Wellcome to National Portal
কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

কৃষি কথা

মাঠপর্যায়ে সার অপব্যবহার : ফসল উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

মাঠপর্যায়ে সার অপব্যবহার : ফসল
উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
ড. মো: এনামুল হক
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের মাটি বিভিন্নভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় মাটির ভৌত গঠনে অবনতি, মাটির জৈব উপাদান এবং উর্বরাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছানাশকের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করি কিন্তু জমির মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নই। মৌসুম, ফসল ও জমিভেদে সারের ব্যবহার ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মাটি পরীক্ষা করে অথবা গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে সরকার নির্ধারিত মাত্রায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী জমিতে সুষম সার ব্যবহার করলে একদিকে যেমন জমির মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে খরচ সাশ্রয় হয় এবং ফসলের ফলন বেড়ে যায়। জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার ব্যবহার করলে ফসল আবাদের খরচ বেড়ে যায়, আবার বেশি পরিমাণ সার আমদানি ও কৃষকদের নিকট সস্তায় বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়াও অব্যবহৃত সার বৃষ্টি অথবা সেচের পানির সাথে মিশে গিয়ে পানি, মাটি, বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত করে। পর্যাপ্ততা, সহজলভ্যতা ও দ্রুত সময়ে রিপোর্ট প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলে সার ব্যবহারের সুফলের ব্যাপারে কৃষকরা অসচেতন হওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই জমিতে সার ব্যবহার করে থাকেন।
সারের ভর্তুকি
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকি প্রদান করে কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সার প্রাপ্তি নিশ্চিত করে আসছে। বিগত বছরসমূহে প্রতি বছর সার বাবদ সরকার প্রায় ৯,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। সারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর বাংলাদেশ সরকারের এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবহৃত সার অধিকাংশই বিদেশ হতে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করতে হয়। সুষম সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার না করার ফলে একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্য দিকে সরকারের ব্যাপক পরিমাণ টাকা অপচয় যাচ্ছে। সারের অপচয় রোধ করে ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন প্রাপ্তিতে সুষম সার পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার কৃষকপর্যায়ে জনপ্রিয় করা গেলে সারের অপচয় তথা এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাইতে পারে।  
পরিমিত মাত্রায় সুষম সারের ব্যবহার গবেষণা প্রকল্প
অস্ট্রেলিয়ার দাতা সংস্থা অঈওঅজ এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা স¤পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠন, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন, পিআইও কনসালটিং লি: এবং অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ উদ্যোগে ফসলে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারে গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার উপর একটি প্রকল্প ঘঁঃৎরবহঃ গধহধমবসবহঃ ভড়ৎ উরাবৎংরভরবফ ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম রহ ইধহমষধফবংয (ঘটগঅঘ) বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্পের এলাকাসমূহ হচ্ছে- ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলা, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলা, রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর ও গোদাগাড়ী উপজেলা, ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা, শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলা, খুলনা জেলার দাকোপ ও ডুমুরিয়া উপজেলা, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা এবং পটুয়াখালী উপজেলার দুমকি উপজেলা। ২০১৮ সাল হতে আমন ধান, বোরো ধান, আউশ ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, মুগ, সরিষা, ছোলা, বাদাম, সুর্যমুখী, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের উপর পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো-
(১) ফসল আবাদে জমিতে পরিমিত ও লাভজনক মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ফসল আবাদ করা;
(২) জমির মাটি পরীক্ষা করে অথবা বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চলভিত্তিক সার সুপারিশমালা (এফআরজি) ব্যবহার করে ফসল আবাদে কৃষকদের আগ্রহী ও অভ্যস্ত করা;
(৩) বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চলভিত্তিক সার সুপারিশমালা (এফআরজি) কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া;
(৪) স্থানীয় ব্লক বা সাব-ব্লক পর্যায়ে কৃষকদের সংগঠিত করে ঐ ব্ল­কের মৌসুমভিত্তিক ফসল/জাত নির্বাচন করে গ্রুপভিত্তিক ফসল আবাদ ও পরিচর্যা কর্মকা- পরিচালনা করা;
(৫) সর্Ÿোপরি ফসল আবাদে নিবিড়তা এবং উৎপাদন ও ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থসমাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা।
ঘটগঅঘ প্রকল্পের প্রাপ্ত ফলাফল
জমিতে সারের প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা ও কৃষক পর্যায়ে সারের ব্যবহার : ঘটগঅঘ প্রকল্পের অধীনে উল্লিখিত উপজেলাসমূহের বিভিন্ন ব্লকে ২০১৮ সাল হতে ফসল আবাদে সারের সঠিক মাত্রা নির্ধারণে ৫০০ টিরও অধিক কৃষকের মাঠে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার ৭৫০ জন কৃষককে দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচন করে ঐ সব             কৃষকদের সার ব্যবহারের পরিমাণ, পদ্ধতি ও ধারণা সম্পর্কে বিস্তৃত পরিসরে জরিপ তথা গবেষণা কার্যক্রম পরিচলনা করা হয়। উভয় গবেষণায় প্রতীয়মাণ হয় যে কৃষি অঞ্চল, ফসলের শ্রেণী ও মৌসুম, শস্যবিন্যাস, কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থা ও কৃষি জমির মালিকানার পরিমাণ, পরিবার প্রধানের জেন্ডার পার্থক্য ইত্যাদির উপর সারের ব্যবহার ও পরিমাণ বহুলাংশে নির্ভর করে।
পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল : পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে ঘটগঅঘ প্রকল্প বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলার            কৃষকদের মাঠে বিভিন্ন ফসলের উপর ব্যাপক সংখ্যক প্রদর্শনী ট্রায়াল স্থাপন করে। যে কোন ফসলের প্রতিটি প্রদর্শনী ট্রায়াল মাঠ ২ (দুই) ভাগে ভাগ করা হয়। এক অংশে কৃষকের ব্যবহৃত সারের মাত্রা ও ধরন প্রয়োগ করা হয়। অন্য অংশে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশকৃত সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ (এফআরজি) অনুসৃত সারের মাত্রা ও ধরন ব্যবহার করে ফসল আবাদ করা হয়। ফসল কাটার সময় ঐ এলাকার অন্যান্য কৃষকদের নিয়ে মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। ট্রায়ালের উভয় অংশের ফসল আলাদা-আলাদাভাবে আহরণ করা হয় এবং উৎপাদিত ফসলের ফলন, উভয় পদ্ধতিতে সার বাবদ খরচ ও লাভ-লোকসানের হিসেব করা হয়।
ট্রায়ালের ফলাফল প্রমাণ করে যে, ফসল এবং কৃষকভেদে সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ ব্যবহার করলে কৃষকের ব্যবহৃত সারের মাত্রা ও প্রকার হতে প্রতি ১ (এক) হেক্টরে প্রতি মৌসুমে টাকা ৩,০০০-৯,৩০০ সার বাবদ খরচ সাশ্রয় করা যায়। ফলনও হেক্টর প্রতি প্রায় ৪৮০-৬২০ (আমন ধান) কেজি বেশি পাওয়া যায়। এফআরজি অনুসৃত সারের মাত্রা ব্যবহারের ফলে ধান আকারে পুষ্ট হয় এবং উজ্জ্বল রং ধারণ করায় কৃষক ঐ ধান বিক্রয়ের সময় মণপ্রতি অতিরিক্ত টাকা ৫০-১০০ বেশি পায়।
ট্রায়ালের ফলাফল নিশ্চিত করে যে, আমন ধান-বোরো ধান - পতিত শস্য পরিক্রমায় আমন ধান আবাদে দুর্গাপুর, ডুমুরিয়া, গোদাগাড়ী, আমতলী ও সদর-ঠাকুরগাঁও এর কৃষকরা ইউরিয়া সার এফআরজি নির্দেশিত মাত্রার থেকে  প্রতি হেক্টরে যথাক্রমে ৩০, ৪৮, ৩৮, ২৬ ও ৩৮ কেজি বেশি মাত্রায় ব্যবহার করে। অন্য দিকে সৈয়দপুর এবং সদর-ময়মনসিংহ এলাকার কৃষকরা হেক্টরপ্রতি ৯ কেজি হারে কম ব্যবহার করে। কিন্তু টিএসপি সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্গাপুর, ডুমুরিয়া, গোদাগাড়ী, সৈয়দপুর, আমতলী ও সদর-ঠাকুরগাঁও আমতলী, সৈয়দপুর, ডুমুরিয়া, দাকোপ, ঠাকুরগাঁও ও সদর-ময়মনসিংহ এলাকার কৃষকরা এফআরজি নির্দেশিত মাত্রার তুলনায় প্রতি হেক্টরে যথাক্রমে ৮৮, ৭৭, ২৭, ৫৭, ৭১ ও ৯৩ কেজি বেশি পরিমাণ ব্যবহার করে।  ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার অধিকাংশ কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মাত্রায় পটাশ ও জিঙ্ক সার ব্যবহার করলেও অন্য সব এলাকার কৃষকরা নগণ্য মাত্রায় পটাশ, জিপসাম, বোরন ও জিঙ্ক সার ব্যবহার করে থাকে। পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহার না করার ফলে             কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং ফসলের কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছেন না।
সার অপব্যবহারের প্রধান কারণসমূহ
ঘটগঅঘ প্রকল্পের গবেষণায় প্রমাণ হয় যে, সুষম ও পরিমিত সার ব্যবহারের উপকারিতা স¤পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকার কারণে আমাদের দেশের কৃষকরা সুষম ও পরিমিত মাত্রায় সার ব্যবহারে উদাসীন। অধিকাংশ কৃষক তাঁদের নিকটস্থ কৃষক ও স্থানীয় সার বিক্রেতার পরামর্শ মোতাবেক এবং তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে জমিতে সার প্রয়োগ করে থাকেন। বাজারে অধিকাংশ সারের পর্যাপ্ত জোগান এবং সরকারি ভর্তুকির মূল্যে দামে সস্তা হওয়ার কারণে অনেক কৃষক বেহিসাবি মাত্রায় বেশি পরিমাণ সার ব্যবহার করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ টিএসপি সারের পর্যাপ্ত জোগান এবং তুলনামূলক দামে সস্তা হওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে কৃষকপর্যায়ে এই সারের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।  
সার সুপারিশমালা গাইড (এফআরজি) ভিত্তিক সার সুপারিশমালা কার্ড বিতরণ এবং ব্যবহার : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতি ৫ (পাঁচ) বছর পর-পর বাংলাদেশের কৃষি অঞ্চলভিত্তিক সার সুপারিশমালা গাইড (এফআরজি) প্রকাশ করে থাকে। ২০১৮ (এফআরজি) অনুসৃত সারের মাত্রা কৃষকদের মাঝে ব্যাপক আকারে প্রচলন করার জন্য ঘটগঅঘ প্রকল্প ২০২০ সালের শুরুতে কৃষক ব্যবহার বান্ধব, সহজ ও সাবলীল ভাষায়, তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে জনসচেতনতার কার্যক্রম নেয়। প্রায় পরবর্তী ৫ (পাঁচ) বছর সংরক্ষণ ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রধান-প্রধান শস্য পরিক্রমায় কৃষি অঞ্চলভিত্তিক ব্যবহার উপযোগী ১ পাতার এফআরজি কার্ড তৈরি করে। প্রকল্পের পার্টনার, পিআইও কনসালটিং লিঃ এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কৃষি সুরক্ষা সেবাদানকারী সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় প্রকল্পের ৮ (আট) উপজেলায় বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কৃষক পরিবারের সকল সদস্যদের মাঝে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল এবং এফআরজি কার্ড ব্যবহার পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করে মোট ৩৪,০০০ কৃষক পরিবারকে এফআরজি কার্ড বিতরণ করা হয়।
সার সুপারিশমালা কার্ড ব্যবহার জনপ্রিয়করণ : বিভিন্ন মৌসুমের পূর্বে কার্ড বিতরণ পরবর্তী এবং ফসল আবাদকালীন সময়ে প্রত্যেক কৃষকের সাথে ব্যক্তিপর্যায়ে একাধিকবার সাক্ষাৎ, মাঠ দিবসে আমন্ত্রণ, মোবাইল ফোনে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়। এসএমএস, ভয়েজ মেইল, ইমো, হোয়াটস্আপ, ফেইসবুক ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করা হয়। বার-বার ও সহজে পরামর্শ পাওয়ায় কৃষকরা এফআরজি কার্ড ব্যবহারে আগ্রহী হয় ও আস্থা তৈরি হয়। প্রথম মৌসুমে কৃষকরা স্বল্প পরিমাণ জমিতে এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে আশানুরূপ ফলন পায় এবং লাভ বেশি হওয়ায় পরবর্তীতে কৃষকরা তাদের প্রায় সকল জমির ফসলে  এফআরজি কার্ড মোতাবেক সার ব্যবহার করেন।
কৃষকপর্যায়ে সার সুপারিশমালা কার্ড ব্যবহারের সুফল মূল্যায়ন : ২০২২ সালের শেষের দিকে এফআরজি কার্ড ব্যবহারের ফলাফল তথা- কৃষকের লাভ/ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন উপজেলার ১,৫০০ জন কৃষকের মাঝে মূল্যায়ন জরিপ পরিচালনা করা হয়। উক্ত জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে প্রায় ১০০% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করে বিগত মৌসুমে ফসল আবাদ করেছেন; ৮৪% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহারে সারের পরিমাণ এবং খরচ সাশ্রয় এবং ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন; ৯৭% কৃষক এফআরজি কার্ড ব্যবহার করা সহজ এবং ভবিষ্যতে তাঁরা ব্যবহার করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ঘটগঅঘ প্রকল্পের গবেষণার আলোকে নির্বাচিত উপজেলায় সারের অপব্যবহারে আনুমানিক ক্ষতির হিসাব
ঘটগঅঘ প্রকল্পের গবেষণলদ্ধ ফলাফলকে ভিত্তি ধরে দুর্গাপুর, ডুমুরিয়া, গোদাগাড়ী, সৈয়দপুর, আমতলী, সদর-ময়মনসিংহ এবং সদর-ঠাকুরগাঁও উপজেলাসমূহের কৃষকরা শুধুমাত্র আমন ধান আবাদে জন্য প্রতি মৌসুমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আনুমানিক  ৪,০৯২ টন ইউরিয়া এবং ১১,০৩২ টন টিএসপি সার ব্যবহার করে। এতে ঐ এলাকার কৃষকদের সার বাবদ অপচয় হয় আনুমানিক প্রায় ৩৬.৫৯ কোটি টাকা। সরকারি ভর্তুকি বাবদ আনুমানিক অপচয় হয় ১৩৪.৭৮ কোটি টাকা (সারণি-২)। পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহার না করার কারণে কৃষক তথা আমাদের দেশ কেবলমাত্র উল্লিখিত ৭টি উপজেলায় প্রতি মৌসুমে আনুমানিক ৯৭,৮৬৩ মেট্রিক টন আমন ধান কম উৎপাদন হচ্ছে বলে ধারণা  করা হচ্ছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২৯৩.৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি আমন মৌসুমের আনুমানিক সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৬৪.৯৬ কোটি টাকা (সারণি-২ ও সারণি-৩ দ্রষ্টব্য)।

লেখক : এডজাঙ্কট অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, মারডক ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া এবং ডেপুটি লিডার নোমান অ্যান্ড কনজারভেশন। মোবাইল : ০১৭৫৫৫২০০৮৬, ই-মেইল :e.haque@murdoch.edu.au

বিস্তারিত
কাঁচা কাঁঠালের পুষ্টি গুণ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

কাঁচা কাঁঠালের
পুষ্টি গুণ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী১ মো: হাফিজুল হক খান২
কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন যা মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা কাঁঠালে শে^তসার ৯.৪ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, খনিজ দ্রব্য ০.৯ গ্রাম, পটাশিয়াম ২৪৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৯৭ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫০ মিলিগ্রাম, লৌহ ১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ৫.৯০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘এ’ ৩০ আউন্স, স্টার্চ ১৬.৫৬% এবং কাঁঠালের বীজে শে^তসার ২৫.৮ গ্রাম, আমিষ ৬.৬ গ্রাম, খনিজ দ্রব্য ১.২ গ্রাম, ফসফরাস ২৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ‘এ’ ১৭ আউন্স, স্টার্চ ২২% বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত দরকার। কাঁচা কাঁঠাল রোগব্যাধি উপশমে যেমন কার্যকর, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান যা হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কাঁচা কাঁঠালে আছে শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এই ফলে রয়েছে আয়রন যা দেহের রক্তস্বল্পতা ও এটি আঁশালো হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও দূর করে। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ভিটামিন ‘সি’। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন ‘সি’ তৈরি হয় না। ভিটামিন ’সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। আবার অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবণ্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
কাঁঠাল চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ
আমাদের দেশে প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ও                 উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই রাস্তাঘাটে, ভ্যানে-রিকশায়, অটোরিকশা, টেম্পু, ট্রাক ও রাস্তার মোড়ে ও বাজারে ক্ষুদ্র চাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার, বেপারী ও পাইকারি বিক্রেতাদের স্তূপ করে বিক্রয় করতে দেখা যায়। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশে কাঁঠালের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫-৪৫ ভাগ প্রতিবছর ৮০০ কোটি টাকার উপরে কাঁঠালের অপচয় হয়ে থাকে। কৃষক তার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এবং সময়মতো বিক্রয় করতে না পারায় অনেকে কাঁঠাল গাছ বা বাগান কেটে উচ্চমূল্যের অন্য ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন।
কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাকতে শুরু করে তখন একসাথে বেশির ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ফলে সেই সময় গাছ হতে ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিকভাবে পড়ে যায়, যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে থাকে। সে সময় অনেকের মতে গরু বা পশু পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। এক্ষেত্রে শুরুতেই কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক পরিমাণ কাঁঠাল গাছ হতে পেড়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হলে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তেমনি কাঁঠালের অপচয় রোধেও সহায়তা করবে। এছাড়াও কাঁঠাল উৎপাদনকারী কৃষক শুরুতেই বিক্রয়মূল্য বেশি পাবে যা ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতেও সহায়তা করবে।
কাঁচা কাঁঠাল বাণিজ্যিকীকরণ
কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলে পাওয়া যাবে।
কাঁঠালকে সঠিকভাবে কাঁচা থেকে ব্যবহার করা গেলে আমাদের দেশেই থাইল্যান্ডের বা ভিয়েতনামের ন্যায় কাঁঠালের চিপস্, ভেজিটেবল মিট, ফ্রেশ-কাট, ফ্রোজেন, রেডি-টু-কুক, আচারসহ বহুবিধ উৎকৃষ্টমানের ও মুখরোচক খাদ্য সামগ্রী বছর জুড়েই অনায়াসে তৈরি করা যাবে। কাঁচা কাঁঠালের কাটলেট, ভেজিটেবল রোল, সিংগারা, সমুচা, পাপড় ইত্যাদি বিবিধ খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা যায়। কাঁচা কাঁঠালের পাউডার বা আটা ঔষধ শিল্পে, শিশুর খাদ্য ও ফর্টিফিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যে মূল্য সংযোজন করে পুষ্টি উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও ভর্তা, মুগ ও ছোলা ডালে কাঁচা কাঁঠাল ব্যবহার করলে খাদ্যের গুণগতমান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানেও সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে।
কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট : ফ্রেশকাট পদ্ধতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া যেখানে খাদ্যসামগ্রীকে কাঁচা অবস্থায় প্রয়োজনীয় এবং পরিমাণমতো আকারে কেটে ন্যূনতম পরিচর্যা ও ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ করে প্রক্রিয়া জাতকরণের পর মোড়কজাত করে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেখানে খাদ্যসামগ্রীর গুণগতমান অক্ষুণœ থাকে এবং কোন অণুজীবের সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। ফ্রেশকাট পদ্ধতিতে সংরক্ষণকৃত কাঁঠাল পরবর্তীতে সবজি বা তরকারি, আচার, চাটনী, ভেজিটেবল মিট, আরটিসি ইত্যাদি হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় বছরব্যাপী বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে খাওয়া যায়। সাধারণত ৪৫-৫৫ দিনের পরিপুষ্ট কাঁঠাল বিভিন্ন ভাবে রান্না করার জন্য উপযোগী। কচি কাঁচা কাঁঠাল সংগ্রহ করে লম্বালম্বিভাবে কেটে টুকরোগুলোকে পরিমাণমতো (০.৫%) সাইট্রিক আসিড, (০.৫%) পটাশিয়াম মেটা-বাই-সালফাইট (কেএমএস), ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (১%) মিশ্রিত পানির দ্রবণে কিছুক্ষণ (৫-৭ মিনিট) ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে টুকরোগুলো বাদামি বা কালো বর্ণ ধারণ না করে। কাঁঠালের টুকরোগুলোকে এইচডিপিই (হাই ডেনসিটি পলি ইথাইলিন) প্যাকেটে ভর্তি করে খোলা মুখ সিল করে বন্ধ করতে হবে যাতে বাতাস প্রবেশ বা কোন জীবাণুর সংক্রমণের সুযোগ না থাকে। প্রক্রিয়াজাতকরণ কাঁচা কাঁঠালের টুকরোগুলোকে রেফ্রিজারেটরে ৫-৭ দিন এবং ডিপ ফ্রিজে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।  সংরক্ষণকৃত কাঁঠালের টুকরোগুলোর গুণগতমানের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে না।
কাঁচা কাঁঠালের আরটিসি (রেডি-টু-কুক) : আরটিসি বা রেডি-টু-কুক এমন একটি প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি যেখানে প্রয়োজনীয় মসলা সামগ্রী পূর্বেই মিশানো রয়েছে, শুধুমাত্র ন্যূনতম পদ্ধতি অনুসরণ করে কম সময়ে সরাসরি রান্না করে খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা যাবে। এতে করে সময় ও শ্রমের সাশ্রয় হবে এবং তা দিয়ে হরেক রকম তরকারি রান্না করা যাবে। সাধারণত ৪৫-৫৫ দিনের অপরিপক্ব কাঁঠাল আরটিসি (রেডি-টু-কুক) তৈরির জন্য উপযোগী। উক্ত অপরিপক্ব কাঁচা কাঁঠাল সংগ্রহ করে ছোট ছোট টুকরো করে কাঁঠালের টুকরোগুলোর সাথে পরিমাণমতো লবণ ও মিক্সড্ মসলা (১৫-২০ গ্রাম/কেজি) যোগ করে ভালভাবে শুকাতে হবে। শুকনো ও ঠা-া জায়গায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কাঁঠালের আরটিসি ৬-৮ মাস পর্যন্ত সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। রান্নার সময় ১ কেজি পরিমাণ কাঁঠালের রেডি-টু-কুক (আরটিসি) প্রডাক্ট নিয়ে তাতে ১:৫ অনুপাতে পানি যোগ করে প্রডাক্টসহ ২৫-৩০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে ভালোভাবে কাঁঠালের আরটিসি প্রডাক্ট সিদ্ধ করতে হবে এবং একটি পাত্রে সরিষা/সয়াবিন নিয়ে তাতে একে একে পরিমাপকৃত মসলা এবং আদা-রসুনের পেস্ট একত্রে হালকা রান্না করে তাতে প্রয়োজনমত লবণ যোগ করে রান্না করতে হবে যা গরম অবস্থায় পরিবেশনের জন্য উপযোগী হবে।
কাঁচা কাঁঠালের আচার : রকমারি মসলা মেশানো ফলমুলকে খাওয়ার তেল বা ভিনেগারে ডুবানো অবস্থায় প্রস্তুত খাদ্যকে আচার বলা হয়।  আচারে প্রায় শুকনা করা ফলমূলের সঙ্গে সরিষার তেল এবং ভিনেগার মিশিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে  ফলমূলের জলীয়াংশ বেশ কমে গিয়ে (১২% বা কম) তেল বা ভিনেগারে সম্পৃক্ত হয়ে উঠলে এদের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায় অর্থাৎ পচন সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কচি কাঁচা কাঁঠাল বা তরকারি খাওয়ার উপযোগী এমন কচি কাঁঠাল (৬-৮ সপ্তাহ) বেছে নিয়ে কাঁঠালের উপরের ত্বক বা চামড়া কাটাসহ ভিতরের কোর আলাদা করে নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে অতঃপর সিদ্ধ করে নিয়ে পরিমাণমতো সরিষার তেলে ভেজে নিতে হবে। আদা, রসুন, সরিষা, হলুদ, মরিচ গুঁড়া, মেথি, কালজিরা, ১% গ্লাসিয়াল এসিটিক ইত্যাদি যোগ করে প্রয়োজনমত রান্না করলে মুখরোচক কাঁঠালের আচার তৈরি হবে। তৈরিকৃত কাঁচা কাঁঠালের আচার কাঁচের বয়াম/বোতলে ভরে শুকনো ও পরিষ্কার জায়গায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১০-১২ মাস অতি সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। তন্ডুল জাতীয় খাদ্য যেমন-ভাত, রুটি, লুচি, পরোটা ইত্যাদির সংগে অল্প পরিমাণ আচার মিশ্রণে খাদ্যকে বেশ সুস্বাদু করে তোলে।
কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়াসে বিএআরআই-এর উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত ৩টি জাত (বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩) উদ্ভাবন করেছে। দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশী। আমাদের দেশের কাঁঠালের মধ্যে হবিগঞ্জের বড় ও ভালমানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উত্তম কৃষি চর্যা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে যা কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগমান করবে।

লেখক : ১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩ ই-মেইল: ferdous613@gmail.com

বিস্তারিত
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসাশ্রয়ী শস্যবিন্যাসের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিসাশ্রয়ী শস্যবিন্যাসের মাধ্যমে
ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা
ড. মো. হোসেন আলী১ পার্থ বিশ্বাস২
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় যে পরিমাণ পানি পাম্পের সাহায্যে উত্তোলন করা হচ্ছে; সে পরিমাণ পানি ভূগর্ভস্থ স্তরে পুনরায় ভরাট বা রিচার্জ হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এমন এক সময় আসবে যখন গভীর নলকূপের সাহায্যেও আর পানি পাওয়া যাবে না। ফলে ভবিষ্যতে পানির অভাবে পরিবেশের বিপর্যয় হতে পারে। জলবায়ু পরিবেশগত টেকসই ব্যবস্থাপনা অর্জনের জন্য ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এ যে মূল ৬টি হটস্পট বিবেচনা করা হয়েছে তার মধ্যে “বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল” অন্যতম। পানি সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং পানি সম্পর্কিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য (বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০: সংক্ষিপ্ত সার)। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এর রূপকল্প হচ্ছে “নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ¦ীপ গড়ে তোলা” এবং অভিলক্ষ্য হচ্ছে “দৃঢ়, সম্বন্বিত ও সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল কার্যকরী কৌশল অবলম্বন এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য ব-দ্বীপ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ”। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এ যে ছয়টি ব-দ্বীপ সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট অভিষ্ট নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে অভীষ্ট ২ এবং অভীষ্ট ৬ পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট। পানি ব্যবহারের প্রধান প্রধান খাতগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশি পানি ব্যবহৃত হয় কৃষিখাতে যা মোট ব্যবহারের প্রায় ৭০ শতাংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলেও এর ব্যতিক্রম নয় এবং বাসাবাড়ি (১০%) ও শিল্প কারখানা (২০%) সহ প্রায় সবটাই উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ উৎস হতে। নাচোল ও নিয়ামতপুর উপজেলার বিগত ৪০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এই এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে প্রায় ১-১.৫ ফুট হারে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং বৃষ্টিপাতের ক্রমধারা (ঢ়বঃঃবৎহ) সুষম নয়। দেশের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় এই অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় অর্ধেক। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের এমন ভাবে পানি উত্তোলন করতে হবে - যেন পানির স্তর বেশি নিচে চলে না যায়, অর্থাৎ ভারসাম্য বজায় থাকে। তাই স্থানীয় চাষাবাদ পদ্ধতি ও পানি ব্যবহারের বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করে টেকসই  কৃষি উৎপাদন এবং আর্থসামাজিক চাহিদা বিবেচনায় নাচোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নিয়ামতপুর, নওগাঁ এই দুইটি স্থানে পরপর তিন বছর (২০১৮-২০২০) গবেষণার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পানি সাশ্রয়ী শস্য পরিক্রমা উদ্ভাবন করা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ অনুসারে  অন্যতম হটস্পট ‘বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল’ এর আওতায় যে ১৮টি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সে জেলাগুলোতে বা অনুরূপ স্থানে এই ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ করা যেতে পারে।  
স্থানীয় চাষাবাদ পদ্ধতি এবং নতুন পদ্ধতি
অধিকাংশ জমিতে ‘আমন-পতিত-বোরো’ শস্য পরিক্রমা অনুসরণ করে বছরে দুটি ফসল চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষকরা সাধারণত দীর্ঘ জীবনকালের আমন ধান চাষ করেন এবং আমন কাটার পর প্রায় ২-৩ মাস জমি পতিত রেখে পরে দীর্ঘ জীবনকালের রোরো ধান চাষাবাদ করেন। ফলে তারা আমন ধানে আংশিক (৪-৬টি) সেচ ও বোরো ধানে সম্পূর্ণ সেচের (১২-১৪টি) জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। পানি সাশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ‘আমন-পতিত-বোরো’ শস্য পরিক্রমা (ব্যবস্থাপনা-৫) এর বোরো ধানকে বাদ দিয়ে আউশ নির্ভর ৩টি এবং স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল বোরো নির্ভর ১টি নতুন শস্য পরিক্রমা/ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (টেবিল-১)। নতুন আউশ নির্ভর ৩টি শস্য পরিক্রমা/ব্যবস্থাপনা যথাক্রমে-ব্যবস্থাপনা-১ (আমন-সরিষা-আউশ), ব্যবস্থাপনা-২ (আমন-মসুর-আউশ)  ও ব্যবস্থাপনা-৩ (আমন-গম-আউশ) এবং নতুন স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল বোরো নির্ভর ১টি হলো ব্যবস্থাপনা-৪ (আমন-সরিষা-বোরো)। উল্লেখ্য, ব্যবস্থাপনা-৪ (আমন-সরিষা-বোরো) এ স্বল্প জীবনকালীন উচ্চফলনশীল বোরো হিসাবে ব্যবহৃত জাত, বিনা উদ্ভাবিত বিনাধান-১৪।
ধান-সমতুল্য ফলন এবং আয়-ব্যয় অনুপাত
ধান-সমতুল্য ফলন বলতে বোঝায় যে, ধান ব্যতীত অন্যান্য ফসল যেমন : গম, সরিষা অথবা মসুর এর ফলনকে ঐ সময়ের বাজার মূল্যে রূপান্তরিত করে তা দ্বারা যে পরিমাণ ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ ধান-সমতুল্য ফলন (টন/হেক্টর) = [ধান ব্যতীত অনান্য ফসলের ফলন (টন/হেক্টর) দ্ধ ঐ ফসলের বাজার মূল্য (টাকা/টন)] স্ট ধানের বাজার মূল্য (টাকা/হেক্টর)। বিদ্যমান শস্য পরিক্রমা ‘আমন-পতিত-বোরো’ (ব্যবস্থাপনা-৫) এর তুলনায় নতুন ৪টি শস্য পরিক্রমা (ব্যবস্থাপনা-১ হতে ব্যবস্থাপনা-৪) কীভাবে পানিসাশ্রয়ী এবং লাভজনক তা হিসাব করার জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদন খরচ এবং স্থানীয় শস্যের বাজার মূল্যসহ আনুসঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আয়-ব্যয় অনুপাত, বিঘা/হেক্টরপ্রতি প্রকৃত আয়, শতকরা ফলন বৃদ্ধি ও পানি সাশ্রয় প্রকাশ করা হয় (টেবিল-১)।
ব্যবস্থাপনা/প্রযুক্তির বর্ণনা
গতানুগতিক আমন-বোরো দুই ফসলি শস্য পরিক্রমার পরিবর্তে আমন-রবি-আউশ পরিক্রমায় সেচের পানি তুলনামূলক কম লাগে। উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালীন আমন ধান (যেমন : বিনাধান-৭, বিনা ধান-১৭, বিনাধান-২২ অথবা ব্রি ধান৭১) কাটার পর রবি মৌসুমে বিনা সেচে মসুর (যেমন : বিনামসুর-৮), একটি বা দুইটি সেচে সরিষা (বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১০ অথবা বারি সরিষা-১৪) এবং গমের ক্ষেত্রে (বারি গম-৩৫, বারি গম-৩৩ বা বারি গম-২৬) ২-৩টি সেচের মাধ্যমে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। গম কাটার পর বা সরিষা/মসুর তোলার পর আউশ ধান “বিনাধান-১৯ বা বিনাধান-২১” লাগালে ৩-৪টি সেচই যথেষ্ট- যা চারা রোপণ হতে ফুল আসা পর্যায়ের পূর্ব পর্যন্ত দিতে হয় এবং বাকি সময়ে প্রাকৃতিক বৃষ্টির মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ হয়। চাষকৃত আউশ ধানের ফলন প্রায় ৪.৭৯ টন/হেক্টর। সেচের পানির চাহিদা অনেকটা বৃষ্টির পানি দ্বারা পূরণ হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে কম হয়। ফলে বোরো ধানের পরিবর্তে রবি ও আউশ শস্য চাষ করায় গভীর নলকূপের পানি কম উত্তোলন করার প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশ বান্ধব। অন্যদিকে বছরান্তে মোট ফলন (ধান-সমতুল্য) বেশি হয় এবং নিট মুনাফা বা          প্রকৃত আয়ও বেড়ে যায় (টেবিল-১)।
এ ছাড়াও দীর্ঘ জীবনকালীন ‘আমন-পতিত-বোরো’ দুই ফসলি শস্য পরিক্রমার পরিবর্তে ‘আমন-সরিষা-বোরো’ শস্য পরিক্রমার মাধ্যমে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিসহ সেচ পানির সাশ্রয় করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালীন আমন ধানের পাশাপাশি বিনা উদ্ভাবিত বোরো ধান (বিনাধান-১৪) ব্যবহার করতে হবে। কারণ বিনাধান-১৪ উচ্চফলনশীল ও স্বল্প জীবনকালীন বোরো ধানের জাত (ব্রাউশ/লেট বোরো) এবং গবেষণায় দেখা যায় স্থানীয় চাষাবাদকৃত বোরো ধানের চেয়ে  ২-৩ সেচ কম প্রয়োজন হয়।
প্রযুক্তি থেকে লাভ
ব্যবস্থাপনা-৫ (আমন-পতিত-বোরো) এর তুলনায় আউশনির্ভর ব্যবস্থাপনা-১ (আমন-সরিষা-আউশ), ব্যবস্থাপনা-২ (আমন-মসুর-আউশ) এবং ব্যবস্থাপনা-৩ (আমন-গম-আউশ) অনুসরণ করলে প্রায় ১০-১৯ শতাংশ ধান সমতুল্য ফলন বৃদ্ধিসহ ৫০-৫৯ শতাংশ সেচের পানি সাশ্রয় করা সম্ভব। ব্যবস্থাপনা-৫ (আমন-পতিত-বোরো) এর তুলনায় ব্যবস্থাপনা-৪ [আমন-সরিষা-বোরো (বিনাধান-১৪)] অনুসরণ করলে প্রকৃত আয় প্রায় ৫২ শতাংশ বৃদ্ধিসহ ২৫ ভাগ সেচের পানি সাশ্রয় করা সম্ভব (টেবিল- ১)। বরেন্দ্র অঞ্চলের একটা পাম্পের আওতায় বিদ্যমান জমি সাধারনত সমতল নয় বরং উঁচু, মাঝারি ও নিচু এই তিন ধরনের। এখানকার মাটি সাধারণত এটেল-দোঁ-আশ। তাই যে সমস্থ জমিগুলো নিচু সেখানে ব্যবস্থাপনা-৪ [আমন-সরিষা-বোরো (বিনাধান-১৪)] এবং বাকি জমিগুলোতে ব্যবস্থাপনা-১, ব্যবস্থাপনা-২ এবং ব্যবস্থাপনা-৩  সমন্বিতভাবে অনুসরণ করলেও প্রকৃত আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সেচের পানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
সুতরাং বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলে বোরো ধানের পরিবর্তে রবি ফসল: সরিষা, মসুর বা গম এবং আউশ ধান চাষ করলে সেচের পানির পরিমাণ কম লাগে, বছরান্তে মোটফলন (ধান সমতুল্য) বেশি হয় এবং নিট মুনাফাও বেশি পাওয়া যায়; পাশাপাশি পানি সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং পানি সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করে পরিবেশগত স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব।
লেখক : ১মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ; মোবাইল : ০১৭২৭৬৫৬২১৬, ই-মেইল: parthi.biswas@gmail.com

বিস্তারিত
ব্রি উদ্ভাবিত ৫টি নতুন উফশী ধানের জাত

ব্রি উদ্ভাবিত ৫টি নতুন উফশী ধানের জাত
কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন
অন্ধকারের অমানিশা থেকে ভোরের আভা পেরিয়ে, আমরা আজ উজ্জ্ব¡ল আলোর দিশায়। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমরা আজ চালে উদ্বৃত্তের বাংলাদেশ। আর যাই হোক বাংলাদেশে এখন খাদ্যের কোন অভাব নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয়, জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ বেশি ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে ডাবল ফসল ফলাতে পারব না, দ্বিগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণ করতে পারি, তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না।” বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন আমাদের বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করে এবং তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করে চলেছে একের পর এক উচ্চফলনশীল ধানের জাত। এসব জাত কৃষি প্রযুক্তি ও সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি সহায়তার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এমনকি বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত তখনও দেশে কোন খাদ্য ঘাটতি হয়নি। এই খাদ্য স্বয়ম্বরতার পেছনে যে সব প্রতিষ্ঠান সরাসরি কাজ করে তার অন্যতম ব্রি (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট)। এই ধারা অব্যাহত রাখতে এবং দেশে যাতে আর কখনোই খাদ্য সংকট না হয় সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি জাতীয় বীজবোর্ড এর ১০৮তম ও ১০৯তম সভায় অনুমোদন পেল এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আরো পাঁচটি নতুন উফশী ধানের জাত। ফলে ব্রি উদ্ভাবিত সর্বমোট ধানের জাত সংখ্যা দাঁড়ালো ১১৩টি। আউশ, আমন ও বোরো ধানের এসব জাতের মধ্যে আছে- জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত, অল্প জিআই সম্পন্ন জাত, সরু ও সুগন্ধী ধানের জাত, ডায়বেটিক চালের জাত, হাইব্রিড জাত, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও ঠা-াসহিষ্ণু ধানের জাত, জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু এবং এন্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ ধানের জাত। দেশের সকল শ্রেণির মানুষের পছন্দ অপছন্দ বিবেচনায় নিয়ে সকল অঞ্চল ও আবহাওয়ার উপযোগি জাত উদ্ভাবন করেছে ব্রি। জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৮তম সভায় আমনের নতুন জাত ব্রি ধান১০৩, বোরো মৌসুমের বাসমতি টাইপ সুগন্ধি জাত ব্রি ধান১০৪ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৮ অনুমোদন করা হয়। সর্বশেষ গত ২রা মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় অনুমোদন করা হয় বোরো মৌসুমে চাষের উপযোগী কম (এষুংবসরপ ওহফবী) (জিআই) সম্পন্ন জাত ব্রি ধান১০৫ (ডায়াবেটিক ধান) ও রোপা আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী নতুন উচ্চফলনশীল ধানের জাত ব্রি ধান১০৬।
নতুন উদ্ভাবিত ব্রি ধান১০৩ : আমন মৌসুমের একটি জাত। ব্রি ধান২৯ এর সাথে ঋখ৩৭৮ নামে একটি সারির সংকরায়ণ এবং পরবর্তীতে এ্যন্থার কালচার পদ্ধতি (জীব প্রযুক্তি) ব্যবহার করে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। এ জাতটির পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২৫ সেমি.। ডিগ পাতা খাড়া। দানা লম্বা ও চিকন। ১০০০ পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৩.৭ গ্রাম। ধানে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৪%। এ জাতটির গড় জীবনকাল ১৩২ দিন। এ জাতটির গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৬.২ টন। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে জাতটি প্রতি হেক্টরে ৮.০ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
লম্বা ও চিকন চালের সুগন্ধি জাত ব্রি ধান১০৪ : ব্রি ধান১০৪ এর কৌলিক সারি বিআর৮৮৬২-২৯-১-৫-১-৩। কৌলিক সারিটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) তে ২০০৭ সালে আইআর৭৪০৫২-২১৭-৩-৩ এর সাথে বিআর৭১৫০-১১-৭-৪-২-১৬ এর সংকরায়ণ করে এবং পরবর্তীতে বংশানুক্রম সিলেকশনের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয় ব্রি গাজীপুরের গবেষণা মাঠে হোমোজাইগাস সারিটি নির্বাচন করা হয় এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত সারিটি পাঁচ বছর ফলন পরীক্ষার পর ২০১৯ সালে ব্রির আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহের গবেষণা মাঠে ও ২০২০ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অতঃপর ২০২১ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি কর্তৃক স্থাপিত প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় (পিভিটি) সন্তোষজনক হওয়ায় জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দল কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরবর্তীতে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৮তম সভায় ব্রি ধান১০৪ বোরো মৌসুমের উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন জাত হিসেবে ছাড়করণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
এ জাতে আধুনিক উফশী ধানের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা, পাতার রং সবুজ। পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ৯২ সেমি.। জাতটির গড় জীবনকাল ১৪৭ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২১.৫ গ্রাম। এ জাতের ধান বাসমতি টাইপের তীব্র সুগন্ধি যুক্ত। এ ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৯.২ ভাগ। এ ছাড়া প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৮.৯ ভাগ এবং ভাত ঝরঝরে এ জাতের জীবনকাল ব্রি ধান৫০ এর প্রায় সমান। এ ধানের গুণগত মান ভালো অর্থাৎ চালের আকার আকৃতি অতিরিক্ত লম্বা চিকন (ঊীঃৎধ খড়হম ঝষবহফবৎ) (৭.৫ মি.মি. লম্বা) এবং রং সাদা। প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষায় দশটি অঞ্চলে ব্রি ধান৫০ এর চেয়ে ব্রি ধান১০৪ এর ফলন প্রায় ১১.৩৩% বেশি পাওয়া গেছে। শীর্ষ ছয় স্থানে এটি ব্রি ধান৫০ এর চেয়ে ১৭.৯৪% বেশি ফলন দিয়েছে। এ জাতটি বাসমতি টাইপের ব্রির একমাত্র সুগন্ধি ধানের জাত। এ জাতের হেক্টরে গড় ফলন ৭.২৯ টন। উপযুক্ত পরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে এ জাতটি হেক্টরে ৮.৭১ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। ব্রি ধান১০৪ এ রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে অনেক কম হয়। গাছের উচ্চতা ১১০-১১৫ সেমি.।
ডায়াবেটিক ধান ব্রি ধান১০৫ : নতুন উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে ব্রি ধান১০৫ হল বোরো মৌসুমের একটি কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) সম্পন্ন ডায়াবেটিক ধান। ব্রি ধান১০৫ এর শনাক্তকারি বৈশিষ্ট্য হলো সবুজ পাতা, খাড়া ডিগপাতা, মাঝারি লম্বা ও চিকন দানা যার জিআই এর মান ৫৫.০। সুতরাং, কম জিআই হওয়ার কারণে এটি ডায়াবেটিক চাল হিসাবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করবে বলে আশা করা যায়। ব্রি ধান১০৫ এর ধান পাকার পরও এর গাছ সবুজ থাকে। এ জাতের পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১০১ সেমি.। গড় ফলন হেক্টরে ৭.৬ টন। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে অনুকূল পরিবেশে হেক্টর প্রতি ৮.৫ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতের দানার আকার ও আকৃতি মাঝারি সরু ও রং সোনালি। এর জীবনকাল ১৪৮ দিন। এই জাতের ১০০০টি ধানের দানার ওজন ১৯.৪ গ্রাম। ব্রি ধান১০৫ এর অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৭.০% এবং প্রেটিনের পরমিাণ ৭.৩%। রান্না করা ভাত ঝরঝরে এবং সুস্বাদু।
জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী ব্রি ধান১০৬ : আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী উচ্চফলনশীল ধানের জাত। এ জাতের ডিগপাতা খাড়া, প্রশস্ত ও লম্বা। পাতার রং গাঢ় সবুজ। এ জাতের গাছের গোড়ায় ও ধানের দানার মাথায় বেগুনি রং বিদ্যমান। এর গড় উচ্চতা ১২৫ সেমি.। এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৪.৭৯ টন, যা অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জনপ্রিয় জাত ব্রি ধান২৭ এর চেয়ে শতকরা ১৭.৪  বেশি। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রি ধান১০৬ এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৫.৪৯ টন পর্যন্ত পাওয়া যায়। নতুন জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি ঢলে পড়া প্রতিরোধী। ফলে গাছ হেলে পড়ে না। ধানের দানা মাঝারি মোটা এবং সোনালি বর্ণের। এ জাতের গড় জীবনকাল ১১৭ দিন। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন গড়ে ২৪.৫ গ্রাম। ধানের দানায় অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৭.২ এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৫। এই ধানের ভাত ঝরঝরে।
এ জাতের কৌলিক সারিটি নির্বাচনের পর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে তিন বছর এর ফলন পরীক্ষা করা হয়। পরে কৌলিক সারিটি আউশ ২০২০-২১ মৌসুমে দেশের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে কৃষকের মাঠে আঞ্চলিক উপযোগিতা যাচাই করা হয়। পরবর্তীতে ২০২১-২২ সালে কৌলিক সারিটি উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ এর গবেষণায় ঢলে পড়া প্রতিরোধী বলে বিবেচিত হওয়ায় ২০২২-২৩ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের ৬টি অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে কৃষকের মাঠে মূল্যায়ন করা হয়। এরপর জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মূল্যায়ন দল কর্তৃক ফলন পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় কৌলিক সারিটি আউশ মৌসুমের অলবণাক্ততা জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের উপযোগী উচ্চফলনশীল আউশ ধানের জাত হিসাবে চূড়ান্তভাবে ছাড়করণ করা হয়।
১১ মে.টন ফলনের জাত ব্রি হাইব্রিড ধান৮ : বোরো মৌসুমের উচ্চফলনশীল জাত। জাতটির ক্রস নাম্বার বিআর২৮২২এইচ। গাছের উচ্চতা ১১০-১১৫ সেমি.। প্রতি গোছায় গড় কুশির সংখ্যা ১০-১২টি। দানার পুষ্টতা ৮৮.৬%। জীবনকাল ১৪৫-১৪৮ দিন। ফলন প্রতি হেক্টরে ১০.৫-১১ মে.টন। বোরো মৌসুমে বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতি হেক্টরে ১.৮-২.২ মে.টন।
আগামী ২৩-২৪ অর্থবছর থেকে মাঠ পর্যায়ে এসব জাতের বীজ পাওয়া যাবে। প্রয়োজনে নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে হবে।

লেখক : ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর এবং পিএইচডি ফেলো, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেকৃবি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০, মোবাইল :smmomin80@gmail.com

বিস্তারিত
ভূউপরিস্থ পানি সংগ্রহ প্রযুক্তি

ভূউপরিস্থ পানি সংগ্রহ প্রযুক্তি
প্রকৌশলী মো: জিয়াউল হক
বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এবং নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে ছোটবড় প্রায় ৩২০টি নদ-নদী রয়েছে। তন্মধ্যে ৫৭টি আন্তদেশীয় নদ-নদী দেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়েছে। ভূউপরিস্থ পানিসম্পদ বলতে দেশের ওপর পতিত বৃষ্টিপাত এবং বহির্দেশ থেকে আগত জল প্রবাহকে বুঝায়। দেশে ভূউপরিস্থ মোট পানিসম্পদের পরিমাণ ১,৩৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম)। তন্মধ্যে নদ-নদীতে ১,০১০ বিসিএম এবং বাকি ৩৪০ বিসিএম বার্ষিক বৃষ্টিপাত (২০০০-২৫০০ মিমি)। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে ভূউপরিস্থ পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ ২৯ হাজার ঘনমিটার/সেকেন্ড এবং সর্বোচ্চ প্রবাহ ১৩৭.৭০ লক্ষ ঘনমিটার/সেকেন্ড। ভূউপরিস্থ পানি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) নদ-নদী, খাল-নালা, হাওর-বাঁওড় ও বিলে থাকে এবং পরবর্তীতে সাগর-মহাসাগরে পতিত হয়। তাই সারাবছর ভূউপরিস্থ পানি  কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সেচের অবদান অপরিসীম। দেশে খাদ্য উৎপাদনে দুই ধরনের সেচ কার্যক্রম প্রচলিত আছে-বৃহৎসেচ ও ক্ষুদ্রসেচ। রবি মৌসুমে ক্ষুদ্রসেচের মাধ্যমে দেশের সেচকৃত জমির প্রায় ৯৫% এবং বৃহৎ সেচের মাধ্যমে প্রায় ৫%। বর্তমান সরকার সেচ সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দক্ষ সেচ ব্যবস্থাপনায় সেচের পানির অপচয় রোধ করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ও সেচ খরচ হ্রাসের নিমিত্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেচ কাজে ভূউপরিস্থ পানির সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সারাদেশে ২০২০-২১ সেচমৌসুমে ভূউপরিস্থ পানির সেচ ২৭% এ উন্নিত হয়েছে। বর্তমানে ভূউপরিস্থ পানিসম্পদের ১.৩৪% সেচ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভূউপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধিতে নিন্মবর্ণিত প্রযুক্তি গ্রহণ করা যেতে পারে।
ড্রেজিং/খনন/পুনঃখনন/সংস্কার: ভরাট বা হাজামজা নদী, খাল-নালা, ডোবা-বিল, পুকুর ড্রেজিং/খনন/পুনঃখনন/সংস্কারের মাধ্যমে পানি প্রবাহের গভীরতা ও প্রস্থ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট জলাধারে ভূউপরিস্থ পানি প্রাপ্যতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ড্রেজার, ল্যান্ড বেইজড এক্সেভেটর এবং এ্যাম্ফিবিয়ান এক্সেভেটর মেশিন খনন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। উক্ত কার্যক্রমে কৃষি, মৎস্য, নৌ-চলাচল, ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণ বৃদ্ধি এবং  ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন হ্রাস পাচ্ছে। সেইসাথে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ এবং সেচ খরচ কমে যাচ্ছে। ফলে উপকূলীয় অধঃপতিত জমি সেচের আওতায় আনয়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণসহ আবাদি জমি, ফসলের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে এলাকাভেদে অনেক নদী/খাল/নালার পাড় গ্রামীণ রাস্তা এবং নৌপথে কৃষি যন্ত্রপাতি ও উৎপাদিত ফসল পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্ণিত কার্যক্রমে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি, এলজিইডি, বিএমডিএ ও মৎস্য অধিদপ্তর ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হচ্ছে।
রাবার ড্যাম : যে সকল ঝরণা/পাহাড়ি ছড়ায় সারাবছর কিছু না কিছু পানি প্রবাহিত হয়, সে সকল ঝরণা/পাহাড়ি ছড়া অথবা সমতল ভূমির অনুরূপ নদীতে আড়াআড়িভাবে আধুনিক প্রযুক্তির রাবার ড্যাম (জঁননবৎ উধস) নির্মাণ করা হয়। উক্ত প্রযুক্তিতে রাবার ব্যাগ পানি দিয়ে ফুলিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত উজানের পানি ধরে রাখা যায়। আবার অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যাগ হতে পানি নিষ্কাশন করলে মাটির সাথে মিশে যায়। ফলে বর্ষা মৌসুমে নৌ-চলাচলে অসুবিধা হয় না। ড্যাম নির্মাণের ফলে এলাকায় এক ফসলি জমি দু/তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর এবং ফসলের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। দেশে ইতোমধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ৬৯টি রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে।
হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম : যে সকল ঝরণা/পাহাড়ি ছড়ায় সারাবছর কিছু না কিছু পানি প্রবাহিত হয়, সে সকল ঝরণা/পাহাড়ি ছড়া অথবা সমতল ভূমির অনুরূপ নদীতে আড়াআড়িভাবে আধুনিক প্রযুক্তির হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণ করা হয়। উক্ত প্রযুক্তিতে কপাট বন্ধ করে নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত উজান বা ভাটির পানি ধরে রাখা যায়। রাবার ড্যামের তুলনায় হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি খুবই সহজ। এতে অতি অল্প সময়ে উজানের পানি আটকানো ও ছেড়ে দেয়া যায়। প্রয়োজনে ড্যামে আংশিক পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব। এ ড্যাম লবণ পানির অনুপ্রবেশ রোধেও কাজে লাগে। দেশে ইতোমধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ২টি হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে।
ঝিরিবাঁধ : দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বিস্তীর্র্ণ উঁচুনিচু ও গাছপালা, বন জঙ্গল বেষ্টিত পার্বত্য এলাকা। অসমতল, বন্ধুর ভূপ্রকৃতি ও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় মাঠ ফসল উৎপাদনের জন্য তেমন উপযোগী নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের উদ্যান জাতীয় ফসল উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড়ি ঝরনা বা ছড়ায় আড়াআড়ি যে মাটির বাঁধ নির্মাণ করা হয় তাকে ঝিরিবাঁধ বলে। উক্ত ঝিরিবাঁধের উজানে সৃষ্ট ছোট ছোট জলাধারের সাহায্যে পাহাড়ি এলাকার জমিতে সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধা প্রদান করা সম্ভব। পার্বত্য এলাকায় সর্বমোট ৮৬টি ঝিরিবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
সেচ অবকাঠামো : দেশের ভূউপরিস্থ পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নদ-নদী, খাল-নালায় আধুনিক প্রযুক্তির সেচ অবকাঠামো যেমন-সাবমার্জড ওয়ার, স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। সাবমার্জড ওয়ার নদী বা খালের আড়াআড়িতে পানির প্রবাহের নির্দিষ্ট উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়। ফলে উজানের পানি জলাধারে থাকার পর অতিরিক্ত পানি চলে যায়। অবকাঠামোটি পানির নিচে অবস্থান করে বলে সাবমার্জড ওয়ার বলে। আধুনিক প্রযুক্তির স্লুইসগেট দ্বারা ভূউপরিস্থ পানি ধরে রেখে জলাধার সৃষ্টি এবং নিষ্কাশন উভয় কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। সেচ অবকাঠামো নির্মাণের ফলে উৎপাদিত শস্য ও        কৃষি যন্ত্রপাতি পরিবহন, সেচ স্কিমে সেচের পানির প্রবাহ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে সহায়ক হয়।  
আইল ব্যবস্থাপনা : সমতল জমি চাষের প্রাক্কালে ১৫-২০ সেমি. উঁচু করে আইল বেঁধে বৃষ্টি/বন্যার পানি ধরে রেখে জলাধার তৈরি করা যেতে পারে। অথবা জমিতে ক্ষুদ্রাকার জলাধার নির্মাণের লক্ষ্যে জমির তুলনামূলক নিচু অংশে অথবা সুবিধাজনক স্থানে জলাধার নির্মাণ করা যায়। উভয় প্রযুক্তিতে কয়েক দিনের সেচ প্রদান করা সম্ভব।
বৃষ্টির পানি সংগ্রহ : পৃথিবীর পানিসম্পদের মধ্যে বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ, নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত। পানি সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং জনসংখার বৃদ্ধির মতো চলমান সমস্যাসমূহ মিটাতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ একটি পুনঃব্যবহার পদ্ধতি। বৃষ্টির পানিকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে পুনরায় ব্যবহারের নিমিত্ত জলাধার/ট্যাংকে সংরক্ষণ করাকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ বলে। সাধারণত পাতকুয়া, টিনের চালা/সসার বা ভবনের ছাদে বৃষ্টির পতিত পানি সংগ্রহ করে পাইপের মাধ্যমে ভূতল বা ভূপৃষ্ঠের জলাধার/ট্যাংকে জমা করা হয়। সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি প্রয়োজন অনুসারে খাবার, গৃহস্থালি ও বসতবাড়ির আঙ্গিনা বা ছাদে সেচ প্রদান করা যায়।
কৃষি প্রধান দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০% সরাসরি এবং প্রায় ৭৫% প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের ভূউপরিস্থ পানিসম্পদ, যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদনশীল রাখবে, তার নিরাপত্তা বিধানে আধুনিক লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে।

লেখক : সাবেক সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্রসেচ), বিএডিসি। এডাপ্ট রহমান গার্ডেন, ফ্ল্যাট নং ৭/এ, ২৭/২ পশ্চিম নাখালপাড়া, তেজগাঁও, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৮৭৮১৯৭৯, ই-মেইল :engrziaulhoque@gmail.com

বিস্তারিত
অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি

অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি
মো: আনোয়ারুল হক
আলু বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম একটি সবজি ফসল। ভাতের পর দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। বর্তমানে অন্য যে কোন শস্যের চেয়ে আলুর ফলন অনেক বেশি হয়। বাংলাদেশে এখন কম বেশি ৪০টি জাতের আলুর চাষাবাদ হচ্ছে। ১৯৯৫-১৯৯৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। ১৯৮০ সালে আলু উৎপাদন হতো মাত্র ৯ লক্ষ মে. টন। অথচ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৪.৬৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১১০.০০ লক্ষ মে. টন আলু উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে রপ্তানি করা হয় মাত্র ৮৪,২৪৩ মে. টন। সারা বছরে ভোগ চাহিদা ৭৭ লক্ষ মে. টন। চাহিদার তুলনায় দেশে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ প্রায় ৩০-৩৫ লক্ষ মে. টন। কিন্তু সারাদেশে মোট উৎপাদনের বিপরীতে ৩৯৪টি হিমাগারের সংরক্ষণ সুবিধার পরিমাণ মাত্র ৩১.৫৮ লক্ষ মে. টন।  
কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আলুর অধিক উৎপাদন হলেও কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসানের গ্লানি। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি, হিমাগারে সংরক্ষণের উচ্চ-ব্যয়, বসতবাড়িতে রাখার জায়গার অভাব এবং নগদ অর্থের প্রয়োজনে আলু চাষিরা ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতি বছর কম মূল্যে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়। উল্লিখিত মজুদ ও রপ্তানির তথ্য হতে এটি স্পষ্ট যে, অবশিষ্ট প্রায় ৮১.৯৬ লক্ষ মে.টন এর অধিক আলু কৃষক নিজ বাড়িতে যেনতেনভাবে সংরক্ষণ করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চকি, মাটি, বস্তা বা ঘরের আনাচে কানাচে মার্চ হতে জুন পর্যন্ত স্তূপ করে রাখে। ফলে ইঁদুর, পোকা মাকরের আক্রমণ ও ওজন হ্রাসসহ প্রায় ১৫-২০% সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হয়।  
প্রতি কেজি আলুর হিমাগারে সংরক্ষণ বাবদ ব্যয় ৬.০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। হিমাগার ভাড়ার সাথে পরিবহন, বস্তা ক্রয়, লোডিং, আনলোডিং ও ওজন বাবদ অতিরিক্ত ৪.০০ টাকা খরচ হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় (৬+৪)= ১০.০০ টাকা। বর্তমানে আলুর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ১০.০০ টাকা। এছাড়া হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য চাষিদেরকে যে ঋণ দেওয়া হয় তার সুদও পরিশোধ করতে হয়। ফলে আলুচাষিদের ন্যূনতম প্রতি কেজি আলু ২৫.০০-৩০.০০ টাকা বিক্রয় না করলে কোনভাবেই লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই।  
এ অবস্থার উত্তরণের জন্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে “আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন” প্রকল্পের মাধ্যমে অধিক আলু উৎপাদনকারী ১৬টি জেলায় বসতবাড়িতে স্বল্প খরচে ৪৫০টি অহিমায়িত মডেল ঘর নির্মাণপূর্বক অনুরূপ ঘর নির্মাণে উদ্বুদ্ধকরণ, আলু সংরক্ষণ কৌশল পদর্শন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অহিমায়িত পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ ইতোমধ্যে আলু চাষিদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।  
বসতবাড়ির উঁচু, খোলা ও আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে দেশীয় প্রযুক্তিতে বাঁশ, কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার দ্বারা (২৫′দ্ধ১৫′) ফুট সাইজের আলু সংরক্ষণের মডেল ঘর নির্মাণ করে আলু সংরক্ষণ করা যায় ফেব্রুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত। আলু সংরক্ষণের জন্য স্বাভাবিক তাপমাত্রা আংশিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রঙিন ঢেউটিনের ছাউনির নিচে ককশিট মডেল ঘরে ব্যবহার করতে হবে। মাটি থেকে ২.০ ফুট উঁচুতে বাঁশ দিয়ে তৈরিকৃত মাচা ৫৪টি ১০ ইঞ্চি ইটের পিলারের উপরে স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আলু সংরক্ষণের সময় মডেল ঘরের মাঝ বরাবর ০৫ ফুট পর পর একটি করে বাশের গ্যাসপাইপ স্থাপন করতে হবে। মডেল ঘরে আরও অধিক পরিমাণে বাতাস চলাচল করার জন্য বিশেষ কারিগর দ্বারা নির্মিত বাঁশের উন্নতমানের দৃষ্টিনন্দন বেড়া দিতে হবে। কৃষক খুব সহজে যেন ঘরে আলু সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্য বিশেষ সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। মডেল ঘরটি ৩০ মে. টন ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট হওয়ায় এর মূল অবকাঠামো যাতে ১৫-২০ বছর পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকে সেই বিবেচনায় সিমেন্টের পিলারের সংখ্যা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে হবে।
মডেল ঘরে চাষিরা আলু সংরক্ষণের পরবর্তী সময়ে (অফসিজনে) মিষ্টি কুমড়া, বাদাম, ভুট্টার আস্ত মোচা, পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ করতে পারবে। আলু উত্তোলনের পর এবং হিমাগারে মজুদকৃত আলু খালাসের মধ্যবর্তী (ফেব্রুয়ারি/মার্চ-মে/জুন) স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হিমাগারে সংরক্ষণ না করে বসতবাড়িতে এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করলে কৃষক উত্তোলন মৌসুম অপেক্ষা অধিক ম্ল্যূ প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।
মডেল ঘর নির্মাণ ও আলু সংরক্ষণে সতর্কতা : বসতবাড়িতে সুবিধাজনক উঁচু ও খোলা এবং আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে ঘরটি নির্মাণ করতে হবে যেখানে কোনরূপ স্যাঁতসে্যঁতে ভাব না থাকে; পর্যাপ্ত বতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে; উত্তোলনকৃত আলু সঠিকভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে কাটা, ফাটা, অপরিপক্ব, রোগযুক্ত ও ছাল ওঠা আলু না থাকে; সূর্যের অধিক তাপ ও বৃষ্টির পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে; আলু সংরক্ষণের ৩ (তিন) দিন পূর্বে পোকা মাকড় ও সুতলি পোকার আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হবে; মডেল ঘর নির্মাণের পূর্বে উক্ত স্থানে ন্যূনতম ১২-১৩ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি কেটে নিয়ে কমপ্যাক্ট করে নিতে হবে। যাতে অতি বৃষ্টিতে ঘরের কোন ক্ষতি না হয়; মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের সময় বস্তাবিহীন অবস্থায় মাচা হতে ৫ ফিট উঁচু পর্যন্ত ২৫-৩০ মে. টন আলু সাধারণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হবে।

লেখক : প্রকল্প পরিচালক, আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্প। খামারবাড়ি, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৫৭৮৬৮২৮৭, ই-মেইল :shahadatbau@gmail.com

বিস্তারিত
পাট পচনে পানির ঘাটতি সমাধানে মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম একটি বিকল্প উদ্ভাবনী প্রযুক্তি

পাট পচনে পানির ঘাটতি সমাধানে মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম একটি বিকল্প উদ্ভাবনী প্রযুক্তি
ড. জাকারিয়া আহমেদ
পাটের কা-ের কাঠের অ-তন্তুযুক্ত (পেকটিন ও অন্যান্য মিউকিলাজিনাস) পদার্থ থেকে আঁশগুলোকে আলাদা করার প্রক্রিয়াকে পাট পচন বা রেটিং বলা হয়। এটি একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন আঁশ গ্রুপের জীবাণুর ক্রিয়া দ্বারা সঞ্চালিত হয়। পাট পচনের সময় বাংলাদেশের কিছু এলাকা বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, পানির অভাব দেখা দেয়। এ কারণে মৌসুমে পাট কাটার তীব্র সংকটে পড়ে কৃষকরা। পাটের সবুজ আঁশ শুকিয়ে সংরক্ষণ করে, পরে যদি শুকনো ছাল থেকে একই মানের আঁশ পাওয়া যায় তবে শুকনো বা সংরক্ষিত আঁশগুলো চাষের জন্য সহায়ক হতে পারে এবং পানির অভাবজনিত সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধান করা যায়। সাধারণত ধীরগতিতে চলমান পানিতে পাট পচন করা সবচেয়ে ভালো। স্থির পানিতে নিকৃষ্ট মানের আঁশ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকে, যদি না প্রতিবার পচন করার পর বিশুদ্ধ পানি এবং জীবাণুর জন্য অনুকূল ব্যবস্থা করা হয়। এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে, আঁশ পাওয়ার জন্য অণুজীব ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া ব্যবহার একটি বিকল্প পাট পচন কৌশল হতে পারে।
অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া হলো জীবম-লজুড়ে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণ। এই অণুজীবগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে এবং তাদের এনজাইম উৎপাদন ক্ষমতার ভিত্তিতে অণুজীব (মাইক্রোবিয়াল) ইনোকুলাম/কনসোর্টিয়া প্রণয়ন করা যেতে পারে। এই ইনোকুলামগুলো শুকনো বা সংরক্ষিত ছালের উপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাইক্রোবিয়াল ফর্মুলেশন শুধুমাত্র পাট পচন এর সময়কাল কমানোর জন্যই নয় বরং আঁশ/ফাইবারের মানের অন্তত দুই থেকে তিন গ্রেডের উন্নতির জন্যও উপযুক্ত বলে মনে করা হয় ।
অতএব, মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়া ব্যবহার করে সংরক্ষিত বা শুকনো পাটের ছাল থেকে রেটিং/ফাইবার নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার বিকাশের জন্য পানির অভাব এলাকায় বা পানির অভাবের সময় পাটের বিকল্প কৌশল হতে পারে। ইনোকুলাম ফর্মুলেশন এবং ডেভেলপমেন্ট হলো একটি সুপ্ত স্টক কালচার থেকে অণুজীবের জনসংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অণুজীবের একটি জনসংখ্যা প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া, যা একটি চূড়ান্ত উৎপাদনশীল পর্যায়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধারণাটি শুধুমাত্র অণুজীবের ইনোকুলামের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রেই নয়, বরং বিশুদ্ধ অণুজীবের বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নি¤েœাক্ত কৌশল পাট কাটার জন্য পানির অভাবের একটি চমৎকার প্রযুক্তি :  
   আঁশ সংগ্রহের জন্য মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম তৈরি করে দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং পাট পচন মৌসুমে পানির স্বল্পতা পরিলক্ষিত হলে, পাট চাষি মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম সংগ্রহকৃত পাটে খুব সামান্য পানিতে ছিটানো মাধ্যমে পাট আঁশগুলোকে সহজেই আলাদা করতে সক্ষম হবে।     
     লাইফোলাইজেশন (শুষ্ক সুপ্ত মাইক্রোবিয়াল পাউডার) কৌশল ব্যবহার মাধ্যমে পাউডার আকারে মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়ার তৈরি করে প্যাকেটজাত অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং প্রয়োজনে পানির স্বল্পতা এলাকায় পাট বা পাটের রিবন থেকে আঁশ সংগ্রহ করতে সহায়তা করবে।      
   পাট পচনের উপযুক্ত মাইক্রোবিয়াল এনজাইমগুলোকে নির্বাচন করে, নির্বাচিত এনজাইমের বিট বা গুটি (এনজাইমের আধার) তৈরি করা সম্ভব, যা পাটের বা পাটের রিবন থেকে আঁশ সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনে বারবার ব্যবহার করা যেতে পারে।   
অতএব, যেহেতু মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম (বোতলজাত অবস্থায়), লাইফোলাইজড মাইক্রোবিয়াল কনসোর্টিয়া (প্যাকেটজাত অবস্থায়) বা এনজাইমের বিট (প্যাকেটজাত অবস্থায়) দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করা যায়; তাই এইগুলোকে  কৃষকদের মাঝে বিপণনের মাধ্যমে পানির অভাবজনিত পাট পচন সমস্যা অনেকাংশে কাটিয়ে উঠা সম্ভব। এই অভিনব কৌশল পাট চাষিদের, তথা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরির মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা ১২০৭, বাংলাদেশ। মোবাইল : ০১৯৬৯৬৯৯৮৫১; ই-মেইল :zakaria.ahmed70@gmail.com

বিস্তারিত
বাউ মুরগি পালন পদ্ধতি

বাউ মুরগি পালন পদ্ধতি
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা একান্ত প্রয়োজন। পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে মুরগি প্রধান ভূমিকা পালন করছে। দেশে মাংসজাত মুরগির উৎপাদন শিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশে ভোক্তাদের একটি অংশ নরম ব্রয়লার মাংসের চেয়ে শক্ত মুরগির মাংস পছন্দ করেন। এ কারণে দেশে শক্ত মাংসের মুরগির চাহিদা বেশি। শক্ত মুরগির মাংস সাধারণত দেশি মুরগি, সোনালী ও অন্যান্য শংকর মুরগি থেকে আসে। তবে অসুবিধে হলো এ জাতীয় মুরগির বৃদ্ধি ও খাদ্য দক্ষতা কম এবং উৎপাদন খরচ বেশি।
শক্ত ও দেশীয় স্বাদের মাংসজাত মুরগির চাহিদা মেটাতে ‘বাউ মুরগি’ (ইঅট-পযরপশবহ) নামে একটি নতুন জাতের মুরগি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ মুরগির মাংস দেশি মুরগির মতোই শক্ত ও মুখরোচক। এ মুরগি অন্যান্য মুরগির তুলনায় খাদ্য দক্ষতা (ঋঈজ), ওজন বৃদ্ধি, অভিযোজন যোগ্যতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উচ্চতর। তাই কম খরচে দেশীয় আবহাওয়ায় ‘বাউ মুরগি’ লাভজনকভাবে পালন করা সম্ভব।
বাউ মুরগির উৎপাদন বৈশিষ্ট্য : বাউ মুরগি দেখতে ও খেতে দেশি মুরগির মতো; ছয় সপ্তাহে বাউ মুরগির গড় ওজন ১১০০+৫৮ গ্রাম; বেঁচে থাকার হার ৯৭-৯৮%; খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (ঋঈজ) ১.৯৫-২.১০ তাই উৎপাদন খরচ কম; বাউ মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি; বাজারজাতকরণের বয়স ৪৫-৪৯ দিন; একদিন বয়সের বাচ্চার ওজন ৩৬+৪ গ্রাম।
বাউ মুরগি পালন পদ্ধতি : বাউ মুরগি পালন পদ্ধতি, সোনালী ও ব্রয়লার মুরগি পালনের মতোই। প্রতিটি মুরগির জন্য ১ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। এ মুরগি লিটার অথবা মাচা পদ্ধতিতে পালন উপযোগী।
মুরগির ঘর : বাচ্চা উঠানোর পূর্বে ঘর জীবাণুমুক্ত করতে হবে; পুরাতন লিটার ভালোভাবে পরিষ্কার করে ৫০০ মিটার দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে; ঘরের পর্দা, মাকড়সার জাল, ফিডার, ড্রিংকার ভালোভাবে ধূয়ে জীবাণুনাশক দ্বারা জীবাণুমুক্ত করতে হবে; ২-৩ বার ঘর ধুতে হবে; ঘরের কোথাও ভাঙা, ফাঁটা থাকলে মেরামত করতে হবে; সেডের মেঝে মাটির হলে ২-৩ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি চেছে তুলে ফেলে দিয়ে নতুন মাটি দিয়ে লেপে দিতে হবে। চুন ও পানি মিশিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে ৭-১৪ দিন রেখে দিতে হবে; ঘরের চারপাশের ঝোপঝাড় চেছে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ৩ ফুট দূর দিয়ে বেড়া দিতে হবে; বাচ্চা ব্রুডিংয়ের একদিন আগে তুষ বিছাতে হবে এবং জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে; বাচ্চা ব্রুডিং করার ২-৩ দিন আগে থেকেই ফুটপাথে জীবাণুনাশক রাখতে হবে। ঘরের চতুপার্শ্বে জীবাণুনাশক অথবা ৫% ফরমালিন স্প্রে করতে হবে।
ব্রুডিং প্রস্তুতি : বাচ্চা উঠানোর ১ দিন পূর্বে লিটার (তুষ) বিছিয়ে গরম করার ব্যবস্থা করতে হবে; ঘরের পর্দার উপরের অংশ ৬-১২ ইঞ্চি পরিমাণ খোলা রাখতে হবে; লিটারের উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে দিতে হবে; চিক গার্ড গোলাকার করে তৈরি করতে হবে, তা না হলে বাচ্চা একদিকে জড়ো হয়ে থাকবে; হোভার গোলাকার চিকগার্ডের মাঝখানে রাখতে হবে; ব্রুডারে বাচ্চা ছাড়ার ৬ ঘণ্টা আগে উপযুক্ত তাপমাত্রা অর্থাৎ ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৩০ঈ) এ আনতে হবে এবং ২ ঘণ্টা পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ০.২৫ গ্রাম গ্লুকোজ ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে; বাচ্চা ফোটার পর প্রতি ১ ঘণ্টায় ০.১ গ্রাম করে ওজন হারাতে থাকে তাই এ সময় গ্লুকোজ পানির সহিত পরিচয় করে দেয়া উচিত। গ্লুকোজ পানিতে বাচ্চার ঠোঁট চুবিয়ে দিতে হবে।
ব্রুডিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
ব্রুডিং ঘর : বাউ মুরগি ৪২-৪৭ দিনেই বাজারজাত করা হয়। এ কারণে আলাদা ঘরের প্রয়োজন হয় না।
হোভার : টিন বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা যায় ৩ ফুট ব্যাসের হোভারের নিচে ১৫০-২০০টি বাচ্চা রাখা যাবে।
চিক গার্ড : ১.৫ ফুট উঁচু চাটাই বা হার্ডবোর্ডের তৈরি এবং  ৯-১০ ফুট ব্যাসের একটি চিক গার্ডে ৩০০-৪০০টি বাচ্চা ব্রুডিং করা যাবে।
খাবার পাত্র : প্রথম ১-২ দিন পাত্রের পাশাপাশি কাগজের উপর খাদ্য দিতে হবে। ১ম সপ্তাহে ২ ঘণ্টা পরপর খাবার সরবরাহ করতে হবে।
পানির পাত্র : বাচ্চার জন্য ছোট প্লাস্টিকের পানির পাত্র পাওয়া যায়। সকালে ও বিকেলে পাত্র পরিষ্কার করতে হবে।
আলো ব্যবস্থাপনা : পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বাচ্চা খাবার ও পানির পাত্র দেখতে পারে। রাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে আলো প্রদান করতে হবে।
বায়ু চলাচল ব্যবস্থাপনা : ব্রুডার ঘরে বায়ু চলাচল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দূষিত বায়ু নিষ্কাশন ও নির্মল বায়ু সরবরাহ একান্ত প্রয়োজন। বাচ্চার মলমূত্র হতে সৃষ্ট অ্যামোনিয়া গ্যাস বাচ্চার ঘরে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে।
৫০০টি বাচ্চা ব্রুডিং করতে ১২ ফুট ব্যাসের ১টি, ৫ ফুট ব্যাসের হোভার ১টি, চিক ফিডার ১৫টি, চিক ড্রিংকার ১০টি, গ্যাস ব্রুডার ১টি প্রয়োজন। গরমকালে লিটার পুরুত্ব হবে ২ ইঞ্চি। শীতকালে ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে দিতে হবে। বাল্ব ব্রুডিং করলে গরমকালে ১০০ ওয়াটের ২টি এবং ৬০ ওয়াটের ১টি। শীতকালে ২০০ ওয়াটের ২টি এবং ১০০ ওয়াটের ২টি বাল্ব সেট করতে হবে।
এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে বাচ্চার ওজন নিতে হবে। ৩ সপ্তাহ বয়স হলে ছোট/দুর্বল বাচ্চাকে আলাদা রেখে খাবার প্রদান করতে হবে। ৪ দিন পরপর মাল্টিভিটামিন দিলে ভালো হয়। ১-২১ দিন ব্রয়লার স্টার্টার খাদ্য, ২২-৪২ দিন পর্যন্ত ব্রয়লার গ্রোয়ার খাদ্য এবং ৪৩ দিন হতে বাজারজাত করা পর্যন্ত ফিনিশার খাদ্য খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
বাউ মুরগির প্রাপ্তিস্থান : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ থেকে সংগ্রহ করা যাবে। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন- প্রফেসর ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা, পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়।
লেখক : প্রাণি চিকিৎসক ও পোল্ট্রি কনসালট্যান্ট ভেটেরিনারি অফিসার, জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতাল, ঝিনাইদহ। মোবাইল : ০১৭১৫২৭১০২৬। ই-মেইল :drmorojit66@gmail.com

বিস্তারিত
মাছ থেকে বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ উদ্ভাবন

মাছ থেকে বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ উদ্ভাবন
মোঃ মাসুদ রানা
আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূল্যবান কৃষিজ পণ্য। বর্তমানে এ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মৎস্য সেক্টরের সাথে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং প্রতিবছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক লোকের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমোচন, রপ্তানি আয় তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান তাৎপর্যপূর্ন। প্রাণিজ আমিষের ৬০% আসে মাছ থেকে, জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৫% এবং রপ্তানি আয়ের ১.২৩% আসে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য হতে।
বর্তমানে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতি বছর লক্ষ্য মাত্রা হতে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঙ্গাস, সিলভারকার্প ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন হার বেশি কিন্তু ভোক্তাদের চাহিদা ও বাজারদর দিন দিন কমতে থাকায় চাষিরা তুলনামূলক কম মূল্যের এই সকল জাতের মাছ চাষ থেকে দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অথচ তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও সিলভার কার্প মাছ গুলো পুষ্টিগুণে অনন্য কিন্তু ভোক্তাদের রুচির পরিবর্তন হওয়ায় মাছগুলোর বাজারদর কম। বিশেষ করে পাঙ্গাস ও সিলভার কার্প মাছের চাহিদা দিন দিন কমছে। এ জন্য মাছ চাষে তেমন আগ্রহ দেখায় না চাষিরা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং মাছ চাষিদের উৎপাদনে আগ্রহ বাড়াতে এসব মাছের বাড়তি মূল্য সংযোজনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
তুলনামূলক কম মূল্যের মাছগুলোর প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধি ও মূল্য সংযোজন পণ্য (ভ্যালু এডেড পণ্য) উৎপাদন করতে না পারলে তুলনামূলক কম মূল্যের কিন্তু অধিক উৎপাদনশীল মাছগুলো এক সময় চাষি পর্যায়ে পাওয়া যাবে না। এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, একোয়াকালচার এ- মেরিন সায়েন্স অনুষদের গবেষণার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট গবেষকবৃন্দ তুলনামূলক কমমূল্যের এই মাছগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে মাছের পাউডার তৈরি করে তা থেকে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ কুকিজ ও স্ন্যাক্স যেমন- বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ উদ্ভাবন করেছেন যা বাজারে প্রাপ্ত সাধারণ বিস্কুট, চানাচুর এবং চিপস্ এর তুলনায় মানসম্পন্ন পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করবে।
উক্ত গবেষণায় তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, সিলভার কার্প ও টুনা মাছ থেকে ৮০-৯০% প্রোটিনযুক্ত (শুকনো ভিত্তি) মাছের গুঁড়া (ফিশ পাউডার) উৎপাদন করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। সেসাথে মাছের দেহ থেকে ফ্যাট বা চর্বি অপসারণ করা হয় যেন তা পণ্যের জারণ (ফ্যাট অক্সিডেশন) ক্রিয়াকে প্রতিহত করে এর যথাযথ পুষ্টি মান বজায় রাখে। অতপর এই চর্বিমুক্ত ও প্রোটিনযুক্ত ফিশ পাউডার থেকে ৩০-৪০% প্রোটিনযুক্ত বিস্কুট, চানাচুর ও চিপস তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে উদ্ভাবিত পণ্যগুলো একটি লম্বা সময় মজুদ করে বা সংরক্ষিত রেখে তা থেকে নমুনা নিয়ে দেখা গেছে যে এতে অনুজীবের সংখ্যা মানব দেহে অনুমোদিত/সহনীয় মাত্রার মধ্যে ছিল এবং এদের পুষ্টির পরিমাণেরও তেমন পরিবর্তন হয়নি।  
উদ্ভাবিত এ খাবারগুলো (কুকিজ ও স্ন্যাক্স) যে কোন সময়ে খাবার উপযোগী মোড়ক জাত বাজার পণ্য হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন, বাজারজাত ও সরবরাহ করা সম্ভব। এর সুফল হিসেবে চাষি পর্যায়ে ভালো বিক্রয় মূল্য পাওয়ার কারণে পাঙ্গাস, সিলভার কার্প এবং তেলাপিয়া জাতীয় তুলনামূলক কমমূল্যের মাছগুলো উৎপাদনে আগ্রহ বাড়বে। তাছাড়াও পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং প্রাণীজ আমিষ সমৃদ্ধ জনপ্রিয় এই পণ্যগুলো ছোট ছেলেমেয়েদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং গর্ভবতী নারীদের পুষ্টির সংকুলানেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ছাড়াও উদ্ভাবিত পণ্যগুলো রপ্তানি করে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব বলে গবেষকরা মনে করেন।
আবার খাদ্যের নিরাপত্তার (ভড়ড়ফ ংধভবঃু) দিক বিবেচনা করলে সাধারণত বাজারে প্রাপ্ত কুকিজ এবং ¯œ্যাক্সগুলো মূলত ময়দা, লবণ, চিনি, মাখন, ডিম, তেল এবং কিছু অতিরিক্ত সুগন্ধি দিয়ে তৈরি করা হয়। আমাদের প্রতিদিনের নিয়মিত গ্রহণ করা আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে সাদা স্টার্চ রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায় যা যকৃতের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফলস্বরূপ লিভারের দূষিত পদার্থ অপসারণ থেকে বিরত রাখে। ফলে ফ্যাটি লিভার নামক রোগের আশংকা তৈরি হয়। মাছের আমিষ ভিত্তিক খাদ্য মানব দেহের জন্য কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার তুলনায় অধিক পুষ্টিকর এবং নিরাপদ।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭৪৫৬২৬১৫৩, ই-মেইল :ranadof.bd@gmail.com

 

বিস্তারিত
পরিবেশ সুরক্ষা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু বৃক্ষরোপণ

পরিবেশ সুরক্ষা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু বৃক্ষরোপণ
ড. আসম হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ সিদ্দীকি
বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সুরক্ষা শব্দ দুটি সকলের অতি পরিচিত। জনজচেতনতা মূলক উক্তি, গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান। আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ আজ অসুস্থ। অসুস্থ পরিবেশ সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমাতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আজ মরণ দশায় পরিণত হয়েছে। বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ক্লরোফ্লোরো কার্বনের (ঈঋঈ) মাত্রা অধিক, ওজনস্তরে ফুটো হয়ে যাওয়া, বাতাসে সিসার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ার ফলে নিশ্বাসে বিষ ঢুকে মানব শরীরে ক্যান্সারের নানাবিধ রোগব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। গাছই একমাত্র নিয়ামক যা বাতাসের বিভিন্ন ক্ষতিকারক বর্জ্য শোধন করে বাতাস পরিশীলিত করে বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে পারে।
সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নির্মল পরিবেশ প্রয়োজন। পৃথিবীর পরিবেশ সুরক্ষায় গাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গাছ বায়ুম-ল হতে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঈঙ২ গ্রহণ করে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য তৈরি করে এবং ঙ২ ত্যাগ করে বাতাস শুদ্ধ করে; বাতাসের উষ্ণতা কমায় এবং পরিবেশের মধ্যে মেঘ বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়া সৃষ্টি করে।
মরুর বুকে গাছ নেই। সেখানে বৃষ্টি  বাদল হয় না। আবার যেখানে অধিক গাছপালা ও বনাঞ্চল সেখানে প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাত হয়। ভারতের চেরাপুঞ্জি এলাকায় কখনও কখনও দিনে ১৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে অধিক গাছ, পাহাড় ও বনভূমি থাকার কারণে এ অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গাছের সাথে বৃষ্টি ও পরিশীলিত পরিবেশ ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং গাছ যেখানে নাই সেখানে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমনের জন্যও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রকৃতিকে শান্ত রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৩টি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ২০ লাখ লোকের এবং কৃষি ও অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত খরার কারণে প্রায় ২২ লাখ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছে এবং বন্যার কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। বিগত ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে প্রায় ৪ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। যাহোক গাছপালা কমে যাওয়ায় পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজান ধ্বংস হওয়াই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাচ্ছে এবং পরিবেশ রুক্ষ হচ্ছে। কাজেই বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবেশ টেকসই করতে হবে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুন্দরবনের অবস্থান। উপকূলীয় এলাকায় সুন্দরবনের পানিতে এখন লবণের পরিমাণ অনেক বেশি কোথাও কোথাও ২৮ পিপিটি পর্যন্ত লবণের মাত্রা। গাছ বেশি লবণ সহ্য করতে পারে না। সুন্দরবনের কতিপয় প্রজাতি যেমন- গেওয়া গরান, গোলপাতা, খলসি, কেওড়া বাইন, ধুন্দুল, ঝানা প্রভৃতি বৃক্ষ লবণসহিষ্ণু। সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী, পশুর, আমুর লবণাক্ততার কারণে আগামরাসহ বিভিন্ন পরিবেশীয় কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে কারণে সুন্দরবন হতে অনেক প্রজাতির বৃক্ষ সম্পদ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু আবার বিরল এবং কিছু  বা বিপদাপন্ন হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। গাছের ন্যায় পরিবেশীয় কারণে অনেক প্রজাতির প্রাণিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে যা বিরল ও বিপদাপন্ন হচ্ছে। বন্য প্রাণির খাবারের ও মারাত্মক সংকট হচ্ছে।
এ সকল দিক বিবেচনা করে উপকূলীয় অঞ্চলের ফাঁকা জায়গায় বাড়ি ঘরের আশে পাশে নতুন চরাঞ্চলে লবণসহিষ্ণু গাছপালা রোপণের মাধ্যমে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সকল প্রকার টক ফল যেমন- আমড়া, পেয়ারা, লেবু, কামরাঙ্গা, জলপাই, আম, তেঁতুল, কুল, তাল, খেজুরসহ নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি লবণসহিষ্ণু প্রজাতির গাছ রোপণ করে পরিবেশ প্রচ্ছন্ন করে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। বরফ গলন কমাতে হবে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা হ্রাস করতে হবে, পৃথিবী একটাই একে সুস্থ রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে প্রত্যেকে ২টি করে গাছ লাগাতে হবে। পৃথিবীর উষ্ণতা কমিয়ে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : বিভাগীয় কর্মকর্তা, ম্যানগ্রোভ সিলভিকালচার বিভাগ, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, খুলনা। মোবাইল নং-০১৭১৮৫০৩৪৪৯।  ই-মেইল : dr.helalfri@gmail.com

বিস্তারিত
লিচুর ক্ষতিকর পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা

লিচুর ক্ষতিকর পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার প্রধান
লিচু বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু ফল। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে ১৩.৬ গ্রাম শর্করা, ০.৫ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ০.৫ গ্রাম আশ, ১.১ গ্রাম আমিষ, ০.২ গ্রাম চর্বি, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৭ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.২ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২, ৩১ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি এবং ৮৪.১ গ্রাম জলীয় অংশ রয়েছে। লিচুতে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণ করে থাকে। ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণে মাঠে লিচুর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হয়ে যায়। দেশের অধিকাংশ কৃষক এসব ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে দীর্ঘস্থায়ী বালাইনাশক প্রয়োগ করেন এবং বালাইনাশকের অপেক্ষমান সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই ফল সংগ্রহ ও বাজারজাত করেন। যেহেতু লিচু সরাসরি ভক্ষণ করা হয় এজন্য বালাইনাশক নির্বাচন ও প্রয়োগের সময় সঠিক না হলে এর অবশিষ্টাংশ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় ক্ষতিকর পোকামাকড় হতে লিচু ফসল রক্ষার জন্য এদের আক্রমণের ধরন ও  সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত জরুরি। নি¤েœ লিচুর প্রধান প্রধান পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং এদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
ফল ছিদ্রকারী পোকা : এটি লিচুর একটি অন্যতম প্রধান ক্ষতিকর পোকা। স্ত্রী পোকা বাড়ন্ত ফলের বোটার কাছে খোসার নিচে ডিম পাড়ে। সদ্যজাত লার্ভা দুধের ন্যায় সাদা, লম্বাটে, মাথা হালকা বাদামি বর্ণের, এরা বোঁটার নিকট দিয়ে ফল ছিদ্র করে ফলের পালপ খায় এবং বীজে আক্রমণ করে। আক্রান্ত ফলের বোটার কাছে কালো দাগ ও করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া দেখা যায়। ফল খাওয়ার অনুপযোগী ও ফেটে যায়। পূর্ণতাপ্রাপ্ত লার্ভা ফল থেকে বের হয়ে আসে এবং সাধারণত পুরাতন পাতায় কোকুন তৈরি করে পিউপায় পরিনত হয়। উচ্চ আপেক্ষিক আর্দ্রতা (বিশেষ করে ফল পরিপক্বতার সময়) ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতে এদের আক্রমণ বেশি হয়।
ব্যবস্থাপনা : পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে; মাটিতে পতিত এবং গাছে আক্রান্ত ফল লার্ভাসহ নষ্ট করতে হবে; ফলের থোকা মশারীর নেট অথবা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে স্ত্রী পোকা ডিম না পাড়তে পারে; গাছে ফুল আসার পূর্বে নিম তেল (৪ মিলি/ লিটার) স্প্রে করা যেতে পারে। এতে স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়; ফল ধারনের ১০ দিন পর ফলের আকার মটর দানার মতো হলে ইমিডাক্লোরপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক (১ মিলি/লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে ফুল ফোটার পর থেকে ফল ধারন পর্যন্ত স্প্রে করা যাবে না কারণ এতে পরাগায়ন বিঘিœত হতে পারে। বিকেল বেলা স্প্রে করা উত্তম।
পাতা মোড়ানো পোকা : পোকার লার্ভা পাতা মুড়িয়ে ফেলে ভেতরে অবস্থান করে খায়। গাছে নতুন পাতা বের হওয়ার পর এরা পাতায় আক্রমণ করে। অতিরিক্ত আক্রমণে গাছের সম্পূর্ণ নতুন পাতা আক্রান্ত হতে পারে। গাছের খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় ও ফলন কমে যায়। স্ত্রী পোকা পাতায় একটি একটি করে ডিম পাড়ে। মাটিতে পতিত পাতায় এরা পিউপা ধাপ সম্পন্ন করে। ডিম, লার্ভা ও পিউপা ধাপ যথাক্রমে ৩,১৬ ও ১১ দিন হয়ে থাকে ।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত ডগা লার্ভাসহ নষ্ট করতে হবে; মোড়ানো পাতা লার্ভাসহ সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে; অত্যধিক আক্রমণে স্পাইনোসেড (০.৪ মিলি/ লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
পাতা জড়ানো পোকা : পোকার লার্ভা পাতার পুষ্পমঞ্জরি, শীর্ষস্থ অংশ, ফলের বোঁটা ও কচি ফলে আক্রমণ করে। এরা সাধারণত পুষ্পমঞ্জরি ও ফলের বোটকে জড়িয়ে ফেলে ভেতরে অবস্থান করে এবং রস চুষে খায়। এরা সিল্ক জাতীয় এক ধরনের সুতা নিঃসরণ করে সমস্ত অংশকে একত্র করে। অতিরিক্ত আক্রমনে গাছের পুষ্পমঞ্জরি শুকিয়ে খড়ের মতো হয়ে যায় এবং ফল ধারণ সম্পূর্ণরূপে ব্যহত হয়। এরা কচি ফলগুলোকেও জড়িয়ে ফেলে, আক্রান্ত কচি ফল ঝরে পড়ে। জড়ানো অংশের ভেতরে এরা রেশমি কোকুনের ভিতরে পিউপা ধাপ সম্পন্ন করে।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত অংশ লার্ভা ও পিউপাসহ নষ্ট করে ফেলতে হবে। অত্যধিক আক্রমণে স্পাইনোসেড (০.৪ মিলি/ লিটার)/ ইমিডাক্লোরপ্রিড (১ মিলি /লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
লুপার : বাংলাদেশে সম্প্রতি এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে।  লার্ভা গাছের নতুন কচি পাতায় আক্রমণ করে মধ্য শিরা ব্যতীত সম্পূর্ণ অংশ খেয়ে ফেলে । এরা গাছের শীর্ষস্থ অংশ, কচি ফুল ও ফলের নরম বোটাতেও আক্রমণ করে। অতিরিক্ত আক্রমণে গাছের সব নতুন পাতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।  লার্ভার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে।  এরা প্রাকৃতিক শক্রু হতে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনে গাছে নিশ্চুপ কাঠির মতো অবস্থান করে, দেখে মনে হয় যেন একটি মরা শাখা। স্ত্রী পোকা পাতার নিচের দিকে ডিম পাড়ে যা ৪-৫ দিন পর ফুটে সদ্যজাত লার্ভায় পরিণত হয়। লার্ভা ধাপ ৯-১৩ দিন। লার্ভার চলাচলের পদ্ধতির জন্য এদের লুপার বলা হয়। এরা দেহের সামনের অংশের ৩ জোড়া প্রকৃত পা এবং পেটের ষষ্ট ও দশম খ-াংশে অবস্থিত ২ জোড়া প্রলেগের (চৎড়ষবম) মাধ্যমে সামনের দিকে ধাবিত হয় ফলে চলার সময় লুপ তৈরি হয়। পিউপা ধাপ ৬-৭ দিন।  এরা পাতার উপরের অংশে রেশমি সুতার সাহায্যে পিউপা ধাপ সম্পন্ন করে যা বাহির থেকে দেখা যায়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা ২-৩ দিন বাচে।
ব্যবস্থাপনা :  আক্রান্ত গাছ থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে;  এরা পাতায় পিউপা ধাপ সম্পন্ন করে যা বাহির থেকে দেখা যায়, পিউপা গুলি সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে; অত্যাধিক আক্রমণে স্পাইনোসেড (০.৪ মিলি/লিটার) অথবা ক্লোরফিনাপির (১ মিলি/লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
লাল উইভিল পোকা :  উইভিল দেখতে উজ্জ্বল বাদামি লাল বর্ণের, ৫-৭ মিলিমিটার লম্বা এবং লম্বাটে শুঁড় বিশিষ্ট। এরা গাছের নতুন পাতার উপরিভাগ ছিদ্র করে খায় ফলে পাতায় ঠোকরানোর মতো অনিয়মিত হালকা গর্ত দেখা যায়। এরা নরম কচি কা-েও আক্রমণ করে। অতিরিক্ত আক্রমণে ব্যাপকভাবে কচি পাতা ও বাড়ন্ত ডগা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। নতুন স্থাপিত বাগান ও চারা গাছেও এদের আক্রমণ দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত শাখার নিচে উল্টানো ছাতা বা বড় পলিথিন ব্যাগ রেখে জোরে ঝাঁকি দিলে পোকা নিচে পড়ে, পতিত পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে; অত্যধিক আক্রমণে স্পাইনোমেড (০.৪ মিলি/লিটার অথবা ক্লোরাফিনাপির (১ মিলি/লিটার) অথবা ডাইমেথোয়েট (২ মিলি/লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে-
পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ঃ লার্ভা পাতার উপত্বকের নিচে আঁকাবাঁকা সুরঙ্গ করে সবুজ অংশ খায়। পাতা কুঁকড়ে বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনা :  আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে; আঠালো হলুদ ফাঁদ প্রয়োগ করতে হবে; জৈব বালাইনাশক বায়োম্যাক্স এম ১.২ ইসি (১ মিলি/লিটার) অথবা স্পাইনোসেড (ট্রেসার ৪৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৪০ মিলি অথবা সাকসেস ১.২ মিলি) ¯েপ্র করতে হবে।
বাগঃ নিমফ ও পূর্ণবয়স্ক পোকা গাছের শীর্ষস্থ কচি অংশ, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত কুড়ি, পাতার বোটা, পুষ্পমঞ্জরি ও কচি ফল থেকে রস চুষে খায়। অতিরিক্ত আক্রমণে বর্ধনশীল কুড়ি ও শীর্ষস্থ শাখা শুকিয়ে যায় । এরা কচি ফল থেকেও রস চুষে খায়। গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও ফলন কমে যায়। স্ত্রী পোকা পাতার নিচের দিকে গুচ্ছাকারে প্রতি গুচ্ছে ১৪টি ডিম পাড়ে।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত শাখার নিচে উল্টানো ছাতা বা বড় পলিথিন ব্যাগ রেখে জোরে ঝাঁকি দিলে পোকা নিচে পড়ে, পতিত পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে; পাতায় পোকার ডিমের গুচ্ছ দেখা যায়, যা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হয়; অত্যধিক আক্রমণে স্পাইনোসেড (০.৪ মিলি/লিটার) অথবা ডাইমেথোয়েট (২ মিলি/লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাগ ওয়ার্ম
পোকার লার্ভা পাতার সবুজ অংশ আচড়িয়ে (ঝপৎধঢ়) খায়, শিরা উপশিরা ব্যতীত সমস্ত সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত পাতা তামাটে বর্ণের হয়ে যায়। এরা পুরাতন পাতা বেশি পছন্দ করে কারন এতে বেশি পরিমাণে ট্যানিন থাকে। সদ্যজাত লার্ভা শুকনো ডগা, ছাল ও নিঃসৃত পদার্থ দ্বারা রেশমি ব্যাগ তৈরি করে ভেতরে অবস্থান করে । গাছের ডাল ও পাতায় ব্যাগগুলো ঝুলিয়ে থাকে। যদি ব্যাগ খুলে লার্ভা বিচ্ছিন্ন করা হয় তাহলে এরা দুই দিনের মধ্যে পুনরায় ব্যাগ তৈরি করতে পারে। লার্ভার চলাচল খুবই মন্থর, শামুকের মতো, খাওয়ার সময় লার্ভা শুধুমাত্র মাথা বের করে থাকে। অতিরিক্ত আক্রমণে পাতার সবুজ অংশ নষ্ট হওয়ায় খাদ্য তৈরি প্রক্রিয়া বিঘিœত হয় ও ফলন কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত গাছ হতে সিল্ক জাতীয় ব্যাগ সংগ্রহ করে লার্ভাসহ নষ্ট করে ফেলতে হবে; অত্যাধিক আক্রমণে ক্লোরপাইরিফস (২ মিলি/লিটার) অথবা ইমিডাক্লোরপ্রিড (০.৫ মিলি/লিটার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাকল খেকো পোকা : স্ত্রী পোকা নরম ছালের নিচে, ডালের কাটা অংশে, ভেঙে যাওয়া শাখায় ডিম পাড়ে। ৮-১০ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। সদ্যজাত লার্ভা গাছের বাকল খায়, সাধারণত দুই শাখার মাঝামাঝি এলাকায় কা- ছিদ্র করে ক্রমান্বয়ে ভেতরে ঢুকে, জাইলেম টিস্যু নষ্ট করে। লার্ভাগুলো ৯-১১ মাস পর্যন্ত কা-ে অবস্থান করে খায়। অতিরিক্ত আক্রমণে কা- দুর্বল হয়, শাখা শুকিয়ে যায় এবং গাছের ফল ধারণক্ষমতা কমে যায়। দিনের বেলায় লার্ভা আক্রান্ত গাছের ছিদ্রের ভেতরে অবস্থান করে এবং রাতে বের হয়ে আসে। সাধারণত বয়স্ক গাছে আক্রমণ বেশি হয়। আক্রান্ত গাছে কাঠের গুঁড়া, পোকার মল ও সিল্কের মতো পদার্থের সমন্বয়ে বাঁকানো ফিতার মতো গ্যালারি দেখা যায়। বর্ষাকালে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত গাছ হতে বাকানো গ্যালারী সংগ্রহ ও পুড়িয়ে ফেলতে হবে; ছিদ্রে লোহা ঢুকিয়ে পোকার লার্ভা মেরে ফেলতে হবে; সিরিঞ্জের সাহায্যে গর্তে কেরোসিন ঢেলে কাদা দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে; অতিরিক্ত আক্রমণে আক্রান্ত অংশে ক্লোরপাইরিফস (২ মিলিলিটার/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
মাকড় : মাকড় লিচু গাছের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এরা অত্যন্ত ক্ষদ্র আকারের, খালি চোখে দেখা যায় না। স্ত্রী মাকড় পাতার নিচের দিকের লোমে একটি একটি করে ডিম পাড়ে, ২-৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে। নিম্ফ ও পূর্ণ বয়স্ক মাকড় পাতার কোষ ছিদ্র করে রস চুষে খায়। ক্রমাগত রস শোষণের ফলে আক্রান্ত অংশ লাল মখমলের মতো হয়। আক্রান্ত পাতা মোটা ও বাকা হয়। এরা পুষ্পমঞ্জরি  ও বর্ধনশীল ফলেও আক্রমণ করে। আক্রান্ত ডালে নতুন পাতা হয় না, আক্রান্ত ফুলে ফলধারণ ব্যাহত হয়, পাতার নিচের দিকে গল সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত আক্রমণে ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়।
ব্যবস্থাপনা : আক্রান্ত পাতা ও পুষ্পমঞ্জরিসহ অন্যান্য আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; আক্রান্ত গাছে এবামেকটিন  (১.২৫ মিলি/লিটার), প্রোপারগাইট (৩ মিলি/লিটার) অথবা ক্লোরফিনাপির (১ মিলি /লিটার) স্প্রে করতে হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কীটতত্ত্ব), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, সেউজগাড়ী, বগুড়া, মোবাইল : ০১৭১৬০৭১৭৬৪,  ই-মেইল :zulfikarhaider@yahoo.com

 

বিস্তারিত
চাষির মঙ্গল তুলা চাষে, বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে

চাষির মঙ্গল তুলা চাষে, বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে
অসীম চন্দ্র শিকদার
আমরা জানি খাদ্যের পরই বস্ত্রের স্থান। আর সেই বস্ত্রের প্রধান উপাদান হলো তুলা। বঙ্গদেশে যদিও তুলা চাষের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। ব্রিটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশে কার্পাস তুলার চাষ ছিল প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাড়িতে বাড়িতে চড়কার মাধ্যমে সুতা তৈরি করে কাপড় বোনার দৃশ্য ছিল সাধারণ। এক সময় এদেশে বিশ^বিখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরি হতো এই তুলা দিয়েই। তবে তা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে পুনরায় বাংলাদেশে তুলা চাষের সূচনা করেন। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া ৩২৫ জন চাষিকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তাদের তুলা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে আমেরিকা হতে ডেল্টাপাইন জাতের তুলা বীজ আমদানি করে নতুন করে তুলা চাষ শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ^জুড়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হলো তুলা। তাই তুলাকে সোনার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। তুলার অন্য নাম তাই সাদা সোনা। তুলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাই বিশ^ব্যাপী তুলা দিবস পালিত হচ্ছে। ৭ অক্টোবর ২০১৯ সালে সুইজাল্যান্ডের জেনেভায় প্রথম তুলা দিবস পালিত হয়।
তুলা চাষের উপর গুরুত্বারোপ : বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, আর বিপুল কর্মসংস্থানের উৎসও এখন এই পোশাক শিল্প। ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ২৮ শতাংশ সুতি কাপড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের জিডিপির ১৩ শতাংশ আসে বস্ত্রখাত থেকে, যা উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পোশাক খাতের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। তবে বস্ত্রশিল্পের চাহিদার তুলনায় দেশে তুলা উৎপাদনে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে তুলা আমদানি করতে হচ্ছে, আর সেজন্য প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে।
বাংলাদেশের জলবায়ু তুলা চাষের জন্য উপযোগী। এ ছাড়া খাদ্য শস্য উৎপাদনে বিঘœ সৃষ্টি না করেও তুলা চাষ এলাকা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এমনকি অনুর্বর জমিতেও তুলা চাষ করা যায়। তাই বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতিকালে হাইব্রিডসহ উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ শুরু হওয়ার ফলে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তুলার মূল্যও বর্তমানে আকর্ষণীয়। বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের বিঘা প্রতি ফলন ১২ থেকে ১৫ মণ আর হাইব্রিড জাতের ফলন বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ। যার বাজার দর বর্তমানে মণপ্রতি (৪০ কেজি) ৩,৮০০.০০ টাকা হিসেবে ৪৫,৬০০.০০ টাকা থেকে ৫৭,০০০.০০ টাকা এবং ৫৭,০০.০০ টাকা থেকে ৭৬,০০০ টাকার মতো। সুতরাং যথেষ্ট লাভজনক বলাই যায়। এ ছাড়া তুলা চাষের পর আর একটি ফসল চাষ করা যায়-যেমন পাট, তিল, গ্রীষ্মকালীন মুগ, ভুট্টা, গম প্রভৃতি। আবার তুলা ফসলের সাথে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাকসবজির চাষও করা যায়।
তুলার চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের সহযোগিতায় তুলা উন্নয়ন বোর্ড নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যেমন-চাষ এলাকা বৃদ্ধি, তুলা গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণ, উচ্চফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ প্রবর্তন, নতুন নতুন চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন, বালাই দমনের জন্য ফেরোমনট্র্যাপ ব্যবহার, সমন্বিত ফসল ব্যবস্থাপনা (ওঈগ) চালু, চাষিদের তুলাচষের উপর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া ইত্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে তথা জোরদার করা হয়েছে। তাই আশা করা যায় দেশে তুলার উৎপাদন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি আমাদের পোশাক শিল্পও সমৃদ্ধ হবে।
আসন্ন তুলা মৌসুমে তুলাচাষি ভাইদের করণীয় : এ বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বৃষ্টি হওয়ায় কৃষকগণ সময় মতো পাট চাষ করতে সক্ষম হয়েছেন, এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদি সবজি চাষও অনেক কৃষক করেছেন। তাই পাট কাটার পর অথবা সবজি উৎপাদনের পর অনেক কৃষক এ বছর সময় মতো অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের মধ্যে তুলা চাষ করতে পারবেন।
তুলা চাষের জমি নির্বাচন : তুলার ভালো ফলন পেতে হলে জমি নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তুলা গাছ দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। তাই তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত জমি হবে-যে জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না, বন্যার পানি উঠে না এবং ছায়ামুক্ত উত্তম নিষ্কাশিত জমি। মাটির প্রকৃতি হবে বেলে দো-আঁশ এবং দো-আঁশ প্রকৃতির; তবে এটেল দো-আঁশ এবং পলি যুক্ত এটেল দো-আঁশ মাটিতেও তুলা চাষ করা যায়। মাটির অম্লত্ব এবং ক্ষারত্বের মান হবে ৬-৭.৫ এর মধ্যে অর্থাৎ অতি অল্প বা অতি ক্ষার  উভয় প্রকার মাটিতেই তুলা চাষ করা যায়। অম্ল বা লাল মাটিতে চুন প্রয়োগ করে মাটিকে নিরপেক্ষ করে নিতে হবে। তুলা যেহেতু গভীরমূলী ফসল, তাই জমি গভীরভাবে চাষ করে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জৈবসার যুক্ত জমিতে তুলা ভালো হয়। তাই জমি তৈরির সময় বিঘা প্রতি ১ থেকে ১.৫ টন গোবর/কম্পোস্ট/ পোল্ট্রিলিটার ছিটিয়ে দিয়ে চাষ দিতে হবে। পোল্ট্রিলিটার খুবই শক্তিশালী জৈবসার এবং বর্তমানে এটি সহজপ্রাপ্য।  
জাত নির্বাচন : এখন তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত যেমন- সিবি-১৪, সিবি-১৫, সিবি-১৯ এবং একটি হাইব্রিড জাত। এছাড়া বেসরকারী পর্যায়ে ২টি সীড কোম্পানি কর্তৃক আমদানিকৃত হাইব্রিড জাত যেমন রূপালী-১, ডিএম-২ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষাবাদ হচ্ছে। চাষি ভাইরা আপনাদের জমির উপযুক্ত যে কোন জাত নির্বাচন করে চাষ করতে পারেন। তবে আগাম চাষ করলে হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করাই ভাল। আগাম চাষ অর্থাৎ আষাঢ়ের ১৫ হতে ১৫ শ্রাবণের মধ্যে চাষ করলে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড জাতের তুলার চাষ করা ভালো।
বপন পদ্ধতি : তুলা বীজ সাধারণত উত্তর দক্ষিণে লাইনে বপন করা হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৯০ সেমি. (৩ ফুট) এবং বীজ হতে বীজের দূরত্ব ৪৫ সেমি. (১.৫ ফুট) সর্ব ক্ষেত্রে বজায় রেখে তুলা বীজ বপন করতে হয়। বিঘা প্রতি বীজের প্রয়োজন হবে হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আর উচ্চফলনশীল জাতের ক্ষেত্রে ১ থেকে ১.৫ কেজি। লাইনে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হাইব্রিড বীজ ২টি করে আর উচ্চফলনশীল বীজ ২/৩টি করে মাটির হাফ ইঞ্চি গভীরে বপন করতে হবে। পরে ১০/২০ দিনের মধ্যে প্রতি মাদায় একটি করে তুলা গাছ রেখে বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ফেলতে হবে। আঁশযুক্ত বা ফাজি বীজ ২/৩ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরে মাটি বা ছাই দিয়ে ঘসে বপনের জন্য প্রস্তুত করে নিতে হবে। বীজ বাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনে বীজ শোধন করে বীজ বপন করা যেতে পারে। ভালো ফলন পেতে হলে বিঘা প্রতি তিন হাজার গাছ থাকা নিশ্চিত করতে হবে। তাই কোন কারণে কোন মাদায় গাছ নষ্ট হয়ে গেলে সেই মাদায় বীজ অথবা চারা দিয়ে ৭/৮ দিনের মধ্যে পূরণ করে দিতে হবে।
সার প্রয়োগের মাত্রা : বিঘা প্রতি টিএসপি ২৫ থেকে ৩০ কেজি, ইউরিয়া ২৫ থেকে ৩০ কেজি, এমওপি ৩০ থেকে ৩৩ কেজি, জিপসাম ১৪ থেকে ১৬ কেজি, বোরণ ২.৫ থেকে ৩ কেজি, জিংক ২.৫ থেকে ৩ কেজি এবং জৈবসার ১ থেকে ১.৫ টন। টিএসপি সার তিন বারে প্রয়োগ করলে ভালো হয়। গাছের বয়স ৪০ ও ৬০ দিনে টিএসপির পরিবর্তে ডিএপি পার্শ্ব প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। জমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে ইউরিয়া সার কম বেশি করা যাবে। পোল্ট্রিলিটার ব্যবহার করলে অর্ধেক রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেই চলে।
তুলা ফসলের পরিচর্যা : ভালো ফলন পেতে হলে তুলা ফসলের অন্তর্বর্তীকালীন সঠিক পরিচর্যা অবশ্যই করতে হবে। যেমন- সঠিক সময়ে সারের পার্শ¦ প্রয়োগ, সঠিক সময়ে পোকামাকড় এবং রোগজীবাণু দমন, ফলিয়ার স্প্রে এবং হরমোন স্প্রে করা, আগাছা দমন, অঙ্গ ছাঁটাই বা ডিটপিং ইত্যাদি। ফুল থেকে ফলে পরিণত হওয়ার সময় এবং ফল পরিপক্ব হওয়ার সময় জমিতে রসের অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে। মনে রাখবেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, সুষম সার প্রয়োগ এবং সময় মতো বালাই দমন তুলার ভালো ফলন পাওয়ার পূর্বশর্ত। চাষিভাইদের সহযোগিতায় মাঠপর্যায়ে কটন ইউনিট অফিসার ও ফিল্ডম্যান সর্বদা চাষি ভাইদের পাশে রয়েছেন।
তুলা এমন একটি ফসল যার প্রতিটি অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেমন-তুলা থেকে  বস্ত্রখাতের প্রধান উপাদান সুতা ছাড়াও বীজ থেকে খৈল, খাবার তেল, ফাজ থেকে ডাক্তারি তুলা, গাছ থেকে জ¦ালানি, কাগজ, হার্ডবোর্ড প্রস্তুত করা যায়। এ ছাড়া অনুর্বর জমিতে কয়েক বার তুলা চাষ করলে জমি উর্বর হয়। তাই বলাই যায় ‘চাষির মঙ্গল তুলা চাষে, বস্ত্র শিল্প তুলার আঁশে’। বাংলাদেশের চাষিভাইদের প্রতি নিবেদন তুলা চাষ করে নিজেরা লাভবান হউন এবং বস্ত্র শিল্পের অগ্রগতিতে অবদান রাখুন।

লেখক : কটন ইউনিট অফিসার (অব:), তুলা উন্নয়ন বোর্ড,  ১০৪/১ (বি-২), শেরেবাংলা রোড, রায়ের বাজার, জাফরাবাদ, মোহাম্মদপুর-১২০৭।  মোবাইল : ০১৯২৩-৪১২২৫৬, ইমেইল : asim.cdb@gmail.com

বিস্তারিত
কৃষি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাভজনক করার কৌশল

কৃষি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাভজনক করার কৌশল
কৃষিবিদ ড. মোঃ ওমর আলী
কৃষি যদি হয় দুর্বার বিনিময়ে আমরা পাবো পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাবার। আর সেই সাথে লাগসই প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক ব্যবহার করে কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও   কৃষিকে লাভজনক করা এসময়ের অগ্রগণ্য দাবি। কৃষি হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক আর পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান। আধুনিকতা আর আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃষির পালেও বাতাস লেগেছে, পরিবর্তিত হচ্ছে   কৃষি। মানুষের চাহিদা আর আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই প্রযুক্তির উন্নয়ন করা হয়।
আগের যুগের কৃষি ব্যবস্থা আর বর্তমান যুগের কৃষির মাঝে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগে জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল বেশি, মানুষ শুধু তার নিজস্ব প্রয়োজনেই পরিকল্পনাহীনভাবে আবাদ করত। খুব একটা লাভ-লোকসানের হিসাব করত না। কিন্তু বর্তমানে মান্ধাতার আমলের সেই তত্ত্ব আর কাজ করে না। কারন বর্তমানে কৃষক তার কৃষি কাজকে একটি ব্যবসায়ী চিন্তাভাবনায় রূপ দিয়েছে এবং সে তার কাজকর্মে সব সময় লাভ-লোকসানের হিসেব খুঁজে। প্রতিটি কাজেরই একটি পরিকল্পনা থাকে, আর সেই পরিকল্পনার উপরই কাজের বাস্তবায়ন এবং লাভ-লোকসান নির্ভর করে। তেমনি   কৃষি কাজেরও রয়েছে একটি উৎপাদন পরিকল্পনা। যুগোপযোগী উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করলে একদিকে যেমন আসবে উৎপাদনের গতিশীলতা অন্যদিকে পরিপূর্ণ হবে লাভের প্রত্যাশা। তাই বাজার চাহিদানুযায়ী কৃষি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি  ও লাভজনক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়গুলো: প্রথমত বাজার চাহিদা অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করতে হবে। সেই সাথে জমি এবং আবহাওয়া নির্বাচিত ফসলের উপযোগী কি না তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। ফসল নির্বাচনে মাটির উর্বরতা বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে মাটির উর্বরতা উন্নয়নে ফসল ধারায় একই ফসল বারবার চাষ না করে শস্যপর্যায় অবলম্বন করতে হবে এবং বছরে জমিতে কমপক্ষে একটি শিমজাতীয় ফসল যেমন ডালজাতীয় ফসল (মসুর, ছোলা, খেসারি, মুগ এবং মাসকলাই ইত্যাদি), শিম এবং বাদাম ইত্যাদি চাষ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কোন একটি ফসল চাষে বেশি লাভ হলে সবাই মিলে ঐ ফসলের চাষ শুরু করে, ফলে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাজারমূল্য কমে যায়। তখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঐ ফসল চাষ থেকে বিরত থাকে। ফলশ্রুতিতে, পরবর্তীতে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারমূল্য বেড়ে যায়। ফসল চাষে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
নির্বাচিত ফসলের উন্নত জাতের ভালো বীজ সংগ্রহ করে ফসলের প্রয়োজন মোতাবেক ভালোভাবে জমি চাষ ও মই দিয়ে সময়মতো বীজ বপন করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে জমি সময়মতো জো অবস্থায় না আসার কারণে সময়মতো জমি চাষ দেওয়া সম্ভব না হলে বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষণ কৃষি পদ্ধতি রয়েছে- যেমন সাথী ফসল চাষ, পাওয়ার টিলার অপারেটর চালিত বীজ বপন যন্ত্র, বেড প্ল্যান্টার ইত্যাদি জমির অবস্থাভেদে ব্যবহার করে সময়মতো ফসল বপন করা যেতে পারে। উচ্চ মূল্যমান সম্পন্ন ফসল যেমন শাকসবজি ও ফলমূল আগাম চাষ করলে বেশি লাভ করা যায়। এজন্য উঁচু জমি নির্বাচন করে আগাম ফসল চাষ করতে হবে। জমিতে ফসলের চাহিদানুযায়ী সার ও সেচ দিতে হবে। মাটিতে মুগ, ধইঞ্চা ও শনপাট ইত্যাদি চাষ করে সবুজ অবস্থায় মাটির সাথে মিশিয়ে মাটির উরর্বতাসহ মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করা যায়, যা পরিবেশবান্ধব কৃষি উৎপাদনে সহায়ক। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে। সময়মতো আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় পরিকল্পিতভাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে দমন করতে হবে এবং মাঝে মাঝে ফসলের মাঠ পরিদর্শন করতে হবে। জমি থেকে সময়মতো ফসল কাটা এবং মাড়াই যত্ন সহকারে করতে হবে। কারণ সময়মতো ফসল কাটা ও মাড়াই করলে ফসলের উৎপাদনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং ফসলের ফলন ও গুণাগুণ উভয়ই বাড়ে। এ ছাড়াও আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাবে যাতে ফসল নষ্ট না হয় সেজন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সঠিকভাবে ফসল ঝাড়াই ও পরিষ্কার করে ভালোভাবে শুকিয়ে পরিমিত আর্দ্রতায় এনে ফসল সংরক্ষণ করতে হবে।
ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং বেশি বাজারমূল্য পাওয়ার জন্য ফসল গ্রেডিং করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত বাজার যাচাই করে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করতে হবে। পরিবেশবান্ধব       কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমন্বিত শস্য ব্যবস্থাপনার উপর জোর দিতে হবে। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে অন্যদিকে ফসল চাষও লাভজনক হবে।
সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা (যেমন- ফসল, পশুপালন,           হাস-মুরগি এবং মৎস্য চাষ) গড়ে তুলতে হবে। এতে করে প্রত্যেকটি কম্পোনেন্ট একে অপরের পরিপূরক হবে। ফলশ্রুতিতে, খামার লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব হবে। মাছ চাষের ক্ষেত্রে পানির পরিমাণ এবং পানির স্থায়িত্বের বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যেমন- পানির পরিমাণ কম এবং কম স্থায়িত্বকাল হলে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের চাষ করতে হবে। যেমন-সরপুঁটি, তেলাপিয়া এবং কার্পজাতীয় ইত্যাদি। ধানের জমিতেও চারিদিকে আইল বেঁধে পানি জমিয়ে রেখে স্বল্পকালীন সময়ে দ্রুত বর্ধনশীল মাছ লাভজনকভাবে চাষ করা যায়। আর যেখানে পানির গভীরতা বেশি সেখানে পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিম্নস্তর, মধ্যস্তর এবং উপরের স্তর বিবেচনায় রেখেই প্রত্যেক স্তরভেদে বিভিন্ন স্তরের মাছ চাষ করতে হবে।
পশুপালনের ক্ষেত্রে- দুগ্ধ উৎপাদন বা গরু মোটাতাজাকরণ যাই করা হোক না কেন অবশ্যই উন্নত জাত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়াও গোখাদ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যান্য খাদ্যের সাথে অবশ্যই সারা বছরব্যাপী কাঁচাঘাসের জোগান থাকতে হবে। এক্ষেত্রে প্যারা ও নেপিয়ার ইত্যাদি বর্ধনশীল ঘাসের চাষ করতে হবে।
বসতবাড়ির আশে-পাশের পতিত/অপরিকল্পিত ব্যবহৃত জায়গাগুলোকে পরিকল্পিতভাবে সবজি ও ফলমূল  চাষের আওতায় আনলে একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার হবে অন্যদিকে সারা বছরব্যাপী প্রয়োজনীয় সবজির জোগান পাওয়া যাবে, যা পরিবারের পুষ্টি মিটানোসহ আর্থিকভাবে লাভজনক হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত এলাকাভিত্তিক ৮টি মডেল রয়েছে, যা ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত পদ্ধতিতে বসতবাড়িতে সবজি ও ফলমূল চাষ লাভজনক করা সম্ভব। বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে প্রথমত একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে, এলাকাভিত্তিক কোন ফলের চাষ বেশি উপযোগী হলে সে এলাকার জন্য সেই ফলের গাছ লাগানোই উত্তম। কারণ এ থেকে একই সাথে ফল ও কাঠ দুটোই পাওয়া যাবে। যেমন রাজশাহী অঞ্চলের জন্য আম গাছ ও ভাওয়াল গড়ের জন্য কাঁঠাল ইত্যাদি এলাকাভিত্তিক উপযোগিতানুযায়ী বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। ফলের ক্ষেত্রে অবশ্য উন্নত জাতের কলম চারা লাগাতে হবে। এ ছাড়া যেসব অঞ্চলে ফলের খুব একটা উপযোগিতা নেই সেখানে এলাকার উপযোজ্যতানুযায়ী লাভের বিষয়টি মাথায় রেখেই বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। আর আবাদি জমির আইলের ধারে মাটি থেকে বেশি রস ও খাদ্যোপাদান শোষণ করে এবং বেশি ডালপালা হয় এধরনের গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন ইউক্লিপটাস ও বাঁশ ইত্যাদি গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ রস ও খাদ্যোপাদান শোষণ করে থাকে যা ফসলের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
আখ একটি ভারী শিল্প ফসল। বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই এই ফসল চাষ হয়ে থাকে। উপযুক্ত জমি, উন্নত জাত ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এর মাধ্যমে এর ফলন বর্তমানের চেয়ে ১.৫ থেকে ২ গুণ বাড়ানো সম্ভব। মিল  এবং গুড় এলাকাতেই ঈশ্বরদী ৩২, ঈশ্বরদী ৩৩, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৯, বিএসআরআই ৪৪, বিএসআরআই ৪৫, বিএসআরআই ৪৬ এবং বিএসআরআই ৪৮ জাতগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে আখের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চিনি ও গুড়ের  উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিএসআরআই উদ্ভাবিত বিএসআরআই ৪২ ও বিএসআরআই ৪৭ চিবিয়ে খাওয়া জাতের আখ চাষের মাধ্যমে  কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব। এছাড়াও  আখের সাথে সাথীফসল হিসেবে আলু, পিয়াজ, রসুন, টমেটো, ফুলকপি, মসুর, ছোলা ইত্যাদি চাষ করে কৃষকের  অন্তর্বর্তীকালীন আয় বাড়ানো যেতে পারে।
সঠিক উপায়ে কৃষি পণ্য সংরক্ষণ করে উপযুক্ত সময়ে বিক্রি করলে নিজস্ব আয় বাড়বে। এ ব্যাপারে নিকটস্থ শস্যগুদামে ঋণ প্রকল্পের গুদামসমূহে কম খরচে শস্য পণ্য সংরক্ষণ ও ঋণ গ্রহণ করা যেতে পারে। কৃষি পণ্যের উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তি ও বাজারজাতকরণ দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমবায়ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ফলে বড় বাজারসমূহে পণ্য দেয়া ও বিক্রি সম্ভব হবে এবং নিজস্ব আয় বাড়বে।
কৃষি পণ্যের উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় বাজার তথ্য যাচাই করতে হবে। এ ব্যাপারে পেপার, পত্রিকা, মোবাইল ও ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হবে। পচনশীল পণ্য দ্রুত বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি লাভ পেতে হলে গ্রামীণ পর্যায়ে মৌসুমভিত্তিক ফলমূল ও শাকসবজির স্বাস্থ্যসম্মত ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্যসামগ্রী পরবর্তী সময়ে (অসময়ে) ব্যবহার বা বাজারের চাহিদা এবং মূল্য দেখে বিক্রি করলে আয় বৃদ্ধি পাবে। বর্তমান বিশ্ব যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী তখন বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে হলে পণ্যের উপযুক্ত ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণন খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এতে করে একদিকে যেমন নিজস্ব পণ্যের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে অন্যদিকে ক্রেতা সকলও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ক্রয় করতে পারবে। ফলশ্রুতিতে, ব্যক্তি, দেশ ও জাতি সকলেই উপকৃত হবে। আর উপরোক্ত বিষয়সমূহে কৃষককে যুগোপযোগী করতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ^রদী। মোবাইল নং-০১৭১২৫৪৩৭২০, ই-মেইল :dg-bsri@bsri.gov.bd

বিস্তারিত
লবণাক্ত অঞ্চলে পাট চাষাবাদ প্রযুক্তি

লবণাক্ত অঞ্চলে পাট চাষাবাদ প্রযুক্তি
ড. মোঃ আবদুল আউয়াল১ ড. এ. টি. এম. মোরশেদ আলম২
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী আঁশ ফসল। বাংলাদেশের বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ জানুয়ারি ২০২৩ পাটকে   কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ জানুয়ারি ২০২৩ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা/২০২৩-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালকে পাটের বর্ষপণ্য হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছেন। এই পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসল চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জলবায়ু বেশ উপযোগী। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পৃৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫.০২ লাখ টন পাট আঁশ উৎপাদিত হয় সেখানে ভারতে উৎপাদিত হয় ৬.৪০ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭.৩৫ লাখ টন পাট। তবে, পাট রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১০৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা (পাট অধিদপ্তর)। তাই পাট উৎপাদনে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনও প্রথম স্থান দখল করে আছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসল নিয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী দেশের প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের প্রায় ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের বিগত ১৩ বছরের শাসনামলে পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের প্রায় ১৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। এসব নব উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে লবণাক্ততাসহিষ্ণু ‘বিজেআরআই দেশী পাট-৮’ এবং  ‘বিজেআরআই দেশী পাট-১০’ দেশের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
লবণাক্ত অঞ্চলে পাট চাষাবাদ
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আয়তন এ দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০% এবং এ অঞ্চলে দেশের প্রায় ৩০% আবাদযোগ্য জমি রয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ২৬.৫০ লাখ হেক্টর। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের এসব জমিতে প্রধানত রোপা আমন ধানের চাষ করা হয়। বৃষ্টির কারণে রোপা আমন মৌসুমে সাধারণত লবণাক্ততা দেখা যায় না। তবে শুষ্ক বোরো মৌসুমে লবণাক্ততা দেখা যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে মোট লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১০.৬০ লাখ হেক্টর। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলীয় অঞ্চলের বেশ কিছু পরিমাণ জমি স্বাদু পানির অভাবে পতিত পড়ে থাকে। এ সময় নদ-নদী ও খাল-বিলের পানিও লবণাক্ত হয়ে পড়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যায়। আবার পাটের সব জাত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ততাজনিত কারণে পাট বীজের অংকুরোদগম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে লবণাক্ততা সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ কিছু কৌশল অনুসরণ করলে লবণাক্ত অঞ্চলে একদিকে যেমন পাট চাষ সম্প্রসারিত হবে তেমনি ওই অঞ্চলের শস্যনিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে।
লবণাক্ত অঞ্চলে পাট চাষ সম্প্রসারণের জন্য অনুসরণযোগ্য বিশেষ কৌশলগুলো হলো : চাষাবাদের জন্য লবণাক্তসহিষ্ণু জাত নির্বাচন করা; বীজ বপণের সময় পরিবর্তন করা; শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনে স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা।
উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে এ তিনটি কৌশল প্রয়োগ করে পাটের চাষ ও এর উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।
চাষাবাদের জন্য লবণাক্তসহিষ্ণু জাত নির্বাচন করা : বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) দুটি লবণাক্তসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করেছে যেগুলো পাট মৌসুমে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে চাষ করা যায়। উপকূলীয় অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবিত লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত দুটি হলো- ক) ‘বিজেআরআই দেশী পাট-৮’। এ জাতটি ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড             কর্তৃক অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটি স্বল্প মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু। এ জাতের লবণাক্ততা সহনশীল মাত্রা ৮ ডিএস/মি পর্যন্ত। খ) ‘বিজেআরআই দেশী পাট-১০’। এ জাতটি ২০২১ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অবমুক্ত করা হয়। এ জাতটিও মধ্যম মাত্রার লবণাক্ততাসহিষ্ণু। এ জাতের লবণাক্ততা সহনশীল মাত্রা ১২ ডিএস/মি পর্যন্ত।
বীজ বপনের সময় পরিবর্তন করা : সাধারণত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাট বীজ বপনের সময় ১৫  মার্চ থেকে  ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। পাটের বীজ বপনের সময় পরিবর্তন করে লবণাক্ততার প্রভাব কিছুটা কমানো যায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি জেলার ৬টি উপজেলায় পাটের আঁশ ও বীজ ফসল উৎপাদনের উপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিভিন্ন এলাকায় পাটের বীজ বপনের সময় পরিবর্তন করে জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বেই শুষ্ক মৌসুমে স্বাদু পানি দ্বারা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে যদি বীজ বপন করা যায় তবে বীজের অংকুরোদগম স্বাভাবিক লবণাক্ততা অবস্থার তুলনায় প্রায় ২০% বৃদ্ধি পায় এবং তুলনামূলকভাবে পাটের ভালো ফলন পাওয়া যায়। কারণ দেরিতে বীজ বপন করলে পাট ফসল অধিক মাত্রার লবণাক্ততার ঝুঁকিতে পড়ে ও বীজের অংকুরোদগম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে পাটের ফলন প্রায় ৫০% কমে যায়।
শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনে স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করা : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে পাট ফসল চাষের একটি প্রধান সমস্যা পাট বপন মৌসুমে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া। এ সময় স্থানীয় নদ-নদী ও খালের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়; অধিক তাপমাত্রা, কড়া রোদ্রোজ্জ¦ল আবহাওয়া ও অনাবৃষ্টিজনিত শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করার ফলে মাটিতে থাকা পানি অধিক হারে বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়ে যায়। এ সময় প্রায়ই মাটির উপরে লবণের দানা বা সাদা স্তর দেখা যায়। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জমিতে সাগরের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনে স্বাদু বা স্বল্প লবণাক্ত পানি দ্বারা সেচ দেয়ার ব্যবস্থা করলে লবণাক্ততা কমে যায়। এমতাবস্থায় স্থানীয়ভাবে খাল খনন/বিদ্যমান খাল সংস্কার করে এসব খালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করলে বীজের অংকুরোদগম ভালো হবে এবং পাটের ফলন বৃদ্ধি পাবে। লবণাক্ততা সহনশীল জাতের পাট চাষ প্রযুক্তি উল্লেখ করা হলো।
লবণাক্ততা সহনশীল জাতের পাট ফসলের চাষাবাদ প্রযুক্তি
বীজ বপনের সময় ও হার : বিজেআরআই দেশী পাট-৮-এর বপনের সময় ৩০ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল; সারিতে বপন করলে ৬.০-৭.০ কেজি/হেক্টর, ছিটিয়ে বপন করলে ৭.০-৮.০ কেজি/হেক্টর বীজের প্রয়োজন। বিজেআরআই দেশী পাট-১০ এর বপনের সময় ১৫ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল; সারিতে বপন করলে ৬.৫-৭.৫ কেজি/হেক্টর, ছিটিয়ে বপন করলে ৮.৫-৯.৫ কেজি/হেক্টর বীজ প্রয়োজন।
সারের মাত্রা (হেক্টর প্রতি) : বিজেআরআই দেশী পাট-৮- ইউরিয়া ২১৭ কেজি, টিএসপি ৭৫ কেজি, এমওপি ১৮০ কেজি এবং জিপসাম ১৬৭ কেজি। শুকনা গোবর সার ব্যবহার করা হলে প্রতি টন শুকনা গোবরের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে। বিজেআরআই দেশী পাট-১০- ইউরিয়া ১৫০ কেজি, টিএসপি ১০ কেজি, এমওপি ৩০ কেজি এবং জিপসাম ২০ কেজি। শুকনা গোবর সার ব্যবহার করা হলে প্রতি টন শুকনা গোবরের জন্য ১১ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি : গোবর সার অবশ্যই বীজ বপনের ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে চাষ ও মই দিয়ে প্রয়োগকৃত গোবর সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের দিন নির্ধারিত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ ইউরিয়া ১ম কিস্তি হিসেবে এবং সম্পূর্ণ মাত্রার টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং জিংক সালফেট সার জমিতে শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করে মই দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। নির্ধারিত মাত্রার বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার ২য় কিস্তি হিসেবে গাছের ৪০-৪৫ দিন বয়সের সময় সামান্য শুকনা মাটির সাথে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের সময় জমিতে যেন পর্যাপ্ত রস থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োগকৃত সার যাতে গাছের কচি পাতা ও ডগায় না লাগে সে দিকে  লক্ষ রাখতে হবে।
চারা পাতলাকরণ : চারা পাতলাকরণে অবহেলা করলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, ফলে ফলন কমে যায়। তাই, বীজ বপনের এক হতে দুই সপ্তাহ পর জমিতে পাট গাছের চারা যদি ঘন থাকে তাহলে প্রাথমিকভাবে চারা পাতলা করে দিতে হবে।
আগাছা দমন : পাট গাছের বয়স যখন ৪০-৪৫ দিন হয় তখন একবার নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। এ সময় সুস্থ সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ জমি থেকে তুলে ফেলতে হবে। (বি. দ্র. : বিজেআরআই দেশী পাট-১০ ও বিজেআরআই দেশী পাট-৮ এর সার প্রয়োগ, চারা পাতলাকরণ, আগাছা দমন পদ্ধতি একই রকম)।
বালাই ব্যবস্থাপনা : বিজেআরআই দেশী পাট-৮- সাধারণত এ জাতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয় এবং এটি মোজাইক রোগ প্রতিরোধী। তবে পাটের জমিতে রোগবালাই দেখা দিলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনুযায়ী বিজেআরআই-এর সুপারিশ মোতাবেক গাছে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। বিজেআরআই দেশী পাট-১০- সাধারণত এ জাতে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম হয় এবং এটি হলুদ মাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধী।
ফসল সংগ্রহের সময় : বিজেআরআই দেশী পাট-৮- গাছের বয়স ১১০-১১৫ দিন হলে এ জাতের গাছ কাটা যায় এবং ফলন ভালো পাওয়া যায়। বিজেআরআই দেশী পাট-১০- গাছের বয়স ১১০ দিন হলে এ জাতের গাছ কাটা যায় এবং ফলন ভালো পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে মানুষের মাঝে পরিবেশবান্ধব পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, বিশ্ব বাজারে পাট পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। ফলশ্রুতিতে পাটের মূল্যও বেশ বেড়ে গেছে। এরই প্রভাবে আমাদের দেশের পাটচাষি কৃষকরা বিগত কয়েক বছর থেকে পাটের ভালো মূল্য পাচ্ছে এবং কৃষকদের মাঝে পাট চাষের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমিতে অধিক সংখ্যক প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, কৃষক প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবস আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে লবণাক্তসহিষ্ণু পাটের চাষাবাদ প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। তাহলে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে, একফসলি অনেক জমিতে দুই ফসল আবাদ করা সম্ভব হবে। এর ফলে পাটের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং      কৃষক অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হবে বলে বিজেআরআই-এর বিজ্ঞানীগণ বিশ^াস করেন।
 
লেখক : ১মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা; পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা-১২০৭; মোবাইল ফোন নম্বর : ০১৭৪০-৫৫৯১৫৫, ই-মেইল : morshedbjri@gmail.com

বিস্তারিত
রূপসায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ

রূপসায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ
মোঃ আবদুর রহমান
তরমুজ বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পুষ্টিকর ফল। তরমুজের মন কাড়া রং আর রসালো মিষ্টি স্বাদের জন্য সবার কাছে এ ফলটি প্রিয়। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বাজারে তরমুজ ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম। ইদানীং এ দেশের বাজারে মৌসুম ছাড়াও অমৌসুমেও এফলটি পাওয়া যাচ্ছে। কম সময়ে, স্বল্প খরচে, অধিক ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
জানা যায়, এ বছর উপজেলার ডোবা, নতুনদিয়া, শিয়ালী, গোয়াড়া, চাঁদপুর, সামন্তসেনা, পাথরঘাটা, তিলক, জাবুসা, হোসেনপুর ও ভবানীপুর গ্রামের মাছের ঘেরের পাড়ে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে রংধনু, রঙ্গিলা, তৃপ্তি, সুগার কিং, কালাচাঁদ, ইয়োলো ড্রাগন এসব হাইব্রিত জাতের অমৌসুমের তরমুজ চাষ হয়েছে। সরেজমিন এসব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাছের ঘেরের পাড়ে সারি সারি মাচায় ঝুলে আছে হলুদ, কালো ও সবুজ ডোরাকাটা রঙের বাহারি তরমুজ। অনেক কৃষক এসব গাছের পরিচর্যা করছেন। আবার কেউ ফল তুলছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে এবং ব্যাপক চাহিদা থাকায় ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি।
রূপসা উপজেলার নতুনদিয়া গ্রামের চাষি লিটন শিকদার এ বছর অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে তৃপ্তি, রঙ্গিলা ও কালাচাঁদ  জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এতে বীজ, মাদা তৈরি, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ তার প্রায় ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বীজ বপনের ৬০ দিন পর থেকে তরমুজ সংগ্রহ শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে তিনি এক হাজার কেজি তরমুজ (প্রতি কেজি ৫০ টাকা দরে) পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। আরো প্রায় ৮-১০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। একই উপজেলার সামন্তসেনা গ্রামের কৃষক সোহাগও এবছর ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে দেড় বিঘা জমিতে রংধনু ও রঙ্গিলা জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এচাষে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। তিনি এ পর্যন্ত ৮০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরো প্রায়  ১৫-২০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান। এদিকে উপজেলার জাবুসা গ্রামের চাষি হাফিজ শেখও এ বছর ঘেরের পাড়ে এক বিঘা জমিতে বর্ষা মৌসুমে তৃপ্তি ও রঙ্গিলা নামক হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। এতে তার খরচ হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। ঘেরের পাড়ের এ জমি থেকে আরো প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
প্রায় অর্ধশতাধিক কৃষক এ বছর প্রথম অমৌসুমে মৎস্য ঘেরের পাড়ে হাইব্রিড জাতের তরমুজ চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রূপসা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস, দেবাশীষ কুমার দাস, নিতীশ বালা ও সোহেল রানা এসব কৃষকদের পাশে থেকে তরমুজ চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এলাকার কৃষকরা বলেন, মৎস্য ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ করে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ঘেরের পাড়ের মাটি বেশ উর্বর। চাষকৃত তরমুজ গাছ চারদিক থেকেই সূর্যের আলো পায়। এতে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও ফলন ভালো হয়। সাধারণত মৎস্য ঘেরের পাড় উঁচু হয়। তাই বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যায়। একারণে বর্ষাকালে ঘেরের পাড়ে খুব সহজে তরমুজ চাষ করা যায়। ঘেরের পাড়ে পানির ওপর মাচা তৈরি করে তা তরমুজ গাছের লতা বাউনির জন্য ব্যবহার করা হয়। একারণে ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে জায়গা কম লাগে। আবার ঘেরে অবাধ পানি সরবরাহ থাকায় গাছে পানি সেচ দিতে সুবিধা হয়। এসময়ে তরমুজে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম হয়। তাছাড়া ঘেরের পাড়ের তরমুজ গাছের পরিচর্যা করতেও সুবিধা হয় এবং অধিক ফলন পাওয়া যায়। অন্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হওয়ায় মৎস্য ঘেরের পাড়ে তরমুজ চাষে ঝুঁকে পড়েছেন এখানকার কৃষকেরা। তাই প্রতি বছর রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কৃষক লিটন শিকদার বলেন, বর্ষার পানিতে ডুবে না যায় এ ধরনের ঘেরের পাড়ের বেলে দো-আঁশ মাটিঁ অমৌসুমে তরমুজ চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। ঘেরের পাড়ে ২ হাত দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে দেড় হাত পর পর ২০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদার ওপরের স্তরের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম ভার্মি কম্পোস্ট, ২৫ গ্রাম টিএসপি, ১৫ গ্রাম এমওপি ও ১০ গ্রাম জিপসাম সার ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা পুনরায় ভরাট করতে হবে। ঘেরের পাড়ের দু’পাশের কিনারে মাদা তৈরি করতে হয়। মাদায় সার প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর প্রতি মাদায় ২টি অংকুরিত বীজ ১ ইঞ্চি (২.৫ সেমি. ) গভীরে বপণ করে ঝুরঝুরে শুকনো মাটি দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে অসময়ে তরমুজ বীজ বপন করা হয়। চারা গজানোর           ১০-১২ দিন পর প্রতি মাদায় ১টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
তিনি বলেন, অমৌসুমে তরমুজের ভালো ফলনের জন্য ইউরিয়া, এমওপি ও বোরন সার তিন ভাগে ভাগ করে চারা গজানোর ১৫ দিন পর প্রথম, ৩০ দিন পর দ্বিতীয় ও ৪৫ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি কিস্তিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০ গ্রাম এমওপি ও ৫ গ্রাম বোরন সার গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেমি. দূরে চারদিকে উপরিপ্রয়োগ করে ঝুরঝুরে শুকনো মাটি দিয়ে এসব সার ঢেকে দেওয়া হয়। প্রতিবার সার উপরিপ্রয়োগের পর মাদায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। তাছাড়া মাটিতে রসের অভাব হলে তরমুজ গাছে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। আবার গাছের গোড়ায় আগাছা হলে নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে তা তুলে ফেলতে হয়। কৃষক লিটন শিকদার আরো বলেন, ঘেরের পাড়ে তরমুজ গাছের পাতায় লাল বিটল, থ্রিপস, লেদা পোকা ও মাকড় এর আক্রমণ বেশি হয়। লালবিটল পোকা দমনের জন্য একতারা-২৫ ডব্লিউ জি (১০ লিটার পানিতে ২ গ্রাম), থ্রিপস ও লেদা পোকা দমনে টিডো-২০ এসএল (১০ লিটার পানিতে ২.৫ মিলি.), আর মাকড়ের জন্য ভারটিমেক-০১৮ ইসি (১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলি.) বা মিটিসল-৫ ইসি (১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি.) নিয়মিত স্প্রে করা হয় বলে তিনি জানান।
তরমুজ গাছ বা লতা ২০-২৫ সেমি. (৮-১০ ইঞ্চি) লম্বা হলে তা ঘেরের পাড়ে তৈরি মাচায় তুলে দিতে হবে। এতে গাছ মাচায় লতিয়ে বা ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। বীজ বপণের ২৫-৩০ দিন পর গাছে ফুল আসে এবং ৩৫-৪০ দিন পর ফল ধরা শুরু হয়। আর ৬০-৬৫ দিন পর তরমুজ ফল সংগ্রহ শুরু করা হয়। প্রতি গাছে ৩ থেকে ৪টি ফল ধরে এবং এক একটি তরমুজের ওজন হয় গড়ে ১ থেকে ৩ কেজি। ওজন ও আকারে অমৌসুমের তরমুজ সবার দৃষ্টি কেড়েছে। শুধু তাই নয়, এসময়ের তরমুজ খেতে যেমন মিষ্টি স্বাদের, তেমনি পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ফসফরাস রয়েছে। তাই আমাদের দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণে তরমুজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এফল আহারে দেহমনে প্রশান্তি আনে। স্থানীয় বাজারে অমৌসুমে উৎপন্ন তরমুজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এর বাজারমূল্যও বেশি। স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা অসময়ের টাটকা ও তাজা তরমুজ কিনতে পেরে খুব খুশি।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মো: ফরিদুজ্জামান বলেন, ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষ হওয়ায় ভালো দাম পেয়ে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই উপজেলায় প্রতি বছর অমৌসুমে তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এসব কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে হাইব্রিড জাতের তরমুজ বীজ ও সার সরবরাহের পাশাপাশি উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এতে কৃষকদের মধ্যে ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ চাষে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আগামীতে মাছের ঘেরের পাড়ে আরও বেশি করে তরমুজ চাষ করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত। কিন্তু জনসংখ্যা ক্রমশ: বাড়ছে, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু জমি বাড়ছে না; বরং কমছে। সেই সাথে উর্বরা জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন মাছের ঘের। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে বাস্তবায়নে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব মৎস্য ঘেরের পাড়ে বা বেড়িতে তরমুজ ও অন্যান্য উপযোগী শস্য চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (পিআরএল), উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা। মোবাইল নং- ০১৯২৩৫৮৭২৫৬, ই-মেইল:rahman.rupsha@gmail.com

 

বিস্তারিত
আষাঢ় মাসের কৃষি (১৫ জুন-১৫ জুলাই)


আষাঢ় মাসের কৃষি
(১৫ জুন-১৫ জুলাই)

কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
আষাঢ় মাস। গরমের দাপট কমাতে আগমন হয় বর্ষার। বৃষ্টির ধারায় সব রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে বাংলার মাটি, পুষ্প, বৃক্ষ, পত্রপল্লবে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে প্রকৃতির অবয়বে। সাথে আমাদের কৃষিকাজে নিয়ে আসে ব্যাপক ব্যস্ততা। প্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন আসুন আমরা সংক্ষিপ্ত আকারে জেনে নেই আষাঢ় মাসে কৃষির আবশ্যকীয় কাজগুলো।
আউশ ধান
আউশ ধানের ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য যতœ নিতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে হবে। বন্যার আশঙ্কা হলে আগাম রোপণ করা আউশ ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলেই প্রয়োজনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করে কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে শুকিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
আমন ধান
আমন ধানের বীজতলা তৈরির সময় এখন। পানিতে ডুবে না এমন উঁচু খোলা জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বন্যার কারণে রোপা আমনের বীজতলা করার মতো জায়গা না থাকলে ভাসমান বীজতলা বা দাপগ পদ্ধতিতে বীজতলা করে চারা উৎপাদন করা যায়।
বীজতলায় বীজ বপন করার আগে ভালো জাতের মানসম্পন্ন বীজ নির্বাচন করতে হবে। রোপা আমনের অনুকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত, যেমন বিআর১০, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭, ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫, ব্রি ধান১০৩, ব্রি হাইব্রিড ধান৪, ব্রি হাইব্রিড ধান৬, বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২২, বিনা ধান-২৩ প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উন্নত জাত চাষ করতে পারেন;
খরাপ্রবণ এলাকাতে নাবি রোপার পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমনের (ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ এসব), লবণাক্ত ও লবণাক্ত জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৩, ব্রি ধান৭৮, অলবণাক্ত            জোয়ারভাটা অঞ্চলে ব্রি ধান৭৬, ব্রি ধান৭৭ এবং জলাবদ্ধতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৭৯ চাষ করা যেতে পারে;
ভালো চারা পেতে প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ২ কেজি গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০ গ্রাম জিপসাম সার প্রয়োগ করা যায়।
আষাঢ় মাসে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ শুরু করা যায়;
মূল জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ৯০ কেজি টিএসপি, ৭০ কেজি এমওপি, ১১ কেজি দস্তা এবং ৬০ কেজি জিপসাম  দেয়া প্রয়োজন; জমির এক কোণে মিনিপুকুর খনন করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন যেন পরবর্তীতে সম্পূরক সেচ নিশ্চিত করা যায়।
ভুট্টা
পরিপক্ব হওয়ার পর বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার আগে মোচা সংগ্রহ করে  ঘরের বারান্দায় সংগ্রহ করতে পারেন। এক্ষেত্রে মোচা থেকে দানা সংগ্রহ করতে প্রয়োজনে ভুট্টা মারাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। রোদ হলে শুকিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মোচা পাকতে দেরি হলে মোচার আগা চাপ দিয়ে নি¤œমুখী করে দিতে হবে, এতে বৃষ্টিতে মোচা নষ্ট হবে না।
পাট
পাট গাছের বয়স চারমাস হলে ক্ষেতের গাছ কেটে নিতে হবে। পাট গাছ কাটার পর চিকন ও মোটা গাছ আলাদা করে আঁটি বেঁধে দুই/তিন দিন দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। পাতা ঝরে গেলে ৩/৪ দিন পাট গাছগুলোর গোড়া একফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানিতে জাগ দিতে হবে।
পাট পচে গেলে পানিতে আঁটি ভাসিয়ে আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে পাটের আঁশের গুণাগুণ ভালো থাকবে। ছাড়ানো আঁশ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাঁশের আড়ে শুকাতে হবে। যেসব জায়গায় জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়। পাট পচনে পানির ঘাটতি সমাধানে মাইক্রোবিয়াল ইনোকুলাম প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
পাটের বীজ উৎপাদনের জন্য ১০০ দিন বয়সের পাট গাছের এক থেকে দেড় ফুট ডগা কেটে নিয়ে দুটি গিঁটসহ ৩/৪ টুকরা করে ভেজা জমিতে দক্ষিণমুখী কাত করে রোপণ করতে হবে। রোপণ করা টুকরোগুলো থেকে ডালপালা বের হয়ে নতুন চারা হবে। পরবর্তীতে এসব চারায় প্রচুর ফল ধরবে এবং তা থেকে বীজ পাওয়া যাবে।
শাকসবজি
এ সময়ে উৎপাদিত শাকসবজির মধ্যে আছে ডাঁটা, গিমাকলমি, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, ঝিঙা, শসা, ঢেঁড়স, বেগুন। এসব সবজির গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনে মাটি তুলে দিতে হবে। এ ছাড়া বন্যার পানি সহনশীল লতিরাজ কচুর আবাদ করতে পারেন; উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের পাড়ে গিমাকলমি ও অন্যান্য ফসল আবাদ করতে পারেন; সবজি ক্ষেতে পানি জমতে দেয়া যাবে না। পানি জমে গেলে সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে; তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরার জন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতাজাতীয় গাছের ১৫-২০ শতাংশের লতাপাতা কেটে দিতে হবে। কুমড়াজাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাত পরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
মুখী কচু জমিতে লাগানো শেষ হয়েছে। মুখী কচুর পুরো উৎপাদন মৌসুমে ৪-৬ বার আগাছা দমনের প্রয়োজন হয়। অঙ্কুরোদগম পূর্ব অনুমোদিত মাত্রায় আগাছানাশক বীজ বপনের পরপর স্প্রে করার দুই মাস পর হতে এক মাস অন্তর অন্তর চারবার নিড়ানি দ্বারা আগাছা দমন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সারের উপরিপ্রয়োগের আগে আগাছা দমন আবশ্যক।
মাটিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়ে মাটির প্রকারভেদে ১০-২০ দিন পরপর সেচ দেয়ার প্রয়োজন। মুখী কচুর উচ্চ ফলনের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা যথাসময়ে গ্রহণ করতে হবে। রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর এবং ৯০-১০০ দিন পর দুই সারির মাঝের মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে কচু গাছের গোড়ায় উঠিয়ে দিলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা তৈরির সময় গর্তপ্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম সরিষার খৈল, ২ কেজি ছাই, ১০০ গ্রাম টিএসপি ভালোভাবে মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি গাদায় ৩/৪টি ভালো সবল বীজ রোপণ করতে হবে। এ ছাড়াও আগাম শীতকালীন সবজি উৎপাদনে টানেল টেকনোলজি ব্যবহার করা যেতে পারে।
গাছপালা
এ সময়টা গাছের চারা রোপণের জন্য খুবই উপযুক্ত। বসতবাড়ির আশপাশে, খোলা জায়গায়, চাষাবাদের অনুপযোগী পতিত জমিতে, রাস্তাঘাটের পাশে, পুকুর পাড়ে, নদীর তীরে গাছের চারা বা কলম রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে; এ সময় বনজ গাছের চারা ছাড়াও ফল ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন; ফলের চারা রোপণের আগে গর্ত তৈরি করতে হবে; সাধারণ হিসাব  অনুযায়ী এক ফুট চওড়া ও এক ফুট গভীর গর্ত করে গর্তের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমওপি সার মিশিয়ে, দিন দশের পরে চারা বা কলম লাগাতে হবে; বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রে উন্নত জাতের রোগমুক্ত সুস্থ-সবল চারা বা কলম রোপণ করতে হবে; চারা শুধু রোপণ করলেই হবে না। এগুলোকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দিতে হবে। এরপর বেড়া বা খাঁচা দিয়ে চারা রক্ষা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, সেচনিকাশ নিশ্চিত করতে হবে; নার্সারি মালিক যারা তাদের মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুব জরুরি। সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার, দুর্বল রোগাক্রান্ত ডালপালা কাটা বা ছেঁটে দেয়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, এ সময় বীজ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় কৃষি উপকরণগুলো বন্যামুক্ত উঁচু বা নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। আপনাদের আগাম প্রস্তুতির জন্য আগামী মাসে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। বিস্তারিত জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। অথবা কৃষি তথ্য সার্ভিসের  কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩ নম্বরে জেনে নিতে পারেন।

লেখক : সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন : ০২৫৫০২৮৪০৪; ই-মেইল : fardousi30@gmail.com

বিস্তারিত