বেশি করা হয়। বড় বড় মাটির টবেও কিছু  কিছু ফলগাছ লাগাতে দেখা যায়। তবে ছাদ ও বারান্দার কিছু অংশে পাকা বেডে মাটি ও সার মিশিয়ে তাতেও ফলের চারা লাগাতে দেখা যায়। ড্রাম, টব বা স্থায়ী কাঠামোতে লাগানো ফলগাছে জমির মতোই পরিচর্যা প্রয়োজন। অনেক সময় এসব কাঠামোতে পুষ্টি উপাদানের দ্রুত ঘাটতি লক্ষ করা যায়। তাই নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিয়মিত জৈবসার ও পরিমিত সেচ নিশ্চিত করা হলে এসব কাঠামোতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যেতে পারে। এসব কাঠামোতে রোপণের জন্য ফলগাছের জাত নির্বাচন সতর্কভাবে করা দরকার। যেসব কলমের চারায় ডালপালা  কম ও দ্রুত ফল দেয় সেসব ফলের চারা ড্রাম বা টবে লাগানো যেতে পারে। আজকাল সরকারি বেসরকারি নার্সারিতে কাজী পেয়ারা, আম্রপালি আম, জামরুল, পেঁপে, লেবু, লিচু হাইব্রিড কামরাঙা, আপেল  কুল, বারোমাসি আমড়া, আঙুর প্রভৃতি ফলের কলম পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো কিনে ড্রাম বা টবে রোপণ করে নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে নির্মল আনন্দের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তবে ছাদে বাগান করতে হলে ইমারতের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া ভালো। তাছাড়া নিয়মিত সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ও নিকাশ এবং বালাই ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
টিপ প্রুনিংয়ের মাধ্যমে আমের ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি : বাংলাদেশে আম চাষাবাদের এলাকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ আম পছন্দ করেন। মানুষ বাড়ির আশপাশে, ছাদে যে আমের জাতটি সবচেয়ে বেশি চাষ করে থাকেন সেটি হলো বারিআম-৩ বা আম্রপালি। শখের কাছে নতি স্বীকার করে কেউ কেউ জাতটি চাষ করেছেন টবে এবং ড্রামে। এ ছাড়াও পার্বত্য জেলা যেমন রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকায় বাগান আকারে ব্যাপক আকারে চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে বারিআম-৩ বা আম্রপালি জাতটি আকারে বেশ ছোট হতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাছে প্রচুর আম ধরলে আকারে ছোট হয়, গাছকে পর্যাপ্ত খাবার না দিলে আকার ছোট হয় এবং গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমের আকারও ছোট হতে থাকে। ফলে জাতটির বাজারমূল্যে দিন দিন কমে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আম সংগ্রহ করার পর অর্থাৎ জুলাই মাসে আম গাছের প্রত্যেকটি ডগার শীর্ষ প্রান্ত থেকে ৩০ সেন্টিমিটার বা ১ ফুট পর্যন্ত কেটে দিলে পরবর্তী বছরে সে গাছ হতে বেশি ফলন ও গুণগত মানসম্পন্ন আম পাওয়া যাবে। তবে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রুনিং করা উত্তম।
প্রুনিংয়ে কর্তিত অংশ থেকে ৩-৪টি নতুন ডগা বের হয় এবং নতুন শাখার বয়স ৫ থেকে ৬ মাস হওয়ায় প্রায় প্রত্যেকটি শাখায় মুকুল আসে। বর্তমানে এ জাতটির ওজন ৬০ থেকে ১৮০ গ্রাম পর্যন্ত হতে দেখা যাচ্ছে কিন্তু এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া প্রুনিংয়ের মাধ্যমে আমের আকার ও গুণগতমান বাড়ানো সম্ভব; পাতার লাল মরিচা রোগ এ জাতের একটি বড় সমস্যা। কোনো প্রকার ছত্রাকনাশক ¯েপ্র ছাড়াই প্রায় ২ বছর পর্যন্ত রোগটি সহজেই দমন করা যায়; আমবাগানে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করা যাবে; কোনো কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই ভালো আম পাওয়া যাবে; বর্তমানে ঘন করে গাছ রোপণ করে যারা কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছেন না সেক্ষেত্রে এ প্রযুক্তিটি সহায়ক হবে; আমগাছের আকার ছোট রাখা যায় অর্থাৎ সুন্দর ক্যানোপি তৈরি করা যায়; প্রচুর জ্বালানি পাওয়া যাবে; আমগাছের বয়স ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত হলে ভালো; প্রুনিং প্রতি ৫ বছরে একবার করতে হবে। প্রুনিং করার পর গাছের বয়স অনুযায়ী সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজন হলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। আগস্ট মাসে প্রুনিং না করা উত্তম। কারণ এ ক্ষেত্রে গাছে মুকুল নাও আসতে পারে। নতুন ডগা বা কুশি বের হলে ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করতে হবে। আমের পাতা কাঁটা দেখা দিলে কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ¯েপ্র করতে হবে। অন্যান্য জাতগুলোর বেলায় এ প্রযুক্তিটির ব্যবহার না করা ভালো। সঠিক সময়ে, পরিমাণমতো অংশ কাটা ও সঠিক সার ব্যবস্থাপনা করা হলে এ প্রযুক্তিটি নিঃসন্দেহে বারিআম-৩ বা আম্রপালি আমচাষিদের জন্য ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনবে।
আম সংগ্রহের পরিপক্ব সময়কাল : আমের মৌসুমে আমের ভালো স্বাদ পাওয়ার জন্য আমচাষিরা আম সংগ্রহের জন্য নিদিষ্ট সময় অনুসরণ করতে পারবেন। স্থানীয়ভাবে কোনো জাতের আম আগে পাকলে কৃষি অফিস বা কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে আম সংগ্রহ করে বাজারজাত করতে পারবেন। তাপমাত্রা বেশি হলে বা কমে গেলে আম সংগ্রহের সময়ে কিছুটা তারতম্য হতে পারে। গোবিন্দভোগ- সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংগ্রহ করা যাবে। বারিআম-১ (মহানন্দা), গোপালভোগ পাহাড়ি জেলাগুলোতে এবং সাতক্ষীরায় মে মাসের দ্বিতীয় এবং রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সংগ্রহ করা যাবে। ক্ষীরসাপাতি/হিমসাগর; সাতক্ষীরা, মেহেরপুরে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, রাজশাহীতে মে মাসের শেষ সপ্তাহে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংগ্রহ করা যাবে। বারি আম-২ (লক্ষণভোগ), ল্যাংড়া পাহাড়ি জেলাগুলোতে এবং সাতক্ষীরায় মে মাসের শেষ সপ্তাহে এবং রাজশাহীতে জুনের প্রথম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংগ্রহ করা যাবে। বোম্বাই রাজশাহীতে জুন মাসের দ্বিতীয় এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। ফজলি রাজশাহীতে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। বারিআম-৩ (আম্রপালি) পাহাড়ি জেলাগুলোতে এবং সাতক্ষীরাই সংগ্রহ শুরু হবে জুনের তৃতীয়, রাজশাহীতে জুনের শেষ সপ্তাহে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। মল্লিকা রাজশাহীতে জুলাই মাসের প্রথম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। বারি আম-৪ রাজশাহীতে জুনের শেষ সপ্তাহ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংগ্রহ শুরু হবে। হাঁড়িভাঙ্গা রংপুরে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ হতে সংগ্রহ শুরু হবে। আশ্বিনা রাজশাহীতে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হবে। গুটি প্রাকৃতিকভাবে পাকা শুরু হলে তারপর সংগ্রহ করা যাবে।
বিশ্লেষণ হলো কিছু তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে, থেকে গেল অনেক কিছু। আগামীতে আবার বিস্তারিত নিয়ে আসব বাকি সব কথা নিয়ে।


কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*

*উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

 

বিস্তারিত
দেশি ফলের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য

বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭০ রকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হচ্ছে। ফল একটি অর্থকরী ফসল। ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়া দেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।  ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়। এ সত্ত্বেও আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক পুষ্টিহীনতার শিকার। বাংলাদেশের প্রায় ৮৮ ভাগ মানুষ ভিটামিন এ, ৯০ ভাগ মানুষ ভিটামিন সি, ৯৩ ভাগ মানুষ ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। আমাদের এ পুষ্টি ঘাটতি পূরণে ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশ দানাদার জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ফলের চাহিদা এখনও সম্পূর্ণ পূরণ করা হয়নি। ফল আমাদের শরীরে ভিটামিন ও খনিজ লবণ সরবরাহ করে। ফল কম গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশে ভিটামিন ও খনিজ লবণের অভাবজনিত অপুষ্টি যেমন রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, গলগ-, স্কার্ভি, বেরিরেরি এর হার পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি।
ফলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। ফল আমাদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। অথচ আমরা ফলকে খাদ্য হিসেবে গুরুত্বই দেই না। পুষ্টিবিদরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা আমাদের শরীরের চাহিদার তুলনায় অনেক কম পরিমাণ ফল গ্রহণ করছি।
ফলে দেহের জন্য অপরিহার্য প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশ থাকে। এসব পুষ্টি উপাদান রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও খাদ্যদ্রব্য হজম, পরিপাক, বিপাক, খাবারে রুচি বৃদ্ধি, বদ হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে এখন ফলের মৌসুম। এ সময় বিভিন্ন রকম দেশীয় ফল যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, বাঙি, তরমুজ, ডালিম, আনারসের সমারোহ লক্ষণীয়। দেশে উৎপাদিত এসব ফল যেমন সস্তা ও সহজলভ্য তেমনি সুস্বাদু, তৃপ্তিদায়ক ও পুষ্টি গুণাগুণে ভরপুর।
ফলে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। এতে প্রচুর পরিমাণে জলীয় অংশ থাকে। এ জলীয় অংশ পানির সমতা রক্ষা, খাদ্যদ্রব্য হজম, পরিপাক, বিপাক ও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালাতে সাহায্য করে। দেশীয় প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী ফলের মধ্যে জলডুবি আনারস, কালোজাম, পাকা পেঁপে, টমেটো, বাঙি, তরমুজ, জাম্বুরাতে ৯০ গ্রামেরও বেশি জলীয় অংশ থাকে।  পাকা কাঁঠাল, পাকা পেঁপে, লিচু, জামরুল, দেশি আনারস, জলপাই, পেয়ারা ও কামরাঙাতে ৮০ গ্রাম থেকে ৯০ গ্রাম জলীয় অংশ থাকে। অন্যান্য ফল যেমন আম, পাকা কলা, বেল ও পাকা তালে ৭০ গ্রামের নিচে জলীয় অংশ থাকে।
ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আঁশ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম দেশীয় ফলের মধ্যে কালোজাম, পেয়ারা, বেল ও আতাফলে ২ গ্রামের বেশি আঁশ থাকে। কামরাঙা, আমড়া ও জামরুলে ১ গ্রাম থেকে ২ গ্রাম এবং অন্যান্য ফলে ১ গ্রামের কম আঁশ থাকে। আমাদের মোট খাদ্যের শতকরা ১ ভাগ আঁশ থাকা উচিত। আঁশ হজম, পরিপাক ও বিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য এবং শর্করা, চর্বি ও আমিষ দহনে সহায়তা করে। খাদ্যের আঁশ মলাশয়ের ক্যান্সার, বহুমূত্র, স্থূলকায়ত্ব, হৃৎপি-, রক্তচাপ এপেন্ডিসাইটিস, মূত্রনালির পাথর প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এছাড়া কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে শরীরকে স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল রাখে।
ফলে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম দেশীয় ফলের মধ্যে আম, লিচু, পেয়ারা, পাকা তাল, কামরাঙা, বেল ও আতাফলে ৫০ থেকে ১০০ ক্যালরি থাকে। অন্যান্য ফল যেমন- পাকা কাঁঠাল, পাকা পেঁপে, আনারস, কালোজাম, বাঙি, তরমুজ, জাম্বুরা ও জামরুলে ৫০ ক্যালরিরও কম খাদ্যশক্তি থাকে। ফলে ক্যালরি কম থাকায় স্থূলকায়ত্ব, ডায়াবেটিস ও মেদবহুল লোকেরা অনায়াসে ফল খেতে পারেন। দেশীয় ফলে শর্করা, আমিষ ও তেল অল্প পরিমাণে থাকে। দেশীয় হলুদ রঙের ফলে প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটিন (প্রাক-ভিটামিন ‘এ’) থাকে। ভিটামিন এ রাতকানা রোগ ও অন্ধত্ব প্রতিরোধ করে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আম-এ ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা পেঁপেতে ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা কাঁঠালে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম, জলডুবি আনারসে ১৮৩০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন থাকে। এ ক্যারোটিনের প্রায় ৬ ভাগের এক ভাগ রোটিনল সমতুল্য বা ভিটামিন এ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে কাজে লাগে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা আমে ১৩৮৩ মাইক্রোগ্রাম, পাকা পেঁপেতে ১৩৫০ মাইক্রোগ্রাম, পাকা কাঁঠালে ৭৮৩ মাইক্রোগ্রাম ও পাকা আনারসে ৩০৫ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ পাওয়া যায়। প্রাপ্তবয়স্ক একজন লোকের দৈনিক ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম ও শিশুদের ২৫০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ এর প্রয়োজন। কাজেই অল্প পরিমাণ আম, কাঁঠাল ও পেঁপে খেলেই আমাদের শরীরে ভিটামিন এ এর চাহিদা পূরণ হয়। দেশীয় অন্যান্য ফলে অল্প পরিমাণ ভিটামিন এ থাকে। ভিটামিন এ শরীরের চাহিদামতো গ্রহণ করলে রাতকানা রোগ ও অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ফলে অল্প পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, যার পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ১০ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম। এ সময়ের ফলে লৌহও কম পরিমাণে থাকে। এদের মধ্যে প্রতি ১০০ গ্রাম তরমুজে ৭.৯ মিলিগ্রাম, জামে ৪.৩ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ১.৫ মিলিগ্রামের কম লৌহ থাকে। লৌহ রক্তস্বল্পতা দূর করে। ফলে কিছু পরিমাণে ভিটামিন বি-১ ও ভিটামিন বি-২ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা আম, কাঁঠাল, বাঙি, আনারস, আমড়াতে ০.১০ থেকে ০.২৮ মিলিগ্রাম ও অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম ভিটামিন বি-১ থাকে। ভিটামিন বি-১ খাদ্যদ্রব্যকে ক্যালরিতে রূপান্তর, হজম, পেশিগুলোকে সবল ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলের মধ্যে পাকা কাঁঠাল ও আতাফলে যথাক্রমে ০.১৫ মিলিগ্রাম ও ০.১৪ মিলিগ্রাম এবং অন্যান্য ফলে ০.১০ মিলিগ্রামের কম ভিটামিন বি২ থাকে। ভিটামিন বি২ এর অভাবে মুখের কোণায় ও ঠোঁটে ঘা, ত্বকের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যতা নষ্ট ও নাকের দুই পাশে চর্মরোগ হয়।
ভিটামিন ‘সি’ এর প্রধান উৎস ফল। দেশীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ থাকে। ভিটামিন ‘সি’ মাঢ়িকে মজবুত, ত্বককে মসৃণ, সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতি ১০০ গ্রাম দেশীয় ফলের মধ্যে পাকা আমে ৪১ মিলিগ্রাম, পাকা পেঁপেতে ৫৭ মিলিগ্রাম, কালোজাম ৬০ মিলিগ্রাম, কামরাঙা ৬১ মিলিগ্রাম, আমড়া ৯২ মিলিগ্রাম, পেয়ারায় ২১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে, লিচু, আনারস, বাঙি, জাম্বুরা ও আতাফলে ২০ মিলিগ্রাম থেকে ৪০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ থাকে। পুষ্টিবিদরা একজন বয়স্ক লোকের দৈনিক ৩০ মিলিগ্রাম ও শিশুদের ২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। দেশীয় ফল রান্না করে খেতে হয় না বলে এসব ফলের পুরো ভিটামিন ‘সি’ আমাদের শরীরে কাজে লাগে। চোখ, দাঁত, মাঢ়ি, হাড়, রক্ত ও ত্বকসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গের পুষ্টি জোগাতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। শরীরের চাহিদামতো প্রতিদিন নিয়মিত ফল গ্রহণ করলে সুস্থ-সবল দেহ নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে পুষ্টি সমস্যা সমাধান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ফল বৃক্ষের অবদান অপরিসীম। কাজেই আগামী প্রজন্মের খাদ্য, পুষ্টি, অর্থ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে ফলদ বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষণ করার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। সারা বছর ফল প্রাপ্তি নিশ্চিতের লক্ষ্যে উপযোগী জাত উদ্ভাবন করতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতের ফলের চারা বা কলম সহজলভ্য করতে হবে। বাংলাদেশে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর পতিত জমি রয়েছে যেখানে অনায়াসেই উন্নত জাতের দেশি  ফলের আবাদ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আমার বিশ্বাস, দেশি ফলের জাত উদ্ভাবন ও চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হবে।

মো. মোশারফ হোসেন*
*অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ), কৃষি মন্ত্রণালয় ও নির্বাহী পরিচালক (অ. দা.), বারটান

 

বিস্তারিত