ন্যানো সার ফসল উৎপাদনে একটি
আধুনিক কৃষি উপকরণ
ড. মো: শহিদুল ইসলাম
ন্যানো সারকে আধুনিক কৃষি উপকরণের নতুন দিগন্ত হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে ন্যানো সারের প্রযুক্তি বাংলাদেশের মাটির উর্বরতা ও সার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারে ফলন বৃদ্ধিতে প্রায় ৫০-৬০%। রাসায়নিক সারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বিশেষ করে নাইট্রোজেন সার মাটির গঠন, পরিবেশ, স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি করে এবং অনেক উপকারী জীবাণুকে মেরে ফেলে। অতএব, উচ্চ পুষ্টি উপাদানসহ পরিবেশবান্ধব সার তৈরি করা বিশেষ প্রয়োজন।
ন্যানো সার একটি চমৎকার বিকল্প প্রযুক্তি যা গাছের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে পুষ্টির ব্যবহার বাড়াতে পারে, রাসায়নিক সারের অত্যাধিক ক্ষতিকারক প্রভাব প্রশমিত করে, মাটির বিষাক্ততা কমায়। অধিকন্তু, ন্যানো জৈবসার হলো চমৎকার উপাদান যা মাটিতে প্রয়োগ করলে, পাতা বা বীজ রাইজোস্ফিয়ারে (জযরুড়ংঢ়যবৎব) উপনিবেশ স্থাপন করে এবং পোষক (ঐড়ংঃ) উদ্ভিদের পুষ্টির প্রাপ্যতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। ন্যানো জৈবসার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নাইট্রোজেন স্থিরকরণের মাধ্যমে, ফসফরাস দ্রবণীয় করে এবং গাছের উদ্দীপক পদার্থ তৈরির মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করে। মাটির প্রাকৃতিক পুষ্টির পুর্নব্যবহার পুনরুদ্ধার করে এবং মাটিতে জৈব পদার্থ তৈরি করে।
ন্যানো সারের শ্রেণী বিভাগ
ন্যানো সারগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়: ক) ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট ন্যানোফর্মুলেশন, খ) মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ন্যানোফম্যুলেশন এবং গ) পুষ্টি-সমৃদ্ধ ন্যানোম্যাটেরিয়ালস। তিনটি ভাগের মধ্যে, পুষ্টি-সমৃদ্ধ ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলো অন্য দুইটি ভাগের তুলনায় বেশি জনপ্রিয়। পুষ্টি সমৃদ্ধ ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলো পরিবেশ বান্ধব এবং শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ। এ সারগুলোকে ধীর-নিঃসরণকারী সার বলা যেতে পারে যা ফসলের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি নির্গত করে। ব্যবহৃত আবরণের মধ্যে রয়েছে পলিমেরিক ন্যানোম্যাটেরিয়ালস, কার্বনভিত্তিক ন্যানো পার্টিকেলস, ন্যানোক্লেস, মেসোপোরাস সিলিকা ইত্যাদি। ছিদ্রযুক্ত ন্যানোম্যাটেরিয়ালগুলো উদ্ভিদের নাইট্রোজন চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর গ্রহণ প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। এতে নাইট্রোজেনের অপচয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।
ন্যানো সারগুলোকে তাদের ক্রিয়াকলাপের উপর ভিত্তি করেও শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে: ক) ধীর-নিঃসরণ সার, খ) নিয়ন্ত্রণ অপচয় সার, গ) ন্যানো কম্পোজিট সার-যা একটি ন্যানো ডিভাইস ব্যবহার করে গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী ম্যাক্রো এবং মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের ন্যানো সার
ন্যানো সার জৈব পদার্থ, ম্যাক্রো এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং হিউমিক পদার্থের সমন্বয়ে প্রস্তুত করা হয়। এ সার মাটির উর্বরতা বাড়ায়। ন্যানো পার্টিকেলগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - এর উচ্চ শোষণ ক্ষমতা, বর্ধিত পৃষ্ঠ - আয়তনের অনুপাত এবং নিয়ন্ত্রিত পুষ্টি নিঃসরণ। এ সকল বৈশিষ্ট্যগুলো এ সারকে উদ্ভিদ বৃদ্ধি উদ্দীপক হিসাবে কার্যকরী করে তোলে। ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট সারের মধ্যে ন্যানো চিলেটেড মিশ্রিত ঘচক ২০-২০-২০ এবং ১২-১২-৩৬ সার, একক পুষ্টিভিত্তিক ন্যানো চিলেটেড নাইট্রোজেন (১৭%), ফসফরাস (১৭%), পটাশিয়াম (২৭%), ক্যালসিয়াম (২৭%), ম্যাগনেসিয়াম (৬%) এবং সালফার (১২%) উল্লেখযোগ্য। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সারের মধ্যে ন্যানো কমপ্লিট মাইক্রো সার এবং একক পুষ্টিভিত্তিক চিলেটেড জিঙ্ক (১২%), বোরন (৯%), এবং লোহা (৯% এবং ৭%), ম্যাঙ্গানিজ (১২%), মলিবডেনাম (৫%) এবং কপার (৮%)। এ পণ্যগুলোর বিশেষগুণ হলো যে এগুলো পাউডার আকারে পাওয়া যায়, পানিতে স¤পূর্ণ দ্রবণীয় এবং মাটি ও পাতার প্রয়োগের মাধ্যমে শোষণযোগ্য।
উদ্ভিদে পুষ্টি গ্রহণের প্রক্রিয়া
ন্যানো সার গাছের শিকড় বা পাতার মাধ্যমে প্রবেশ করে। যদিও ন্যানো পার্টিকেলগুলোর সুনির্দিষ্ট গ্রহণ এবং স্থানান্তর এখনও পুরাপুরি জানা যায়নি, তবে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে ন্যানো পার্টিকেলগুলোর গ্রহণ এবং স্থানান্তর মূলত কোষ প্রাচীরের সাথে ন্যানো পার্টিকেলগুলোর আকার, আকৃতি এবং মিথস্ক্রিয়া আচরণের উপর নির্ভরশীল। ন্যানো পার্টিকেলগুলো স্টোমাটা খোলার মাধ্যমে বা কিউটিকলের মাধ্যমে অ্যাপোপ্লাস্টিক এবং সহানুভূতিশীল পথের মাধ্যমে ভাস্কুলার সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে। ৫০-২০০ হস আকারের পরিসরের বড় কণাটি সহানুভূতিশীল পথ পছন্দ করে, আর ১০-৫০ হস আকারের পরিসরের ছোট কণাটি অ্যাপোপ্লাস্টিক পথ পছন্দ করে। পুষ্টির ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলের গুণমান উন্নত করা, পুষ্টি উপাদান নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ, সারের চাহিদা কমানো, কীটপতঙ্গের উপদ্রব কমানো এবং মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ন্যানো সারের উপকারী প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তাদের কিছু অসুবিধা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাটির উপাদানগুলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া এবং বিষাক্ততা তৈরি করা, উদ্ভিদের টিস্যুতে জমা হওয়া এবং কিছু কোষের মৃত্যু ঘটানো।
পরিশেষে সকলের বিশেষকরে কৃষক এবং সার ডিলার ও পরিবেশকদেরকে জানানো যাচ্ছে যে বিলস্বে হলেও বাংলাদেশে ন্যানো সারের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তত্বাবধানে বেশ কিছু কোম্পানি ন্যানো সার নিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং শেরে -ই-বাংলা কৃষি বিশ^ বিদ্যালয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। আশা করা যায় শীঘ্রই ন্যানো সার বাজারে পাওয়া যাবে।
লেখক : প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মোবাইল : ০১৭১৩০০২১৮০, ই-মেইল : dmsislam12@gmail.com