‘যে যা ভাবে সে রূপে সে হয়’ - লালন
কখন ব্যবহার করতে হয়?
কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নে কৃষক সংগঠনের সদস্যদের জন্য দূরদর্শিতার অনুশীলন একটি শক্তিশালী পদ্ধতি। একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার সময় অথবা যখন একটি কৃষক সংগঠন বড় মাপের পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন এ অনুশীলনটি খুবই উপযোগী। সংগঠনের সমৃদ্ধির জন্য যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে নেতৃত্বকে দূরদর্শী হতে হয়। সে নেতাই দূরদর্শী যিনি ভবিষ্যৎকে দেখতে পান, বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং ফলাফল অর্জনে লক্ষ্য স্থির করতে পারেন।
এ অনুশীলনটি চর্চা করার পূর্বে সংগঠনের লক্ষ্য (ভিশন) এবং উদ্দেশ্য (মিশন) সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। লক্ষ্য বা ভিশন হচ্ছে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বক্তব্য যা একটি সংগঠন মধ্যবর্তী বা দীর্ঘমেয়াদে অর্জন করতে চায়। আর উদ্দেশ্য বা মিশন হচ্ছে লক্ষ্য পূরণে সংগঠনটি মধ্যবর্তী মেয়াদে বা দীর্ঘমেয়াদে কী কী কাজ সম্পাদন করবে। সহজ কথায় ভিশন হচ্ছে স্বপ্ন দেখা আর মিশন হচ্ছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু কাজ সম্পাদন করা। এ স্বপ্নটা কিন্তু কোনো ব্যক্তির বা বহিঃপ্রেরণাকারীর স্বপ্ন নয়; এ স্বপ্ন দেখতে হবে সংগঠনের সব মিলে ফলে তার বাস্তবায়নও হবে সবার অংশীদারিত্বে।
কাজেই একটি সংগঠনের ভিশন ও মিশন ঠিক করতে সব সদস্যর অংশগ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশের কৃষক সংগঠন বা যে কোনো গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র বা উপধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সব ভিশন ও মিশন মোটামুটি একই। কেন এমন হলো? এটা বহিঃপ্রেরণাকারী হিসেবে যে মাঠ সম্প্রসারণ কর্মী কাজ করে প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় তিনিই অন্য কোনো সংগঠনের ভিশন ও মিশন দেখে হুবহু বসিয়ে দেন। ফলে সংগঠন কি লক্ষ্যে করব, লক্ষ্য পূরণে কী কী কাজ করব, কোন পদ্ধতিতে করব, কখন করব, কাকে কী কাজ দেব, ইত্যাদি প্রশ্ন কৃষকদের মনে জাগে না। প্রশ্ন জাগে না তো স্বপ্নও জাগে না, স্বপ্ন নাই তো আপনি একটি নাবিকহীন বা বৈঠাহীন নৌকা। আপনার লক্ষ্য নাই তো আপনার গন্তব্যও নাই। ফলে সংগঠন গড়ে তোলার মূলেই রয়েছে সবার অংশীদারিত্বে ভিশন ও মিশন স্থির করা। ভিশন ও মিশন ঠিক করতে গিয়েই একটি সংগঠন সর্বপ্রথম তার সদস্যদের মাঝে সংগঠনের প্রতি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। সবার অংশগ্রহণে যখন সংগঠনের ভিশন ও মিশন তৈরি করা হয় তখন সেটি পূরণে সব একযোগে কাজ করে যেহেতু সবাই স্বপ্নপূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে।
উদাহরণ : একটি কৃষক সংগঠনের সদস্যরা শুরুর দিকে সবাই মিলে সংগঠনের ভিশন স্থির করল যে ‘২০২০ সালের মধ্যে আমরা আমাদের সংগঠনকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও বিশ্বস্ত এবং সক্রিয় সংস্থা হিসেবে শক্তিশালী করে সদস্যদের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করব’।
উপরের উদাহরণে সংগঠনের সদস্যরা তাদের ভিশন হিসেবে তিনটি বিষয়ে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হয়েছে-
১. সংগঠনের কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এনে শক্তিশালী করবে;
২. শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে সদস্যদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাবে;
৩. মধ্যমেয়াদি সময়ে অর্থাৎ আগামী ৫ বছরে তারা এটা অর্জন করতে চায়;
আর এ লক্ষ্য পূরণে সংগঠনটির সব সদস্য মিলে উদ্দেশ্যসমূহ ঠিক করল নিম্নরূপ
১. গ্রামের সমশ্রেণীর (ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীন, বর্গা) কৃষকদের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা;
২. চিহ্নিত সমশ্রেণীর কৃষকদের নিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে কৃষিতে বিদ্যমান প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যা সব কৃষককে সমভাবে প্রভাবিত করে;
৩. চিহ্নিত প্রধান সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করতে সবাইকে সংবেদনশীল ও সচেতন করা
৪. সচেতন, সংবেদনশীল ও সংগঠনমনা কৃষকদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলা;
৫. সবার অংশীদারিত্বে সংগঠনের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা;
৬. গঠনতন্ত্রের আলোকে সংগঠন পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ করা;
৭. অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে সব সদস্যর কৃষিখামার বৃত্তান্ত ফরম পূরণ করে তাদের জমির শ্রেণিকরণ, পছন্দসই ফসল নির্বাচন, গবাদিপশু-হাঁস-মুরগি-পাখি শুমারি, মৌসুমভিত্তিক তাদের উপকরণের চাহিদা, মৌসুমভিত্তিক মোট উৎপাদন, ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা;
৮. সদস্য বৃত্তান্ত অনুসারে সংগঠনের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং জনে জনে কেনা ও বেচা না করে সংগঠিতভাবে কেনা বেচার অভ্যাস করতে সদস্যদের অনুপ্রাণিত করা;
৯. সদস্যদের জন্য সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করতে সরকারি সম্প্রসারণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ;
১০. সংগঠনের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করতে নিয়মিত সদস্য চাঁদা আদায় এবং সামাজিক ব্যবসা শুরু করা।
উপরের উদাহরণটি থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই? সংগঠনের নেতাগণ কি দূরদর্শী? উপরের ১০টি উদ্দেশ্য কিভাবে ভিশনে উল্লিখিত তিনটি মূল প্রতিশ্রুতি পূরণে সক্ষম?
দূরদর্শিতার অনুশীলন
‘স্বপ্ন তাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না’
মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীগণ যারা কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেন তাদের জন্য এ অনুশীলনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি কৃষক সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করতে সব সদস্যর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। কৃষক সংগঠনে সদস্যদের অংশীদারিত্বে কিভাবে ভিশন ও মিশন ঠিক করা যায় তার একটি অনুশীলন নিচে দেয়া হলো। যে কোনো কৃষক দল গড়তে সংগঠনের সব সদস্যর অংশগ্রহণে একটি সাধারণ লক্ষ্য ও লক্ষ্য পূরণে উদ্দেশ্যগুলো স্থির করার জন্য দূরদর্শিতার অনুশীলনটি চারটি মূল ধাপে সম্পন্ন করা যায়-
ধাপ ১ : সংগঠনে সদস্যদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা (২০ মিনিট)
এ ধাপে সহায়ক সংগঠনের সব সদস্যদের বলবেন যে, ‘চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন আপনি এখন থেকে ৫ বছর পর দাঁড়িয়ে আছেন এবং আপনার সংগঠনটি সবার সেরা, কৃষক সংগঠনের সবচেয়ে সফল মডেল, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সব কৃষক সংগঠনের জন্য অনুসরণীয়। এ সংগঠনের একজন নেতা বা সদস্য হতে পেরে আপনি নিজেও গর্বিত যেহেতু এ পর্যায়ে আসতে আপনার শ্রম ঘামও এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ সংগঠনে আপনার একটা তীব্র অনুভূতি জড়িয়ে আছে। চলুন স্বপ্ন দেখি! চলুন স্বপ্নদ্রষ্টা হই!!’
চোখ খোলে প্রথমত : অংশগ্রহণকারীগণ একে একে সংগঠনের লক্ষ্য সম্পর্কে তাদের নিজেদের অভিব্যক্তি সবার সামনে উপস্থাপন করবেন। সংগঠনের লক্ষ্য সম্পর্কে সবার ধারণাগুলো ফ্লিপচার্টে লিখে রাখতে হবে। এ ধাপে অংশগ্রহণকারীগণ পরস্পরের সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে পারবেন না, প্রয়োজনে কিছু না বুঝলে প্রশ্ন শুধু করতে পারবেন। সব ধারণাকেই স্বাগত জানাতে হবে, মনে রাখতে হবে সব ধারণাই ভালো ধারণা এবং ভবিষ্যতে সংগঠন গড়তে সম্ভাব্য আকর্ষণীয় হতেও পারে। দ্বিতীয়ত অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে অন্যদের ধারণাগুলোকে সমৃদ্ধ করার জন্য যাতে ভবিষ্যতের জন্য একটা সমৃদ্ধ আদর্শ চিত্র পাওয়া যায়।
ফলাফল : সদস্যদের ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির মাধ্যমে জানা যাবে ভবিষ্যতে তারা সংগঠনকে কোথায় নিয়ে যেতে চান।
ধাপ ২ : একটি সমষ্টিগত সৃজনশীল লক্ষ্য গড়া (৩০ মিনিট)
দ্বিতীয় ধাপে অংশগ্রহণকারীগণকে ছোট দলে ভাগ করে দিয়ে বলতে হবে ‘প্রথম ধাপের সবার ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আপনার সংগঠনের লক্ষ্য কি হতে পারে তার একটি উৎসাহব্যাঞ্জক মডেল তৈরি করুন। মডেলটি আর্থিক বা সামাজিক জগতের যে কোনো উপাদানকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে তৈরি করতে পারেন। হতে পারে একটি গাছ, প্রাণী বা যে কোনো নিরেট বস্তু।’
অংশগ্রহণকারীদের এ মডেলের মূল বৈশিষ্টগুলোর একটি তালিকা প্রণয়ন করতে বলুন যা দ্বারা তাদের সংগঠনের মডেলটিকে আগামী পাঁচ বছরে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা যায়। প্রতিটি দল তাদের ভিশন মডেলটি এমনভাবে আঁকবেন যাতে সবাই এটা দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে।
ফলাফল : সদস্যরা ভবিষ্যতে সংগঠনকে কেমন দেখতে চায় তার লিখিত দলীয় অভিব্যক্তি।
ধাপ ৩ : সংগঠনের সম্মিলিত লক্ষ্যের মধ্যে সদস্যদের ব্যক্তিগত লক্ষ্যগুলোর ঐকতান (৩০ মিনিট)
এ ধাপে সব অংশগ্রহণকারী সম্মিলিতভাবে সংগঠনের জন্য একটি সাধারণ লক্ষ্য বা ভিশন স্থির করবেন। প্রতিটি দলকে তাদের গড়া ছবি বা মডেলটি সবার সামনে উপস্থাপন করতে অনুরোধ করতে হবে। তারপর প্রতিটি দলকে তাদের পৃথক পৃথক ভিশনগুলো একত্রিত করে সংগঠনের জন্য একটি সাধারণ ভিশন এ সংক্ষেপিত করতে অনুরোধ করতে হবে। ‘আগামী ৫ বছরে আমরা একটি টেকসই...’
ফলাফল: সংগঠনের জন্য একটি সর্বসম্মত সাধারণ ভিশন বা লক্ষ্য।
ধাপ ৪ : লক্ষ্য পূরণে উদ্দেশ্য নির্ধারণ (৩০ মিনিট)
শেষ ধাপে সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে স্থির করা সাধারণ লক্ষ্যটি পূরণে উদ্দেশ্যসমূহ স্থির করবেন। উদ্দেশ্য স্থির করতে লক্ষ্যে বর্ণিত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শব্দগুলোর দিকে জোড় দিতে হবে। ওপরের উদাহরণে ৩টি প্রতিশ্রুতির নিরিখে মোট ১০টি উদ্দেশ্য স্থির করা হয়েছিল।
ফলাফল : সংগঠনের জন্য সর্বসম্মত সাধারণ মিশন বা উদ্দেশ্য।
সহায়কের জন্য নোট : দূরদর্শীতার অনুশীলনের সময় অংশগ্রহণকারীদের প্রাণবন্ত রাখতে সহায়ক যথেষ্ট উৎসাহ দেবেন যাতে তারা
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন;
মতামত যেন খুবই নির্দিষ্ট হয়;
ভবিষ্যতে নিজ নিজ সংগঠনে নাটকীয় পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা পোষণ করেন।
ড. ইমানুন নবী খান* মাহমুদ হোসেন**
* প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ** ন্যাশনাল টিম লিডার, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা