ড. মো: আলাউদ্দিন খান১ মো: মুশফিকুর রহমান২
পাতা পিয়াজ (Allium fistulosum L.) একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসলা জাতীয় ফসল। ইহা Japanese bunch ing onion নামেও পরিচিত। এ প্রজাতির গাছের মূলত দুইটি অংশ-সবুজ পাতা ও সাদা মোটা সিউডোস্টেম (Blanched pseudostem)। এ জাতীয় পিয়াজে সাধারণ বাল্ব পিয়াজের (Allium cepa L) মত বাল্ব উৎপাদন হয় না। তবে সাদা সিউডোস্টেমের গোড়ায় বাল্বের মত বৃদ্ধি (Bulb enlargement) পরিলক্ষিত হয়। এ প্রজাতির গাছ বহুবর্ষজীবী। বীজ সংগ্রহের পর পুনরায় কুশি উৎপাদনের মাধ্যমে রেটুন ফসল (Ratoon crop) হিসেবে চাষ করা যায়। ফলে একবার কোন জমিতে এ ফসল চাষ করলে নতুন করে ঐ জমিতে বীজ বপন বা চারা রোপণ করার প্রয়োজন হয় না। কেবলমাত্র পুরাতন গাছ উঠিয়ে এবং আগাছা নিড়িয়ে ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে বছরের পর বছর রেটুন ফসল চাষ করা সম্ভব।
বীজ বা কুশির মাধ্যমে পাতা পিয়াজের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। এ ফসলটির কুঁশি উৎপাদনের প্রবণতা খুবই বেশি। এ প্রজাতিটি পার্পল বøচসহ বিভিন্ন রোগ সহিঞ্চু/প্রতিরোধী (Tolerant/ resistant)। এর পাতা ও ফুলের দণ্ড (Scape) ফাঁপা। এলাইল প্রোপাইল ডাইসালফাইড থাকার কারণে এর স্বাদ ও গন্ধ সাধারণ পিয়াজের মতো। এ মসলাটি রন্ধনশালায় (Culinary) ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মূল বা হলুদ পাতা ছাড়া ফুলের দণ্ডসহ সমস্ত অংশই বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যকে রুচিকর ও সুগন্ধপূর্ণ করে তোলে। ইহা সালাদ হিসেবে কাঁচা অথবা বিভিন্ন তরকারি/অন্যান্য খাবারের সাথে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়ে থাকে। ইহা ভর্তা হিসাবেও খাওয়া যায়। সাধরণত মোটা সাদা সিউডোস্টেম মাংস বা অন্যান্য তরকারিতে এবং সবুজ পাতা সালাদ হিসেবে অথবা সুপ, নুডুলস, স্যান্ডউইজ ইত্যাদি খাবারকে সুগন্ধ করার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। ইহার যথেষ্ট পুষ্টিগুণ রয়েছে। পাতা পিয়াজের প্রতি ১০০গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে আর্দ্রতা (৭৮.৯%), আমিষ (১.৮%)চর্বি (০.১%), খনিজ পদার্থ (০.৭%), শর্করা (১৭.২%), ক্যালসিয়াম (০.০৫%), ফসফরাস (০.০৭%), লোহা (২.৩ মি.গ্রাম), ভিটামিন-এ (৩০ আইইউ), ভিটামিন-বি১ (০.২৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি (১১ মিলিগ্রাম) ও এনার্জি (৩৪ কিলোক্যালরি) আছে। এর অনেক ঔষধি গুণাবলিও রয়েছে। ইহা পরিপাক ক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে। মাথাব্যথা, বাতের ব্যথা ও ঠাণ্ডাজতি রোগ থেকে উপশমে সহায়তা করে। হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এ পিয়াজ খেলে রোগ থেকে উপশম পেয়ে থাকেন। সৌন্দর্যবর্ধক হিসেবে গোছা (ঈষঁসঢ়) আকারে পাতা পিয়াজের যথেষ্ট আকর্ষণ রয়েছে। নিচে এ জাতের পিয়াজের উৎপাদন কলাকৌশল বর্ণনা করা হলো।
মাটি ও আবহাওয়া
পাতা পিয়াজ সকল ধরনের মাটিতে জন্মে থাকে তবে বেলে দো-আঁশ ও পলি-দো-আঁশ মাটিতে ভালো ফলন দিয়ে থাকে। তবে উচ্চ এসিড ও ক্ষার মাটিতে ভাল জন্মে না। গাছ সুন্দরভাবে বৃদ্ধির জন্য মাটি ঢ়ঐ৫.৮-৬.৫ থাকা ভালো। প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটিই উত্তম। পাতা পিয়াজের জমিতে সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। ইহা ঠাণ্ডা ও গরম উভয় তাপমাত্রায় জন্মাতে পারে। অন্যান্য Allium spp. প্রজাতির তুলায় এ প্রজাতির পিয়াজের গাছ ভারী বৃষ্টির প্রতি অনেক সহিঞ্চু। জমিতে প্রতিষ্ঠিত পাতা পিয়াজের গাছ খরার প্রতিও সহিঞ্চু। দিবা দৈর্ঘ্য বেশি হলেও এ পিয়াজের গাছের বৃদ্ধি হতে থাকে অর্থাৎ আমাদের দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও এ পিয়াজের চাষ উপযোগী। এ প্রজাতির পিয়াজে নিম্ন তাপমাত্রায় ও ছোট দিনে ফুল আসে।
বীজ বপন ও চারা উত্তোলন
ফেব্রæয়ারি-এপ্রিল মাসের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। তবে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করলে কিছুদিন পরেই ফুল আসা শুরু হয়। সারি পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি বীজের দরকার হয়। বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পরে ১২ ঘণ্টা শুকনা পাতলা কাপড়ে বেঁধে রেখে দিলে বীজের অংকুর বের হয়। বীজতলায় পচা গোবর সার দিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পোকা ও ক্রিমি দমনের জন্য বীজতলায় ফুরাডান ব্যবহার করাই ভালো। পরে বীজতলায় বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিয়ে তার ওপর ০.৪-০.৫ সেমি. ঝুরঝুরে মাটি প্রয়োগ করে কলাগাছ/হাত দিয়ে বীজতলা চাপ দিতে হয়ে। বীজতলায় আগাছা নিড়ানোসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা হয়। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। চারা উত্তোলনের পর চারার ওপর থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছেঁটে ফেলে দিয়ে চারা লাগাতে হয়। এর ফলে লাগানোর পরে চারা থেকে কম পরিমাণে পানি বের হয় এবং চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে উঠে। এক হেক্টর জমির জন্য ৬-৬.৫ লক্ষ চারার প্রয়োজন হয়।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
মূল জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। চাষের আগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পচা গোবর সার দিতে হয়। এ প্রজাতির পিয়াজে কুশি উৎপাদনের প্রবণতা বেশি থাকায় সাধারণ বাল্ব পিয়াজের তুলনায় রোপণ দূরত্ব বেশি দিতে হয়। এর চারা বা কুশি ২০ সেমি. x ১৫ সেমি. অথবা ২০ সেমি. x ২০ সেমি. দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করা হয়। চারা একটু গভীরে লাগানো ভালো।
সার প্রয়োগ
জমির উর্বরতার ওপর ভিত্তি করে সারের পরিমাণ নিরূপণ করতে হয়। পাতা পিয়াজ উৎপাদনের জন্য জমিতে পচা গোবর সার ৪০০০-৫০০০, ইউরিয়া ১৫০-২০০, টিএসপি ১৫০-২০০, এমওপি ১০০-২৫০ এবং জিপসাম ১০০-১২০ কেজি/হেক্টর প্রয়োগ করতে হয়। জমি চাষের আগে সম্পূর্ণ পচা গোবর সার এবং শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমান দুইভাগ করে চারা রোপণের ৩০ ও ৬০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর প্রয়োজন হলে পানি সেচ দিতে হবে।
রোগবালাই দমন
পাতা পিয়াজ পার্পল বøচ ও অন্যান্য বøাইট রোগের প্রতি প্রতিরোধী। তবে কোন রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড/ডাইথেন এম-৪৫/ রোভরাল এর যে কোনো একটি বা একাধিক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা যেতে পারে। থ্রিপস ও কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এ সমস্ত পোকা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। থ্রিপস দমনের জন্য এডমায়ার বা টিডো (১ মিলি/লিটার) ১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য আগাছা পরিষ্কার, আবর্জনা আগুনে পোড়া, শস্যাবর্তন ইত্যাদি সমন্বিত ব্যবস্থা করা উত্তম।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
পাতা পিয়াজ সংগ্রহকালীন সময় ইহার মাটির উপরের সম্পূর্ণ অংশ সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস পরেই প্রথমে পাতা সংগ্রহ করা যায়। ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসে বীজ বপন করলে নভেম্বর পর্যন্ত গাছ থেকে গড়ে ৩-৪ বার পাতা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায় অথবা যেকোন সময় সম্পূর্ণ গাছ উঠিয়ে খাওয়া যায়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করলে সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। কারণ ডিসেম্বর থেকে ফুল আসা শুরু হয়। প্রথমে সংগ্রহের ২০-২৫ দিন পরপর পাতা সংগ্রহ করা যায়। গাছটি তুলে মূল এবং হলুদ পাতা কেটে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। ছোট ছোট আটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ৭.৫-৮.৫ টন পাতা এবং সাদা অংশসহ ১২-১৫ টন ফলন পাওয়া যায়।
বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
ফেব্রæয়ারি থেকে নভেম্বর মাসের যখনই বীজ বপন করা হোক না কেন মূল জমিতে রোপণের পর ডিসেম্বর মাসে পাতা পিয়াজের ফুল আসা শুরু হয়। ইহা পরপরাগায়িত ফসল। তাই জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি জাতের মাঠ থেকে অন্য জাতের মাঠের দূরত্ব কমপক্ষে ১০০০ মিটার বজায় রাখতে হবে। সকল আম্বেলের (কদম) বীজ একসাথে পরিপক্ব হয় না। তাই কয়েক দিন পরপর পরিপক্ব আম্বেল সংগ্রহ করা হয়। একটি আম্বেলের মধ্যে শতকরা ১০-১৫টি ফল ফেটে কালো বীজ দেখা গেলে আম্বেলটি কেটে বা ভেঙে সংগ্রহ করতে হবে। মাঠে সমস্ত আম্বেল সংগ্রহ করতে ৪-৫ দিন সময় লাগতে পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সামান্য দেরিতে বীজ সংগ্রহ করলে আম্বেল থেকে সমস্ত বীজ ঝড়ে মাঠিতে পড়ে যায়। পাতা পিয়াজের বীজ সধারণত ফেব্রæয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। বীজ আম্বেল সংগ্রহ করার পর রোদে শুকিয়ে হালকা লাঠি দ্বারা পিটিয়ে বীজ বের করা হয়। পরে বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ছিদ্রবিহীন পলিথিন বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম। হেক্টর প্রতি ৮০০-৯০০ কেজি বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে।
এ দেশে বাল্ব পিয়াজের যথেষ্ট ঘাটতি থাকার কারণে পিয়াজের সারাবছর চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে বসতভিটাসহ মাঠপর্যায়ে সারাবছর (Year-round) এ জাতের চাষ করা সম্ভব। এ ছাড়াও পাতা পিয়াজ বাসাবাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে ও টবেও চাষ করা যায়। আশা করা হচ্ছে এ জাতের পাতা পিয়াজ চাষের মাধ্যমে একদিকে সাধারণ বাল্ব পিয়াজের পরিবর্তেও এটি ব্যবহার করা যাবে। পাতা পিয়াজ তরকারিতে ব্যবহার করলে সাধারণ পিয়াজ ব্যবহারের কোনো প্রয়োজনই হয় না। অন্য দিকে সাধারণ বাল্ব পিয়াজের সাথে সংকরায়নের মাধ্যমেও রোগমুক্ত উন্নত জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। যেহেতু সহজেই সারাবছর বারি পাতা পিয়াজ-১ চাষ করা সম্ভব সেহেতু পিয়াজের বিকল্প হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিধায় বাংলাদেশে পিয়াজের ঘাটতি মিটাতে পাতা পিয়াজ চাষের কোনো বিকল্প নেই। এক হেক্টর জমিতে পাতা পিয়াজ উৎপাদন খরচ হয় ৮৫,০০০-৯০,০০০ টাকা এবং খরচ বাদে ১,৫০,০০০-২,০০,০০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবাইল : ০১৭১১৫৭৩৩৬১, ই-মেইল : khanalauddirsrsc@gmail.com, ২বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর, মোবাইল : ০১৭২৩৮৭৯৪৫৩৮, ই-মেইল : musfiqur bari@gmail.com
বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় এক পবিত্র ফল ত্বীন (ডুমুর)
ড. শামীম আহমেদ
বাংলাদেশ আয়তনের তুলনায় বেশ ছোট একটি দেশ, তার উপর প্রবল জনসংখ্যার চাপ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনার কারণে ফসলি কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর। এত কিছুর পরও বাংলাদেশর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে সীমিত সাধ্য নিয়েই কৃষি খাতে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। কৃষিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পাট রপ্তানিতে ১ম, পাট ও কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, ধান ও সবজি উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপদনে ৮ম ও ফল উৎপাদনে ২৮ তম। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই এই সফলতা অনেকটা সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। জমির বিবেচনায় মূল্যায়ন না করে ছোট, মাঝারি ও মধ্যমমানের পাহাড়ি এলাকা এবং বাড়ির আঙ্গিনাতে ছোট ছোট ফলের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র গড়ে তোলার এক দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। আজকাল কিছু গ্রাহক তৈরি হয়েছে যাদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট বাজার রয়েছে যেখান থেকে তারা কৃষকদের নিজের উদ্ভিদ থেকে বা বাগান থেকে তাজা ফল সংগ্রহ করে উপভোগ করতে পছন্দ করেন। এসব ফলকে কেউ কেউ ফার্মফ্রেশ বা অর্গানিক বাগান নামে পরিচয় দেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব স্থানে এগ্রো টুরিজমও গড়ে উঠেছে। এসব বাগানে অনেক প্রকৃতির এক্সোটিক ফল বা গৌণ ফলের চাষাবাদ হচ্ছে। এমনই এক এক্সোটিক ফলের নাম ত্বীন বা ডুমুর। ইংরেজিতে এই ফলকে বলা হয় ঋরম যার বৈজ্ঞানিক নাম ভরপঁং পধৎরপধ যা গড়ৎধপবধব পরিবারের অন্তর্গত। এর মধ্যে রয়েছে ৬০০ থেকে ১৯০০ এরও বেশি জাত, যার বেশির ভাগ জন্মে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উদ্যানতত্ত্বের সাথে ডুমুর ফলের নাম দীর্ঘকাল ধরে জড়িত। সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এই ফলকে ত্বীন (ডুমুর) নামে ডাকলেও অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত।
পবিত্র কুরআন মাজিদের আত-ত্বীন সূরায় বর্ণিত ত্বীন ও জয়তুন ফলের গুণাগুণ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। সেই ত্বীন বা ডুমুর গাছগুলো সাধারণত পাতলা, দ্রুত বর্ধনশীল এবং বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যার ফলে গাছগুলো উচ্চতার চেয়ে প্রস্থে বেশি হয়ে থাকে। ত্বীন চরম জলবায়ু অর্থাৎ শুষ্ক ও শীত প্রধান দেশে চাষ হলেও আমরা প্রমাণ করেছি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতেও ৩৬৫ দিন এ ফল উৎপাদন সম্ভব।
ডুমুরের অনুমোদিত কোনো জাত নাই। তবে বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে ডুমুরের যে গাছগুলো হয় সে ডুমুরগুলো হলো জগডুমুর। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঋরপঁং ৎধপবসড়ংধ। জগডুমুরের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। কোনোটি বিশ-ত্রিশ গ্রাম, আবার কোনোটি পঞ্চাশ-ষাট গ্রাম ওজনের হয়। পাকলে কোনোটি লাল, আবার কোনোটি হলুদ রঙ ধারণ করে।
এ ছাড়াও আরেক প্রজাতির মূল্যবান ডুমুর আছে, যেটিকে মিসরীয় ডুমুর (ঊমুঢ়ঃরধহ ঋরপঁং) বলা হয়। এটি খুব রসালো ফল ও অনেক বড় হয়। এটি দু’ভাবে খাওয়া যায়। একটি হলো কাঁচায় সরাসরি খাওয়া যায়। অন্যটি হলো রোদে শুকিয়ে কাঁচের কন্টেইনারে রেখে সারা বছর খাওয়া যায়।
প্রতিটি গাছ থেকে প্রথম বছরে এক কেজি, দ্বিতীয় বছরে ৭ থেকে ১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ কেজি পর্যন্ত ফল ধরে। এভাবে ক্রমবর্ধিত হারে একটানা ৩৪ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। গাছটির আয়ু হলো প্রায় ১০০ বছর। তিন মাসের মধ্যেই শতভাগ ফলন আসে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডুমুর আকৃতির এই ফল সবার দৃষ্টি কেড়েছে। প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ত্বীন ফল জন্মে থাকে।
ত্বীন বা ডুমুরের জৈবিক বৈশিষ্ট্য
ডুমুর ফল একটি সমন্বিত বা কম্পোজিট আকৃতির ফল যা মূলত : ফাঁকা শেলের মধ্যে অভ্যর্থনা টিস্যু বা ৎবপবঢ়ঃধপষব ঃরংংঁব দ্বারা ঘেরা পৃথক পৃথক স্ত্রী ফুল থেকে শত শত পৃথক পেডিকেলেট ড্রপলেটস আকারের অভ্যর্থনা প্রাচীরের আস্তরণ থেকে বিকাশ লাভ করে। কম্পোজিট আকৃতির ফলকে বলা হয় ‘ংুপড়হরঁস’। একটি পরিপক্ব ডুমুর ফলের ত্বক শক্ত চামড়া বিশিষ্ট সাদা রঙের হয়ে থাকে। ভেতরে একটি মিষ্টি জিলেটিনাস সজ্জা সমন্বিত পৃথক পৃথক পাকা ড্রপলেটের অস্তিত্ব বিশিষ্ট বীজ বিদ্যমান। এই পুরো অভ্যন্তরীণ অংশটিই ভক্ষণযোগ্য। স্বতন্ত্র ফলের পাশাপাশি ডুমুর পরাগায়ন বায়োলজিও বেশ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। জংলি ডুমুর গাছে একই ‘ংুপড়হরঁস’ এ কার্যকরী পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ফুলই বিদ্যমান। ভক্ষণযোগ্য ডুমুরের স্ত্রী ফুল সাধারণত বড় আকৃতির হয় এবং রসালো ফ্রুটলেট তৈরি করে।
ত্বীন বা ডুমুর গাছের আকৃতি ও চারা মূল্য
ত্বীন গাছগুলো দ্রুতবর্ধনশীল, ঝোপালো আকৃতির হওয়ায় এই গাছগুলো যেমন বৃদ্ধি কম হয়, তেমনি এর কাণ্ড খুব নরম প্রকৃতির হয়। তাই ত্বীন বা ডুমুরের যেমন কাটিং করে বংশবিস্তার করা যায় তেমনি বীজ থেকেও চারা উৎপাদন করা যায়। প্রতিটি গাছ ছয় থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছে ন্যূনতম ৭০ থেকে ৮০টি ফল ধরে। খোলা মাঠ ছাড়াও টবের মধ্যে ছাদ বাগানে ত্বীন চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। দুই মাস বয়সি চারার পাইকারি মূল্য ৫২০ টাকা ও খুচরা মূল্য ৭২০ টাকা।
মাটিতে কিংবা টবে ত্বীন বা ডুমুর ফলের চাষাবাদ পদ্ধতি
কোনো রাসায়নিক সার ছাড়াই, মাটিতে জৈব ও কম্পোস্ট সার মিশিয়ে রোদে মাঠে ও ছাদে টবে লাগিয়ে ত্বীন ফল উৎপাদনে সাফল্য পাওয়া গেছে। তাই ছাদবাগানীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফল গাছের তুলনায় ডুমুর গাছে খুব দ্রুত ফল ধরে। একটি ডুমুরের কাটিং চারা লাগানোর ৪-৫ মাস পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। তাই গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকেই টবের গাছকে নিয়মিত অল্প করে সরিষার খৈল পচা পানি দিতে হবে। সে অনুযায়ী ১০-১৫ দিন পর পর সরিষার খৈল পচা পানি প্রয়োগ করতে হবে। সরিষার খৈল গাছে দেওয়ার কমপক্ষে ১০ দিন আগেই পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে সেই পচা খৈলের পানি পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। ১ বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থে এবং ৬ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। টবের মাটি পরিবর্তনের কাজটি সাধারণত শীতের আগে ও বর্ষায় শেষ করাই ভালো হয় । টব বা ড্রামের মাটি ১০-১৫ দিন পর পর কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।
ত্বীন বা ডুমুরের পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
পোকামাকড়ের মধ্যে গবষড়রফড়মুহব, ঘবসধঃড়ফধ দ্বারা ডুমুর গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। অৎঃযৎড়ঢ়ড়ফ এর দ্বারাও ডুমুর গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে ফল ভেঙে যাওয়া রোগ (ভৎঁরঃ ংঢ়ষরঃঃরহম) হতে দেখা যায়। অষঃবৎহধৎরধ, অংঢ়বৎমরষষঁং, ইড়ঃৎুঃরং, এবং চবহরপরষষরঁস ছত্রাক রোগ দমনে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয়। ডুমুরের আর একটি কমন রোগ হলো ভরম সড়ংধরপ ফরংবধংব (ঋগউ) যা হলে ডুমুর গাছ মোজাইকের মতো হলুদ রং ধারণ করে। এ সমস্ত রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে নিকটবর্তী কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে পরিমিত বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
ত্বীন বা ডুমুর ফলের পুষ্টি গুণাবলি
ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ছাড়াও প্রায় সব রকমের জরুরি নিউট্রিশনস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি আছে। ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাবজনিত রোগে এটি বেশ কার্যকরী। কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফ্যাট, প্রোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ছাড়াও বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ডুমুর। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি ডুমুরের অনেক ঔষধি গুণও রয়েছে। ডুমুর কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে সহায়তা করে। ডুমুর দেহের ওজন কমানো, পেটের সমস্যা দূর করা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখাসহ নানা উপকার করে থাকে। মৃগীরোগ, প্যারালাইসিস, হৃদরোগ, ডিপথেরিয়া, প্লীহা বৃদ্ধি ও বুকের ব্যথায় ডুমুর কার্যকরী। ডুমুর শরীরে এসিডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। শরীরে পিএইচের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। ডুমুর পাতা ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালের নাশতার সঙ্গে ডুমুরের পাতার রস খেতে হবে। ডুমুর ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও ডুমুর গাছের কষ পোকার কামড় বা হুল ফুটানো ব্যথা নিরাময়ে কার্যকরী।
ত্বীন বা ডুমুরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে ব্যাপক ত্বীন চাষাবাদের ফলে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি বিকল্প আরেকটা সম্ভাবনা হিসেবে ত্বীন ফলের চাহিদা দেখা দিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই ফল রপ্তানি করে আন্তর্জাতিকভাবে বাজার ধরা সম্ভব। ত্বীন একটি সম্ভাবনাময় ফসল। যা চাষ করে দেশের বেকারত্ব দূর এবং রপ্তানি করে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে চাষাবাদকৃত ত্বীন বা ডুমুরের জাতগুলোর মধ্যে ফল নীল, মেরুন, লাল, হলুদসহ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এখানকার গাছে প্রতিটি ত্বীন ফল ওজনে ৭০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডুমুরের প্রতি কেজির মূল্য এক হাজার টাকা। ফলের পাশাপাশি শৌখিন চাষিরা চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায় টবসহ ফল ধরা চারা বিক্রি হচ্ছে। রমজানে পবিত্র ফল হিসেবে খেজুরের পাশাপাশি ত্বীন ফলকে নিয়েও অনেকে ভাবছেন। দেশের প্রচার মাধ্যমে ত্বীন ফলের চাষ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়াও বিদেশ থেকে ত্বীনের আমদানি নির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া বাজারেও এই ত্বীন ফলের একটি বড় ব্যবসায়িক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্সোটিক বা গৌণ ফল হিসেবে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুটস কিংবা এভোকেডোর চেয়ে ত্বীন ফলের চাহিদা বেশি। য়
অতিরিক্ত উপপরিচালক, হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি। মোবাইল : ০১৭১১১৭৪৩৪৫
ইমেইল : ashamim.uni@gmail.com
ছাদ কৃষি
মো. শামীম সেখ
ছাদ বাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদ বাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। বিশ্বব্যাপী নগরায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর নগরায়নের প্রভাবে নগর কৃষি দিনে দিনে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে কৃষির এ খাত গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাদ বাগান স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে। যেমন-ছাদ বাগান পরিকল্পনা; উপকরণ সংগ্রহ; মাটি প্রস্তুতি; টবে মাটি ভরাট; উদ্ভিদ নির্বাচন।
ছাদ বাগান পরিকল্পনা
ছাদ বাগান করার জন্য দৃঢ় মানসিক প্রস্তুতি দরকার এবং ছাদ বাগানের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও ভালো উৎপাদনের জন্য সঠিক পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। ছাদ বাগান স্থাপনের আগে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে যে, ছাদ বাগান করার উপযোগী কি না? অর্থাৎ ছাদ গাছপালার ওজন বহন করার মতো যথেষ্ট মজবুত কি না? পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো কি না? পরিকল্পনা ও নকশা নিজে করা ভালো। তবে ল্যান্ডস্কেপ হর্টিকালচারিস্ট দ্বারাও ডিজাইন করানো যেতে পারে।
পারিবারিক ছাদ বাগানের পরিকল্পনা ও নকশা করার ক্ষেত্রে ছাদের আকার ও আয়তন অনুযায়ী পেন্সিল দিয়ে একটি নকশা একে নিতে হবে। নকশায় ছাদের চারপাশের সীমানা ও মাপ নির্ধারণ করতে হবে। চলাচলের সুবিধার জন্য খানিকটা খোলা জায়গা রাখতে হবে। ছাদের আয়তন বেশি হলে ছাদকে কয়েকটা অংশে ভাগ করে প্রতি অংশের মাঝে প্রায় ১ থেকে ১.৫ মিটার চওড়া করে চলাচলের পথ রাখতে হবে। এবার ছাদের যে কোন এক কিনারা থেকে পরিকল্পনা ও নকশা আঁকা শুরু করতে হবে। ছাদের যে কোন এক কোণে বা চিলে কোঠার সাথে লোহার পাইপ বা কাঠের খুঁটি লাগিয়ে যাতে একটি মাচা করা যায় সেটা নকশায় রাখতে হবে। ভেতরের এক এক অংশে এক এক ধরণের গাছ রাখা বা লাগানোর জন্য কাঠামো তৈরি বা টবের জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। অবশ্যই পানির উৎস নকশায় রাখতে হবে। ছাদে বাগান করতে হলে কিছু জিনিসপত্র রাখার জায়গাও দরকার হয়। তাই নকশায় কোঠাঘরের জায়গা রাখতে হবে। বাগানের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য ছাদে মাঝের দিকে ফল গাছ লাগালে ভালো হয়। ছাদের কিনারায় যদি কিছু লতানো গাছ লতিয়ে দেয়ার কথা ভাবেন, তবে ছাদের রেলিংয়ের উপরে অনুচ্চ গ্রীল বা রেলিংয়ের ভেতরে বা বাইরের দিকে লোহার কিছু ক্ল্যাম্প বা হুক লাগিয়ে রাখা ভালো। যে কোনো গাছের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যালোক একটি অপরিহার্য বিষয়। তাই বাগানের নকশা তৈরি করার সময় ছাদের কোন দিক থেকে রোদ আসে এবং ঋতুভেদে রোদ কোনদিকে সরে যায় ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে। ছাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য খোলা জায়গায় লন তৈরি এবং একটি বসার শেড ও তৈরি করা যেতে পারে তবে শেডের আকার ছাদের সাথে মানানসই হতে হবে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
ছাদ বাগানের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাদি কোদাল, গার্ডেন ফর্ক, বাডিং নাইফ, সিকেচার, প্রুনিং শেয়ার, করাত, ব্যালেন্স, ডিবলার, ওয়াটারিং ক্যান ইত্যাদি সংগ্রহে রাখতে হবে। পাত্রসমূহের মধ্যে ট্রে, সীডপ্যান, পট, প্লাস্টিক পট, গ্রোইংব্যাগ, বালতি, পলিব্যাগ, ড্রাম, হাফ ড্রাম, মাটির বোল ইত্যাদি।
মাটি প্রস্তুত
টবে/ পটের গাছ বৃদ্ধির সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে মাটির মিক্সার তৈরি করার উপর। মাটি গুঁড়া করে, মাটি থেকে অনাকাক্সিক্ষত বস্তু অপসারণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাটি নিয়ে, প্রতি কেজি মাটির জন্য ০.৫ গ্রাম (মাটির ঢ়ঐ ৫ থেকে বেশি হলে)/১ গ্রাম হারে (মাটির ঢ়ঐ ৫ এর কম হলে) করে ডলোচুন মিশিয়ে, ৮- ১০ দিন পলিথিনে মুড়িয়ে রাখতে হবে। শোধনকৃত মাটিতে পরিমাণমতো গোবর ও কোকোপিট মিশিয়ে প্রতি কেজি মিশ্রণের জন্য ১ গ্রাম হারে ইউরিয়া, টিএসপি এবং ০.৫ গ্রাম হারে এমওপি যোগ করতে হবে। পটে/টবে মাটি: গোবর: কোকোপিট মিশ্রণের অনুপাত হবে ২:১:১।
টবে মাটি ভরাট
টব থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্যে টবের নিচে তিন থেকে চারটি ছিদ্র রাখতে হবে। টবের তলায় ২/৩ সেমি. পুরু করে ইটের খোয়া সাজাতে হবে এটা যদি সম্ভব না হয় তবে ছিদ্রের উপরিভাগে ভাঙ্গা টবের ৩ অথবা ৪টি অংশ কিংবা ইটের টুকরা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে ছিদ্রগুলো মাটিদ্বারা বন্ধ না হয়ে যায়। টবে মাটি ভরার সময় টবের উপরিভাগে ০.৫ থেকে ১ ইঞ্চি পরিমাণ এবং হাফ ড্রামের ক্ষেত্রে ১.০ থেকে ১.৫ ইঞ্চি ঠিকমতো সার ও পানি দেয়ার জন্য খালি রাখতে হবে। সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত টব/পট ভরাট করতে হবে। ভরাটকৃত পট ১২-১৫ দিন ফেলে রাখার পর চারা রোপণ/বীজ বপন করতে হবে।
উদ্ভিদ নির্বাচন
ছাদ বাগানের জন্য এমন গাছ নির্বাচন করতে হবে যার জাত খর্বাকার, মূলের গভীরতা কম এবং সারা বছর ফল দেয়। ছাদ বাগানের জন্য উপযোগী ফলের জাত হচ্ছে, বারি আম-৩ (আম্রপালি), বাউ আম-২ (সিন্দুরী), থাই কাঁচা মিঠা, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, বারি আম-১১, কাটিমন, সূর্য ডিম, পুনাই, বারি পেয়ারা-২, ইপসা পেয়ারা-১, থাই পেয়ারা, বাউ কুল-১, ইপসা কুল-১ (আপেল কুল), থাই কুল-২, বারি লেবু-২, বারি লেবু-৩, বাউ কাগজি লেবু-১। বারি আমড়া-১, বাউ আমড়া-১, থাই আমড়া, থাই মিষ্টি করমচা। গনেশ, পাকিস্তানি ড্রাগন ফল, বারি কমলা-১, বারি মাল্টা ১, বারি মাল্টা-৪। বাউ জামরুল-১ (নাসপাতি জামরুল), বাউ জামরুল-২ (আপেল জামরুল) ইত্যাদি। নানা ধরনের শাকসবজি লাগানো যায়। যেমন- লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমীশাক, পুইঁশাক, চুকুর, ক্যাপসিকাম, লেটুস, বেগুন,টমেটো, ঢেড়স, শিম, বরবটি, করলা, লাউ, ধুন্দল ইত্যাদি। সৌন্দর্য্য ও মনের প্রশান্তির জন্য বিভিন্ন ফুল যেমনÑ গাধা, গোলাপ, বেলী, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, জবা, টিকোমা, জারবেরা, শিউলি, এলামন্ডা ইত্যাদি। মসলা ও ঔষধিগুণসম্পন্ন মরিচ, ধনেপাতা, বিলাতি ধনিয়া, পুদিনা, কারিপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, অ্যালোভেরা, তুলসী, থানকুনি, ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।
সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
ছাদ বাগানে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ সেচ ব্যবস্থাপনা। নিয়মিত পরিমিত সেচের উপর ছাদ বাগান স্থাপনের সফলতা নির্ভর করে। পানি কম দেয়া যেমন ক্ষতিকর তেমনই অতিরিক্ত পানি দেয়াও গাছের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি দেয়ার ফলে টবের/ পটের গাছে বিভিন্ন রোগ দেখা এমনকি গাছ/চারা মারাও যায়। এজন্য কেবলমাত্র গাছের গোড়া শুকালেই পানি দেয়া যাবে, গোড়া ভেজা থাকলে কোনো মতেই পানি দেয়া যাবে না। বর্ষাকালে খেয়াল রাখতে হবে শিম, মরিচ, বেগুন ইত্যাদি গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকেলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে অন্যথায় ঢলে পরা রোগে আক্রান্ত হবে। ছাদের গাছ একবার ঢলেপড়া রোগে আক্রান্ত হলে তা থেকে আর ভালো ফলন আশা করা যায় না। বর্ষার সময় ব্যতীত ছাদ বাগানে সকাল বিকেল পানি দেয়া উত্তম তবে গরমে অবশ্যই সকাল বিকালে পানি দিতে হবে। গরমের সময় পানি দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে পাইপের পানি যেন গরম না থাকে। প্রখর রোধে অবশ্যই পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গাছে ফুল আসার সময় পানির পরিমাণ কম দিতে হবে তবে নিয়মিত গোড়ায় অল্প পরিমাণ পানি দিতে হবে না হলে পানির অভাবে ছাদ বাগানের গাছের ফুল ঝরে যাবে। কুমড়াজাতীয় গাছে অবশ্যই ঠিকমতো সেচ দিতে হবে না হলে কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি তথা ফলন পাওয়া যাবে না। ছাদ বাগানের জন্য ড্রিপ বা বিন্দু সেচ খুবই উপযোগী একটি পদ্ধতি ড্রিপ সেচ হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে গাছের শিকরে সঠিক এবং সুষম হারে পানি প্রয়োগ করা যায়। এ ছাড়া পানিতে দ্রবণীয় সার সঠিক মাত্রায় গাছে প্রয়োগ করা যায়। ড্রিপ সেচ একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে ছিদ্রযুক্ত নলের সাহায্যে গাছের গোড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় সেচ দেয়া হয় এতে পানির কোন অপচয় হয় না। যেখানে সেচের জন্য পানি অপ্রতুল সেখানে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
সার ব্যবস্থাপনা
ছাদ বাগানে সার প্রয়োগের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দুই (২) সপ্তাহ পরপর অল্প পরিমাণ সার স্প্রে করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম টিএসপি, ১-২ গ্রাম বোরণ সার ভাল করে গুলে নিতে হবে ( সেক্ষেত্রে টিএসপি সার ৩/৪ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখা ভাল)। ২য় পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে (১ম বারের ২ সপ্তাহ পর) ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৫ গ্রাম জিংক গুলিয়ে নিতে হবে। ৩য় পর্যায়ে ১ লিটার পানিতে (২য় বারের ২ সপ্তাহ পর) ৫ গ্রাম ইউরিয়া, ২-৩ গ্রাম এমওপি সার গুলিয়ে, চারা/ছোট গাছের ক্ষেত্রে ৪/৫টি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে, বড় গাছের ক্ষেত্রে (বড় টবে হলে) ২টি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে, আবার হাফ ড্রামে হলে ১টি গাছের গেড়ায় প্রয়োগ করা যেতে পারে। এভাবে অল্প অল্প সার আবর্তকভাবে প্রয়োগ করলে ছাদ বাগানে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। সার মিশ্রিত পানি পড়ন্ত বিকেলে প্রয়োগ করা ভাল তবে গাছের গোড়ার মাটিতে ঐ পরিমাণ সার মিশ্রিত পানি প্রয়োগ করতে হবে যাতে গোড়ার মাটি পরের দিন শুকিয়ে যায় । বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় অতিরিক্ত পানি না জমে সেভাবে সেচ দিতে হবে। ছাদ বাগানে জৈবসার ব্যবহার সব থেকে উত্তম।
অন্যান্য সাধারণ ব্যবস্থাপনা
কিউকারবিটস জাতীয় ফসলের পরাগায়ণজনিত সমস্যা রোধে হস্তপরাগায়ন করা প্রয়োজন। সাদা মাছি পোকা, জাবপোকা, ফলের মাছি পোকা, ডগা ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, লিফমাইনর ইত্যাদি ছাদ বাগানে খুব বেশি দেখা যায়। এগুলো দমন করার জন্য সঠিক নিয়মে ফেরোমন ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণ তামাক পানি অথবা নিমতৈল অথবা সাবান পানি বা অন্যান্য জৈব বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে। ছাদ বাগান সম্পার্কিত যে কোন প্রয়োজনে স্থানীয় মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। য়
মনিটরিং অফিসার, নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক (পাইলট) প্রকল্প, মোবাইল নং: ০১৭১৭০৩৩৯৩২, ইমেইল: kbdshamimshaikh@gmail.com
স্ট্রবেরি
মো. আবদুস সবুর মণ্ডল*
যদি চাষ করেন স্ট্রবেরি ভাগ্য ফেরাতে হবে না দেরি
নিজের সংসার চলবে বেশ সমৃদ্ধও হবে আমার দেশ।
গাছ লাগানোর দুই মাসে সব গাছে ফুল আসে
এরপরেও ৩০ দিন গুণে ফল তুলে নিন।
এইভাবে তুলুন ফল সাড়ে তিন মাসকাল।
পাকা ফল খান নিজে বাড়তি ফল রাখুন ফ্রিজে।
মূল্য যার আকাশ ছোঁয়া ২৫০ টাকা প্রতি পোয়া।
সুযোগমতো বাজারে দেন নগদ টাকা বুঝে নেন।
এগিয়ে আসুন সাধক চাষা এবার পুরাবো মনের আশা।
আমরা দেশের গর্ব দেশের সেবা করব
চেষ্টা করলে শেষটা উন্নত হবে দেশটা।
. . . . . . . . .
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি সবাই মিলে
দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
এসে মা জননী সোনামণি সবাই মিলে দেব পানি
এসো ভাই সবাই মিলে এটা আমার দাবি।
তাড়াতাড়ি নাওগো মেনে
স্ট্রবেরি চাষ করলে ভাগ্য ফিরবে রাখ জেনে।
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি
সবাই মিলে দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
ওরে একটি বাড়ি একটি খামার
হয়ে যাবে তোমার আমার।
টাকায় ভরবে পকেট মোদের
আল্লাহ তায়ালা ফসল দিলে
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি।
সবাই মিলে দেশটা গড়ি কর চাষ স্ট্রবেরি।
কেজি ৬০০ নয়কো পাকা
অধম চাষি সবুর বলে স্ট্রবেরি চাষ করলে
টাকার অভাব যাবে চলে
কর চাষ স্ট্রবেরি তাড়াতাড়ি
সবাই মিলে দেশটা গড়ে কর চাষ স্ট্রবেরি।
. . . . . . . . . .
রসাল ফল স্ট্রবেরি চাষ কর তাড়াতাড়ি ওরে চাষি ভাই
চাহিদা তার বিশ্বব্যাপী তুলনা যার নাই।
পুষ্টিগুণে ভরপুর রোগবালাই হবে দূর
ফল খেলেও রোগবালাই যাবে ভাই।
কৃষকবান্ধব আমাদের সরকার
ঘটাতে চাষের প্রসার হয়েছে বদ্ধ পরিকর
প্রতি কেজি ৬০০ টাকা একথাটি নয়কো ফাঁকা
প্রতি গাছে ৪শ’র মতো ফল পাওয়া যায়
সাড়ে চার হাজার গাছে বিঘাপ্রতি কত আসে
হিসাব করলে পাবে রায়।
জিরো থেকে হিরো হতে বেশি পুঁজি লাগে না
চাষের কাজ করতে শুরু ধরতে কিন্তু হবে গুরু।
শুনতে যত সহজ কাজে তত সহজ নয়
বীজ হয় না এ গাছে তবে আবার মজা আছে
লতি কচুর মতো করে বাড়ে এ গাছ
গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখতে আছে অনেক কাজ
প্রতিকূল আবহাওয়ায় গাছগুলো যায় মরে
মরে যাওয়ার আগে কিন্তু নোটিশ দেয় না
যেতে হবে নিয়ম ধরে ধৈর্যের সাথে কাজ করে
তবে ফল পাওয়া যাবে মিছে কথা না।
বাড়ি আঙিনায় ঘরের ছাদে স্ট্রবেরি লাগানো যাবে
নিজের লাগানো ফল খাবে বেড়ে যাবে আয়
তাই আর না করে দেরি চাষ করুন স্ট্রবেরি
লেগে যান সবাই মিলে দেশের সেবায়।
*গোপালপুর ২নং ওয়ার্ড, পুরাইকালী, পাইকগাছা পৌরসভা, খুলনা ০১৯৪৪৮৪১৪২১
কৃষিবিদ ড. মোঃ আবুল কালাম আল আজাদ
দেশি খেজুর গাছ (Phoenix sylvestris) বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রস ও ফল সংগ্রহের আবহমান পদ্ধতি। যাহা ব্যবহার করা হয় রস সংগ্রহ, ফল সংগ্রহ, ঘরের চাহনী ও জ¦ালানি কাঠ হিসেবে। গাছের রস দিয়ে উন্নত মানের সিরাপ তৈরি করা হয়। তাই ইহা একটি পুরাতন গাছ ফসল (Fayadul and Al showiman, 1990). বাংলাদেশে সাধারণত দেশি খেজুর সব জেলাতে উৎপন্ন হয়। তবে দেশের যশোর ফরিদপুর, নাটোর, মাগুরা, খুলনা ও চরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে উৎপন্ন হয়। ইহার স্ত্রী গাছ ও পুরুষ গাছ আলাদা হয়। স্ত্রী গাছ ও পুরুষ গাছ হতে রস আহরণ করা হয় এবং স্ত্রী গাছ হতে ফলও উৎপন্ন হয়। ইদানীং দেশের কিছু প্রগতিশীল চাষি আরবীয় খেজুরের চাষ করে যাহা এখনও আমাদের দেশে পরীক্ষাধীন অবস্থায় আছে। আরবীয় খেজুর গাছ হতে শুধুমাত্র আরবীয় খেজুর ফল সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত স্ত্রী গাছের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা প্রায় স্ত্রী গাছ হয় এবং ফল ধরে। এক্ষেত্রে স্ত্রী গাছের বাগানে পুরুষ গাছও থাকতে হয় যাতে পরাগায়ন হতে পারে। তাই স্ত্রী গাছের টিস্যু কালচারের মাধ্যমে এর বিস্তার ব্যাপক হারে ঘটানো সম্ভব।
দেশি খেজুরের চারা উৎপাদন ও রোপণ পদ্ধতি
সাধারণত দেশি খেজুরের বীজ বীজতলায় বপন করে তৈরি করা যায়। বীজতলার মাটি বেলে মিশ্রিত ভিটা মাটি হলে ভালো হয়। তাহলে চারা গজাতে সুবিধা হয়। তবে পলিব্যাগে ও চারা উৎপাদন করা যায়। ভালো গুণাগণ সম্পন্ন মাটি দিয়ে পলিব্যাগ তৈরি করে খেজুরের বীজ উলম্বভাবে ১.৫ সেমি.-২ সেমি. পলিব্যাগের ভেতরে বপন করলে ১.৫- ২ মাসের মধ্যে বীজ হতে চারা গজানো হয়। তবে অঙ্কুরোদগম হার বৃদ্ধি করার জন্য বীজকে খালি পাত্রে ২ দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং এই ২ দিনে প্রতিদিন ১বার করে বীজগুলোকে পানিতে নেড়ে চেড়ে পুরাতন পানি ফেলে দিয়ে নতুন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তার পর বীজগুলোকে পলিব্যাগে বা বীজতলায় বসিয়ে দিতে হবে। অঙ্কুরিত চারার বয়স যখন ১ বছর হবে তখন চারা রোপণের উপযোগী হবে। সাধারণত জুন জুলাই হতে আগস্ট সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। চারা রোপণের জন্য মূল জমিতে র্২ ঢ র্২ ঢ র্২ গর্ত ১০ ফুট ঢ ১০ ফুট দূরে দূরে করতে হবে। প্রতিটি গর্ত ৩-৪ ইঞ্চি গভীর হতে হবে। প্রতিটি গর্তে ১০ কেজি গোবর ২০০ গ্রাম টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ সার মিশ্রিত করে গর্তের মাটি গোবর ও রাসায়নিক সার ভালো করে মিশিয়ে গর্তটিকে ঢেকে দিতে হবে। এতে মিশ্রিত সার ও গোবর পচন ক্রিয়া সম্পন্ন হবে। প্রায় ১৫-২০ দিন পর উপরের মাটি সরিয়ে পলিব্যাগ থেকে চারা মাটিসহ আলগা করে গর্তে বসিয়ে দিয়ে গাছের গোড়ায় পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে পলিব্যাগের মাটি ভালোভাবে ভিজে যায় এবং গর্তের মাটির সাথে মিশে যায়।
সার প্রয়োগ
উংপাদনক্ষম খেজুর গাছের গোড়া থেকে ৭৫ সেমি. দূরে গোলাকৃতি করে ১০-১৫ সেমি. গভীর গর্ত খুড়ে প্রতি বছর অক্টোবর ও মে মাসে প্রতি বারে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি ও ২০ কেজি পচা গোবর সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। দেশি খেজুর গাছে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। তবে মাঝে মাঝে কোন কোন গাছে বিটলজাতীয় পোকা দেখা যায়।
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ
গাছ সাধারণত নির্বাচন করা হয় ৫-৭ বছর বয়সের। যে সকল গাছ দেখতে সুস্থ সবল, সেসব গাছ নির্বাচন করলে অধিক রস আহরিত হয়। খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য গাছ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খেজুরের রস সংগ্রহ গাছ কাটার ওপর নির্ভর করে কারণ রস সংগ্রহের জন্য প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ করা অতীব জরুরি। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ গাছি দিয়ে গাছ কাটলে ও রস আহরণের হার ও গাছের স্থায়িত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পাবে।
খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য কিভাবে গাছ কাটতে হবে গাছের কোন অংশে কতটুকু কাটতে হবে, কোন সময়ে বেশি পরিমাণ রস, সর্বোপরি গাছটি কিভাবে কাটলে অধিক রস সংগৃহীত হবে এবং গাছটি দীর্ঘস্থায়ী হবে তাহা গাছীর সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এই সব ধারণা ও জ্ঞান থাকলে গাছটি সহজে মরবে না। আর এই জন্য গাছীকে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হতে হবে। কারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ১টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ এবং তাহা থেকে সিরাপ, গুড়, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরি করার জন্য অধিক পরিমাণে রস আহরণ করতে পারবে। গবেষণায় দেখা গেছে গাছের বেডের অংশ লম্বা ও ৭.৫-১০ সেমি. গাছ কাটলে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায়।
রস সংগ্রহ পদ্ধতি
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ কার্তিক মাসের প্রথম দিকে গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করতে হয়। গাছ পরিষ্কার করার পর ১৫-২০ দিন পর গাছ কাটা শুরু করতে হয়। এরপর ছাটা অংশের যেখানে রস নিঃসরণ শুরু করা হয় সেখানে ট আকৃতির চিকন প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা বাশের কঞ্চি আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে দিতে হয়। ট আকৃতির কাঠির মধ্যে দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের রস ঝুলন্ত হাঁড়িতে জমতে থাকে।
গাছ একবার ছাটলে ৩-৪ দিন রস সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তীতে ৩ দিন শুকাতে হয়। এইভাবে কাটলে গাছের রস সুমিষ্ট হয়। রস সাধরণত নভেম্বর- ডিসেম্বর হতে মার্চ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করতে হয়। রস সংগ্রহের পর হাঁড়ি পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় অথবা আগুনে ছেকে নিতে হয়। এতে সংগৃহীত রসে গাঁজন (Fermentation)) বন্ধ হয়।
রস সংগ্রহের জন্য ধারালো দা, মাটির পাত্র বা হাঁড়ি, নেট বা জাল লোহার বা স্টিলের কড়াই, চুলা, জ¦ালানি, ছাকনি, কাঁচের বোতল ও বোতলের কর্ক ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
ফলাফল
২০১৯-২০ ক্রপ মৌসুমে আঞ্চলিক সুগারক্রপ গবেষণা কেন্দ্র, গাজীপুরে একটি খেজুর বাগানে বর্ণিত পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত রস দিয়ে সিরাপ, পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাধারণত খেজুর গাছের সংগৃহিত রসের বিক্স ৮-১২% পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে এবং সিরাপের বিক্স ৭০-৭৮% পর্যন্ত পাওয়া যায়। বর্ণিত মৌসুমে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি ও মার্চ মাসে রস সংগৃহীত হয়। উক্ত মাসগুলোর ৬টি দিনের রসের হাঁড়ির রস মাপা হয়।
ফলাফলে দেখা যায় যে গাছ কাটার প্রথম দিকে রসের পরিমাণ কম; পরবর্তী মাসে গাছের রসের পরিমাণ বাড়তে থাকে অর্থাৎ জানুয়ারি, ফেব্রæয়ারি মাসে রসের পরিমাণ বেশি সংগৃহীত হয়েছে। ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে রসের পরিমাণ কমতে থাকে যাহা তাপমাত্রার সাথে সম্পর্কিত।
খেজুর রসের সিরাপ উৎপাদন
গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে ছাঁকনি দিয়ে ছেকে সংগৃহীত রস কড়াইতে বা পাতিলে ঢেলে চুলায় জ¦াল দিতে হয়। রস জ¦াল দেয়ার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে গাদ বা ফেনা ভেসে উঠে। উক্ত গাদ বা ফেনা যত দ্রæত সম্ভব ছাঁকনি দিয়ে ফেলে দিতে হবে। ফলে গুণগত মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত গুড় হবে। রস ঘনীভূত হলে দেখা যাবে রস আঠালো হয়েছে কি না। ঘনীভূত রস আঠালো সিরাপের মতো হলে রস চুলা থেকে নামিয়ে সিরাপ তৈরি করতে হবে এবং উক্ত সিরাপের ঘনত্ব (বিক্স %) ৭০-৭৮ হলে ভালো হয়। ফলে উক্ত সিরাপ তৈরি করলে সিরাপ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং গুণগত মানসম্পন্ন হয়।
খেজুরের গুড় প্রস্তুতকরণ
খেজুরের সিরাপ কড়াইয়ের মধ্যে রেখে জ্বাল দিতে হবে। ফুটন্ত ঘনীভূত রস হাতলের সাহায্যে লাগাতার নাড়তে হবে এবং চুলার তাপমাত্রা দ্রæত কমিয়ে আনতে হবে। চুলা থেকে গুড় নামানোর সময় মিশ্রিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে গুড় অর্থাৎ এক চিমটি পরিমাণ গুড় ২০০ মিলি লিটার পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। পানিতে গুড় দ্রæত জমাটবদ্ধ হলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে এবং চুলা থেকে গুড়সহ কড়াই দ্রæত নামিয়ে ঠাÐা করতে হবে এবং ছাঁচে ঢালতে হবে।
খেজুর গাছের ফল উৎপাদন
সাধারণত জুলাই আগস্ট মাসে দেশীখেজুর স্ত্রী গাছের ফল সংগৃহীত হয়। খেজুরের ঝারের ফল যখন গাড়ো হলুদ বর্ণ হয় তখন পাকা শুরু করে। পাকা ফল যখন শালিক পাখি খেতে দেখা যায় তখন উক্ত খেজুরের ঝার কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ১-২ দিনের মধ্যে সমস্ত খেজুর পেকে যায়। তখন পাকা ফল সংগ্রহ করে খাওয়ার উপযোগী হয় বা বাজারজাত করা হয়।
অধিক খেজুর গাছ লাগানোর জন্য আমাদের কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নতি সাধন সম্ভব হবে। সিরাপ, পাটালী গুড় ও খেজুরের ফল উৎপাদন কুটির শিল্প হিসাবে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হবে। য়
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আরএসআরএস, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৯০৭৯৫৯১, ই-মেইল :kalambsri@gmail.com
বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মোঃ বেনজীর আলম
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্থপতি, উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা-রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন। জাতির পিতার কৃষি বিপ্লবের সেই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে ও খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং তখন থেকেই বাংলাদেশ সংস্থাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। জাতির পিতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষির উন্নয়ন করতে হবে। তাই তিনি সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষক ও শ্রমিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যখন সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন, তখন উন্নয়ন বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ দেয়ার পাশাপাশি কৃষির উন্নয়নে অনেক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশনায় প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে খাদ্য ও পুষ্টিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দুঃসময়ে দেশের হাল ধরে দূরদর্শী ও সাহসী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্ব দরবারে দেশকে এক বিশাল সফলতায় নিয়ে গেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই স্বল্পকালীন গত ১০-১২ বছরের শাসনের সাফল্যও অনেক। কৃষিতে সাফল্য বিবেচনায় প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের ২০০৯ সালের সাথে তুলনায় ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চালের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩%, গমের ৪৫%, ভুট্টার ৭৭৫%, আলুতে ১০১%, ডালে ৩৭৫%, তেলবীজে ৮১%, সবজির ক্ষেত্রে ৫৭৮% যা বিশ্বে অভাবনীয়। এ দেশে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
কৃষিবান্ধব নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ এখন দানাশস্য, সবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সারা বছর এখন শাকসবজি ফলমূল যে কোন মানুষের জন্য সহজলভ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল দপ্তর-সংস্থা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে বিধায় দেশে এখন খাদ্য নিরাপত্তা বিরাজমান। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পর্যায়ে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৩য়, পাট উৎপাদনে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু ও আম উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম এবং মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম স্থান অর্জন করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক পদক্ষেপে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড বোরো উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ টন, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এছাড়াও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এক বছরে ৭ লাখ টন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। করোনাকালের মাঝেও বাংলাদেশ বিশ্বে পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য Leave no one behind. Better production,better nutrition,a better environment and a better life. এর ভাবানুবাদ “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন”। সময় বিবেচনায় উপযুক্ত প্রতিপাদ্য। বর্তমানে বিশ্ব এক ভয়াবহ অদৃশ্য শত্রু কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসজনিত রোগের সম্মুখীন। এই মহামারি থেকে মুক্তি পায়নি বাংলাদেশও। চরম ক্রান্তিকাল ও সংকট মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে খাদ্যের কোন অভাব না থাকলেও সঠিক পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে অসংখ্য মানুষ। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ এবং ৭৫ ভাগ মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি ৮৮% পরিবারে এবং ভিটামিন ‘সি’ এর ঘাটতি ৯০% পরিবারে বিদ্যমান। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩% এবং ৫ বছরের নিচের শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। ন্যূনতম খাদ্যশক্তির চেয়ে কম পরিমাণে গ্রহণকারী জনসংখ্যার হার ১৯.৫%। মানুষের খাদ্যক্রয়ে যথেষ্ট আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। পুষ্টিবিদরা সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণের কথা বলেন। সুষম খাদ্যের অর্থই হলো দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবেলায় খাদ্যের প্রত্যেকটি উপাদান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা। আর এজন্য প্রয়োজন সফল উৎপাদন নিশ্চিতকরণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মিশন বা অভিলক্ষ্য হলো টেকসই ও লাভজনক ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে দক্ষ, ফলপ্রসূ, বিকেন্দ্রীকৃত, এলাকানির্ভর, চাহিদাভিত্তিক এবং সমন্বিত কৃষি সম্পসারণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে সকল শ্রেণির কৃষকের প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন দেশের সর্ববৃহৎ কৃষি সম্প্রসারণ সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে দেশের কৃষির উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থাটি দলভিত্তিক সম্প্রসারণ সেবা প্রদান পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত লাগসই সকল প্রযুক্তিসহ এই সময়ে ২০০টিরও বেশি ফসলের উৎপাদনে বীজ ব্যবস্থাপনা; মাটি, সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা; ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণ সহজলভ্যকরণ ও কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন দুর্যোগে কৃষকের পাশে থেকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এই অধিদপ্তর মাঠ ফসলের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বিভিন্ন ফসলের এলাকাভিত্তিক অভিযোজন কলাকৌশলও মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করছে। এছাড়াও ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষ সম্প্রসারণ করে সবজি ও মসলা উৎপাদন বৃদ্ধি করার কাজ চলমান রয়েছে। প্রচলিত কৃষির পাশাপাশি উচ্চমূল্যের সবজি চাষ এবং অপ্রচলিত ও ট্রপিক্যাল অঞ্চলের বিদেশি ফলমূল জনপ্রিয় করাসহ এর উৎপাদন বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে। পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে সেচকাজে ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সুসমন্বিত ও সুপরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সংস্থাটির বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রমের ফলে বর্তমানে দেশের কৃষি জমি চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে। ফসল সংগ্রহ ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে ৫০-৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্র পরিচালনায় এসেই কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম শুরু করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ তার মধ্যে অন্যতম। জুলাই, ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাওয়ার টিলারসহ মোট ৭৪৯৮০টি কৃষি যন্ত্রপাতি ডিএইর মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
কৃষিতে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং লাগসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই কৃষিতে সাফল্য বয়ে আনছে ডিএই কর্মীরা। গবেষণা কার্যক্রম ও কৃষকের মধ্যে তারা যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি সম্প্রসারণ কর্মীদের প্রযুক্তিগতভাবে আরও দক্ষ করে তুলতে কাজ করছে সংস্থাটি। এতে যেমন কৃষকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়, তেমনি সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নও সহজ হয়।
কৃষি উন্নয়নে বাংলাদেশের সার্বিক সাফল্যে আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো এসডিজি বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার এবং জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি কর্তৃক ক্ষুধার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানজনক ‘সেরেস’ (CERES) পদক প্রাপ্তি, যা কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি বড় অর্জন। এখানে কাজের অংশীদার হতে পেরে ডিএই পরিবার গর্বিত।
বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এর জাতীয় উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ’ এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার অনুসৃত নীতিমালার আলোকেই বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ ও সর্বোপরি দেশের সার্বিক সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দেশে বিদ্যমান যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আধুনিক, ব্যয় সাশ্রয়ী ও লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রণীত রোডম্যাপ কার্যকর করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় কৃষকের সাথে থেকে কাজ করে যাবে।
লেখক : মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন: ০২৫৫০২৮৩৬৯, ইমেইল:dg@dae.gov.bd
৮৩তম বর্ষ ড় ৪র্থ সংখ্যা ড় শ্রাবণ-১৪৩০ (জুলাই-আগস্ট ২০২৩)
সূচিপত্র
নিবন্ধ/প্রবন্ধ
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও আজকের কৃষি গবেষণার সাফল্য ০৩
ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ড. সুস্মিতা দাস
লবণাক্ত অঞ্চলে আমন ধান উৎপাদন কৌশল ০৫
ড. সত্যেন ম-ল
খরিফ-২ মৌসুমে সয়াবিন চাষ ও বীজ হিসেবে ব্যবহার ০৭
ড. মো. আব্দুল মালেক
প্রাকৃতিক রং দ্বারা পাট ও পাটবস্ত্র রঞ্জিতকরণ ০৯
ড. ফেরদৌস আরা দিলরুবা
সার ব্যবহার আধুনিকায়ন ১১
ড. মো. সদরুল আমিন
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে গ্লাডিওলাসের করমেল উৎপাদন প্রযুক্তি ১৩
ড. মো. খালিদ জামিল
আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ ১৫
ড. মো. শরফ উদ্দিন
খাদ্যে ঘনচিনির ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি ১৭
ড. মারুফ আহমেদ, সৌরভ প্রামানিক শুভ
ধানের টুংরো রোগ দমন ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ১৮
মোঃ মামুনুর রশিদ
নিরাপদ উপায়ে পানের বালাই দমন ২০
নাহিদ বিন রফিক
আগামীর কৃষি ভাবনা
মাশরুম একটি অসীম সম্ভাবনাময় ফসল ২২
ড. আক্তার জাহান কাকন
স্মার্ট কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার ২৪
সমীরণ বিশ^াস
আলফা আলফা ঘাস চাষ পদ্ধতি ২৬
ডা: মনোজিৎ কুমার সরকার
বর্ষাকালে মাছ চাষে করণীয় ২৭
মোঃ লতিফুর রহমান সুজান
সফল কৃষকের গল্প
বোরোর ফলনের ধারণা বদলে দিয়েছে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাত ২৮
কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন
নিয়মিত বিভাগ
প্রশ্নোত্তর ৩০
কৃষিবিদ আয়েশা সুলতানা
ভাদ্র মাসের কৃষি (১৬ আগস্ট- ১৫ সেপ্টেম্বর) ৩২
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
ড. মো. আলাউদ্দিন খান১ কৃষিবিদ মো. মুশফিকুর রহমান২
পেঁয়াজ (Allium cepa L.) বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাবারের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে (জনপ্রতি দৈনিক ৩৫ গ্রাম) মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। উৎপাদনের বিবেচনায়ও এ মসলা ফসলটি প্রথম স্থানে আছে। কিন্তু পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। সংগ্রহ মৌসুমে পেঁয়াজ এর ব্যাপক সরবরাহ থাকার কারণে কৃষক খুবই কম মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রয় করে থাকে। উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় চাষ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে কৃষক ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। পেঁয়াজ উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি (Good Agricultural Practices) প্রয়োগ না করার কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০-৪০ শতাংশ অপচয় হয়ে যায়। এমনকি পেঁয়াজের গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে। যা পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশে বছরে ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বছরে পেঁয়াজ অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৫-৬ লক্ষ মেট্রিক টন। এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার দেশের পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রায় ১০ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। গুণগতমান বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্টোরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে সঠিক মূল্যে বিক্রয় করা ও বাজার স্থিতিশীল রাখা সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণের মাধ্যমে ভোক্তার নিকট বছরব্যাপী পেঁয়াজ সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। পেঁয়াজের প্রকৃত বীজ (True seed) সাধারণত বীজ কন্দ (Seed bulb) থেকে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বীজ কন্দকে ভালো রাখাও সংরক্ষণের আরেকটি উদ্দেশ্য। স্টোরে পেঁয়াজ জীবিত অবস্থায় থাকে। তাই পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় (প্রস্বেদন, শ^সন, অংকুরোদগম/মূল গজানো, পেঁয়াজের খোসা খসে পড়া) এবং বিপাকীয় (এনজাইমের কার্যকারিতা, টিস্যু নরম হওয়া) কার্যক্রম চলতে থাকে। ভালো কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ ও উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় কার্যাবলী বন্ধ করে বা নিম্ন পর্যায় রেখে এবং ছত্রাক/ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতাকে বন্ধ করে বা সুপ্তাবস্থায় রেখে পেঁয়াজের সংরক্ষণ কালকে বৃদ্ধি করাই পেঁয়াজ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মূল চ্যালেঞ্জ। পেঁয়াজের সংরক্ষণজনিত ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায় রাখা এবং সংরক্ষিত পেঁয়াজের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য নিম্নলিখিত প্রযুক্তি প্রয়োগ করা জরুরি।
পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুম
খরিপ মৌসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজে স্বভাবতই পানির পরিমাণ বেশি থাকে। স্টোরে এ মৌসুমের পেঁয়াজের অংকুরোদগম ও পচন হার খুবই বেশি। এ পেঁয়াজ ১.৫-২.০ মাস সংরক্ষণ করলে প্রায় ৫০-৬০% পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই খরিপ পেঁয়াজ সংরক্ষণ না করে বাজারজাত করাই ভাল। রবি পেঁয়াজে পানির পরিমাণ কম থাকে বিধায় দীর্ঘ দিন (৮-৯ মাস) সংরক্ষণ করা যায়। এ সময়ে রবি পেঁয়াজের প্রায় ৩০-৪০% নষ্ট হয়ে যায়।
পেঁয়াজের জাত নির্বাচন
সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের পচন, অঙ্কুরোদগম ও ওজন হারোনোর পরিমাণ জাতভেদে কম বেশি হয়ে থাকে। দৃঢ় ও আঁটসাঁটে, ঝাঁঝ বেশি, পানি কম, আকারে মধ্যম, গলা চিকন, উচ্চ শুষ্ক পদার্থ সম্বলিত বৈশিষ্ট্যের জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি। যেমন- বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪। হাইব্রিড জাত অপেক্ষা স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা ভাল। যে পেঁয়াজের শুষ্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বেশি থাকে সে পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল বেশি হয়। কিউরিং করলেই শুস্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বাড়ে। হলুদ ও সাদা রংবিশিষ্ট জাতের পেঁয়াজের তুলনায় লাল রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের ফিনোলিক এসিড, এন্থোসায়ানিন, ফ্লাভোনয়েড (কুয়েরসিটিন, ক্যাম্পফেরল), পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। বারি পেঁয়াজ-৪ জাতের পেঁয়াজে এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। তবে লাল রং এবং সাদা রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের তুলনায় হালকা লাল রং বারি পেঁয়াজ-১ বিশিষ্ট পেঁয়াজে শ^সন হার কম হয়। রোপণ পদ্ধতি
হালি পেঁয়াজের (চারা থেকে পেঁয়াজ চাষ) তুলনায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ (ছোট কন্দ থেকে পেঁয়াজ চাষ) অত্যধিক ফুল হওয়ার কারণে মুড়িকাটা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। মুড়িকাটা পেঁয়াজে পানির পরিমাণও বেশি থাকে। অতি আগাম পেঁয়াজের চারা রোপণ করলে প্রায় ৬০-৭৫ শতাংশ গাছে ফুল আসতে পারে। যাহা সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। পেঁয়াজের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাসের ১৫-৩০ (নভেম্বর ১-১৫) তারিখ। পেঁয়াজের রোপণ দূরত্ব বেশি হলে গলা মোটা হয়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে যায়। সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের তুলনায় চারা রোপণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পেঁয়াজে তুলনামূলকভাবে বোল্টার (ফুল উৎপাদনকারী কন্দ) ও বহুকোষী পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।
সার ব্যবস্থাপনা
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সাধারণত ৩০ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য এ ফসলটি হেক্টরপ্রতি ৮৫ কেজি নাইট্রোজেন, ৩৬ কেজি ফসফরাস এবং ৬৮ কেজি পটাশ মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। তাই জমির ধরন বুঝে পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) প্রয়োগ করলে পেঁয়াজের গলা মোটা হয়ে যায়, পেঁয়াজ ফেটে যায় এবং সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের অংকুরোদগম হয় ও পচে যায়। গলা মোটা পেঁয়াজের রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। পেঁয়াজ সংগ্রহের ২৫-৩০ দিন আগেই নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। এই সময়ের ভিতর নাইট্রোজেন সার উপরি প্রয়োগ করলে ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে সংরক্ষণাগারে বাল্ব পচে যায়। পেঁয়াজ চাষে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন প্রয়োগ করলে স্টোরে পেঁয়াজের আগাম অংকুরোদগম হয়ে যায়। কোন কারণে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করে থাকলে পরবর্তীতে পটাশ সার (এমওপি) প্রয়োগ করলে পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া পটাশ সার প্রয়োগে কার্বহাইড্রেট ভাঙনকারী এনজাইমের কার্যকারিতা কমিয়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। পটাশ সার অংকুরোদগম ও পানি অপচয় রোধেও সহায়তা করে।
প্রয়োজনমতো ফসফরাস সার (টিএসপি) প্রয়োগ করলে সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফসফরাস সার বেশি দিলে পেঁয়াজ বহুকোষী হয়ে যায়। পরিমাণমতো জিপসাম (সালফার/ক্যালসিয়াম সার) প্রয়োগ করলে পেঁয়াজে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে কন্দ দৃঢ় হয় এবং পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বোরন জাতীয় সার প্রয়োগ করলে পেঁয়াজ দৃঢ় ও আঁটসাঁট হয়ে সংরক্ষণাগারে ভালো থাকে। জৈবসার প্রয়োগে শুষ্ক পদার্থ বৃদ্ধির মাধ্যমে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । ফলে পারতপক্ষে পেঁয়াজের জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করা খুবই ভালো।
সেচ ব্যবস্থাপনা
জমির ধরন ও আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে পেঁয়াজের জমিতে ৪-৫ টি সেচ দিতে হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে অথবা মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে সেচ বন্ধ না করলে পেঁয়াজের গলা পচা (Neck rot) রোগের মাধ্যমে পচনের হার বেড়ে যায়। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় পানি পেলে ঐ পেঁয়াজ সহজেই অংকুরোদগম হয়ে যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত সেচের কারণে গলা মোটা হয়ে যায়। আবার পেঁয়াজে সেচের পরিমাণ কম হলে পেঁয়াজের অংকুরোদগম হার বেড়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে গিয়ে সংরক্ষণ ক্ষমতা কমে যায়। নালা সেচ পদ্ধতির তুলনায় প্লাবন সেচে রোগবালাইর পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে স্টোরে পেঁয়াজ পচনের হার বেশি হয়ে। তবে ড্রিপ (Drip) সেচ পদ্ধতি সবচেয়ে ভাল কিন্তু ইহা ব্যয়বহুল পদ্ধতি।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
স্টোরের পেঁয়াজে সাধারণত ছত্রাকজনিত ব্লাক মোল্ড (Aspergillus niger), গলা পচা বা গ্রে মোল্ড (Botrytis allii), ব্যাসাল রট (Fusarium oxysporum f. sp. cepa) এবং ব্যাক্টেরিয়াজনিত নরম পচা (Erwinia carotovora/ Pseudomonas gladioli) রোগ হয়ে থাকে। এ রোগগুলো পেঁয়াজের মাঠ থেকেই শুরু হয়। স্টোরে বøাক মোল্ডে আক্রান্ত পেঁয়াজের গলা ও কন্দ কালো হয়ে যায়। ব্যাসাল রট রোগের মাধ্যমে মাঠের পেঁয়াজের নিচের দিকে আক্রমণ করে এবং পেঁয়াজের ভেতরে নষ্ট হয়ে যায়। নরম পচা রোগে প্রথমে পেঁয়াজের মাঠে পাতা ভেঙে যায়। পরে স্টোরের পেঁয়াজে পানি ভেজা দাগ দেখা যায়। বেশি আক্রান্ত হলে পেঁয়াজ হলদে বাদামি রং ধারণ করে নরম হয়ে পচে যায় এবং আক্রান্ত পেঁয়াজ থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। নরম পচা রোগটি পেঁয়াজ পরিবহণের সময়েও দেখা দেয়। স্টোরে ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগের কারণে আক্রান্ত সম্পূর্ণ পেঁয়াজ পচে যেতে পারে। পোকামাকড় বা অন্য কোন কারণে মাঠে পেঁয়াজের ক্ষত হলে এ সমস্ত রোগ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। এ সমস্ত রোগ থেকে পেঁয়াজকে মুক্ত রাখার জন্য পরিষ্কার পরিছন্ন চাষাবাদ, ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। সঠিক পরিপক্বতার সময়ে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে এই সমস্ত রোগ থেকে পেঁয়াজকে রক্ষা করা যায়। পেঁয়াজের বীজ এবং চারার গোড়া ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন/রোপণ করা উচিত। প্রতি কেজি বীজ ২ (দুই) গ্রাম ছত্রাকনাশক (রোভরাল/ডায়থেন-এম ৪৫ ইত্যাদি) দ্বারা শোধন করলে এবং ছত্রাকের দ্রবণে পেঁয়াজের চারার মূল ২ (দুই) মিনিট ডুবালে ছত্রাকজাতীয় রোগের আক্রমণ কমে যায়। কোন পেঁয়াজের মাঠে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে সময়মতো রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারে অতি তাড়াতাড়ি পচে যায়। পার্পল বøচসহ অন্যান্য রোগের জন্য রোভরাল/রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেম এম-৪৫/নাটিভো ইত্যাদি বালাইনাশক ২.০-২.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৫-২০ দিন পর পর এবং থ্রিপস দমন করার জন্য কুইনালফস ২৫ ইসি/ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি ২.০-২.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে পর্যায়ক্রমে ১৫ দিন পরপর প্রয়োগ করতে হয়।
প্রতি বছর একই জমিতে পেঁয়াজ/রসুন না করাই ভালো। পেঁয়াজ সংরক্ষণাগারে চারিদিক থেকে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে সংরক্ষিত পেঁয়াজে এ সমস্ত রোগের আক্রমণ কম হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের আগে অবশ্যই রোগাক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজ বাছাই করতে হবে। রোগাক্রান্ত পেঁয়াজের শুষ্ক পদার্থ, মোট কঠিন পদার্থের পরিমাণ কমে যায় এবং রং নষ্ট হয়ে বাজার মূল্য কমে যায়।
মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ
মাঠের ৬০-৭০ শতাংশ পেঁয়াজের গাছ ভেঙে পড়লে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা উচিত। আগাম অপরিপক্ব পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে সংগৃহীত পেঁয়াজে বেশি পানি থাকার কারণে ব্যাক্টেরিয়া/ছত্রাকজনিত রোগ দেখে দেয় এবং স্টোরে বাল্ব থেকে পাতা গজায় (অংকুরোদগম)। আবার দেরিতে পেঁয়াজ সংগ্রহ করলে বাল্বের খোসা পড়ে গিয়ে সংরক্ষণাগারে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। পেঁয়াজের রং নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে গিয়ে স্টোরে পেঁয়াজের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে।
মাঠ থেকে সংগৃহীত পেঁয়াজ শুকানো
সাধারণত বাংলাদেশের কৃষকগণ পেঁয়াজের কিউরিং না করেই পেঁয়াজ স্টোরে সংরক্ষণ করে থাকেন। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে মাঠ থেকে পেঁয়াজ সংগ্রহের পর পাতাসহ ০৫-০৭ দিন হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে পেঁয়াজকে শুকাতে হয়। পেঁয়াজ সংগ্রহের সময় আগাম বৃষ্টিতে পেঁয়াজ ভিজে গেলে দ্রুততার সাথে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। প্রয়োজনে ফ্যানের বাতাসে শুকাতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, পেঁয়াজকে রোদে শুকালে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুকানোর পর পেঁয়াজের ৪-৫% ওজন হ্রাস পায় যাতে পেঁয়াজ দৃঢ় ও আঁটসাঁটে হয় এবং পেঁয়াজের গলা সংকুচিত হয়ে ছত্রাক এবং ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিউরিং এর ফলে শ^সন হারও কমে যায়। অপর্যাপ্ত কিউরিং এর ফলে রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিউরিং করার কারণে পাতা শুকিয়ে গাছের বৃদ্ধি বাধাদানকারী হরমোন পেঁয়াজে (কন্দ) প্রবেশ করে যাহা পেঁয়াজের সুপ্ততার মেয়াদ বৃদ্ধি করে। পেঁয়াজের সংরক্ষণক্ষমতা বৃদ্ধি ও গুণগতমান বজায় রাখার জন্যেই পেঁয়াজকে পাতাসহ শুকানো হয়। হালকা ছায়ায় শুকানোর কারণে পেঁয়াজের রং উজ্জ্বল হয়। পেঁয়াজ শুকানোর পর বাল্বের উপরের গলা ২.০-২.৫ সে. মি (সর্বোচ্চ ১ ইঞ্চি) রেখে পাতা কেটে দিতে হয়। পরে বাল্বের মূল কেটে পরিষ্কার করে পেঁয়াজ স্টোরে সংরক্ষণ করা হয়।
উল্লেখ্য, রোগবালাই, থেঁতলানো, গলা মোটা, বোল্টার, পচা, ক্ষত ইত্যাদি মুক্ত একক দৃঢ় বাল্ব সংরক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়। খুবই ছোট/বড় বাল্ব সংরক্ষণের জন্য একসাথে না রাখাই ভালো।
পেঁয়াজ পরিবহণে মোড়কের ধরন
ভালো মোড়ক পেঁয়াজ পরিবহণ ও বাজারজাতকরণের সময় পেঁয়াজের ক্ষতি যেমন ক্ষত, রোগবালাই, পানির অপচয় রোধ করে। পেঁয়াজের ক্ষত সৃষ্টি হলে ঐ পেঁয়াজে মূল/অংকুরোদগম হয়। তাছাড়া ক্ষত পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনুপযুক্ত মোড়কে পেঁয়াজ পরিবহণ করলে পেঁয়াজের রং নষ্ট হয়ে যায়, যা ভোক্তার নিকট অপছন্দনীয়। পেঁয়াজ পরিবহণে চটের বস্তা, নাইলনের বস্তা ও প্লাস্টিক ক্রেট (Crate) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে ছিদ্রযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করলে বাতাস চলাচলের মাধ্যমে পেঁয়াজ খুবই ভালো থাকে।
হরমোন/রেডিয়েশনের ব্যবহার
স্টোরে পেঁয়াজের অংকুরোদগম বন্ধ করার জন্য ফসল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে বিভিন্ন প্রকার হরমোন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে ম্যালেইক হাইড্রাজাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকরি। এ ধরনের বৃদ্ধি প্রতিরোধী হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজের কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অংকুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। মাঠের শতকরা ১০ ভাগ পেঁয়াজ গাছ ভেঙে পড়লে প্রতি লিটার পানিতে ২৫০০-৩০০০ মি. গ্রাম ম্যালেইক হাইড্রাজাইড এর দ্রবণ তৈরি করে স্প্রে করা হয়। তবে হরমোনকে পানিতে মেশানোর আগে অ্যালকোহলে দ্রবীভূত করে নিতে হয়। হরমোনের দ্রবণে আঠা জাতীয় পদার্থ মিশিয়ে স্প্রে করা ভালো। অনেক সময় গামা রেডিয়েশনের মাধ্যমে অংকুরোদগম বিলম্বিত করে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করা হয়।
সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা
বিশ্বে সাধারণত ০৩টি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে যথা- কোল্ডস্টোরেজ (তাপমাত্রা ০-২/৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%), অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ/হিট স্টোরেজ (সাধারণ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৫-৭০%) এবং কন্ট্রোল্ড অ্যাটমোসফিয়ার স্টোরেজ (অক্সিজেন ১-২%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ৩% ও তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। নিম্ন তাপমাত্রা অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের জন্য কোল্ডস্টোরেজ উপযুক্ত পদ্ধতি। বাংলাদেশের মতো গরম অঞ্চলের দেশেসমূহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করাই উপযুক্ত পদ্ধতি, যাকে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ (Ambient storage) বা হিট স্টোরেজ (Heat storage) বলে। অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজে ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণকৃত পেঁয়াজে অংকুরোদগম/মূল উৎপাদনকারী হরমোন (সাইটোকাইনিন) উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের দেশে অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ সাধারণত বাঁশের তৈরি হয়ে থাকে। বাঁশ দ্বারা এক বা দুই স্তর বিশিষ্ট মাচা/চাং তৈরি করা হয়। পেঁয়াজের মাচা বাঁশের বানা দিয়ে তৈরি করা হয়। স্টোর ঘরের চাল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। খড়ের/অ্যাসবেসটস দ্বারা নির্মিত চাল থেকে টিন দ্বারা নির্মিত চালে বেশি তাপ উৎপন্ন হয়ে থাকে। সংরক্ষণাগারের চাল টিনের হলে টিনের নিচে অ্যালুমিনিয়াম ইনসুলেটর দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তাছাড়া পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থার জন্য পেঁয়াজের মাচার চারিদিক থেকে ভেন্টিলেটারের ব্যবস্থা করতে হয়।
বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে অরিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে গুদামজাত রোগ বøাক মোল্ড/গ্রেমোল্ড এবং নরম পচা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে। টিন দ্বারা নির্মিত সংরক্ষণাগারে স্তুুপীকৃত পেঁয়াজের পুরুত্ব ৩০ সেমি. (১২ ইঞ্চি) এবং খড় বা অ্যাসবেসটস দ্বারা নির্মিত সংরক্ষণাগারে স্ত‚পীকৃত পেঁয়াজের পুরুত্ব ৩৭ সেমি. (১৫ ইঞ্চি) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো। দৈনন্দিন রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিক বা বাঁশের তৈরি র্যাকে ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) পুরুত্বে সংরক্ষণ কর যায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ও আর্দ্রতা ৬৫-৭০%। যা পেঁয়াজের গুণাগুণ, রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পায়। স্টোর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর পেঁয়াজ নামিয়ে পচা, অংকুরোদগমকৃত এবং রোগাক্রান্ত বাল্ব আলাদা করে পুনরায় সংরক্ষণ করতে হয়। এভাবে মাঝে মাঝে বাছাই না করলে পেঁয়াজের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের মেয়াদ বাড়ার সাথে সাথে পেঁয়াজের ওজনেরও হ্রাস পেতে থাকে। আবহাওয়াজনিত কারণে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বছর থেকে বছরে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কৃষকপর্যায়ে ৪০০-৫০০ মন পেঁয়াজ সংরক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিস্তর বিশিষ্ট একটি অ্যাম্বিয়েন্ট স্টোরেজ তৈরি করতে প্রায় ৩-৩.৫ লক্ষ টাকা প্রয়োজন হবে। এ ধরনের স্টোর প্রায় ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত এ ভাবে ভালো কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পেঁয়াজের সংরক্ষণজনিত ক্ষতির পরিমাণ গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে রাখা সম্ভব।
১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর, মোবাইল : ০১৭২৩৭৯৪৫৩৮, ই-মেইল : musfiqur.bari@gmail.com, ২ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, ফরিদপুর
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল। হেমন্ত বাংলার বিখ্যাত নবান্ন উৎসবের সময়। নবান্ন উৎসবের সমান্তরালে উৎসবমুখর থাকে বৃহত্তর কৃষি ভুবন। সুখ্যাত আমন ও আউশসহ নানা নতুন ধান কেটে এই সময়ে ঘরে তোলা হয়। কেননা এ মৌসুমই কৃষির জন্য তুলনামূলক নিশ্চিত একটি মৌসুম। তাহলে আসুন আমরা জেনে নেই অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিতে আমাদের করণীয় কাজগুলো।
আমন ধান
এ মাসে অনেকের আমন ধান পেকে যাবে তাই রোদেলা দিন দেখে ধান কাটতে হবে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় আমন ধান শতকরা ৮০ ভাগ পাকলে কেটে ফেলতে হবে। আমন ধান কাটার পরপরই জমি চাষ দিয়ে রাখতে হবে, এতে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে মাটির রস কম শুকাবে। উপকূলীয় এলাকায় রোপা আমন কাটার আগে রিলে ফসল হিসেবে খেসারি আবাদ করতে পারেন। আগামী মৌসুমের জন্য বীজ রাখতে চাইলে প্রথমেই সুস্থ সবল ভালো ফলন দেখে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এরপর কেটে, মাড়াই-ঝাড়াই করার পর রোদে ভালোমতো শুকাতে হবে। শুকানো গরম ধান আবার ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং ছায়ায় রেখে ঠা-া করতে হবে। পরিষ্কার ঠা-া ধান বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ রাখার পাত্রটিকে মাটি বা মেঝের ওপর না রেখে পাটাতনের ওপর রাখতে হবে। পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে হলে ধানের সাথে নিম, নিসিন্দা, ল্যান্টানার পাতা শুকিয়ে গুঁড় করে মিশিয়ে দিতে হবে।
বোরো ধান
আগ্রহায়ণ মাস বোরো ধানের বীজতলা তৈরির উপযুক্ত সময়। রোদ পড়ে এমন উর্বর ও সেচ সুবিধাযুক্ত জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হবে। চাষের আগে প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ২-৩ কেজি জৈব সার দিয়ে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে। পানি দিয়ে জমি থকথকে কাদা করে এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে ভেজা বীজতলা তৈরি করতে হবে। যেসব এলাকায় ঠা-ার প্রকোপ বেশি সেখানে শুকনো বীজতলা তৈরি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি দুই প্লটের মাঝে ২৫-৩০ সেমি. নালা রাখতে হবে। বোরো মৌসুমের পানি সাশ্রয়ী ব্রি ধান৯২ এ ছাড়া যেসব এলাকায় সেচের পানির ঘাটতি থাকে সেখানে আগাম জাত হিসেবে ব্রি ধান৪৫ এবং ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৮১, ব্রি ধান ৮৪ ও ব্রি ধান৮৬, ব্রি ধান৮৮, উর্বর জমি ও পানি ঘাটতি নেই এমন এলাকায় ব্রি ধান২৯, ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৫৮, ব্রি ধান৫৯, ব্রি ধান৬০, ব্রি ধান৬৩, ব্রি ধান ৬৪, ব্রি ধান৬৮, ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২ ব্রি হাইব্রিড ধান১, ব্রি হাইব্রিড ধান২ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৩, ঠা-া প্রকোপ এলাকায় ব্রি ধান৩৬, হাওর এলাকায় বিআর১৭, বিআর১৮, বিআর১৯, লবণাক্ত এলাকায় ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৬১ চাষ করতে পারেন। বীজ বপন করার আগে ৬০-৭০ ঘণ্টা জাগ দিয়ে রাখতে হবে। এ সময় ধানের অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুরিত বীজ বীজতলায় ছিটিয়ে বপন করতে হবে। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮০-১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গম
অগ্রহায়ণের শুরু থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম বোনার উপযুক্ত সময়। এরপর গম যত দেরিতে বপন করা হবে ফলনও সে হারে কমে যাবে। দো-আঁশ মাটিতে গম ভালো হয়। অধিক ফলনের জন্য গমের আধুনিক জাত যেমন- বারি গম-২৫, বারি গম-২৮, বারি গম-২৯, বারি গম-৩০, বারি গম-৩১, বারি গম-৩২, বারি গম-৩৩ এবং লবণাক্ততাসহিষ্ণু বিনা গম-১ এসব বপন করতে হবে। বীজ বপনের আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে নিতে হবে। গজানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ বা তার বেশি হলে বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি বীজ বপন করতে হবে। সেচসহ চাষের ক্ষেত্রে শেষ চাষের সময় প্রতি শতক জমিতে ৩০-৪০ কেজি জৈবসার, ৬০০-৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫৫০-৬০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০-৪৫০ গ্রাম এমওপি, ৪৫০-৫০০ গ্রাম জিপসাম প্রয়োগ করতে হবে। তিন পাতা বয়সে প্রথম সেচের পর দুপুর বেলা মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ৩০০-৪০০ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, সেচ ছাড়া চাষের ক্ষেত্রে সমস্ত ইউরিয়া শেষ চাষের সময় অন্যান্য সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে। গমে তিনবার সেচ দিলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। বীজ বপনের ১৭-২১ দিনের মধ্যে প্রথম সেচ, ৫০-৫৫ দিনে দ্বিতীয় সেচ এবং ৭৫-৮০ দিনে ৩য় সেচ দিতে হবে।
ভুট্টা
ভুট্টা গত মাসে আবাদ না করে থাকলে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমি তৈরি করে বীজ বপন করতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো খই ভুট্টা, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৯, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৫, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৬, বারি মিষ্টি ভুট্টা-১, বারি বেবি কর্ন-১ এসব। খরা প্রধান এলাকা ও সাদা দানার ক্ষেত্রে বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১২ ও বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১৩ এসব। এক শতাংশ জমিতে হাইব্রিড বীজ বপনের জন্য ৮০-৯০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য সারিতে বীজ বপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ২৫ সেমি. রাখতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সার প্রয়োগ করলে কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে ইউরিয়া ২-২.২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫০-১০০০ গ্রাম, এমওপি ৭০০-৯০০ গ্রাম, জিপসাম ৯৫০-১০০০ গ্রাম, দস্তা ৪০-৬০ গ্রাম, বরিক এসিড ২০-৩০ গ্রাম এবং ১৬-২০ কেজি জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে।
সরিষা ও অন্যান্য তেল ফসল
তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। তাছাড়া বাদাম, সূর্যমুখী এসব আবাদ করতে পারেন। সরিষা গাছে ফুল আসার সময় শতাংশপ্রতি ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। উপরি সার প্রয়োগের পর হালকা একটি সেচ দিতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে ২০-২৫ দিন পর আবারো একটি সেচ দিতে হবে।
আলু
উপকূলীয় অঞ্চলে এ মাসেও আলু আবাদ শুরু করা যায়। অন্যান্য স্থানে রোপণকৃত আলু ফসলের যতœ নিতে হবে। মাটির কেইল বেঁধে দিতে হবে এবং কেইলে মাটি তুলে দিতে হবে। সারের উপরিপ্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেচ দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
শাকসবজি
মাঠে এখন অনেক সবজি বাড়ন্ত পর্যায়ে আছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, মুলা এসব বড় হওয়ার সাথে সাথে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। চারার বয়স ২-৩ সপ্তাহ হলে সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সবজি ক্ষেতের আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। এতে পোকা দমনের সাথে সাথে পরিবেশও ভালো থাকবে। জমিতে প্রয়োজনে সেচ প্রদান করতে হবে। টমেটো গাছের অতিরিক্ত ডাল ভেঙে দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। ঘেরের বেড়িবাঁধে টমেটো, মিষ্টিকুমড়া চাষ করতে পারেন। মিষ্টিআলু, চীনা, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়। এসব ফসলের কোনটি এখনো না লাগিয়ে থাকলে দেরি না করে চারা লাগাতে হবে। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খরা সহনশীল ছোলা, মুগ, তিসি, যব এসব বপন করা যায়।
গাছপালা
এবারের বর্ষায় রোপণ করা ফল, ঔষধি বা বনজ গাছের যতœ নিতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি আলগা করে দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। প্রয়োজনে গাছকে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় জাবরা প্রয়োগ করলে তা পানি ধরে রাখবে। মাটিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে গাছের গোড়ায় সেচ প্রদান করতে হবে। এ সময় গাছের বাড়বাড়তি কম হয় তাই পারতপক্ষে এখন গাছের ডালপালা কাটা ঠিক হবে না।
প্রাণিসম্পদ
হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর ভালো সময় এখন। তাছাড়া সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে পোলট্রিতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বেড়ে যায় এবং রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, বসন্ত রোগ, কলেরা এসব রোগ মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে। এসব রোগ থেকে হাঁস-মুরগিকে বাঁচাতে হলে এ মাসেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ মাসে পশুখাদ্যের কোনো অভাব থাকে না। বিশেষ করে কাঁচা ঘাসের। তাই আমন ধানের খরসহ অন্যান্য খাদ্য যেমন ভুট্টা, ডাল, ঘাস দিয়ে সাইলেজ তৈরি করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে পারেন। এ সময় গবাদিপশুর খুরা রোগ, তড়কা, গলাফুলা দেখা দিতে পারে। গবাদিপশুতে রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রাণী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
মাছের খাবার হিসেবে রাসায়নিক সার এ সময় বেশি উপযোগী। জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে মৎস্যবিদদের সাথে পরামর্শ করে চুন বা তুঁতে প্রয়োগ করতে পারেন। পুকুরে রোদ পড়া নিশ্চিত করতে পুকুর পাড়ের গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। পুকুরের ঢালে প্যারা, নেপিয়ার বা অন্যান্য ঘাসের চাষ করলে অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যায় এবং কার্পজাতীয় মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া মাছ সংক্রান্ত যে কোনো পরামর্শের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, সংক্ষেপে আগামী তথা অগ্রহায়ণ মাসের কৃষিকথা উপস্থাপন করা হলো। বিস্তারিত কৌশল জানার জন্য স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে। এ ছাড়া কৃষি সম্পর্কিত যে কেনো সমস্যার সমাধানের জন্য যে কোনো মোবাইল থেকে ১৬১২৩ নম্বরে কল করতে পারেন। মনে রাখবেন আমাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই নিয়ে আসবে কৃষির কাক্সিক্ষত সাফল্য।
কৃষিবিদ ফেরদৌসী বেগম
সম্পাদক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা, টেলিফোন:০২৫৫০২৮৪০৪, মেইল: fardousi30@gmail.com
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র এলাকা। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১,৬০,০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহারের আবহাওয়া বেশি রুক্ষ্ম, এগুলোকে ‘ঠা ঠা বরেন্দ্র’ বলা হয়। ‘বরেন্দ্র’ শব্দের সরল ও ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্রের বরে (বর+ইন্দ্র) অর্থাৎ অনুগ্রহ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত দেশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এ মাটিতে শতকরা মাত্র ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্থ রয়েছে। এ মাটিতে নাইট্রোজেন কম, ফসফরাস কম-মধ্যম, পটাশ, গন্ধক ও দস্তা কম-মধ্যম মানের রয়েছে। এ মাটি অম্লধর্মী, এর পিএইচ ৫.২-৬.২। বরেন্দ্র অঞ্চলে বেলে বা বেলে দো-আঁশ জাতীয় মাটি নেই। এখানে লাল মাটি রয়েছে। পলি অঞ্চলে লাল মাটি দেখা যায় না। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয়। মাটির রস ধারণক্ষমতা কম।
সংক্ষেপে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির অতীত এবং বর্তমান অবস্থা
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির ইতিহাস ব্যাপক। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, ব্রিটিশ কর্মচারী রেনেলা তার ১৭৭১ সালের বর্ণনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক বন জঙ্গলে আচ্ছাদিত ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা দিয়েছেন। পরবর্তীতে কার্টারের রিপোর্টেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু পাকা দালানের ধ্বংসাবশেষ এবং ভরাট হয়ে যাওয়া বড় বড় দীঘির উল্লেখ প্রমাণ করে এককালে এ এলাকায় সমৃদ্ধ বসতি এবং সুগঠিত কৃষি ব্যবস্থা ছিল। তবে ব্রিটিশ কর্মচারী সাইমন ১৮৮৬ সালের বর্ণনায় বরেন্দ্র অঞ্চলকে প্রধানত কৃষি বহির্ভূত, খরাপীড়িত, উঁচুনিচু কাঁটাবন হিসেবে দেখিয়েছেন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে কার্টারের ১৯২৮ সালের সেটেলমেন্ট রিপোর্টে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলকে উঁচু, উন্মুক্ত এবং বন্ধুর ভূমি, উপত্যকার মাঝ দিয়ে সরুনালা প্রবাহিত গ্রীষ্মকালে শুধু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম ও বনের ভগ্নাংশ ব্যতীত সমগ্র বরেন্দ্র ছায়াহীন ধু-ধু প্রান্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ অঞ্চলে শুধু বৃষ্টিনির্ভর আমন ধান ব্যতীত তেমন কোনো ফসল চাষ হতো না। এ কারণে বছরে প্রায় ৭-৮ মাস জমি পড়ে থাকত। বর্তমানে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেচ সুবিধা প্রবর্তন করায় রোপা আমন ছাড়াও উফশি বোরো ধান এবং শাকসবজি ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। ফলে কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। নলকূপগুলো থেকে আজ আর সেভাবে পনি পাওয়া যাচ্ছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাড়ি (খাল) এবং পুকুর ছিল কিন্তু বর্তমানে এগুলো বেশিরভাগ মাছ চাষে লিজ দেয়া হয়েছে। এর কারণে সেখান থেকে পানি নিয়ে সেচকাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধের জন্য নদীর পানি শুকিয়ে সেচ কাজে বিঘœ হচ্ছে। তবে আশার কথা এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান ফল হচ্ছে আম, লিচু, কলা, কুল, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য। তবে কয়েক বছর ধরে স্ট্রবেরির চাষ এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবজি চাষে এরই মধ্যে এ অঞ্চল অনেক অগগ্রতি লাভ করেছে। এর মধ্যে আগাম শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলু, করলা, শসা উল্লেখযোগ্য। অতি সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ী উপজেলায় লতিরাজ কচু, মাচায় তরমুজ চাষ, ফুল চাষ শুরু হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় পলিব্যাগ দ্বারা পেয়ারা উৎপাদন, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন, মাল্টা, ড্রাগনফল, মুগডাল ব্যাপকভাবে আবাদ শুরু হয়েছে।
মাটির গুণাবলি উন্নয়নে করণীয়
বরেন্দ্র্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ খুব কম এ কারণে ফসল বিন্যাসে সবুজ সারের চাষ সংস্থান করা প্রয়োজন। তাছাড়া মাটি শুকনো অবস্থায় খুব শক্ত হয় এবং মাটির রস ধারণক্ষমতা কম। সেজন্য অধিক জৈব পদার্থ যোগ করলে এসব ধর্মের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন হয়। বছরে তিন বার ধান না করা ভালো এ ক্ষেত্রে একবার ডাল চাষ করতে হবে, যাতে মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ হয় এবং মাটিতে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তবে আমন ধানের পর জাবড়া বা মালচ ব্যবহার করে আলু চাষ করা যেতে পারে। বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য মুগডালের আবাদ একটি আশীর্বাদ। মুগডালের পড বা ফল তুলে গাছগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং আমন ধানে কম ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। তবে মুগডালের গাছ মাটির সঙ্গে মিশানোর ৪-৫ দিন পর আমন ধানের চারা লাগালে বেশি লাভ হয়। আর মুগডাল চাষে পানির তেমন প্রয়োজন হয় না এবং উৎপাদন খরচ কম হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে কম জৈবপদার্থ থাকার কারণে ধৈঞ্চা ফসলকে শস্য বিন্যাসে আনতে হবে। এজন্য গম, ছোলা, মসুর, সরিষার মতো রবি ফসল করে ধৈঞ্চা চাষ করলেও বছরে তিনটি ফসল করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে ধৈঞ্চা বপনের ৪-৫ সপ্তাহ পর মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানি অধিক হারে ব্যবহার না করে খাল, খাস পুকুর পুনঃখনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে হবে, যা হতে শুষ্ক মৌসুমে বা খরায় আমন ধানে এবং গম চাষে সম্পূরক সেচ প্রদান করা যাবে। কারণ যেভাবে বোরো আবাদের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আবাদ করাই কঠিন হয়ে পড়বে। তবে বিল এলাকায় কূপ খনন করা যেতে পারে। কারণ বিল এলাকায় কূপ খননের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া জমির পাশে মিনি পুকুর খনন করে আমন চাষাবাদ করতে হবে এতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমবে এবং মাটিতে পানির স্তর বৃদ্ধি পাবে। আর সেচ কাজে যদি নদীর পানি ব্যবহার করা যায় তবে সবচেয়ে ভালো, প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহার করে নদীর পানি খাল, পুকুরে সরবরাহ করতে হবে। আর খরা খেকে ফসলকে রক্ষার জন্য চাষিদের সম্পূরক সেচের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
বোরো ধান আবাদ কমিয়ে গম, আলু, টমেটো, ছোলা, মসুর, তিসি, খেসারি, সরিষার আবাদ বৃদ্ধি করা। গমের জন্য বারি গম-২৬ এবং বারি গম-২৮ বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। আর সরিয়ার জন্য বারি সরিষা-১৪ ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এগুলো অধিক ফলনশীল এবং জীবনকাল স্বল্প।
বোরো চাষ করলে আউশ আবাদ কম হয় সেহেতু বোরো ধান না করে, গম, আলু অথবা স্বল্প জীবনকালীন রবি ফসলের আবাদ করে আউশ ধান করতে হবে। আউশের জন্য ব্রিধান ৪৮ (জীবনকাল- ১১০ দিন এবং ফলন-৫.৫ টন/হেক্টর), ব্রিধান ৫৫ (জীবনকাল-১০৫ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর) চাষ করলে সঠিক সময়ে আমন চাষ করা যাবে, এ ক্ষেত্রে আমনের জন্য বিনা-৭ (জীবনকাল-১১০-১১৫ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর) বা ব্রিধান ৫৬ (জীবনকাল-১১০ দিন এবং ফলন-৫.০ টন/হেক্টর), ব্রিধান ৫৭ (জীবনকাল- ১০৫ দিন এবং ফলন-৪.৫ টন/হেক্টর) চাষ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আউশের চারা ২০-২৫ দিন এবং আমনের চারা ২৫-৩০ দিন বয়সের হতে হবে।
স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট নেরিকা ধানের লাইন এনে আরও গবেষণা এবং মাঠপর্যায়ে এর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজশাহী অঞ্চলের জন্য আরও পানি কম ব্যবহার হয় এমন শস্য বিন্যাস উদ্ভাবন করতে হবে। তবে নিম্নলিখিত শস্য বিন্যাস এ অঞ্চলের জন্য উপযোগী হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলকে নিয়ে আলাদা ফল উৎপাদন প্রকল্প এবং আলাদা ফ্রুট জোনিং সিস্টেমের আওতায় এনে উন্নত চাষাবাদ কৌশলের জন্য গবেষণা করতে হবে।
এ অঞ্চলে বর্তমানে প্রচুর ফল বাগান তৈরি হচ্ছে এর মধ্যে প্রধান প্রধান হচ্ছে আম, লিচু, কুল, পেয়ারা উল্লেখযোগ্য। তবে আমের বাগান সবচেয়ে বেশি। বিবিএস ২০১৪ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হয় এবং উৎপাদন প্রায় ৯.৫ লাখ মেট্রিক টন। এর বেশির ভাগ আম বাগানের অবস্থান এ অঞ্চলেই। তাই উন্নত জাত রোপণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগ ও পোকামাকড় দমন করলে আম চাষাবাদে বিপ্লব আসতে পারে এবং ব্যাপকভাবে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি যেহেতু শুষ্ক এবং পানির প্রাপ্যতা কম সেজন্য কুল একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফল। কিছু দিন আগেও বসতবাড়ির আশপাশেই কুল চাষ হতো। তবে এখন আপেলকুল, বাউকুল, বারিকুল-১, বারিকুল-২, বারিকুল-৩ এর মতো উন্নত জাত উদ্ভাবিত হওয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং এর চাষাবাদের ব্যাপকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পেয়ারা গুণাগুণে আপেলের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। সেজন্য একে ‘গরিবের আপেল’ বলা হয়। থাই পেয়ারা একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে এ অঞ্চলের জন্য দেখা যাচ্ছে। তাই পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য এর আবাদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে নেতিয়ে পড়া বা উইল্টিং রোগের কারণে পেয়ারা চাষে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিচ্ছে। এজন্য নেতিয়ে পড়া প্রতিরোধী জাত (পলি পেয়ারা এবং স্টবেরি পেয়ারা) দ্বারা জোড় কলমের মাধ্যমে নেতিয়ে পড়া প্রতিরোধী পেয়ারা গাছ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
‘পুষ্টির ডিনামাইট’ খ্যাত বারো মাসি সজিনা গ্রামের রাস্তার ধারে এবং বসতবাড়ির আঙিনায় যতœ ছাড়াই বেড়ে ওঠে। তবে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর কারণে বারো মাসি সজিনা এ এলাকাতে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সুনির্দিষ্টভাবে দেশব্যাপী সজিনা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আলাদা কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করা যেতে পারে। যেখান এ অঞ্চলের কৃষকরা স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে প্রয়োজনীয় তথ্য সময়মতো পেতে পারে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে আম একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তথ্য মতে, রাজশাহী অঞ্চলে উন্নত এবং রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
কৃষি গবেষণার সঙ্গে সমন্বয় করে চাষি প্রশিক্ষণ। আম বাজারজাতকরণ এবং প্রশিক্ষণের জন্য হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করা।
গুটি আমের গাছ না কেটে টপ ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ভালো জাতে পরিবর্তন করা। এছাড়া হটওয়াটার ট্রিটমেন্টের (গরম পানিতে শোধন ৫৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় আম শোধন) সুবিধা সৃষ্টি করা। যাতে আম আরও উজ্জ্বল, বেশি দিন স্থায়ী হওয়া এবং ফ্রুট ফ্লাই রোধ করা যায়।
উন্নত পদ্ধতিতে আম উৎপাদনকারী চাষিদের তালিকা করা, নিবন্ধন করা এবং সমিতির আওতায় এনে সমন্বয় সাধন করা।
আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোর তৈরি, হিমায়িত পরিবহনের ব্যবস্থা, দ্রুত স্থানান্তরকরণ, প্যাকেজিং এবং গুণগতমান পরীক্ষা করার পরীক্ষাগার তৈরি করা।
সমবায়ভিত্তিক আম সংরক্ষণের স্থাপনা তৈরির ব্যবস্থা করা এবং বিদেশিদের চাহিদামাফিক আমের জাত উদ্ভাবন করা।
জৈব প্রযুক্তি নির্ভর আম উৎপাদনে উৎসাহিত করা। এক্ষেত্রে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে আমবাগানে আলো বাতাসের অভাবে বা অন্য কারণে আমগুলো কালো বিবর্ণ এবং মাছি পোকার আক্রমণ হয় সেসব আম বাগানে এ পদ্ধতি খুব লাভজনক। এ পদ্ধতিতে ১০০% রোগ এবং পোকামুক্ত আম উৎপাদন সম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে এ আমগুলো ১০-১৪ দিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনে ১৫-৬২ বার স্প্রে করা হয়। অথচ ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৭০-৮০ ভাগ স্প্রে খরচ কমানো যায়।
পরিশেষে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি আজ হুমকির মুখে পড়েছে। এর থেকে উত্তোরণের জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, টেকসই প্রশিক্ষণ, সঠিক সময়ে সঠিক উপকরণ সরবরাহ, ভূমি ব্যবহারের সঠিক দিকনির্দেশনামূলক গবেষণা এবং কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানামুখী উদ্যোগ। তবেই বরেন্দ্র অঞ্চল হবে আমাদের ‘সোনার বাংলার’ অন্যতম শস্যভাণ্ডার।
কৃষিবিদ মো. আবদুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী
এফএও’র Four Betters
ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন
মোঃ এনায়েত উল্ল্যাহ রাফি
উন্নয়নের সবধরনের মাপকাঠিতে কিছুদিন আগেও মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাপূরণকে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য ছিল, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত একটি দেশ বিনির্মাণ। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২২ সালের বাংলাদেশ ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে এগিয়েছে, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চলেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রধান দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সেকারণেই মৌলিক চাহিদা হিসেবে সবার জন্য খাদ্য সংস্থানের পাশাপাশি, সবার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর, গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন আরও বেশি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম অভীষ্টসমূহ হলো কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাউকে পশ্চাতে না রেখে সবার জন্য সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমতার ভিত্তিতে সকলের জন্য খাদ্য সহজলভ্য করা ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন প্রসপেক্ট, ২০২২ অনুযায়ী চলতি বছরের শেষে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার সাথে খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে বহুগুণ। সেই সাথে সবার জন্য গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ আর পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডঋচ) এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৯-২০২২ এই তিন বছরে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের শিকার মানুষের সংখ্যা ২১০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩৪৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। প্রতিদিন প্রায় ৮২৮ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় রাতে ঘুমাতে যায়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড ১৯ বৈশ্বিক মহামারীর প্রকোপে, মানব সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসমতা (ক্রমবর্ধমান বৈষম্য), লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এবং নানাবিধ আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বেড়েছে খাদ্য ও পুষ্টি সংকট এবং কমছে উর্বর কৃষি জমির পরিমাণ, সেই সাথে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
বিগত তিন বছরে (২০১৯-২০২২) বিশ্বব্যাপী অপুষ্টির শিকার জনসংখ্যা ৮৩ কোটিতে উন্নীত হয়েছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় এক দশমাংশ। এশিয়া মহাদেশে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবের সম্মুখীন। এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রতি বছর জন্ম নেয়া প্রতি ছয়জন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এক চতুর্থাংশ শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে সঠিক দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে বলা যেতে পারে, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন বর্তমানে সবচেয়ে বড় এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের খাদ্য মূল্যসুচক গত বছরের তুলনায় ১৩.১ শতাংশ বেড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেড়েছে জ্বালানী মূল্য, সারের মূল্য যার ধারাবাহিকতায় বেড়েছে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয়। ফলস্বরূপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য মূল্য প্রায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিগত দশ বছরের খাদ্যদ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ধরনের পরিসংখ্যান ব্যাখ্যাতীতভাবে নির্দেশ করে যে, উৎপাদনশীলতা বহুগুণবৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ এখনো পুষ্টিকর খাদ্যের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন বর্তমান সময়ের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের অন্যতম একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ইতালির লিনসেই একাডেমি আয়োজিত এক সেমিনারে মূল আলোচক হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিবৃত্তির লক্ষ্যে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ব্যাপক রূপান্তরের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এ আলোচনায় তিনি খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনার কৌশলগত রূপরেখা- এফএও’র ফোর বেটারস (ঋড়ঁৎ ইবঃঃবৎং) এর কথা উল্লেখ করেন যার মূল উদ্দেশ্য (ভালো উৎপাদনের মাধ্যমে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন নিশ্চিতকরার মাধ্যমে) ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। সেই লক্ষ্য অর্জনে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হল , “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়: ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন”। এই মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির মৌলিক চাহিদা পূরণে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এফএও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এমএমআই (গরংংরহম গরফফষব ওহরঃরধঃরাব) প্রকল্প, টেলিফুডের আওতায় বরিশালে ক্ষুদ্র পরিসরে সেচকাজ, কক্সবাজারে ডিজিটাল ভিলেজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এফএও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রযুক্তি, বাজার এবং অর্থায়নের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণসহ জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা প্রদান করে যাচ্ছে।
“বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২” উদযাপন উপলক্ষ্যে নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্যকে লালন করে সকলকে একত্রে নিয়ে কাজ করে যেতে হবে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।
লেখক : ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। মোবাইল : ০১৮৪২২৫৯২৪৮, ই-মেইল : md.ullahrafi@fao.org
ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন দেশের কৃষি ও কৃষকের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এবং স্বনিভর্রতা। তাই তো বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কৃষি ক্ষেত্রে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে বঙ্গবন্ধু বিশেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা গ্রামই সব উন্নয়নের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যখন বেগবান হবে তখন গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার মানসে জাতির পিতা এসময় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ছিল যে কোনো উপায়ে কৃষকের স্বার্থরক্ষা করা। কেননা কৃষকই এ দেশের আসল নায়ক যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের সবার অন্ন জোগায়। কৃষকের চলমান, চাহিদা যথোপযুক্তভাবে নিশ্চিত করতে পারলে কৃষক অনেক আগ্রহে স্বতঃস্ফূর্ততায় কৃষিতে নিজেকে বিনিয়োগ করতে পারবে, উন্নয়নের জোয়ার বইবে।
আরেকটি কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু, গ্রামের কৃষক অনেক অভিজ্ঞ অনেক দক্ষ। তাদের সাথে শেয়ার করে সমন্বয় করে আধুনিক কৃষিতে এগোতে হবে। মানুষের ওপর জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া যাবে না এটি খুব ভালো করে জানতেন বঙ্গবন্ধু। তাই তো তিনি বলেছেন করে দেখাতে হবে, এতে কৃষক নিজে নিজে শিখে নিজের আঙিনায় বাস্তবায়ন করবে। এক গ্রামের ২০ জনকে একসাথে ক্ষেতখামারে হাতেকলমে কাজ দেখালে পাশের অন্য কৃষক দেখে দেখে নিজের জমিতে বাস্তবায়ন করলে উৎপাদন বেড়ে যাবে। তখন সারা বাংলার অন্যরা এগিয়ে আসবে সম্পৃক্ত হবে উন্নয়নের মূলধারায়। কেননা আমাদের কৃষক দেখে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত।
সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা হলো খামারের উপাদানসমূহে (ধান চাষ, রবিশস্য চাষ, বসতবাড়ীতে ফল মূল ও শাকসবজির চাষ, হাঁস- মুরগি পালন, গরু পালন, ছাগল/ভেড়া পালন এবং মাছ চাষ) উন্নত কলাকৌশলের সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং এদের আন্তঃ সম্পর্ক বিবেচনায় রেখে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে কাক্সিক্ষত ফলন লাভ করাই হলো সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যদি সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলা না যায় তাহলে আমাদের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হবে, আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব না। আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। কোঅপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে আগাতে পারলে আমাদের কৃষির উৎপাদন এবং সার্বিক উন্নয়ন দুটিই মাত্রা পাবে। অধিক শস্য উৎপাদনের জন্য আমাদের সবার সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মাঠের ফসল, গবাদিপশু, মাছ পরিবেশ সব কিছুর মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করেত হবে। তা না হলে আমরা কাক্সিক্ষতভাবে এগোতে পারব না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, খাদ্য শুধু চাউল, আটা, নয়; মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, তরকারিও আছে। সুতরাং কৃষির উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর দর্শনেই আজ বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার (আইএফএম) মাধ্যমে কৃষক তার খামারের সম্পদসমূহ চিহ্নিত করে এদের আন্তঃসম্পর্ক বিবেচনায় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করেন। এতে খামারের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করে অধিক লাভবান হওয়া যায়। খামারের সমস্যা সমাধানে খামারের নিজস্ব সম্পদ কি কি আছে তা দেখবেন। খামারের উপাদানের উপজাত যেমন গোবর, খড়, ছাই, কুড়া, মুরগির বিষ্ঠা, চাল ভাঙা ইত্যাদি খামারি ব্যবহার করবেন এবং খামারে নতুন কোন উপাদান যোগ করার সুযোগ আছে কি না তা দেখবেন এবং তা ব্যবহার করে খামারের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করে অধিক লাভবান হবেন।
খামারের সকল উপাদানসমূহে (ধান চাষ, রবিশস্য চাষ, বসতবাড়িতে ফলমূল ও শাকসবজি চাষ, হাঁস- মুরগি পালন, গরু পালন, ছাগল/ভেড়া পালন এবং মাছ চাষ) ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং খামারের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করে অধিক লাভবান হবে।
নিরাপদ খাদ্যকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দেশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু, অণুজীব, রোগ ও পোকা ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করছে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হবে। নিজের বসতবাড়িতে উৎপাদিত কৃষি পণ্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় দারুণ ভ‚মিকা রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমন্বিত কৃষি খামারের ধারণাটি কৃষকের বাড়িতে করা যায়। দেশের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার অপার সুযোগ হবে বলে আমার বিশ্বাস। য়
উপপরিচালক (এল.আর.), ডিএই, মোবাইল-০১৭১৬০০৪৪০০, ই-মেইল : Jagot_mala@yahoo.com
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম১, ড. মো. শামছুল আলম২
রিজুভেনাইজেশন বা উজ্জ্বীবিতকরণ হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে বয়স্ক বা ঘন করে লাগানো গাছ/বাগান, যে গাছে/বাগানে আদৌ ফল ধরে না বা খুবই কম ফল দেয় সে ধরণের ফল গাছ/বাগানকে ফল উৎপাদনক্ষম করে তোলার পদ্ধতি। সাধারণত ১৫-২০ বছর বয়সী বাগানে আগের চেয়ে ফল উৎপাদন কমে যায়, গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে, গাছ বা বাগান ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পাদন করা জটিল হয়ে উঠে এবং রোগ ও পোকা-মাকড় দ্বারা গাছ বেশী আক্রান্ত হয়। পোকা-মাকড় সহজে দমন করা যায় না। এমতাবস্থায় নিম্নলিখিত জটিলতা দেখা যায়।
* ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় অথবা হয়-ই না।
* ডালে শর্করা ও নাইট্রোজেনের প্রয়োজনীয় অনুপাতের (ঈ:ঘ) ব্যাঘাত ঘটে। আমের ডালে মুকুল আসতে হলে, ফুল আসার আগে ডালটিতে পর্যাপ্ত পরিমানে অধিক শর্করা ও কম নাইট্রোজেন দুই-ই থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, শর্করার ভাগ নাইট্রোজোনের ভাগের চেয়ে যথেষ্ট বেশী থাকতে হবে। আর যদি দু’টির ভাগ সমান হয় বা বিশেষ করে ডালটির নাইট্রোজেনের মাত্রা শর্করার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ঐ ডালের ডগায় মুকুল আসার বদলে পাতা এসে যায়।
* ঘন করে লাগানো বাগানের ক্ষেত্রে, গাছের মধ্যে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা চলে। ফলে গাছ পরিমিত খাদ্য পায় না।
* ঘন ডালপালা থাকার কারণে আলো ও বায়ু চলাচল ঠিকমত হয় না বলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
বয়স্ক/ঘন বাগানে মরা, রোগাক্রান্ত এবং পোকাক্রান্ত ডালপালা বেশি থাকে। উক্ত ডালপালা গুলো খাবার নেয় কিন্তু কোন ফলও ধরে না, ফলে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়।
* গাছের নীচের দিকের ডালপালায় রোদ কম পড়ে, ফলে ফলন হয় না বললেই চলে। তাছাড়া ঐ সমস্ত ডালগুলো রোগ ও পোকার আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
রিজুভিনাইজেশন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা: রিজুভেনাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বয়স্ক, অনুৎপাদনশীল/ঘন আম বাগান বা গাছকে উজ্জ্বীবিত করা যেতে পারে যা নি¤েœ বর্ণনা করা হলো-
* বয়স্ক, অধিক ঘন এবং ফল হয় না এমন বাগান/গাছ আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে মাটি থেকে ২.৭৫ মি- ৩.০০ মিটার উচ্চতায় গাছের সমস্ত ডাল কেটে ফেলতে হবে।
* কর্তিত অংশে আলকাতরা/রং এর প্রলেপ দিতে হবে।
* সার, সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা করতে হবে।
* ডাল কাটার পর ৩-৪ মাসের মধ্যে নতুন কুশি বের হবে।
* ডাল কাটার পর ৬-৭ মাসের মধ্যে ঘন শাখা প্রশাখা বের হবে।
* প্রতিটি শাখায় সুস্থ-সবল, মোটা-তাজা ৫-৭টি ডাল রেখে, রোগাক্রান্ত, মরা, কীটাক্রান্ত, দূর্বল ডালসহ বাকীডালগুলো কেটে ফেলতে হবে।
* ডাল কাটার পর মূলগাছে ও নতুন গজানো পাতায় রোগ ও পোকামাকড়েরর উপদ্রব বেশি হয়। এজন্য গাছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
* কর্তিত গাছে প্রথম বছরে কোন ফল পাওয়া যায় না।
* দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত কর্তিত গাছের নতুন গজানো ডাল পাতলাকরণের কাজ চলতে থাকবে।
* দ্বিতীয় বছরে জানুয়ারি- ফেব্রæয়ারি মাসে কর্তিত গাছের গজানো শাখায় ফুল আসবে।
* দ্বিতীয় বছরে কর্তিত গাছের নুতন গজানো শাখায় ফল ধরে।
যথাযথ ব্যবস্থাপনায় তৃতীয় বছরে কর্তিত গাছটি একটি পূর্ণাঙ্গ ফলবান বৃক্ষে পরিণত হবে।
সার প্রয়োগ : কর্তিত গাছে নতুন ডালপালা গজানো ও সতেজ করার লক্ষ্যে আম বাগানে চাষ দিয়ে বা গাছের গোড়া আগাছা মুক্ত করে জৈবসার প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে গোড়া থেকে ১.০-১.৫ মিটার দূরে নালা পদ্ধতিতে সার দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে সমস্ত সার প্রয়োগ করতে হবে তা সারণি-১ দ্রষ্টব্য।
উল্লেখিত সারগুলোর অর্ধেক পরিমাণ সার গাছের ডাল কাটার পর পরই প্রথম ধাপে প্রয়োগ করতে হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে বাকি অর্ধেক সার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও নিকাশ: সার প্রয়োগের পর উক্ত সার যাতে গাছ গ্রহণ করতে পারে সে জন্যে আম বাগানে প্রথমে একটি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পর মাঝে মাঝে গাছের প্রয়োজন অনুসারে এমন ভাবে সেচ দিতে হবে যেন মাটিতে রস থাকে। লক্ষ রাখতে হবে যেন আম বাগানে বা গাছের গোড়ায় যেন কোন অবস্থায় দীর্ঘ সময় পানি জমে না থাকে।
পোকামাকড় ও ব্যবস্থাপনা
পাতাখেকো শুঁয়োপোকা
এ পোকার কীড়া (বাচ্চা) চারাগাছ ও বড় আমগাছের পাতায় আক্রমণ করে। স্ত্রী মথ আমপাতার ওপরের পিঠের কিনারায় লাইন করে মুক্তার দানার মতো সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হলে, কীড়াগুলো প্রথমে ঐ পাতার ওপর গুচ্ছাকারে থাকে, পরে গাছে ছড়িয়ে যায় এবং পাতার মধ্যশিরা রেখে পুরো পাতা খেয়ে ফেলে আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ বা আংশিক পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। এতে গাছের খাবার তৈরি বাধা পায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রমণ খুব বেশি হলে গাছে ফুল ও ফল হয় না।
দমনব্যবস্থা
ডিমসহ পাতা দেখামাত্রই সংগ্রহ করে পুড়িয়ে মারতে হবে। গুচ্ছাকারে বা ছড়ানো অবস্থায় থাকা শুঁয়োপোকাগুলো সংগ্রহ করে পা-দিয়ে পিষে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পা-দিয়ে পিষে মারার সময় অবশ্যই পায়ে স্যান্ডেল বা জুতা থাকতে হবে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার ডাইমেক্রন/ ডায়াজিনন ৬০ ইসি (৪ কর্ক) বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি (৪ কর্ক) মিশিয়ে পাতা ও ডাল-পালাসহ গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে।
পাতাকাটা উইভিল ক্ষতির ধরন: এ পোকা কচি আমপাতার নিচের পিঠে ছোটছোট গর্ত করে ডিম পাড়ে। এরপর ডিমসহ কচিপাতাটি (লাল পাতা) রাতের বেলা বোঁটা থেকে একটু দূরে কাঁচি দিয়ে কাটার মতো করে কেটে ফেলে দেয়। এতে গাছের নুতন পাতা ধ্বংস হয় এবং খাবার তৈরি কমে যায়। ফলে চারা বা গাছ দুর্বল হয়ে যায়।
দমনব্যবস্থা
আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছে কচিপাতা দেখার সাথে সাথে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার সুমিথিয়ন ৬০ ইসি (৪ কর্ক) মিশিয়ে গাছসহ গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে ¯েপ্র করতে হবে। এ পোকা দিনের বেলায় গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতার নিচে ও আগাছার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাই গাছের নিচে পড়ে থাকা কচিপাতা দেখামাত্র সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ফল ধারণ: আম গাছকে উজ্জীবিতকরণ করার প্রথম বছরের পর ঐ গাছে সাধারণত কোন ফল ধরে না তবে ঠিকমত ব্যবস্থাপনা দিলে দ্বিতীয় বছর থেকে গাছে ফল ধরা শুরু হয়। য়
১পরিচালক, বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বা.কৃ.বি., ময়মনসিংহ। ২এসএসও, উদ্যানতত্ত¡ বিভাগ, বিনা, মোবা : ০১৭১১১২৪৭২২ ই-মেইল : mithuhort@yahoo.com
মো. আবু হানিফ, গ্রাম : ঘোলদাড়ি, উপজেলা : আলমডাঙ্গা, জেলা : চুয়াডাঙ্গা
প্রশ্ন : লাউয়ের বয়স্ক পাতায়-বাদামি-হলুদ দাগ হয়, ধীরে ধীরে পাতা পুড়ে যায়, কী করলে সমাধান পাব?
উত্তর : লাউ গাছের এ ধরনের সমস্যা সারকোস্পোরা নামক ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। এ রোগে পাতায় পানি ভেজা দাগের মতো ছোট ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। দাগগুলো একত্রে বড় হয়ে বাদামি রঙ ধারণ করে। পরে আক্রান্ত পাতাগুলো শুকিয়ে যায়। এ রোগ প্রতিকারে কার্বেনডাজিম গ্রুপের ১ গ্রাম ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে লাউ গাছে সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তবেই আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
মো. হেলাল উদ্দীন, গ্রাম : গৌরাঙ্গপুর, উপজেলা : মোহনপুর, জেলা : রাজশাহী
প্রশ্ন : পানের পাতায় কালো পানি ভেজা দাগ হয়ে আস্তে আস্তে পচে যায়। কী করলে উপকার পাব?
উত্তর : সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণে নিচের পাতার আগায় বা কিনারায় প্রথমে হলুদ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। দাগ আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে যেতে থাকে। আবার তাপমাত্রা বেশি হলেও এ রোগ বেড়ে যায়। এ ধরনের সমস্যায় কপার অক্সিক্লোরাইড গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে সুফল পাবেন।
মো. জয়নাল উদ্দীন, গ্রাম : লক্ষীরপাড়, উপজেলা : বিশ্বম্বরপুর, জেলা : সুনামগঞ্জ
প্রশ্ন : স্ট্রবেরির পাতায় প্রথমে বাদামি, পরে কালো দাগ পড়ে, এর প্রতিকার কী?
উত্তর : স্ট্রবেরির এ সমস্যাটিকে পাতায় দাগ পড়া রোগ বলে। ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিকারে ফেনামিডন ও মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করলে আপনি সুফল পাবেন।
মো. গোলাম মোস্তফা, গ্রাম : পিরোজপুর, উপজেলা : মেহেরপুর সদর, জেলা : মেহেরপুর
প্রশ্ন : আমার আম্রপালি ও হিমসাগর আমগাছে সাদা ছত্রাকের মতো দেখা যাচ্ছে । বর্তমানে গাছের কাণ্ড ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ছে । আমি কিভাবে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি?
উত্তর : আক্রমণের বর্ণনা অনুযায়ী মনে হচ্ছে আপনার আম গাছে মিলি বাগ নামক পোকার আক্রমণ হয়েছে। ব্রাশ দ্বারা সাদা বস্তু/ পোকা সরিয়ে ফেলে কিংবা আক্রান্ত পাতা ও ডগা সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। গুঁড়া সাবান (হুইল/জেট পাউডার) পানিতে (৫ গ্রাম/লি) মিশিয়ে স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ডাইমেথয়েট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে। তাহলেই আপনি উপকার পাবেন।
মো. শরিফ উদ্দীন, গ্রাম : পুরনাপাইল, উপজেলা : ক্ষেতলাল, জেলা : জয়পুরহাট
প্রশ্ন : এক বছর আগে আমি একটি আনারের কলমের চারা কিনে রোপণ করি এবং গাছে প্রচুর ফুল আসে। কিন্তু ফুল টিকে না এবং ফলও হয় না। এ অবস্থায় আমার করণীয় কী?
উত্তর : বাংলাদেশে ডালিমের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। ডালিমের ক্ষেত্রে কলমের চারা ভালো। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার, পানি ও পরিচর্যা প্রয়োজন। চারা কলম লাগানোর পর প্রথম ৩ বছর গাছে কোন ফুল ও ফল ধরতে দেয়া যাবে না। বরং ফুল এলে তা অপসারণ করতে হবে। গাছের বয়স অনুযায়ী সারের মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর অবশ্যই সেচ দিতে হবে। ১ম কিস্তি বর্ষার শুরুতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ইউরিয়া ও এমওপি অর্ধেক করে। ২য় কিস্তি ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ইউরিয়া ও এমওপির বাকি অর্ধেকসহ সব সার। ৩য় কিস্তি শীতের শেষে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে আনারের চাষ করলে আশা করা যায় আপনি আপনার কাক্সিক্ষত ফল পাবেন।
মুক্তা আকতার, গ্রাম : দক্ষিণভাদারতিল, উপজেলা : কালীগঞ্জ, জেলা : গাজীপুর
প্রশ্ন : লাউ গাছের পাতায় সাদা সাদা গুঁড়া দেখা যাচ্ছে। কী ব্যবস্থা নিলে উপকার পাব?
উত্তর : লাউ গাছের এ সমস্যাটিকে পাউডারি মিলডিউ বলে। এ রোগে পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের আবরণ দেখা যায়। আক্রমণ বেশি হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধানে প্রপিকোনাজল গ্রুপের ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে স্প্রে করলে উপকার পাবেন। এছাড়া পরবর্তীতে আগাম বীজ বপন, রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার এবং সুষম সার ব্যবহার করলে এ সমস্যা থেকে আপনি সুরক্ষা পাবেন।
মো. মিনহাজুল ইসলাম, গ্রাম : ফলিয়ামারি, উপজেলা : ময়মনসিংহ সদর, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : আমার গরু ৮ মাসের গর্ভবতী। নড়াচড়া করতে চায় না। বসে থাকলে উঠতে পারে না। কিছু খেতে চায় না। এ অবস্থায় করণীয় কী?
উত্তর : গাভীর মিল্ক ফিভার বা দুগ্ধ জ্বর হয়েছে। গাভীকে শিরার মাধ্যমে ক্যালসিয়াম বোরোগ্লুকোনেট প্রয়োগ করতে হবে। গর্ভাবস্থায় গাভীকে ক্যালসিয়াম প্রিপারেশন (ক্যালপ্লেক্স) খাওয়াতে হবে। দুগ্ধ জ্বর হলে গাভী যাতে কাত হয়ে না শোয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ একপাশে ভর করে শুয়ে থাকলে নিউমোনিয়া হতে পারে।
শফিকুল ইসলাম, গ্রাম : বাকতা, উপজেলা : ফুলবাড়ীয়া, জেলা : ময়মনসিংহ
প্রশ্ন : আমার গাভীকে বীজ দেয়া হয়। কিন্তু বীজ দেয়ার ২১ দিন পর আবার গরম হয়। এভাবে দুইবার বীজ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আমার করণীয় কী?
উত্তর : যদি দেখা যায় বীজ দেয়ার ২১ দিন পর আবার গরম হচ্ছে তাহলে বীজ দেয়ার ২ ঘণ্টা আগে ২.৫ সিসি ওভুরেলিন ইনজেকশন ঘাড়ের মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। আর বকনার ক্ষেত্রে ২.৫ সিসি ওভুপ্রোস্ট ইনজেকশন মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। আশা করি আপনার সমস্যাটি দূর হয়ে যাবে।
মো. কাশেম, গ্রাম : বিষ্ণুগ্রাম, উপজেলা : পাইকগাছা, জেলা : খুলনা
প্রশ্ন : আমি এ মৌসুমে পুকুরে মাছ ছাড়তে চাই। তবে আমি কি মাছ চাষ করলে লাভবান হব?
উত্তর : আপনি স্বল্প সময়ে লাভবান হতে চাইলে থাই কই, মনোসেক্স তেলাপিয়া, থাই সরপুঁটি এবং গিফট তেলাপিয়া চাষ করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার কাছের উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করে হাতে কলমে আরো বেশি প্রশিক্ষণও নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনি অনেক লাভবান হবেন।
নাজমুল করিম, গ্রাম : বালাগ্রাম উপজেলা : জলঢাকা, জেলা : নীলফামারী
প্রশ্ন : পুকুরে শোল মাছ চাষ করতে চাই। এ ব্যাপারে পরামর্শ দিলে উপকৃত হব?
উত্তর : পুকুরে শতকপ্রতি ১ কেজি করে চুন প্রয়োগ করে তারপর পুকুরে পানি ঢুকাতে হবে। পানি ঢুকানোর ১ সপ্তাহ পর পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। শোল মাছের রেণু পোনা আমরা সাধারণত হ্যাচারি থেকে পাই না। শোল মাছের প্রজনন সাধারণত পুকুরেই হয়ে থাকে। একক চাষের জন্য শতকপ্রতি ১০টি মাছ এবং মিশ্র চাষের জন্য শতকপ্রতি ৪টি করে দেয়া যেতে পারে। খৈল বা চালের কুড়া দিয়ে বানানো খাবার সাধারণত শোল মাছ খায় না। ছোট মাছই এর প্রধান খাবার। পোনা মাছের প্রিয় খাবার শুঁটকির গুঁড়া ভালোভাবে পিষে দিতে হয়। আর বড় মাছের জন্য ছোট ছোট মাছ যেমন পুঁটি, চান্দা এগুলো দেয়া যেতে পারে। তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খায়। কিন্তু পচা মাছ এরা খায় না। এছাড়াও এরা খাবার হিসেবে কেঁচো ও ব্যাঙ খায়। বাগদা চিংড়ির মাথাও শোল মাছের প্রিয় খাবার। যে পুকুরে শোল মাছ চাষ করবেন সেই পুকুরে কচুরিপানা অথবা কলমিলতা থাকলে ভালো কারণ শোল মাছ আড়ালে আবডালে থাকতে পছন্দ করে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কচুরিপানায় পুকুর ভরে না যায়। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড় দিতে হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে মাছ বের হয়ে যাবে। এভাবে শোল মাছ চাষ করলে আপনি অবশ্যই লাভবান হবেন।
কৃষির যে কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান পেতে বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন আমাদের কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ এ নাম্বারে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত যে কোনো দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে। তাছাড়া কৃষিকথার গ্রাহক হতে বার্ষিক ডাক মাশুলসহ ৫০ টাকা মানি অর্ডারের মাধ্যমে পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ এ ঠিকানায় পাঠিয়ে ১ বছরের জন্য গ্রাহক হতে পারেন। প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিকে কৃষিকথা পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়।
কৃষিবিদ মো. তৌফিক আরেফীন*
*উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এল আর, সংযুক্ত কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫ suman_arefin@yahoo.com
মোতাহার হোসেন
গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুক্তিকামী,স্বাধীনতাকামী মানুষের এবং সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে চির প্রতিবাদ কণ্ঠস্বর। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন,বিশ্বের নিপীড়িত মানুষেরও মুক্তির পথপ্রদর্শক। তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে বাংলার আনাচে কানাছে ঘুরেছেন, কৃষক, শ্রমিক, চাষাভুসা, কামার কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের অভাব, অভিযোগ, সমস্যার কথা শুনেছেন, সমাধানে তাদের নিয়েই রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ফলে বাংলার কৃষক শ্রমিক, ছাত্র, মজুর সকলের সমস্যা, অভাব তিনি জানতেন। তাই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর পরই কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্রসহ সকল স্তরের মানুষের কল্যাণে নিয়েছিলেন পৃথক পৃথক কর্মসূচি। তিনি একাদ্বারে কৃষক, শ্রমিক মুজুর, ছাত্র, শিক্ষকের, খেটে খাওয়া মানুষের নেতা। এমন এক মহীরুহ ছিলেন জাতির পিতা ১৯৭৫ সালে আগস্টের ১৫ তারিখ একদল ক্ষমতা লিপ্সু রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে।
তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন, এমনকি ফাঁসির দড়িও তাঁকে লক্ষ্য থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় জনগণের মাঝে। নিজেকে সঁপে দেন দেশ গড়ার কাজে। শুরু হয় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন এ দেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাই তিনি সব সময় কৃষির প্রতি শ্রদ্ধা ও অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলেন। দার্শনিক রুশোর একটি উক্তি এখানে প্রাসঙ্গিক, তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমÐিত শিল্প হচ্ছে কৃষি। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক। চির আধুনিক রাজনৈতিক নেতা। তিনি দার্শনিক রুশোর বাণীকে লালন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষিশিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য। তিনি উপলব্ধি করতেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হতে না পারলে, মানুষের অন্ন সংস্থান করতে না পারলে সকল অর্জন ব্যর্থ হবে। তিনি বুঝেছিলেন কৃষি একটি জ্ঞাননির্ভর শিল্প। তাই শিক্ষিত জনগৌষ্ঠীকে দেশ গঠনে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করার উপর গুরত্ব দিয়েছেলন। কারণ তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থা দ্বারা দ্রæত ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য চাই কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। আর কৃষিশিল্পের আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর হচ্ছেন কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ১১ দফায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সব প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও আত্মমর্যাদাশীল কৃষিবিদরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দেশের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানে নিয়োজিত রয়েছেন। কৃষিবিদদের চিন্তাচেতনা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা ও প্রগতিশীল কর্মকাÐের মাধ্যমে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ উপহার দিতে সক্ষম।
কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে মমত্ববোধ ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। বঙ্গবন্ধু শত ব্যস্ততার মধ্যেও কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শ্যামল আঙিনায়। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল তা প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কী বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে, সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের সোনার বাংলা নয়। বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না। তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে এবং কৃষিবিদদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালে চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। পরে ফেললে আমার ধান নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষক তথা আপামর জনগণের মুক্তির জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর প্রদত্ত ভাষণ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি ছিলেন আবহমান বাংলার একজন পথচারী। বংলার মাটির সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে নির্মম ভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে দেশের স্বাধীনতা,মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয় ঘাতক চক্র। সেই সঙ্গে কৃষের স্বপ্নও ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। বরং সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অলিখিত ভাবে দেশের কৃষকের উপর চালানেরা হয় এক প্রকারের স্টিম রোলার।
এই বৈশ্বিক দুর্যোগে বঙ্গবন্ধুর এবারের শাহাদতবার্ষিকী নতুন রূপে, নতুন আঙ্গিকে বিশেষ করে তাঁর জš§শতবার্র্ষিকীর এই শুভ লগ্নে তাঁকে নতুন করে , নব রূপে আবিষ্কার, তাঁর চেতনায়, তাঁর আদর্শের মশাল ভবিষ্যত প্রজšে§র কাছে পৌঁছে দেয়ার একটি বিরাট সুযোগ। বঙ্গবন্ধুকে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলকে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, দুলক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানি আর বিপুল বিশাল সম্পদ ক্ষতির স্বীকার করে অর্জিত মহান স্বাধীনতাকে হৃদয়ে ধারণ করে সামনের দিকে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়েই মূলত তাঁকে স্মরণ এবং সম্মান দেয়া সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই তাঁকে স্বরণ, অনুকরণ, অনুপ্রেরণাই হবে আজকের প্রজšে§র সামনে শিক্ষণীয়।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি বাংলাদেশের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কবির ভাষায় বলা প্রাসঙ্গিক যে, ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত/বঙ্গবন্ধু মরে নাই/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো/ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই/তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা/আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা/যে মানুষ ভীরু কাপুরুষের মতো/ করেনি কো কখনো মাথা নত/এনেছিল হায়েনার ছোবল থেকে/ আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা/কে আছে বাঙালি তার সমতুল্য/ ইতিহাস একদিন দেবে তার মুল্য...।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মাশাল এখন বহন করছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি বছর আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে ছিল। ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তি আবার ক্ষমতায় এলে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কৃষি খাতে আবার ভর্তুকি, সার বিতরণ ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, শস্য বহুমুখীকরণসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭২ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল প্রায় এক কোটি টন সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি ৩২ লাখ টন। একই সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেরও উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে এ যুগান্তকারী সাফল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।
বর্তমানে জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব, শিল্পায়ন নগরায়ণ, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, রাসায়নিক সার ও কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে কৃষিসম্পদ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য এ দেশের কৃষি, কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবান্ধব সরকারের যৌথ উদ্যোগে কাজ করে চলছে। এই দিনে তাঁর বিদেহী আতœার মাগফেরাত কামনা করছি। একই সঙ্গে এ দিনে তাঁর পরিবারের অপরাপর শহীদ সদস্যদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। য়
সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম। মোবাইল ০১৮৪১৮১২৭৫ motaherbd123@gmail.com
পুষ্টিকর খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়তে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রথম এবং প্রধান উপজীব্য। যা প্রথম শুরু করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই ফলশ্রুতিতে তিনি কৃষিকে ঢেলে সাজানোর প্রয়াস নিয়েছিলেন। কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গড়ে তুলেছিলেন এদেশের মিষ্টি ফসলের ভিত্তি। কারণ মিষ্টি ফসলের সব উদ্ভিদ উৎসই পুষ্টিক এবং এগুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। ফলে ভবিষ্যতের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অল্প জমিতে অধিক পুষ্টিকর খাবার উৎপাদন করতে মিষ্টি ফসলই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি ফসল আখ। আখ থেকে হয় রস, গুড়, চিনি। আখের পাশাপাশি রয়েছে তাল, খেজুর, গোলপাতা, স্টেভিয়া, সুগারবিট, মধু, যষ্টিমধু প্রভৃতি। তাল থেকে হয় রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি। খেজুর ও গোলপাতা থেকেও হয় রস, গুড়। সুগারবিট থেকে হয় গুড়, চিনি, মাছের খাবার, গবাদি পশুর খাবার প্রভৃতি। স্টেভিয়া, যষ্টিমধু এবং মধুর পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণ সর্বজনবিদিত। আর বড় কথা হলো এসব খাবারের পাশাপাশি ওইসব ফসলভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের খাদ্য শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। তাতে রয়েছে দারিদ্র্য মোচনেরও অপার সম্ভাবনা। এসব ছাড়াও তাল থেকে তৈরি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি তাল গাছ বজ্রপাতের বিপদ থেকে রক্ষা করে। এখানে আলোচিত ফসলগুলোর মধ্যে আখ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে বেশি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু। তবে তাল ও খেজুর গাছও প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে। বিশেষ করে বজ্রপাত নিরোধে তালগাছের ভূমিকা অপরিসীম।
পরিবারের আয় এবং পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আখ চাষ
আখ মিষ্টি ফসল এবং পুষ্টিকর ফসল। আজকাল সারা দেশে সারা বছর উপজেলা শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটি বাজারের কোণায় কোণায় চিবিয়ে খাওয়া আখ ব্যাপক হারে বিক্রি হয়। যার বাজারদর এলাকা ভেদে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিটি আখের দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও মধ্য, দক্ষিণ ও পাহাড়ি অঞ্চলে দাম ও চাহিদা খুবই বেশি। এক বিঘা জমিতে ৩০০০টি চিবিয়ে খাওয়া আখের চারা রোপণ করা যায়। এক্ষেত্রে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ১ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি.। এক বিঘা অর্থাৎ ১৩৪৯ বর্গমিটার জমিতে ওই মাপে লাগানো হলে ২৯৯৮ বা ৩০০০টি চারা লাগানো যাবে। সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে এটা রোপণ করে, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে গাছ প্রতি কমপক্ষে ৫টি কুশি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ঝাড় প্রতি ১টি মাতৃগাছ এবং ৫টি কুশি অর্থাৎ ৬টি আখ পাওয়া যাবে। সুতরাং ৩০০০টি ঝাড়ে ৩০০০ী ৬=১৮০০০টি আখ পাওয়া যাবে) তা থেকে ১৮০০০টি সুস্থ ও সবল আখ উৎপাদন করা সম্ভব। সর্বনিম্ন বাজারদরে (১০টাকা) তা বিক্রি করেও এ থেকে ১,৮০,০০০/-টাকা আসবে যার চাষাবাদ থেকে বিক্রি পর্যন্ত মোট খরচ হয় প্রায় ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা। অর্থাৎ নিট লাভ হয় ১,৫০,০০০ টাকা। এটা গেল আখের হিসাব। আখ ছাড়াও ওই জমিতে সাথী ফসল চাষ করে প্রায় ১০,০০০-১৫০০০ টাকা নিট লাভ হবে। এ টাকা দিয়ে চাষি তার আখ চাষের ওই খরচ মিটাতে পারবে। যদিও বলা হয় আখ ১২-১৪ মাস মাঠে থাকে কিন্তু এর পরিপক্বতার জন্য ১০-১২ মাসই যথেষ্ট। তদুপরি যদি চিবিয়ে খাওয়ার আখ হয় তাহলে তা ৭-৮ মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়। সে কারণেই সঠিক জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আখ চাষ করে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করা যেমন সম্ভব তেমনি সম্ভব অধিক উপার্জন এর মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা এবং এভাবেই সম্ভব দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকার পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা।
বিভিন্ন মিষ্টি ফসলের পুষ্টিমান
আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের (অর্গানিক লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন) মতে আখের রসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৪৩। অর্থাৎ এটি নি¤œমাত্রার গ্লাইসেমিক খাবার। তাই ডায়াবেটিক রোগীরাও আখের রস নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় নির্ভয়ে খেতে পারেন। বিভিন্ন ফসলের গুড় ও চিনির পুষ্টিমান সারণি-১ দেয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রতিকূল এলাকায় যেখানে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করা যায় না কিংবা করেও তা লাভজনকভাবে ধরে রাখা যায় না সেখানেও পুষ্টিকর এসব মিষ্টি ফসল আবাদের মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
ক) খরাপীড়িত এলাকা
উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকায় আখ ফসল সবচেয়ে বেশি টিকে থাকতে পারে। শুধু তাই নয় যেখানে অন্য সব ফসল পানির অভাবে মারা যায় সেখানেও আখ ফসল বেঁচে থাকতে পারে এবং পানি পেলে তা আবার পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ওঠে। সেজন্যই উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকায় আখ চাষের ব্যাপকতা বেশি। শুধু আখই নয়, খরাপীড়িত এলাকার জন্যও আখের সঙ্গে সাথী ফসল চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আখের পাশাপাশি তাল, খেজুরেরও রয়েছে এই খরাসহিষ্ণু ক্ষমতা।
খ) চরাঞ্চলের বালুময় পতিত জমি
চরের বালিময় পতিত জমিতে আখ চাষ করে, আখের সাথে সাথী ফসল করে এবং গুড় তৈরি করে যথেষ্ট লাভ করার সুযোগ রয়েছে। এর কারণ আখের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত গভীরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া চরে অন্যান্য ফসল চাষ করে চাষিরা ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ বন্যায় তা ডুবিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অথচ আখ এমন একটি ফসল যা ১২ -১৫ ফুট লম্বা হয় এবং বন্যায় এর নিম্নাংশ ডুবে থাকলেও কোনো ক্ষতি হয় না। আবার চরে যেসব স্বল্পমেয়াদি ফসল হয় সেগুলো সাথী ফসল হিসেবে আখের সাথে চাষ করা যায়।
গ) দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকা
লবণাক্ততার কারণে যেখানে অন্য কোনো ফসল উৎপাদন করা যায় না সেখানেও আখ ফসল বেড়ে উঠতে পারে। একমাত্র আখ ফসল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতি মিটারে ১৫ ডিএস মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাই লবণাক্ত এলাকারও লাভজনক ফসল আখ। আখ ছাড়া সুগারবিটও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
ঘ) পাহাড়ি এলাকা
পাহাড়ি এলাকায় আখের বাজার দর অপেক্ষাকৃত বেশি। অল্প জমি ব্যবহার করে সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ ও সাথী ফসল চাষ করে এত বেশি আয় করা শুধু আখ চাষের মাধ্যমেই সম্ভব। একইভাবে পাহাড়ি এলাকায় গুড়ের দামও বেশি। তাই ওখানকার মানুষ গুড় করেও বেশি লাভ করতে পারেন। পাহাড়ি এলাকায় তাল ও খেজুর ফসল চাষের সম্ভাবনাও যথেষ্ট।
ঙ) পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা
হাওর এলাকার অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে অল্প কিছুদিন পরেই পানি নেমে যায়। এসব জায়গাগুলো নির্বাচন করে সেখানে জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু আখের জাত রোপণ করা যেতে পারে। যেমন ঈশ্বরদী ৩৭, ঈশ্বরদী ৩৪, ঈশ্বরদী ২০, ঈশ্বরদী ২১ প্রভৃতি। তাছাড়া হাওরে প্রতি বছর বজ্রপাতের কারণে অনেক সংখ্যক মানুষ মারা যায়। তাই এই এলাকায় অধিক তালগাছ রোপণের মাধ্যমে একদিকে যেমন তালের রস, গুড়, তালমিছরি প্রভৃতি বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় তেমনি এরই পাশাপাশি বজ্রপাত প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চ) দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকা
সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকা যেখানে প্রায় প্রতি বছরই মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়ে ক্ষেতের সব ফসল ল-ভ- করে দেয়, সেখানে আখ ফসল থাকলে তা ওই এলাকার জীবন রক্ষাকারী ফসলে পরিণত হয়। কারণ ঘূর্ণিঝড়ে ল-ভ- সবকিছুতে রান্না করার উপকরণও চলে যায়, ঘরের শুকনা খাবারও (যদি থাকে) শেষ হয়ে যায়, আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পানীয় জলের। ওই এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে চিবিয়ে খাওয়া আখ থাকলে ঝড়ে তা যত ক্ষতিগ্রস্তই হোক না কেন তা থেকে পানি ও পুষ্টি উভয়ই পাওয়া যেতে পারে। সংকটকালীন ওই সময়ে বাড়ির শিশুদের জন্য তা হয় জীবন রক্ষাকারী খাদ্য। সেকারণেই সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বাড়িতেই চিবিয়ে খাওয়া আখের আবাদ করতে হবে। এছাড়া সেখানে তাল গাছের প্রতিরক্ষা বেষ্টনীও গড়ে তোলা যেতে পারে।
অর্থাৎ সারা দেশেই পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য মিষ্টি ফসল চাষ করা প্রয়োজন। বরং উল্টা করে বলা যায় আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে যখন বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরিবর্তনসহিষ্ণু ফসল, সেখানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনসহিষ্ণু ফসল হচ্ছে আখ এবং অন্যান্য মিষ্টি ফসল। আখের রস যেমন পুষ্টিকর, আখের চাষও তেমনি লাভজনক। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে এলাকাভিত্তিক আখের জাত নির্বাচন করে তার ভালো বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি করা। মনে রাখতে হবে যে আখ চাষের উপকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি-জ্ঞান এবং উৎপাদিত কাঁচামালের বাজার সবই আমাদের দেশেই যথেষ্ট ভালো রয়েছে। তাই দেশের যেকোনো এলাকায় আখচাষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। আর এটা করতে পারলেই দেশের চিনি ও গুড় এর জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা এবং দারিদ্র্যবিমোচনেও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব।
ড. মো. আমজাদ হোসেন১ ড. সমজিৎ কুমার পাল২
১মহাপরিচালক, ২পরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ফোন : ০৭৩২৬৬৬৬২৮, ই-মেইল : bsridg123 @gmail.com
নিরাপদ খাদ্যকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন দেশ কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু, অণুজীব, রোগ ও পোকা ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করছে। বিধায় আমাদের গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, অপরিকল্পিতভাবে নানা গাছ গাছড়া দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। এতে করে বাড়িতে তেমন আলো বাতাস পড়ে না কোথাও কোথাও ফাঁকা পতিত পড়ে আছে যেখানটা সহজেই আবাদের আওতায় আনা যায়। এতে করে আমাদের বসতবাড়ির উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। এই অসুবিধা দূর করে বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানসমূহের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সহজেই উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বসতবাড়ির বিভিন্ন অব্যবহৃত স্থানসমূহের ব্যবহার পরিকল্পনায় পরিকল্পিতভাবে কোন স্থানে কী কী সবজি ও ফল আবাদ করা সম্ভব সেগুলো চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন।
বসতবাড়ির কোন স্থানে কোন সবজি ও ফল চাষ করা যায় তার বিবরণ
রৌদ্রজ্জ্বল স্থান/ খোলা জায়গা : বিভিন্ন প্রকার পাতা জাতীয় সবজি পুঁইশাক, লালশাক, পালংশাক, কলমিশাক, বাটিশাক, বেগুন, টমেটো ইত্যাদির বেড করে আবাদ করা সম্ভব।
ছায়াযুক্ত/অর্ধছায়াযুক্ত স্থান/ মাচার নিচে : আদা, হলুদ, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি।
স্যাঁতসেঁতে স্থান : বিভিন্ন প্রকার কচু।
মাচায়/পুকুর পাড়ে মাচায় : বিভিন্ন প্রকার কুমড়াজাতীয় সবজি, পুঁইশাক, শিম, বরবটি ইত্যাদি।
ঘরের চালে : চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, দেশি শিম, পুঁইশাক ইত্যাদি।
বেড়া/প্রাচীর : কুমড়া জাতীয় সবজি, পুঁইশাক, শিম, বরবটি ইত্যাদি।
ঘরের পীড়ায় : পেয়ারা, ডালিম, সজিনা, পেঁপে, বেগুন, বারোমাসি মরিচ, মানকচু, ফেনকচু, দুধকচু ইত্যাদি।
বাড়ির সীমানায় : সজিনা, পেঁপে ইত্যাদি।
গর্তে নিচু জায়গায় : পানিকচু, হেলেঞ্চা ইত্যাদি।
অফলা গাছে : মেটে আলু, মৌসুমি, ছুই, ধুন্ধল, গাছ আলু ইত্যাদি।
পতিত জায়গা : লেবু, কুল ইত্যাদি।
পুকুর পাড়ে : লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি।
এতে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি ও ফল পাওয়াসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। উত্তম কৃষি পদ্ধতি সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম যা অনুসরণে নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য, পরিবেশ সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং সমাজ সুসংহত হবে। য়
ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
উপপরিচালক(এল.আর.), ডিএই, মোবাইল : ০১৭১৬০০৪৪০০, ই-মেইল : Jagot_mala @yahoo.com
মানুষের সুষম খাদ্য চাহিদা পূরণে ডাল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। ডালে পর্যাপ্ত পরিমাণে হজমযোগ্য আমিষ থাকে অথচ মাংস অপেক্ষা দাম কম। তাই ডালকে গরিবের মাংস বলা হয়। শুধু মানুষের খাদ্যই নয় পশুর খাদ্য ও মাটির খাদ্য হিসেবে পরিবেশবান্ধব কৃষি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ডাল এদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। FAO এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন জনপ্রতি ৪৫ গ্রাম করে ডাল খাওয়ার কথা থাকলেও আমরা খাচ্ছি মাত্র ১২-১৩ গ্রাম করে। বর্তমানে ৭.০৭ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ৭.৬৯ লাখ মেট্রিক টন ডাল উৎপাদন হচ্ছে। ডালের ঘাটতি দূর করতে জমির পারিমাণ ও ফলন উভয়ই বাড়াতে হবে। মসুর বাংলাদেশের ডাল ফসলের মধ্যে অন্যতম প্রধান ডাল ফসল। প্রতিদিন খাবার টেবিলে মসুর ডালের উপস্থিতিই প্রমাণ করে এর জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা। কিন্তু বর্তমানে মসুর উৎপাদন নিম্নমুখী। এর কারণ আমন ধান কেটে জমি তৈরি করতে মসুর বপনের উপযুক্ত সময় (Optimum sowing time) চলে যায়, যার কারণে মসুর দেরিতে বপন করতে হয়। এতে মসুরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এছাড়া ফুল ধারণের সময়েই (Flowering stage) ব্যাপকভাবে স্টেম ফাইলিয়াম ব্লাইট রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। তাছাড়া ইদানীং চাষকৃত জমিতে ব্যাপকভাবে মসুরের গোড়া পচা (Foot rot) রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তাই চাষ করে মসুর আবাদের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ৩টি কারণে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না-
ক. উপযুক্ত সময়ের পরে বপন (Late planting) করার জন্য শারীরবৃত্তীয় কারণে ফলন কম হচ্ছে।
খ. গোড়া পচা (Foot rot) রোগের কারণে ব্যাপকভাবে গাছের সংখ্যা (Plant population) কমে যাচ্ছে।
গ. স্টেম ফাইলিয়াম ব্লাইট (Stemphylium Blight) দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
এসব সমস্যাগুলো থেকে মসুরকে রক্ষা করে কাঙ্খিত ফলন অর্জনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে পরিবর্তিত জলবায়ুতেও মসুর উৎপাদনের লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আর তা হল বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে (সাথী ফসল হিসেবে) মসুর চাষ। প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুরের আবাদ ও রিলে পদ্ধতিতে বিনা চাষে মসুরের আবাদের একটি গবেষণালব্ধ তুলনামূলক ফলাফল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
টেবিল-১ : প্রচলিত ও রিলে ফসল হিসেবে মসুরের ফলন ও ফলনে সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক ছক, আটঘড়িয়া, পাবনা, ২০১৬-১৭
ট্রিটমেন্ট |
গাছের উচ্চতা (সে.মি.) |
প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা |
প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা |
এক হাজার বীজের ওজন(গ্রাম) |
হেক্টর প্রতি ফলন (কেজি) |
হেক্টরপ্রতি খড়ের ফলন (কেজি) |
বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুর আবাদ | ৪৫.৫৫ | ৫৪.২৫ | ২.০০ | ১৮.৫৬ | ১৬১৩ | ১৩৮৮ |
প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুর আবাদ | ৩৯.৫০ | ৪৪.৭৫ | ১.৮৫ | ১৮.১১ | ১৩৬২ | ১২৬৮ |
উৎস : বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, গাজীপুর, ২০১৬-১৭
টেবিল-২ : মসুর উৎপাদনে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও বিনা চাষে রিলে পদ্ধতির খরচ ও লাভের তুলনামূলক হিসাব, আটঘড়িয়া, পাবনা, ২০১৬-১৭
ট্রিটমেন্ট |
প্রতি হেক্টরে বীজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ (টাকা) |
প্রতি হেক্টরে খড় থেকে প্রাপ্ত অর্থ (টাকা) | প্রতি হেক্টররে মোট প্রাপ্ত অর্থ (টাকা) | প্রতি হেক্টরে মোট খরচ (টাকা) |
প্রতি হেক্টরে লাভ (টাকা) |
বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুরআবাদ | ১,২০,৯৭৫.০০ | ১৩,৮৮০.০০ | ১,৩৪,৮৫৫.০০ | ২৮,০২০.০০ | ১,০৬,৮৩৫.০০ |
প্রচলিত চাষের মাধ্যমে মসুর আবাদ | ১,০২,১৫০.০০ | ১২,৬৮০.০০ | ১,১৪,৮৩০.০০ | ৩২,৫২০.০০ | ৮২,৩১০.০০ |
ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, মসুরের ফলনে সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্য ও ফলন প্রচলিত চাষের চেয়ে বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে বেশি এবং রিলে পদ্ধতিতে ফলন প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ বেশি। বিনিয়োগ ও লাভের হিসাবেও দেখা যাচ্ছে কম খরচ করে বেশি লাভ পাওয়া যাচ্ছে রিলে পদ্ধতিতে প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে এবং তা প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। তাই উল্লিখিত গবেষণার ফল থেকে দৃঢ়ভাবে বলা যায় প্রচলিত চাষ পদ্ধতির চেয়ে বিনা চাষে রিলে পদ্ধতিতে মসুর উৎপাদন একটি লাভজনক প্রযুক্তি যা বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে বাস্তবায়নের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিনা চাষে রিলে ফসল হিসেবে মসুর উৎপাদনের কলাকৌশল
এ পদ্ধতিতে আমন ধান কাটার ১০-১৫ দিন আগে (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ) জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই কাদার মধ্যে মসুর বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হয়। যদি জমিতে রসের অভাব থাকে তাহলে বীজ বপনের ১ দিন আগে একটি হালকা সেচ দিয়ে নিতে হবে। সাধারণত মাঝারি উঁচু জমির ক্ষেত্রে আমন ধানের শেষ সেচের পরই মসুরের বীজ বপন করা যেতে পারে। রিলে পদ্ধতিতে একটু বেশি বীজের প্রয়োজন হয় এবং তা হেক্টরপ্রতি ৪৫-৫০ কেজি। বপনের আগে বীজ মোটামুটি ৬-৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে (প্রাইমিং) রাখলে ভালো হয়। যদিও এ পদ্ধতিতে গোড়া পচা রোগের প্রাদুর্ভাব কম তারপরও বপনের আগে বীজ কেজি প্রতি ৩ গ্রাম হারে প্রোভ্যাক্স অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দ্বারা শোধন করে বপন করলে এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
সার ব্যবস্থাপনা পরিমাণ : ইউরিয়া ৪৫ কেজি/হেক্টর; টিএসপি ৯০ কেজি/হেক্টর; এমপি ৪৫ কেজি/হেক্টর। সমুদয় সার বীজ বপনের আগের দিন অথবা একই দিনে বীজ বপনের আগে প্রয়োগ করা যাবে।
আন্তঃপরিচর্যা এ পদ্ধতিতে মসুরের জমিতে সাধারণত আগাছা দমন ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে মাটিতে যদি রসের অভাব হয় এবং রসের অভাবে যদি গাছের বৃদ্ধি কম হয় সেক্ষেত্রে চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন পর একবার হালকা সেচ দিতে হয়। জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ মসুর জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। আগাছার প্রকোপ বেশি হলে বীজ গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর একবার আগাছা পরিষ্কার করতে হয়।
রোগ দমন মসুরের প্রধান রোগ হলো স্টেমফাইলিয়াম ব্লাইট যা Stemphylium প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত গাছের পাতায় ছত্রাকের সাদা জালিকা (মাইসেলিয়াম) দেখা যায়। দূর থেকে আক্রান্ত ফসল আগুনে ঝলসানো মনে হয়। আক্রমণের শেষ পর্যায়ে গাছ লালচে বাদামি রঙ ধারণ করে। বীজ, বিকল্প পোষক, বায়ু প্রভৃতির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। রিলে পদ্ধতি যেহেতু সঠিক সময়ে মসুর বপন করা হয় সেহেতু সাধারণত দানা গঠন পর্যায়ে এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে ফুল আসা শুরু করলেই (Flowering stage) রোভরাল-৫০ ডব্লিউপি নামক ছত্রাকনাশক ১০ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে ফসলকে রক্ষা করা যায় এবং ফলনের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না।
ফলন এ পদ্ধতিতে মসুরের ফলন হেক্টরপ্রতি ১৫০০-২০০০ কেজি।
বাজারদর : বীজ- প্রতি কেজি ৭৫ টাকা, খড়- প্রতি কেজি ১০ টাকা।
ড. মো. জাহেরুল ইসলাম* ড. মো. রবিউল আলম**
*সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাবনা # ০১৭১৫-৫২৪১২৬
মৌ চাষের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
মো: খায়রুল আলম
আমাদের দেশে মধু চাষের অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে সুজলা সুফলা ষড়ঋতুর বাংলাদেশ, যার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে ফসলের মাঠ, বৃক্ষরাজি, সবজি ও ফলবাগান। এখানে প্রায় প্রত্যেক Ĺতুতেই কোন না কোন ফুল ফোটে। এসব জায়গা থেকে মৌমাছি প্রায় সারা বছরই মধু আহরণ করতে পারে। বর্তমানে প্রায় ২৫০০ জন মৌচাষি বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন করছে এবং বছরে প্রায় ৬ হাজার মে.টন মধু উৎপাদিত হচ্ছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে মধুর উৎপাদন এক লক্ষ টনে উন্নীত করা সম্ভব। আর মৌমাছি দ্বারা পরাগায়নের ফলে পরপরাগায়িত ফসলের গড় উৎপাদন ২০-৩০ ভাগ বেড়ে যাবে।
মৌমাছি চাষের ইতিহাস
প্রাচীন কাল থেকে মৌমাছি চাষ করা হলেও ১৮৫৩ সালে বিজ্ঞানী ল্যাং স্ট্রোথ আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন এবং তাকেই আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়। ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম একজন ইংরেজ ডকলাস উপমহাদেশে মৌচাষের প্রবর্তন করেন। পরে ড. আক্তার হামিদ খান ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা করেন। বাংলাদেশে ১৯৬৩ সালে বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন) প্রথমবার মানুষকে মৌ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে এবং এরপর থেকে বিভিন্ন সংস্থা মৌমাছি পালন বিষয়ে মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া, মৌবাক্স বিতরণ করা ইত্যাদি কাজ চালিয়ে যায়। বিসিকের প্রচেষ্টার সাথে পরবর্তীতে ৮০’র দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সম্পৃক্ত হয় এবং এর মাধ্যমে বর্তমানে মৌপালন সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
মধুর উপকারিতা
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেন ‘সকল পানীয় উপাদানের মধ্যে মধু সর্বোৎকৃষ্ট।’ এ কথা দ্বারা স্পষ্ট যে মধু নিঃসন্দেহে উপকারী। পরবর্তীতে বিজ্ঞানের গবেষণা দ্বারা মধুতে উপস্থিত উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা যায়। মধুর প্রধান উপকরণ হলো সুগার, যার মধ্যে ডেক্সট্রোজ, ম্যালটোজ, গ্লুকোজ, লেভিউলোজ এবং সুক্রোজ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম মধুতে ২৮০-৩০৪ গ্রাম ক্যালরি পাওয়া যায়। মধুতে নিয়সিন, রাইবোফ্লাভিন, ভিটামিন বি, এমাইনো এসিড, প্যান্টোথেনিক রয়েছে, এ ছাড়াও ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফরফরাস, পটাশিয়াম, দস্তা, তামা ইত্যাদি খনিজে ভরপুর মধু। মধুতে কোন ফ্যাট বা কোলেস্টেরল থাকে না। মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান যা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন জীবাণু আক্রমণ রোধ করে কিংবা প্রতিকার করতে পারে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
বাংলাদেশে মৌচাষের বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
বর্তমানে দেশে দুই হাজার ৫০০ বাণিজ্যিক বা পেশাদার মৌ খামার রয়েছে। অপেশাদার বা সৌখিনভাবে মৌ পালন করছে আরো ২৫ হাজার। তার মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি মৌ বাক্স রয়েছে। গত বছর ১০ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হয়েছে। এ বছর এখন সরিষার মাঠ থেকে মধু আহরণ করা হচ্ছে। তবে এ বছর ১২ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মৌ চাষের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি চাষিদের উৎপাদিত মধু বাজারজাতকরণে সহায়তা করে যাচ্ছে বিসিক। বাংলাদেশে উৎপদিত ৫০০ মেট্রিক টন মধু জাপান, ভারত ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। চাষিরা এখন রপ্তানির জন্য বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষে ঝুঁকছেন। দেশের মৌ খামারগুলো থেকে এক লাখ টন মধু আহরণের সুযোগ রয়েছে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। মধুর উৎপাদন বৃদ্ধি, মৌচাষিদের প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় উন্নয়নে যৌথভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও কাজ করছে বিসিক।
জানা গেছে, বিসিক বাণিজ্যিকভাবে এখন পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি মৌ চাষিকে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই কার্যক্রম প্রসারে মৌমাছি পালন স্থায়ী ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে বিসিক। ক্রমাগতভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন মৌচাষি তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৌচাষ উপযোগী আরও ১২টি জেলায় বিশেষ খামার সৃষ্টি করে মধু উৎপাদনে কাজ করছে সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষকপর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ-৩য় পর্যায় (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের একটি উদ্দেশ্য হলো যথাযথ পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মৌচাষ। ফসলের পরাগায়ন কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য আগ্রহী বীজ এসএমইকে মোট ২০০০টি উন্নতমানের মৌবাক্স, মধু এক্সট্রাক্টর, এক্সেসরিজ এবং মৌ-কলোনি সরবরাহ করা হয়েছে। এ সব বক্স থেকে প্রতি বছর ৪০ মে. টন করে অর্থাৎ প্রকল্পাধীন সময়ে প্রায় ১৬০ মে. টন উৎকৃষ্ট মানের মধু উৎপাদিত হবে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ মে.টন মধু উৎপন্ন হয়েছে। প্রকল্পাধীন সময়ে প্রায় ১৬০ মে. টন উৎকৃষ্ট মানের মধু উৎপাদিত হবে যার মূল্যমান প্রায় ২.৫০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৯০০ জন কর্মকর্তার ডাল, তেল ও মসলা ফসলের উৎপাদন প্রযুক্তি ও মৌপালনের উপর ৬ দিনব্যাপী টিওটি কোর্স সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ ছাড়াও ৬০ জন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মৌচাষের ওপর ৩ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেছেন, যারা বর্তমানে মাঠপর্যায়ে মৌচাষে মৌ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে কৃষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ মৌ-পালন বিষয়ে সম্পৃক্ত রয়েছেন। প্রকল্পের আওতায় এসএমইগণকে মৌ বক্স সরবরাহের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মধু উৎপাদন এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ পরপরাগী ফসলের পরাগায়ন নিশ্চিত হচ্ছে। প্রকল্পে মৌচাষ সম্পৃক্ত হওয়ায় অতিরিক্ত ১৫-৩০% ফলন বৃদ্ধিসহ মধু উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে কৃষকগণ উৎসাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মধু একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী খাত। দেশে বর্তমানে দুই প্রজাতির মৌমাছির দ্বারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-বাক্সে চাষ করা হয়। মৌ চাষ বিশেষজ্ঞ ও কৃষি গবেষকদের মতে ফসলের মাঠে মৌমাছি বিচরণ করলে সেখানে বাড়তি পরাগায়নের কারণে ফসলের উৎপাদন ৩০ শতাংশ বাড়বে। তার মানে মৌচাষের মাধ্যমে মধু আহরণে লাভ দুটি-১) অর্থকরি খাত হিসেবে মধু আহরণে সমৃদ্ধি, ২) শস্য বা মধুভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি। অথচ অধিকাংশ কৃষকের এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চাষিপর্যায়ে এ ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মৌচাষিরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌসুমে মৌসুমে সরিষা, ধনিয়া, তিল কালজিরা, লিচু এসব ফসলের জমিতে বা বাগানে মৌ বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে। আধুনিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে মৌ চাষ করে শত শত মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করা হচ্ছে। এর ফলে মধু আহরিত শস্য যেমন সরিষা, তিল, কালিজিরা, লিচু ইত্যাদির ফলনও বেড়েছে অনেকগুণ। মৌচাষিরা বিভিন্ন ঋতুতে তাদের মৌবাক্স নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সাভার, দিনাজপুর, রাজশাহী বরগুনা ও সুন্দরবনের সাতক্ষীরায় মধু সংগ্রহে চলে যান। একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে তারা অবস্থান করেন এবং মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসেন। সংগ্রহকারীর কেউ কেউ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মধু বিক্রি করেন। বড় খামারিরা সংগ্রহীত মধু প্রসেসিং প্লান্টে পরিশোধন করে বাজারজাত করেন। সরিষা, লিচু, তিল ও কালিজিরা ফুল থেকে সংগৃহীত মধু আলাদা আলাদাভাবে বাজারজাত করছেন ব্যবসায়ীরা।
২০১৯-২০ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মধু উৎপাদনে শীর্ষ দেশ চীন। এশিয়ার মাঝে ভিয়েতনাম এবং ভারতের মধু রপ্তানিতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য স্থান। দেশের বাজারে মধু সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন ভারত, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত ইত্যাদি দেশে মধু রপ্তানিতে বংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম এবং আমদানিতে ৬৬তম।
দেখা গেছে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ জমিতে সরিষা, লিচু আম তিল ইত্যাদি ফসলের চাষ হয় তার মাত্র ১০ ভাগ জমিতে মৌ চাষ হয়। তাই বলা যায় যে, মধু চাষে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। শতভাগ জমি যদি মৌ চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন যেভাবে বাড়বে, মধু উৎপাদনও অনুরূপভাবে বাড়বে।
বংলাদেশে মৌ খামার গড়ে তোলার যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। এপিস সেরানা এ দেশীয় প্রজাতি এবং সহজে লালন-পালন যোগ্য। তাছাড়া এর উৎপাদন ক্ষমতাও মোটামুটি ভালো। ইউরোপীয় গোষ্ঠীর এপিস মেলিফেরা প্রজাতিও আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সহনশীল হয়েছে এবং দেশে এ প্রজাতির খামার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন, মধুপুর বনাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় মৌমাছির খামর গড়ে তোলার অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান। অধিকন্তু আমাদের দেশে আবহাওয়া এবং সারা বছর মাঠে সুবিধা সমৃদ্ধ ফসলের সমারোহ থাকে। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বিশেষত বেদে এবং পাহাড়ে বসবাসকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে মৌ খামার গড়ে তুলতে আগ্রহী করা যেতে পারে।
বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি চাষের মাধ্যমে আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এবং মৌ কলোনি ফসলের পরাগায়নে ব্যবহার করে ফসলের অধিক ফলনপ্রাপ্তি সম্ভব। মৌ কলোনির উপজাত মানুষের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। তাছাড়া ওষুধ ও নানা শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার এবং বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের যথেষ্ট সম্ভাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের মৌ খামার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করছে। দেশে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে মৌ খামার ব্যাপকতা লাভ করলে দেশে গুণগত মানের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে এবং সেই সঙ্গে মৌ কলোনির উপজাত এবং সেসব থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ, উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প-৩য় পর্যায় (১ম সংশোধিত), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা। ফোন : ৫৫০২৮২১৬, ই-মেইল : ঢ়ফঢ়ড়ংঢ়৩ৎফ@মসধরষ.পড়স
বাংলাদেশে তিন মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়- আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৯-১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে আউশ ধানের উৎপাদন করা হয়। যেহেতু আউশ ধানের আবাদ বৃষ্টি নির্ভর, সেহেতু এ ধান উৎপাদনের সেচ খরচ সাশ্রয় হয়। তাছাড়া উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান চাষ করলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় আউশ ধানের চাষাবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রদান করছে। এতে অধিক সংখ্যক কৃষক আউশ ধান চাষে উৎসাহী হবেন বলে আশা করা যায়।
মৌসুম ও জাত
আউশ ধানের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১৫-৩০ চৈত্র (৩০মার্চ-১৫ এপ্রিল)। রোপা আউশের উফশী জাত হিসেবে বিআর২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৮২ ও ব্রি ধান৮৫ এবং বোনা আউশের উফশী জাত হিসেবে বিআর২০, বিআর২১, বিআর২৪, ব্রি ধান৪২, ব্রি ধান৪৩, ব্রি ধান৮৩ আবাদ করা যায়।
বীজতলা
দোঁ-আশ ও এঁটেল মাটি বীজতলার জন্য ভালো। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। যদি অনুর্বর হয় তাহলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে ১.০০-১.৫ কেজি হারে জৈবসার ছড়িয়ে দিতে হবে এর পর ৫-৬ সেমি. পানি দিয়ে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে এবং পানি ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে। আগাছা, খড় পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দুই বেডের মাঝখানে ৪০-৫০ সেমি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার বেডে ৮০-১০০ গ্রাম অঙ্কুরিত বীজ সমানভাবে বুনে দিতে হবে। জাতভেদে বীজের হার ৪০-৫০ কেজি/হেক্টর।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি চাষ ও মই দিতে হবে, যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। জমি উঁচু-নিচু থাকলে সমান করে দিতে হবে। অধিক ফলন পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জৈবসারসহ সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ করুন। রোপা আউশে হেক্টরপ্রতি ১৩০ কেজি ইউরিয়া, ৫৫ কেজি টিএসপি, ৬ কেজি এমওপি এবং বোনা আউশে ১২০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৫৫ কেজি এমওপি সার ব্যবহার করুন। টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করা হলে টিএসপি সারের সমপরিমাণ ডিএপি সার ব্যবহার করে প্রতি কেজি ডিএপি সার ব্যবহারের জন্য ৪০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া কম ব্যবহার করতে হবে। মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সার ব্যবহার করা উত্তম। ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে (প্রথম কিস্তি জমি শেষ চাষের সময়, দ্বিতীয় কিস্তি চারা রোপণের ১৫ দিন পর, তৃতীয় কিস্তি কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে) এবং অন্যান্য সার জমি শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়ার পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে ফলন বাড়ে এবং সারের কার্যকারিতা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। গুটি ইউরিয়া প্রতি চার গোছার মাঝখানে একটি করে প্রয়োগ করতে হয়। আউশ ধানের ১.৮ গ্রাম ওজনের গুটি ব্যবহার করুন। গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে আউশ মৌসুমে প্রতি হেক্টরে ৬৫ কেজি ইউরিয়া সাশ্রয় হয়।
চারা রোপণ
সাধারণভাবে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকলেই চলে। ১ হেক্টর জমিতে ৮-১০ কেজি বীজের চারা লাগে। সারিতে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. হবে।
পরিচর্যা
আউশের জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে প্রয়োজনে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করে ২-৩টি নিড়ানি দিতে হবে। অনুমোদিত আগাছানাশক ব্যবহার করেও আগাছা দমন করা যায়। জমিতে রসের অভাব হলে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা নিতে হবে। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০-১২ দিন ছিপছিপে পানি রাখতে হবে, যাতে নতুন শিকড় গজাতে পারে, এর পর কম পানি রাখলেও চলবে। সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।
পোকামাকড় ও রোগবালাই
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনের জন্য নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে রোপা আউশের জমিতে ৮-১০ ফুট দূরে দূরে ধৈঞ্চার চারা রোপণ করতে হবে অথবা কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি/গাছের ডাল পুঁতে দিতে হবে। বাদামি গাছফড়িং দমনে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। ধানের নিবিড় চাষাবাদের কারণে ফসলের পেকার প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। এসব পোকার মধ্যে রয়েছে- মাজরা পোকা, পামরি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধী পোকা, লেদা পোকা, চুঙ্গি পোকা, ঘাসফড়িং, ছাত্রা পোকা, থ্রিপস্ ইত্যাদি। দশটি প্রধান রোগ ধানের ক্ষতি করে। এগুলো হচ্ছেÑ টুংরো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া, উফরা, ব্লাস্ট, খোলপোড়া, বাকানি, বাদামি রোগ ইত্যাদি। এসব পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনে সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ধানের ফলন বৃদ্ধি হবে এবং প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি বিভাগে যোগাযোগ করতে হবে।
ফসল কর্তন
শতকরা আশি ভাগ ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। কাটা ধান স্তূপ না করে দ্রুত মাড়াইয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। খাবার ধান যথাসম্ভব শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ ধান ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে ১২% আর্দ্রতায় বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আউশ ধান কাটার উপযুক্ত সময় ১৫ শ্রাবণ-২০ ভাদ্র (৩০জুলাই- ৪ সেপ্টেম্বর)।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভালো ফলন পেতে হলে ভালো বীজের প্রয়োজন। এজন্য যে জমির ধান ভালোভাবে পেকেছে, রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সেসব জমির ধান বীজ হিসেবে রাখা। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় (ড়ভভ-ঃুঢ়ব) গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। যেসব গাছের আকার-আকৃতি, শিষের ধরন, ধানের আকার-আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং ধান পাকার সময় জমির আিধকাংশ গাছ থেকে একটু আলাদা সেগুলোই বিজাতীয় গাছ। সব রোগাক্রান্ত গাছও অপসারণ করতে হবে। এরপর ফসল কেটে মাঠে শুকনো স্থানে রাখতে হবে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই করে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে। বীজ ধান মজুদের সময় যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো হলো-
* রোদে ৫-৬ দিন ভালোভাবে শুকানো যাতে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে। দাঁত দিয়ে বীজ কাটলে যদি কটকট শব্দ হয় তাহলে বুঝতে হবে বীজ ঠিকমতো শুকিয়েছে। পুষ্ট ধান বাছাই করতে কুলা দিয়ে কমপক্ষে দুইবার ঝেড়ে নেওয়া যেতে পারে।
* বায়ুরোধী পাত্রে বীজ রাখতে হবে। বীজ রাখার জন্য প্লাস্টিকের ড্রাম উত্তম তবে বায়ুরোধী মাটি বা টিনের পাত্রে রাখা যায়। মাটি মটকা বা কলসে বীজ রাখলে গায়ে দুইবার আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে শুকানো। আর্দ্রতা রোধক মোটা পলিথিনেরও বীজ মজুদ করা যেতে পারে।
* রোদে শুকানো বীজ ঠা-া করে পাত্রে ভরা। পুরো পাত্রটি বীজ দিয়ে ভরে রাখা। যদি বীজে পাত্র না ভরে তাহলে বীজের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর শুকনো বালি দিয়ে পাত্র পরিপূর্ণ করা।
* পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন বাতাস ঢুকতে না পারে। এবার এমন জায়গায় রাখা যেন পাত্রের তলা মাটির সংস্পর্শে না আসে।
* টনপ্রতি ধানে ৩.২৫ কেজি নিম, নিশিন্দা বা বিষকাালি পাতার গুঁড়া মিশিয়ে গোলাজাত করলে পোকার আক্রমণ হয় না। বীজের ক্ষেত্রে ন্যাপথলিন বল ব্যবহার করা যায় তবে অবশ্যই বীজ ধান প্লাস্টিক ড্রামে সংরক্ষণ করতে হবে।
মাহমুদ হোসেন
সাবেক মহাব্যবস্থাপক (অব.) বিএডিসি; মোবাইল : ০১৮৩৭৩৫৩৯৭০ ই-মেইল : mahmood1945bd@gmail.com
মো. শরিফুল ইসলাম
গ্রাম-পানচুর
উপজেলা-লোহাগড়া
জেলা-নড়াইল
প্রশ্ন : আদা গাছের গোড়া পচে যাচ্ছে, কী করব?
উত্তর : আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা নষ্ট করে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে কন্দ সংগ্রহ করতে হবে। কাঁচা গোবর পানিতে গুলে কন্দ শোধন করে ছায়ায় শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম কম্প্যানিয়ন বা নোইন বা রিডোমিল গল্ড বা ডাইথেন এম-৪৫ বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ১% বর্দোমিশ্রণ মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
দীপঙ্কর সরকার
গ্রাম-লতাখামার
উপজেলা-দৌলতপুর
জেলা-খুলনা
প্রশ্ন : করলা গাছের পাতা গুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে এবং গাছ বাড়ছে না, কী করব?
উত্তর : আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে নষ্ট বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। ক্ষেতের আশপাশের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। বাহক পোকা ধ্বংস করার জন্য বালাইনাশক যেমন- এসাটাফ, টিডো, এডমায়ার প্রয়োগ করতে হবে। টেট্টাসাইক্লিন বা লেডার মাইসিন (৫০০ পিপিএম বা ০.৫ গ্রাম/ লিটার পানি) ছিটিয়ে রোগ দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সফিকুল ইসলাম
জেলা-পঞ্চগড়
উপজেলা-দেবীগঞ্জ
গ্রাম-শালডাঙ্গা
প্রশ্ন : মাছ চাষ পানির পিএইচ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?
উত্তর : পুকুর বা খামার তৈরির সময় কেজি/প্রতি শতকে ১ কেজি হারে চুন ৩-৫ ফুট পানির গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। মজুদ পরবর্তীতে প্রতি শতকে ২৫০-৫০০ গ্রাম/প্রতি শতকে হারে প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ পরীক্ষা করে যদি ৬ এর নিচে থাকে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
চুনের পরিবর্তে জিওটক্স/জিওলাইট শতাংশে ২৫০ গ্রাম/ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এছাড়াও বায়োকেয়ার প্রতি ৭ দিন অন্তর ৮০-১২০ মিলি./প্রতি শতকে হারে দিতে হবে প্রতিষেধক হিসেবে। আর নিরাময়ের জন্য পর পর ২ দিন ১২০-১৬০ মিলি./প্রতি শতকে হারে প্রয়োগ করতে হবে।
আবদুর রহিম
জেলা-চাঁদপুর
উপজেলা-ফরিদগঞ্জ
গ্রাম-কড়ইতলী
প্রশ্ন : পুকুরের পানি ঘোলা হলে কী কী করণীয়?
উত্তর : পোড়া চুন ১-২ কেজি/প্রতি শতকে বা জিপসাম ১.৫-২ কেজি/ শতক হারে প্রয়োগ করতে হবে। ফিটকিরি ২৪০-২৪৫ গ্রাম/ প্রতি শতকে ৩০ সেমি. গভীরতায় প্রয়োগ করতে হবে। পানি পরিবর্তন করা বা খাদ্য কমিয়ে দিতে হবে। পুকুর তৈরির সময় জৈবসার বেশি ব্যবহার করতে হবে। পানি পরিবর্তন বা নতুন পানি সংযোগ করতে হবে।
আবদুল রফিক
গ্রাম-পূর্ব তিমিরপুর
উপজেলা-নবীগঞ্জ
জেলা-হবিগঞ্জ
প্রশ্ন : পটোল গাছের কা- থেকে আঠা ঝরছে, এবং বাকল ফেটে কষ পড়ছে। কী করণীয়?
উত্তর : এটি পটোলের ছত্রাকজনিত রোগ এজন্য-
- আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করতে হবে।
- আক্রান্ত কাণ্ডে বর্দোমিশ্রণ (১%) বা কুপ্রাভিট (০.৪%) স্প্রে করতে হবে;
- রোগমুক্ত গাছ থেকে কাটিং সংগ্রহ করতে হবে।
কানাইলাল বিশ্বাস
গ্রাম-করগাদি
উপজেলা-মধুখালি
জেলা-ফরিদপুর
প্রশ্ন : ধানের গুদামে ইঁদুরের আক্রমণে ধানের ক্ষতি হচ্ছে। ইঁদুর দমনে কী করণীয়?
উত্তর :
- ঘরবাড়ি, গুদাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা;
- সম্ভব হলে শস্য টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা;
- ড্রাম বা গোলা মাচার ওপর সংরক্ষণ করা;
- বিভিন্ন প্রকার ফাঁদ ব্যবহার করা;
- গ্লুবোর্ড (আঠা বোর্ড) ব্যবহার করা;
- তীব্র বিষ হিসেবে জিংক ফসফাইড (২%) বিষটোপ হিসেবে ব্যবহার করা।
মমতাজ বেগম
গ্রাম-শালগাড়িয়া
উপজেলা-পাবনা সদর
জেলা-পাবনা
প্রশ্ন : আম গাছের বয়স ২/৩ বছর। হঠাৎ করে চারা গাছের আগা শুকিয়ে আসছে। কী করলে উপকার পাবো।
উত্তর : এ রোগটি আম গাছের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক ও অধিকাংশ জাতে কমবেশি দেখা যায়। গাছের যে কোনো বয়সে এ রোগটি হতে পারে। আক্রান্ত গাছের আগা মরে যায় যাকে ডাইব্যাক বলে। কচি পাতা শাখা-প্রশাখা, কা-, মুকুল ও ফল আক্রান্ত হয়।
রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত পাতা দেখলেই ব্যাভিস্টিন বা নোইন ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
লিটন রায়
গ্রাম-বেলাই
উপজেলা-দিনাজপুর সদর
জেলা-দিনাজপুর
প্রশ্ন : পেঁপে গাছের ফল পচে ঝরে যাচ্ছে। করণীয় কী?
উত্তর : এটা পেঁপের ফল পচা বা পেঁপের অ্যানথ্রাক্সনোজ রোগ। পাতা, বোঁটা, ফলে বাদামি দাগ দেখা যায়। পাকা ফলে কালো দাগ হয়। আক্রান্ত অংশগুলো সংগ্রহ করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা পুড়ে ফেলতে হবে। গাছে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম কার্বেনন্ডাজিম (ব্যাভিস্টিন বা নোইন) জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ১০-১২ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে। ফল সংগ্রহের অন্তত ২০ দিন আগে স্প্রে বন্ধ করতে হবে।
সুমন
গ্রাম-নকীপুর
উপজেলা-শ্যামনগর
জেলা-সাতক্ষীরা
প্রশ্ন : গরুকে পাগলা কুকুর কামড় দিয়েছে। কী করব?
উত্তর : কামড়ানো জায়গা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। রেবিসিন ১০ সিসি ১০০ কেজি ওজনের জন্য ১ম দিন ৪ সিসি, ৭ম দিন ৩ সিসি এবং ২১তম দিন ৩ সিসি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে।
আরিফ
গ্রাম-লেবুখালী
উপজেলা-দুমকী
জেলা-পটুয়াখালী
প্রশ্ন : আর্থ্রাইটিস/ গিরা ফোলা রোগে কী করব?
উত্তর : এ রোগের আক্রমণে : পায়ের গিরা ফুলে যায়, পানি জমে থাকে, ব্যথা হয়, খুঁড়িয়ে হাঁটে।
- অ্যাসিটাইল স্যালিসাইলিক এসিড প্রতিবার ১ গ্রাম করে দিনে ২-৩ বার খাওয়ানো যেতে পারে।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম, নিয়মিত হালকা ব্যায়াম, পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য এবং ওষুধ প্রয়োগ করে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়।
- ডিসপিরিন ট্যাবলেট ০.৩ গ্রাম হিসেবে দিনে ৩ বার খাওয়ার পর দেয়া যেতে পারে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মারুফ*
*সহকারী তথ্য অফিসার (শস্য উৎপাদন), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫ ধরড়পঢ়@ধরং.মড়া.নফ
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন
সৈয়দ মুনিরুল হক
করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলছে অস্থিরতা। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে আগামীতে খাদ্য সংকট হতে পারে। আমাদের মাননীয় কৃষি মন্ত্রী মহোদয় করোনা পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নিরন্তন কাজ করছেন। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে আবাদের কাজে লাগানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিকনির্দেশনা রয়েছে। সরকারি নির্দেশনা মেনে পতিত জমিতে কৃষি সম্প্রসারণের কার্যকরি উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে দানাদার খাদ্যশস্যের পাশাপাশি শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে দেশে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য রপ্তানির এক বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও সেই সুযোগ আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের দেশে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে এখনো অর্গানিক ফার্মিং/ ঈড়হঃৎধপঃ ফার্মিং এর ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ঈড়হঃৎধপঃ ঋধৎসরহম ছাড়া কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত তাতে কী কী ইনপুট (সার, কীটনাশক ইত্যাদি) কী মাত্রায়, কখন প্রয়োগ করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় না। তাছাড়া মাটি পরীক্ষা করা হয়না বিধায় কোন গরপৎড়/গধপৎড় বষবসবহঃ এর ঘাটতি রয়েছে কিনা তারও সঠিক তথ্য নেই । ফলে গজখ (গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ) মাত্রা না জানার জন্য উন্নত বিশ্বে আমাদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কীটনাশক মানেই বিষ। কৃষকের কাছে কীটনাশক মানেই আক্রান্ত পোকামাকড় মেরে অধিক ফসল পাওয়ার এক ওষুধ। তাই তারা ক্ষেতে পোকামাকড় দেখা মাত্রই কীটনাশক প্রয়োগ করে। অনেক সময় সবজি উত্তোলনের দিনও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় । কীটনাশক অবশিষ্টাংশ (জবংরফঁব) বিষক্রিয়ায় আমাদের দেহে নানা জটিল ও দুরারোগ্য রোগ সৃষ্টি হয়। অসতর্কভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ধ্বংস হচ্ছে অ্যাকোয়াটিক ইকোসিস্টেম। মাছেও এখন কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। উন্নত বিশ্ব অনেক আগে থেকেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ফলে তারা কৃষি ক্ষেত্রে ঙৎমধহরপ ফার্মিং এর ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে । আশার কথা হলো কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে সরকার সম্প্রতি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের দরুন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর কাজ নিবিড় তত্ত¡াবধানে পরিচালিত হবে। ফলে কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া জবপড়ৎফ শববঢ়রহম করা সম্ভব হবে।
উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য রপ্তানিতে চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব জঁষবং ২০১১ ্ চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব ঙৎফরহধহপব ২০১৮ সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাও অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় আমরা যে দেশে কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানি করব সেই দেশের চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। তাছাড়া ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃধহফধৎফ ড়ভ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং (ওঝচগ) এঁরফবষরহব মেনে যে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞৎধফব পরিচালিত হয় সেই বিষয়ে রপ্তানিকারকরাও অধিকাংশ অজ্ঞ। চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ ঈড়সঢ়ষু না করতে পারায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন রাশিয়ায় আলু রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে যা আজও চালু করা যায়নি। সম্প্রতি ফিজির একদল বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে সফর করে আলুর প্রতি আগ্রহ দেখালেও তাদের চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ পূরণ করতে না পারায় আলু রপ্তানির সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
এজন্য উৎপাদিত কৃষি পণ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়া পরীক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন । কীটনাশক অবশিষ্টাংশ সম্পর্কে ঋঅঙ/ডঐঙ এর যৌথ বাস্তবায়নে ঈড়ফবী অষরসবহঃধৎরঁং ঈড়সসরংংরড়হ এর নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে । বাংলাদেশ যেহেতু এর স্বাক্ষর দাতা একটি দেশ কাজেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রবেশ করতে হলে চবংঃরপরফব জবংরফঁব খবাবষ সম্পর্কে গবেষণা করা দরকার। রপ্তানির পাশাপাশি আমদানি পণ্যেও চবংঃরপরফব জবংরফঁব অহধষুংরং করা দরকার । বর্তমানে নিরাপদ খাদ্য প্রবিধানমালা, ২০১৭ অনুযায়ী গজখ এর সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা (ঢ়ঢ়স) নির্ধারণ করা আছে।
যেসব কৃষিজাত পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করা হয় তার মাধ্যমে রোগজীবাণু ও পোকামাকড় যা আমাদের দেশে নেই বা থাকলেও ঙভভরপরধষষু ঈড়হঃৎড়ষষবফ অবস্থায় আছে সেসব জীবাণু ও পোকামাকড় আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে ফসলের জন্য যেন মারাত্মক ক্ষতির/ধ্বংসের কারণ হতে না পারে তা প্রতিরোধ করাই হচ্ছে প্লান্ট কোয়ারেন্টিন। এই জন্য চবংঃ জরংশ অহধষুংরং (চজঅ) করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঝঃধহফধৎফং ড়ভ চযুঃড়ংধহরঃধৎু গবধংঁৎবং (ওঝচগ) এর অধিকাংশ গাইডলাইনই চজঅ সংক্রান্ত যা অনুসরণ করে এই ব্যাপারে সারা বছর গবেষণা কার্যক্রম চালু রাখা দরকার। বাংলাদেশে অল্প কয়েকটি ফসলের চজঅ কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে এই কাজের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কারণ আমদানির জন্য আমদানি অনুমতিপত্রে (ওচ) পরিবর্তিত বাস্তব অবস্থার উপর রোগজীবাণু ও পোকামাকড় সংক্রমণের ফসলভিত্তিক সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমদানি অনুমতিপত্রে অতিরিক্ত শর্তাবলীতে সংযোজন বিয়োজন করাটা অত্যন্ত জরুরি।
বিদেশে পণ্যে রপ্তানির জন্য পণ্যের ক্যাটাগরি এবং দেশ ওয়ারি টার্গেট ঠিক করে রপ্তানির জন্য সেই রপ্তানিকারী দেশের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ প্রতিপালন করা সম্ভব হলেই কেবল সেই পণ্যে রপ্তানির সুযোগ থাকবে। অপরদিকে যেসব পণ্যের রপ্তানিকারী দেশের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ বর্তমানে বাস্তব সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিপালন করা যাচ্ছে না সেগুলোর ব্যাপারে অতি দ্রæত রপ্তানি বৃদ্ধির স্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সেই লক্ষ্যে দ্রæত অন্তত পক্ষে একটি হলেও অপপৎবফরধঃবফ খধনড়ৎধঃড়ৎু স্থাপন অপরিহার্য। অপপৎবফরধঃবফ খধনড়ৎধঃড়ৎু স্থাপনের জন্য ল্যাবরেটরি সংশ্লিষ্ট জনবলের সুস্পষ্ট কার্যপরিধি ও প্রয়োজনীয় অর্গানোগ্রাম নির্ধারণ করাও দরকার। এই ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোয়ারেন্টিন অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দর ও হজরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যে রপ্তানির নিমিত্তে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত একটি প্যাকিং হাউজ নির্মাণ করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে পণ্যের দ্রæত ওহংঢ়বপঃরড়হ ও পরীক্ষা করে গ্রেডিং, সর্টিং, প্যাকেজিং এর মাধ্যমে চযুঃড়ংধহরঃধৎু জবয়ঁরৎসবহঃ পূরণ সাপেক্ষে রপ্তানি কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
বিজ্ঞান এবং তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাভারস্থ পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ‘‘কীটনাশক সংক্রান্ত গবেষণা ও পরিবেশের অবশিষ্টাংশ পরিবীক্ষণ ” শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শাকসবজি সংগ্রহ করে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের বিষক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য গধীরসঁস জবংরফঁব খরসরঃ(গজখ) বা অপপবঢ়ঃধনষব উধরষু ওহঃধশব (অউও) মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমান বাস্তবতায় গজখ নির্ণয়ের জন্য সহায়ক ল্যাবরেটরি হিসাবে পরমাণু শক্তি কমিশনের ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঋড়ড়ফ জধফরধঃরড়হ ্ ইরড়ষড়মু(ওঋজই) এর ল্যাব অথবা ইধহমষধফবংয অমৎরপঁষঃঁৎধষ জবংবধৎপয ওহংঃরঃঁঃব(ইঅজও) ল্যাবে ক্রস চেক অহধষুংরং করা যায় কি না সেটাও চিন্তা করা যেতে পারে। বর্তমান সরকার বাংলাদেশে “নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ” নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে । যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোডেক্স ফুড কোড অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বে আমাদের শাকসবজি-ফলমূল রপ্তানি করতে হলে আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনেই রপ্তানি করতে হবে। এই ক্ষেত্রে যে অঞ্চলের শাকসবজি, ফলমূল রপ্তানি করা হবে সেই এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় চবংঃ জরংশ অহধষুংরং করে ওঝচগ অনুযায়ী ঘড়ঃরভরপধঃরড়হ করতে হবে। উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে রপ্তানি করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মনিটরিং, জবপড়ৎফ কববঢ়রহম সহ সুনির্দিষ্ট ভাবে গজখ সহ তাদের ওসঢ়ড়ৎঃ জবয়ঁরৎসবহঃ অনুযায়ী পণ্যটি ঈড়সঢ়ষু করে তারপর রপ্তানি করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পেস্টিসাইড রেসিডিও ল্যাব স্থাপন করা যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং রেসিডিও অ্যানালাইসিসের কাজ অত্যন্ত সূ² । যা করতে অত্যন্ত দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। প্রায় প্রতিটি দেশেই ঘচচঙ (ঘধঃরড়হধষ চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঙৎমধহরুধঃরড়হ) স্বাধীন স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে কাজ করে আসছে। অন্যান্য দেশের আলোকে আমাদের প্ল্যাট কোয়ারেন্টিনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার বর্তমান ব্যবস্থাকে পুর্নবিন্যাস করার ব্যাপারে নীতি নির্ধারকগণের সক্রিয় বিবেচনা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী কোয়ারেন্টিন সার্ভিস পুরোপুরি জবমঁষধঃড়ৎু ঝবৎারপব যা আন্তর্জাতিক বিধিবিধান, আমদানি-রপ্তানি নীতি, ওঝচগ জঁষবং, ওঝঞঅ জঁষবং সহ ঝধহরঃধৎু ্ চযুঃড়ংধহরঃধৎু অমৎববসবহঃ(ঝচঝ) সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ ব্যাপারে দক্ষ জনবল তৈরি করা যেমন সময়সাপেক্ষ তেমনি দক্ষ জনবলকে সঠিকভাবে পদায়ন ও পরিচালনা করাও আবশ্যক। উন্নত যন্ত্রপাতির সাথে সাথে দক্ষ জনবল, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কাজের জন্য সময়মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ, সুনির্দিষ্ট অর্গানোগ্রাম কাঠামো নিশ্চিতকরণ করা হলে তা কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিনের বর্তমান ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট পরিচালনা করা অত্যন্ত জরুরি যেন আমদানি ও রপ্তানিকারকরা এ সংক্রান্ত সকল তথ্য এক জায়গায় পেতে পারেন। সেই সাথে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন।
করোনাকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে কোনো অজানা জীবাণু কিভাবে জীবন ও জীবিকাকে লÐভÐ করে দিতে পারে। তাই দেশের ঐঁসধহ ছঁধৎধহঃরহব, চষধহঃ ছঁধৎধহঃরহব, অহরসধষ ছঁধৎধহঃরহব ধহফ ঋরংয ছঁধৎধহঃরহব এর কার্যক্রমকে অবিলম্বে জোরদার করা দরকার। যদি কোন ভাবে কোন অজানা পোকামাকড়, রোগ জীবাণু দেশে প্রবেশ করে আমাদের প্রধান শস্য ধান গাছে একবার আক্রমণ করে একটি মৌসুমে ধানের উৎপাদন পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই বর্তমান বাস্তবতায় কোয়ারেন্টিন এর গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় কোয়ারেন্টিন দিবস পালনসহ ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মহল এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে দ্রæত যুগোপযোগী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই প্রত্যাশা।য়
কোয়ারেন্টিন প্যাথোলজিস্ট, সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম, মোবাইল: ০১৭৫১৬৪৬৬১১, ই-মেইল : syedhq74@gmail.com
ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানিতে যোগ করে সে পানিতে ফসল উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় হাইড্রোপনিক ফার্মিং। গাছের জন্য সরবরাহকৃত পানিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকলে মাটি ছাড়াও গাছ উৎপাদন করা যায়। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মাটির পরিবর্তে পানিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ফসলের সব খাদ্য উপাদান দ্রবণে মিশিয়ে সেখানে গাছ রোপণ করা হয়। আবার কখনও কখনও মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে চারা রোপণ করে তাতে খাদ্য উপাদান স্প্রে করেও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এটি একটি অত্যাধুনিক ফসল চাষ পদ্ধতি। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশও এ পদ্ধতি ব্যবহারে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বর্ধিত মুখের চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত খাদ্য। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটি ছাড়া ভিন্ন মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে একদিকে যেমন অনুর্বর এবং উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জায়গা ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসল উৎপাদন করা যাবে তেমনি শহরেও বদ্ধ জায়গায় উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়া সম্ভব হবে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব এবং এ চাষে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম বিধায় ফসলে কোনো পেস্টিসাইড প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদিত ফসলে কোনো বিষাক্ত প্রভাব থাকে না। এ পদ্ধতিকে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য একেবারে নতুন বলা যাবে না। এ দেশে কৃষক পর্যায়ে মনের অজান্তে অনেক আগ থেকেই কিছু হাইড্রোপনিক কালচার হয়ে আসছে। বর্তমানে সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে আরও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকে সেখানে ভাসমান জৈব বেডে এ পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে ফসল উৎপাদিত হয়ে আসছে। এ প্রাকৃতিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতেও অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে সারা বছর ফসল চাষ করার সুযোগ রয়েছে। এসব প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়নের জন্যও আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানার আবশ্যকতা রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে ভাসমান চাষ পদ্ধতি বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর হাইড্রোপনিক পদ্ধতি থেকে অবশ্যই আলাদা। আমরা হাইড্রোপনিক কালচার বা ফার্মিং বলতে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হাইড্রোপনিক ফসল চাষ ব্যবস্থাপনাকেই বুঝাতে চাচ্ছি। এ পদ্ধতির প্রসারে বাংলাদেশ নিবিষ্টভাবে কাজ করছে এবং দ্রুতগতিতে সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক কৃষির ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভাসমান বেডে যে সবজি আবাদ হয়ে আসছে তা হাইড্রোপনিক পদ্ধতিরই একটি সাধারণ রূপ বলা যেতে পারে। আমাদের শহরাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে লতানো গাছ বোতলে পানির মধ্যে রেখে বারান্দায় গ্রিলে উঠিয়ে দেয়ার যে রীতি তাও হাইড্রোপনিক ব্যবস্থাপনারই মূলমন্ত্র। অনেক সময় পাতাবাহার জাতীয় গাছের ডাল কেটে বোতলের পানিতে রেখে মূল গজিয়ে তারপর মাটিতে লাগানো হতো সেটাও একই ধারণা প্রসূত। বর্তমানে এ পুরনো ধারণার সাথে যোগ হয়েছে পানিতে গাছের খাদ্য উপাদান মিশিয়ে এবং পরিবেশের অন্যান্য প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অনেক আগে থেকেই আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল চাষ শুরু করে। বাংলাদেশ হাইড্রোপনিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করে মাত্র কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮ সালে প্রথম এ পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, সার্বিক পর্যালোচনা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে লেগে যায় ২০০৫ সাল পর্যন্ত। অতপর ২০০৬ সালে এসে শুরু হয় হাইড্রোপনিক কালচারের ওপর প্রকৃত গবেষণা। বছরান্তে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণা শুরু হয় টমেটো, ক্যাপসিকাম, লেটুস ও স্ট্রবেরি নিয়ে। আরও এক বছর পরে ২০০৮ সালে তার সাথে যোগ হয় ক্ষিরা, শসা, গাঁদা ফুল ও বেগুন। এভাবে ২০০৯ সালে বামন শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি এবং চন্দ্রমল্লিকাকেও গবেষণার তালিকায় আনা হয়। অতঃপর ২০১১-১২ অর্থবছরে এ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোপনিক কালচার পদ্ধতিতে বারোটি অর্থনৈতিক ফসল উৎপন্ন করতে সক্ষম হয় যা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ষোলোতে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন আঞ্চলিক কেন্দ্রেও এগিয়ে চলেছে হাইড্রোপনিক কালচারের জন্য গবেষণা। গবেষণা শুরু করেছে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়। গবেষণার পাশাপাশি হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এগিয়ে আসছেন আগ্রহী কৃষকগণ।
বাংলাদেশে বর্তমান হাইড্রোপনিক চাষের অবস্থা
বাংলাদেশে হাইড্রোপনিক কালচারের গবেষণা অনেকটা এগিয়ে গেছে। হাইড্রোপনিক ফার্মিং ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে স্বাভাবিক চাষের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ ফলন বেশি পাওয়া যায়। সেজন্য এ চাষ পদ্ধতির সুবিধার দিকগুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনে বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। বারির পটুয়াখালী উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সারা বছর তরমুজ উৎপাদনের প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে প্রদান করেছেন। বারির হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি বিএআরসি ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ফসল চাষের জন্য ঢাকার মহাখালীতে শহর পর্যায়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক সম্প্রসারণ কর্মীকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে এ চাষ ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা বেশ এগিয়ে গেছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ চলমান আছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ একুয়াপনিক কালচার পদ্ধতির ওপর গবেষণা করছে। এ পদ্ধতিতে পানির ট্যাংকে পিলেট খাদ্য দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পানির ওপর ককশিট দিয়ে সবজির চাষ চলছে। আলাদা জায়গায় চারা তৈরি করে সারা বছর এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যাচ্ছে। একই সাথে পানিতে মাছের পোনা মজুদ করা হয়। শীতকালে টমেটো, লেটুস, পুদিনা এবং গ্রীষ্মকালে ঢেঁড়স, পুঁইশাক ও কলমি চাষ করা যায়। শীত কালে গিফট তেলাপিয়া ও মনোসেক্স তেলাপিয়া এবং গ্রীষ্মকালে এর সাথে থাই কই, ভিয়েতনামি কই, সরপুঁটি ও লাল তেলাপিয়া চাষ করা যাচ্ছে। আশা করা যায় এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তা পাবে।
বাংলাদেশের হাইড্রোপনিক ফসল
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশে জন্মানো যাবে পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গিমাকলমি, বিলাতি ধনিয়া ও বাঁধাকপি এসব। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, শসা, ক্ষিরা, ক্যাপসিকাম, মেলন ও স্কোয়াস উল্লেখযোগ্য। ফলের মধ্যে আছে স্ট্রবেরি এবং ফুলের মধ্যে উৎপাদন করা যাবে অ্যানথরিয়াম, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড ও চন্দ্রমল্লিকা। ভবিষ্যতে যোগ হতে পারে তালিকায় আরও অনেক নতুন ফসলের নাম। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ট্রে, প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল ও মাটির পাতিল ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সবজি উৎপাদন করতে পারবেন। গ্রিন হাউস, প্লাস্টিক হাউস, ফিনাইল হাউসে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।
হাইড্রোপনিক ফার্মিং পদ্ধতি
হাইড্রোপনিক ফার্মিং কেবল চারা উৎপাদনের সময় ছাড়া কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করার দরকার হবেনা। এ পদ্ধতিতে পটে পাথর নুড়ি বা স্পঞ্জ দিয়ে পূর্ণ করে তাতে শুধু চারা উৎপাদন করা হয়। পরবর্তিতে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণে এ চারা রোপণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, মিডিয়া পদ্ধতিতে হাইড্রোপনিক ফার্মিং করতে গাছের চারা দ্রবণে রোপণ না করে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে রোপণ করে সেখানে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণ প্রয়োগ করতে হবে। মাধ্যম হিসেবে অজৈব ও জৈব উভয় প্রকার মাধ্যমই ব্যবহার করা যাবে। বালি কণা, গ্রাভেল, বা কৃত্রিম কাদা অজৈব মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে তিন মিলিমিটার ব্যাসার্ধের চেয়ে কম আকারের বালি কণা ব্যবহৃত হয়। গ্রাভেল কালচারে নির্দিষ্ট সময় পরপর নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম কাদাতে সাধারণত শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়। জৈব উপাদানের মধ্যে কাঠের গুড়া এবং ধানের তুষ বা তার ছাই ব্যবহার করা হয়। এতেও ড্রিপিং পদ্ধতিতে নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে হবে। তৃতীয়ত, এরোপনিক্স পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক অথবা সময় সময় ফসলের মূলে নিউট্রিয়েন্ট স্প্রে করা লাগে। এখানেও কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করা হয়না বলেই একেও হাইড্রোপনিক কালচার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে শুনেই আগ্রহী কৃষকদের কাজ শুরু করতে হবে। প্রযুক্তিকে সামর্থের সাথে মিলিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগ্রহীদের সহায়তার জন্য সরকারি পর্যায়েও প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা দেয়ার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে হবে।
হাইড্রোপনিক দ্রবণ সংগ্রহ
সব ধরনের হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এখন বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে হাইড্রোপনিক কালচারের জন্য উৎপাদিত নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করছে। হাইড্রোপনিক সার তরল আকারে বা পাউডার আকারে থাকে যাকে দ্রবীভূত করে প্রয়োগ করতে হয়। মাটিতে যে সব অর্গানিক উপাদান ব্যবহার করা হয় সেগুলোর সাথে মাটির বিভিন্ন বিক্রিয়ায় উৎপন্ন উপাদানের কথা বিবেচনা করে এ নিউট্রিয়েন্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। হাইড্রোপনিক বাগানে যদিও গাছ পানিতে জন্মায় তবুও মূল আটকানোর জন্য মাধ্যম প্রয়োজন হয়। মাধ্যম হিসেবে পারলাইট, নারিকেলের ছোবড়া, রকউল এমনকি বালিও ব্যবহার করা যেতে পারে। যাই ব্যবহার করা হোক না কেন তাতে মৃত্তিকা বাহিত রোগের হাত থেকে গাছ রক্ষা পায়। অন্যান্য দেশে অনেকেই হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফুলের বাগান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ পদ্ধতিই এখন চিরাচরিত মাটিতে ফুল বাগানের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফুল বাগান করার বেশ কিছু সুবিধা আছে।
পদ্ধতি সম্প্রসারণে উদ্যোগ
সরকারের পক্ষ থেকে হাইড্রোপনিক চাষ মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি কিছু এনজিও এ প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে। ব্র্যাক ভূমিহীন কৃষকদের হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষের কৌশল শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। গত ২০১২ সালে এ প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর, নেত্রকোনা ও মানিকগঞ্জের ১০০ ভূমিহীন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়। এসব কৃষককে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য দশটি করে বাকেট এবং নিউট্রিয়েন্ট সলুশন সরবরাহ করা হয়। তাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত আছে। গ্রিন লিফ এগ্রো মহাখালিতে এর সেল সেন্টারে হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্ট সলুশন বিক্রি করে থাকে। আলফা এগ্রো প্রান্তিকও এ পদ্ধতিতে চাষের কাজ শুরু করেছে। হাইড্রোপনিক কালচার প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক ফার্ম করার পরিকল্পনাও এগিয়ে চলেছে। এখনও এ ধরণের ফার্মিং ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠলেও শিগগিরই গড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। তাহলেই কৃষি আর শুধু মাঠে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং সম্প্রসারিত হবে নিয়ন্ত্রিত বহুতল বিশিষ্ট হাইড্রোপনিক খামারে। বাংলাদেশের কৃষি পরিগণিত হবে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে।
সুপারিশ
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির গবেষণার পাশাপাশি প্রযুক্তি বিস্তারে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি বিস্তারের জন্য যথেষ্ট প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সমবায়ের ভিত্তিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। ভূমিহীন কৃষকদের এ সংক্রান্তে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তাদের এ চাষ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানুষ যদি বুঝতে পারে তারা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে লাভবান হবে তাহলে অবশ্যই গ্রহণ করবে। সকল পর্যায়ে হাইড্রোপনিক চাষ ও খামার গড়ে তোলার জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যারা আগ্রহী হবেন তাদের সহায়তা করার জন্য সরকারের কৃষি অধিদপ্তরকে সার্বক্ষণিক তৎপর থাকতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে গৃহিত পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সফল হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত পরিস্থিতিতিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ বাংলাদেশে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দায়, পলিটানেল ও নেট হাউস কিংবা চাষের অযোগ্য পতিত জমিতে সহজেই চাষাবাদ করা সম্ভব হবে। বাড়ির আঙিনায় নানা ফুলের চাষ করা যাবে। এতে করে একদিকে যেমন পতিত জমি বা অব্যবহৃত জায়গার সফল ব্যবহার হবে, অন্য দিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হবে। সেদিন আর হয়ত দূরে নয় যখন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাটি ছাড়া হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে শাক সবজি, ফল ও ফুলের চাষ হবে। আমাদের বিশ^াস আগামী দিনে হাইড্রোপনিক ফার্মিং পাল্টে দিবে বাংলাদেশের সামগ্রিক কৃষি তথা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। আমরা সেদিনের প্রত্যাশায় থাকলাম।
ড. পিয়ার মোহাম্মদ*
*পরিচালক (অর্থ), বাংলাদেশ টেলিভিশন, রামপুরা, ঢাকা
৮২তম বর্ষ ড় ১২তম সংখ্যা ড় চৈত্র-১৪২৯ ড় মার্চ-এপ্রিল ২০২৩
সম্পাদকীয়
মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় মাস। ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদী কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমণ চালায়। ২৬ মার্চ জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম। বাঙালি দীর্ঘ ৯ মাস পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। অভ্যুদয় হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর ১০৩তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্ন ছিল কৃষি সমৃদ্ধ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমানে বিশ^ব্যাপী মহামারি, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী প্রভাব মোকাবিলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যহত রেখেছে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের দিকনির্দেশনায় কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন যুগোপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যার ফলে দানাদার শাকসবজি, ফলমূল ও প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নেই খাদ্যের ঘাটতি, রয়েছে উদ্বৃত্তী এবং স্থান করে নিয়েছে বিশে^র শীর্ষ দশটি দেশের তালিকায়। এ অর্জনের কারিগর কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীলসমাজ, বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ ও কৃষকেরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে এ সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিতে বর্তমান কৃষির সাফল্য ও আগামীর কৃষির ভাবনা নিয়ে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের অষ্টম সমাবর্তনে মাননীয় কৃষিমন্ত্রী এর বক্তব্যে এবং পল্লী উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ও স্মার্ট পল্লী নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কৃষিকে টেকসই ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারা গতিশীল রাখতে আগামীর কৃষিকথায় উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ, সফল কৃষকের গল্প ও নিয়মিত বিভাগ দিয়ে সাজানো হয়েছে পত্রিকাটি। আশা করি সময়োপযোগী কৃষিকথার এ সংখ্যা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
ভুট্টা সারা বছর চাষযোগ্য বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী দানাজাতীয় ফসল। ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টার পুষ্টিমান বেশি। এতে প্রায় ১১% আমিষজাতীয় উপাদান রয়েছে। উন্নত পুষ্টিমান ও বহুবিধ ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে ভুট্টার আবাদ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে, গাছ ও সবুজ পাতা গোখাদ্য হিসেবে এবং হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালে ভুট্টার আওতায় জমির পরিমাণ ৩৮৯৭০০ হেক্টর এবং উৎপাদন ৩০২৬০০০ মেট্রিক টন। ভুট্টার গড় ফলন আশানুরূপ নয়। ফলন কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ। এসব ক্ষতিকর পোকা ভুট্টা উৎপাদনে প্রভাব বিস্তার করে এবং এদের আক্রমণে ফসলের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য কারণে বাংলাদেশে ভুট্টা ফসলে নতুন নতুন পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ হতে ফসল রক্ষার জন্য এদের আক্রমণের ধরন এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত জরুরি। নি¤েœ ভুট্টা ফসলের প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
কাটুই পোকা (ঈঁঃড়িৎস, অমৎড়ঃরংরঢ়ংরষড়হ)
পোকার লার্ভা মাটি সংলগ্ন চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়। একটি লার্ভা একাধিক গাছের গোড়া কেটে দিতে পারে। লার্ভাগুলো দিনের বেলায় মাটির ফাটলে, ঢেলা ও আবর্জনায় লুকিয়ে থাকে এবং রাতের বেলায় ক্ষতিসাধন করে। অতিরিক্ত আক্রমণে জমিতে গাছের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। পূর্ণতাপ্রাপ্ত লার্ভা ৪০-৫০ মিমি লম্বা, কালচে বাদামি বা মেটে বর্ণের।
ব্যবস্থাপনা
*জমি চাষের সময় পোকার লার্ভা এবং পিউপা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
*কাটা চারার নিকটে লার্ভাগুলো লুকিয়ে থাকে। এ জন্য সকাল বেলা হাত দ্বারা আশপাশের মাটি খুঁড়ে লার্ভা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
*ক্ষেতে সেচ দেওয়া হলে লার্ভাগুলো বের হয়ে আসে। এ সময় কাঠি পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে।
*অত্যাধিক আক্রমণে নিম্নলিখিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে-
ক্লোরপাইরিফস (ডারসবান ২০ ইসি বা পাইরিফস ২০ ইসি বা ক্লাসিক ২০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতিলিটার পানিতে ৫ মিলি অথবা নাইট্রো ৫৫ ইসি (ঈযষড়ৎঢ়ুৎরভড়ং+ঈুঢ়বৎসবঃযৎরহ) প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি অথবা বীজবপনের সময় প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি কার্বোফুরান (ফুরাডান ৫জি, ব্রিফার ৫জি বা অন্য নামের) প্রয়োগ করতে হবে।
জাব পোকা (অঢ়যরফং, জড়ঢ়ধষড়ংরঢ়যঁসসধরফরং)
পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও নিম্ফ উভয়েই গাছের পাতা, নতুন ডগা, টাসেল ও কচি মোচার সবুজ অংশ থেকে রস চুষে খায়। এরা মধু রস নিঃসৃতকের ফলে আক্রান্ত অংশে শুটিমোল্ড জন্মায় এবং কাল রঙ ধারণ করে। টাসেলে মধু রস জন্মালে পরাগায়নে বিঘœ ঘটে ফলে মোচায় সঠিকভাবে দানা তৈরি হয় না। অতিরিক্ত আত্রমণে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যেতে পারে। এরা ভাইরাস রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে।
ব্যবস্থাপনা
*পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও নিম্ফ প্রাথমিক অবস্থায় ডগা এবং পাতায় দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। এই অবস্থায় এদেরকে হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
*বিভিন্ন বন্ধু পোকা যেমন লেডি বিটল, সিরফিডফ্লাই এবং জবফ ঝড়ষফরবৎ নববঃষব জাবপোকা খায়। এ সমস্ত বন্ধু পোকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
*অত্যধিক আক্রমণে ম্যালাথিয়ন (ফাইফানন ৫৭ ইসি, সাইফানন৫৭ ইসি, ম্যালাটন৫৭ ইসি, ম্যালাটাফ৫৭ ইসি, সুমাডি৫৭ ইসি বা অন্য নামের) প্রতিলিটার পানিতে ১ মিলি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
মাজরা পোকা (ঝঃবস নড়ৎবৎ, ঈযরষড়ঢ়ধৎঃবষষঁং)
লার্ভা কচি কাÐ ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে এবং ডিগ পাতার গোড়া কেটে দেয়। ফলে গাছের বিবর্ণ ডগা (উবধফ যবধৎঃ) লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং টান দিলে উঠে আসে। এরা বড় গাছে আক্রমণ করে কাÐে ছিদ্র করে ভেতরের অংশ খায় । ফলে অল্প বাতাসে বড় গাছ ভেঙে পড়ে এরা মধ্যস্থ পাতা ছিদ্র টাসেল আক্রমণ করে, টাসেল কেটে দেয় (চিত্র-১) ফলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। মোচা ধরার পর এরা মোচায় আক্রমণ করে দানা নষ্ট করে ফেলে। এরা রাতের বেলায় কার্যক্ষম। পূর্ণতাপ্রাপ্ত লার্ভা ২০-২৫ মিমি লম্বা, গায়ে রঙ্গিন ডোরাসহ অনেক ফোটা যুক্ত দাগ দেখা যায়। এরা পূর্ণাঙ্গ লার্ভা হিসাবে ভুট্টার সংগ্রহ পরবর্তী গাছ, ডালপালা ও অসংগ্রহকৃত দানায় অবস্থান করে এবং পরবর্তী মৌসুমে পুনরায় আক্রমণ করে।
ব্যবস্থাপনা
*ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্ট অংশ নষ্ট করে ফেলতে হবে কারণ পোকার লার্ভা এদের মধ্যে অবস্থান করে।
*ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে।
*অত্যধিক আক্রান্ত এলাকায় বীজবপনের সময় হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি কার্বোফুরান (ফুরাডান ৫জি, ব্রিফার ৫জি বা অন্য নামের) প্রয়োগ করতে হবে।
*আক্রান্ত গাছ হতে লার্ভা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
*ভুট্টা গাছের উপর থেকে হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি কার্বোফুরান (ফুরাডান ৫জি, ব্রিফার ৫জি বা অন্য নামের) এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন কীটনাশকের দানাগুলো পাতার ভেতরে আটকে যায় (ডযড়ৎষ অঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ)।
*অত্যধিক আক্রমণে ডায়াজিনন (সেবিয়ন ৬০ ইসি, হেজিনন৬০ ইসি, ডায়াজল৬০ ইসি, ডায়াজন৬০ ইসি, ডায়াজিনন৬০ ইসি বা অন্য নামের) অথবা কার্বোসালফান (মার্শাল ২০ ইসি, সানসালফান ২০ ইসি, জেনারেল ২০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে-
গোলাপীমাজরা পোকা (চরহশ নড়ৎবৎ, ঝবংধসরধরহভবৎবহং)
সদ্য জাত লার্ভা কচি কাÐ ছিদ্র করে ভেতরের নরম অংশ খায় ফলে মধ্য ডগা বা মাইজ মরে যায়। লার্ভা গোলাপী রঙের এর মাথা কালচে কমলা বর্ণের হয়। আক্রান্ত ডগা হাত দিয়ে টান দিলে উপরে উঠে আসে। এরা মধ্যস্থ পাতা ছিদ্র করে টাসেলে আক্রমণ করে, টাসেল কেটে দেয় (চিত্র-২) ফলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়।
ব্যবস্থাপনা
*আলোর ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
*আক্রান্তগাছ হতে লার্ভা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
অত্যধিক আক্রান্ত এলাকায় বীজবপনের সময় হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি কার্বোফুরান (ফুরাডান ৫জি, ব্রিফার ৫জি বা অন্য নামের) প্রয়োগ করতে হবে।
অতিরিক্ত আক্রমণে ডায়াজিনন (সেবিয়ন ৬০ ইসি, হেজিনন৬০ ইসি, ডায়াজল৬০ ইসি, ডায়াজন ৬০ ইসি, ডায়াজিনন৬০ ইসি বা অন্য নামের) অথবা কার্বোসালফান (মার্শাল ২০ ইসি, সানসালফান ২০ ইসি, জেনারেল ২০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
আর্মিওয়ার্ম (অৎসুড়িৎস, গুঃযরসহধংবঢ়ধঃধঃধ)
পোকার লার্ভা গাছের মধ্যস্থ ভেতরের নরম পাতায় আক্রমণ করে খায়। এরা পাতার কিনারা দিয়ে খাওয়া শুরু করে। পরবর্তীতে লার্ভাগুলো বয়স্ক পাতায় আক্রমণ করে। অতিরিক্ত আক্রমণে গাছ পাতাবিহীন হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত গাছে পোকার মল দেখা যায়। লার্ভাগুলো গাছের টাসেল এবং মোচায়ও আক্রমণ করে। পূর্ণতাপ্রাপ্ত লার্ভামাটির ভেতরে চেম্বার তৈরি করে পিউপা ধাপ সম্পন্ন করে।
ব্যবস্থাপনা
*আক্রান্ত গাছ থেকে লার্ভাগুলো হাত দ্বারা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
*জমি চাষের সময় মাটিতে অবস্থানরত পোকার পিউপা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
অত্যাধিক আক্রমণে স্পেনোসেড (ট্রেসার ৪৫ এসসি @, ০.৪মিলি/লিটার বা সাকসেস ২.৫ এসসি@ ১.৩ মিলি/লিটার) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি, সাহাম৫ এসজি, হেক্লেম৫ এসজি বা অন্য নামের) @১ গ্রাম/লিটার) কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে-
ফল আর্মিওয়ার্ম (ঋধষষ অৎসুড়িৎস, ঝঢ়ড়ফড়ঢ়ঃবৎধভৎঁমরঢ়বৎফধ)
এটি ভুট্টা ফসলের একটি নতুন বিধ্বংসী পোকা। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম পোকাটির আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এটি একটি সর্বভুক পোকা, এরা ২৬টি পরিবারের ৮০টি ফসলে আক্রমণ করে থাকে, যার মধ্যে ভুট্টা সর্বাধিক আক্রান্ত ফসল।
এরা ভুট্টা গাছে সকল ধাপে (চারা, অঙ্গজ বৃদ্ধি, টাসেল ও মোচায় দানা তৈরি পর্যায়) আক্রমণ করে থাকে। সদ্যজাত লার্ভা পাতায় ছোট ছিদ্র করে এবং শুধুমাত্র পাতার উপরের সবুজ অংশ খায় । পরবর্তীতে এরা ব্যাপকভাবে পাতা খেয়ে ফেলে। ফলে পাতায় বড় বড় ছিদ্র দেখা যায় । লার্ভাগুলো রাতের বেলায় বেশি ক্ষতি করে। অতিরিক্ত আক্রমণে মাঠের প্রায় সম্পূর্ণ গাছ ঝাঝরা হয়ে যায়। লার্ভাগুলো গাছের খোলের (চিত্র-৩) ভেতরে অবস্থান করে কীটনাশক ও প্রাকৃতিক শত্রæ হতে নিজেদের রক্ষা করে। এরা গাছে মল ত্যাগ করে, যা পরবর্তীতে শুকিয়ে করাতের গুঁড়ার মতো দেখায়। এরা মধ্যস্থ পাতা ছিদ্র করে টাসেলে আক্রমণ করে, টাসেল কেটে দেয় ফলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। মোচা হওয়ার পরে এরা মোচা ও কাÐের সংযোগস্থল ছিদ্র করে মোচার ভেতরে ঢুকে এবং ভেতরের নরম দানা খেয়ে ফেলে ।
ব্যবস্থাপনা
*জমি চাষের সময় মাটিতে অবস্থানরত পোকার পিউপা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
*ডিমের গাদা এবং ডিম থেকে সদ্য বের হওয়া লার্ভা (যা একত্রে পাতায় অবস্থান করে) হাত দিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
*বপনের পূর্বে বীজ শোধন করে জমিতে লাগাতে হবে (ঈৎঁরংবৎ ৭০ ডঝ@৪ গ্রাম/কেজি বীজ।
*আক্রান্ত গাছ থেকে লার্ভা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
*পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ পোকা ধরার জন্য সেক্স ফেরোমন ফাঁদ অত্যন্ত কার্যকরী। ভুট্টা বীজ লাগানোর পর পরই আক্রান্ত এলাকায় ২০-২৫ মিটার দূরে দূরে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ লাগাতে হবে।
*জমিতে উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর অবমুক্ত করতে হবে। এক হেক্টর জমির জন্য প্রতি সপ্তাহে ১ বাংকার ব্রাকন (৮০০-১০০০টি পোকা) অবমুক্ত করতে হবে।
*আক্রান্ত এলাকায় জৈব বালাইনাশক এসএনপিভি (ঝঘচঠ) @ ০.২ মিলি/লিটার প্রয়োগ করতে হবে।
*পোকাটি অতিদ্রæত কীটনাশক প্রতিরোদ্বিতা গড়ে তুলতে পারে। এ জন্য অধিক আক্রান্ত এলাকায় একান্ত প্রয়োজনে সঠিক নিয়মে স্পেনোসেড (ট্রেসার ৪৫ এসসি @, ০.৪মিলি/লিটার বা সাকসেস ২.৫ এসসি@ ১.৩ মিলি/লিটার) বা এমামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি, সাহাম৫ এসজি, হেক্লেম৫ এসজি বা অন্য নামের @১ গ্রাম/লিটার) বা ঞযরধসবঃযড়ীধস +ঈযষড়ৎধহষৎধহরষরঢ়ৎড়ষব (ভিরতাকো ৪০ ডবিøওজি@০.৬ গ্রাম/লিটার) কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মোচা ছিদ্রকারী পোকা (ঈড়ৎহ বধৎড়িৎস, ঐবষরপড়াবৎঢ়ধধৎসরমবৎধ)
এরা গাছের নরম পাতা ও মোচায় আক্রমণ করে। পোকার লার্ভা গাছের পাতা ছিদ্র করে খায় ফলে পাতায় গোলাকার দাগ দেখা যায়। গাছে মোচা ধরার পর এরা মোচায় আক্রমণ করে সাধারণত মোচার উপরের অংশে এদের দেখা যায়। এরা সিল্ক কেটে মোচা থেকে আলাদা করে (চিত্র-৪) ফলে পরাগায়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। মোচায় দানা তৈরি পর্যায়ে এরা নরম দানা খেয়ে ফেলে ফলে ভুট্টার ফলন ব্যাপকভাবে কমে যায়। ফসলের প্রকারভেদে লার্ভার গায়ের রঙ সবুজ, গোলাপী, কমলা, হালকা বাদামি বা কালচে ধূসর রঙের হতে পারে।
ব্যবস্থাপনা
*জমি উত্তমরূপে চাষ করতে হবে এবং চাষকৃত জমি হতে পোকার পিউপা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে।
*জমিতে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ প্রয়োগ করে পুরুষ পোকা ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
* আক্রমণের শুরুতে জেব বালাইনাশক এইচএনপিভি (ঐঘচঠ) প্রতিলিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
*অতিরিক্ত আক্রমণে স্পোনোসেড (ট্রেসার ৪৫ এসসি ০.৪ মিলি/লিটার বা সাকসেস ২.৫ এসসি @ ১.৩ মিলি/লিটার) অথবা ঞযরধসবঃযড়ীধস +ঈযষড়ৎধহষৎধহরষরঢ়ৎড়ষব (ভলিয়ামফ্লাক্সি ৩০০ এসসি) @ ০.৫মিলি/লিটার অথবা এমামেকটিন বেনজোয়েট (প্রোক্লেম ৫ এসজি, সাহাম৫ এসজি, হেক্লেম৫ এসজি বা অন্য নামের) @১ গ্রাম/লিটার)। কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ড. মোঃ জুলফিকার হায়দার প্রধান
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (কীটতত্ত¡), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সেউজগাড়ী, বগুড়া, মোবা : ০১৭১৬০৭১৭৬৪, ই-মেইল: zulfikarhaider@yahoo.com
প্রাণিজ আমিষ টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত জীবন গঠন
ডা: শেখ আজিজুর রহমান১, ফয়সাল মেহেদী হাসান২
খাদ্য নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন যাপনের প্রয়োজনে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এ ঘোষিত ‘ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান’ অর্জনে টেকসই প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার কার্যকর উদ্যোগ ও অঙ্গীকার প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-Our Actions are our future. Better production, better nutrition, a better environment and a better life. অর্থাৎ ‘আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভালো উৎপাদনে ভালো পুষ্টি আর ভালো পরিবেশেই উন্নত জীবন।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রণীত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন তথা প্রাণিসম্পদের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য সুষম পুষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রাণিসম্পদ সেক্টর দেশের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ গবাদিপশু-পাখির জাত সংরক্ষণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চামড়াসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এ খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার নিরাপদ প্রাণিজ পুষ্টি উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ খাত নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। মানবসভ্যতা বিকাশের প্রতিটি স্তরে প্রাণিসম্পদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কৃষি কাজ শুরুর আগে পশু শিকারই মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হলেও, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পশুকে ভূমি কর্ষণ, পরিবহন ও খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে। ৭০ এর দশকে পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ, জমি কর্ষণ ও পরিবহন শক্তিই ছিল পশুপাখির পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৭টি হলস্টাইন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় আনয়নের মাধ্যমে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিও বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দেশীয় গবাদিপশুর উন্নয়ন ঘটেছে। ৮০ এর দশক থেকে এই খাতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছে উৎপাদনশীল গবাদিপশু-পাখির বাণিজ্যিক পালন পদ্ধতি। ফলে, সামগ্রিক প্রাণিসম্পদ খাত শিল্প খাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গার্মেন্টের পর পোল্ট্রি শিল্প এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান খাত, যেখানে প্রায় ৬০ লক্ষের অধিক মানুষ সরাসরি কর্মরত। বর্তমানে, জনসংখ্যার প্রায় ২০% প্রত্যক্ষ এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের উপর নির্ভরশীল। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিজাত উৎপাদন বেড়ে চলছে। বাংলাদেশ ছাগলের মাংস উৎপাদনে চতুর্থ এবং গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (এফএও) ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ২০১৫ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বে অন্যতম সেরা মাংস ও চামড়া উৎপাদনকারী জাত। বিগত চার বছর ধরে দেশীয় গবাদিপশু দ্বারা দেশের কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। সামগ্রিক কৃষি উন্নয়নে বৃহৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন সবার আগে দরকার আমাদের টোটাল জরিপ। জরিপ ছাড়া কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ মেট্রিক টন, ৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ১৫০ কোটি, যা বর্তমানে ২০২০-২১ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১১৯.৮৫ লাখ মেট্রিক টন, ৮৪.৪০ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৫৭.৬৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
উক্ত পরিসংখ্যানই বলে দেয়, পুষ্টিসমৃদ্ধ এসব খাদ্য উপাদানসমূহ মানুষের আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। এফএও এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২৫০ মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। যেখানে বর্তমানে দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা যথাক্রমে ১৯৩.৩৮ মিলি/জন/দিন, ১৩৬.১৮ গ্রাম/জন/দিন এবং ১২১.১৮টি/জন/বছর। বিগত ১২ বছরে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৫ গুণ, ৭ গুণ এবং ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে দেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রূপকল্প হচ্ছে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ করা। তাই দুধ, মাংস ও ডিমের প্রাপ্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, ডেইরি শিল্পের বিকাশে ২০১৬ সাল থেকে দেশব্যাপী ৫% হারে স্বল্প সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে গাভী পালন করার জন্য ঋণ প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বিদেশে মাংস রপ্তানির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরকার এফএমডি ও ক্ষুরারোগ মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, মাংস ও মাংসজাত পণ্যের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বমানের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি স্থাপন, গবাদিপশুর জাত উন্নয়নসহ নানা ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য মোট ১৭ প্রকারের টিকা উৎপাদন, বিতরণ ও প্রয়োগ করে আসছে। ই-প্রাণিসম্পদ সেবা, আইসিটি উন্নয়ন, উদ্ভাবনী কার্যক্রম, প্রাণিসম্পদ সহায়ক মোবাইল এ্যাপ এবং সফটওয়ারভিত্তিক রিপোর্টিং চালুর মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় অগ্রসরমান। সরকার কোভিড-১৯ ক্ষতিগ্রস্ত ডেইরি এবং পোল্ট্রি খামারিদের প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৭৪ জন খামারিকে ৮৪৬ কোটি প্রণোদনা প্রদান করেছে। তাছাড়া সরকার প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন অব্যাহত রাখার নিমিত্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ৪% সুদে ৪৩ হাজার ৫০১ জন খামারিকে প্রায় ৮৫৭ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। মহামারি করোনা ভাইরাসের ক্রান্তিকালীন সময়েও ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে সকলের জন্য নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ নিশ্চিত করা হয়েছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিগত ১২ বছরে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৯১.২ লাখ বেকার যুবক, যুব-মহিলা, দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালনবিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র খামারি ও কৃষকদের গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি লালন পালনের উপর প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা প্রদান বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রাণী চিকিৎসক কর্তৃক সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ক্ষুধা দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ উন্নত সহজলভ্য পুষ্টির জোগান এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্য-২ বাস্তবায়ন প্রাণিসম্পদ খাতের উপর অর্পিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে কাক্সিক্ষত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রাণিজ আমিষের পর্যাপ্ত জোগান আমাদের আশাবাদী করছে। আগামীতে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে প্রাণিসম্পদ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা, বাংলাদেশ। ২উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, পরিকল্পনা শাখা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১৩৪০৩২১৩, ই-মেইল : kfaysal_1971@yahoo.com
মুক্তা একটি দামি রত্ন। এটি শৌখিনতা এবং আভিজাত্যের প্রতীক। মুক্তার ব্যবহার প্রধানত অলংকার হিসেবে হলেও এর আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে, যেমন- মুক্তা চূর্ণ বিভিন্ন ওষুধের দামি কাঁচামাল হিসেবে এবং প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরিসহ আরও নানা কাজে মুক্তার ব্যবহার রয়েছে। গোলাকার মুক্তার মতো ইমেজ মুক্তাও অলংকার এবং শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ইমেজ মুক্তা তৈরিতে স্বল্প সময়ের প্রয়োজন হয় (৭-৮ মাস) এবং তৈরির কৌশলটি সহজ বলে যে কেউ সহজেই তা আয়ত্ব করতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ইমেজ মুক্তা চাষের খুবই অনুকূল। উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট “মুক্তা চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ” প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উপাদানে তৈরি ইমেজ মুক্তার উপর গবেষণা পরিচালনা করে ব্যপক সফলতা অর্জন করে।
ইমেজ মুক্তা কি?
মুক্তা হচ্ছে জীবন্ত ঝিনুকের দেহের ভিতর জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক ধরনের রত্ন। এই রত্নটি যখন ছবি বা ইমেজ আকারে তৈরি হয় তখন তাকে ইমেজ মুক্তা বলে। বিভিন্ন ধরনের ছাঁচ বা ইমেজকে ঝিনুকের ম্যান্টল টিস্যুর নিচে প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপিত ইমেজটির চারদিকে ঝিনুকের শরীর থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (নেকার) নিঃসৃত হয়ে জমা হয় এবং ধীরে ধীরে ইমেজ মুক্তা তৈরি হয়।
ইমেজ মুক্তার গুরুত্ব : ইমেজ মুক্তা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
ডেকরেশন পিস হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
ভ্যালু এডেড প্রোডাক্ট (মূল্য সংযোজিত পণ্য) হিসেবে ব্যবহার করা যায়;
স্বল্প সময়ে, স্বল্প পুঁজিতে এবং ক্ষুদ্রাকৃতির জলাশয়ে এ ধরনের মুক্তা চাষ সম্ভব;
মাছের সাথে একত্রে ইমেজ মুক্তা চাষ করে মাছ চাষি বাড়তি আয় করতে পারে;
বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ইমেজ মুক্তা চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের ইমেজ মুক্তা : বিভিন্ন ধরনের উপাদান ইমেজ মুক্তার ইমেজ বা ছাঁচ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়, যেমন- মোম, ঝিনুকের খোলস, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুক্তা গবেষণাগারে মোম এবং ঝিনুকের খোলসের তৈরি ইমেজ/ ছাঁচ দিয়ে আকর্ষণীয় ইমেজ মুক্তা উৎপাদন করা হয়েছে। ইমেজ বা ছাঁচ তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে ছাঁচের তলা যেন উত্তল হয় এবং ছাঁচের ডিজাইন যেন স্পষ্ট হয়।
মোমের ইমেজ : মোম দিয়ে ইমেজ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে একটি মৃত ঝিনুকের পরিষ্কার খোলসের ভেতরের দিক তেল দিয়ে পিচ্ছিল করা হয়। এরপর গলিত মোম ঐ খোলসে ঢেলে মোম জমাট বাঁধার পূর্বে খোলসটি ডানে বামে নেড়ে মোমের একটি পাতলা স্তর তৈরি করা হয়। এরপর একটি সূচের সাহায্যে মোমের স্তরের উপর মৃদুচাপ প্রয়োগ করে পছন্দমাফিক ডিজাইনের ইমেজ তৈরি করা হয়। তৈরিকৃত ইমেজটি এক মিনিট পরিষ্কার পানিতে ডুবিয়ে মোমের খসখসেভাব দূর করা হয়।
খোলসের ইমেজ : খোলসের ইমেজ বা ঝযবষষ ইমেজ তৈরির জন্য প্রথমে কিছু মৃত ঝিনুকের খোলস সংগ্রহ করা হয়। এগুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এরপর শেলকাটিং মেশিনের সাহায্যে এই খোলসগুলোর বাইরের স্তরটি অর্থাৎ পেরিওস্ট্রাকাম স্তরটি ঘষে পরিষ্কার এবং মসৃণ করা হয়। অতঃপর কাটিং মেশিনের সাহায্যে খোলসটির অবতল অংশ আয়তাকার করে ব্লকাকারে কেটে নেওয়া হয়। এরপর ব্লকটির উপর পেন্সিল দিয়ে নির্দিষ্ট মাপের বিভিন্ন ধরনের ইমেজের চিত্র অঙ্কন করা হয়। অতঃপর মিনি গ্রাইন্ডার মেশিনের সাহায্যে অঙ্কিত ইমেজটি ছাঁচ আকারে কেটে নেওয়া হয়। পরিশেষে একই মেশিনের সাহায্যে ইমেজের ধারগুলো ঘষে মসৃণ করা হয়। এভাবে একটি খোলস ইমেজ বা ঝযবষষ ইমেজ তৈরি করা হয়। যা পরে জীবাণুমুক্ত করে জীবিত ঝিনুকে কাঙ্খিত মুক্তা পাওয়ার জন্য প্রবেশ করানো হয়।
ইমেজ মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুক
সকল ঝিনুক মুক্তা উৎপাদন করতে পারে না। বিশেষ কিছু ঝিনুক আছে যেগুলো মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাদুপানিতে চার প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে যেগুলো মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম;
যেমন-
Lamellidens marginalis, L. corrianus,
L. phenchooganjensis, L. jenkinsianus
তন্মধ্যে Lamellidens marginalis এবং খ. L. corrianus ঝিনুকগুলো ইমেজ মুক্তা উৎপাদনে অধিক উপযোগী।
ইমেজ মুক্তা উৎপাদন কৌশল : ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের কৌশলকে অপারেশন বলা হয়। নিম্নে ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপগুলো বর্ণনা করা হলো :
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঃ ড্রপার বোতল, অপারেশন তাক, ঝিনুক খোলার যন্ত্র, স্ট্যুপল, স্প্যাচুলা, ট্রে, ছিদ্রযুক্ত ট্রে
প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঃ ইমেজ (মোমের ও শেল), ৭০% এ্যালকোহল, পটাস, বিশুদ্ধ পানি
ঝিনুক নির্বাচন ঃ সব আকৃতির ঝিনুক ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়। সাধারণত বড় আকৃতির সুস্থ সবল হলুদাভ ঝিনুক ইমেজ মুক্তা উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী। গোলমুক্তা তৈরির জন্য সাধারণত অল্প বয়স্ক ঝিনুক নির্বাচন করা হয় কারণ এই ঝিনুকগুলোর নেকার নিঃসরণের হার বেশি থাকে। কিন্তু ইমেজ মুক্তা তৈরির জন্য বড় ঝিনুকের প্রয়োজন হয় বলে কিছুটা বয়স্ক ঝিনুক নির্বাচন করতে হয়, কারণ অল্প বয়সের ছোট ঝিনুকে ইমেজ বা ছাঁচের মতো একটা বড় বহিরাগত বস্তু প্রবেশ করালে ঝিনুক তা দেহ থেকে বের করে দেবে।
পুকুরে ঝিনুক ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
অপারেশনকৃত ঝিনুক পুকুরে ফোল্ডার আকৃতির নেট ব্যাগে মজুদ করা হয়। নেট ফোল্ডার হচ্ছে এক বা একাধিক সারির পকেট বিশিষ্ট ফোল্ডার যা বাঁশ বা লোহার কাঠামো ও জাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এই নেট ফোল্ডারগুলো পুকুরে দড়ির সাহায্যে নির্দিষ্ট গভীরতায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ফোল্ডারের প্রতি পকেটে একটি করে ঝিনুকের অঙ্কীয় দিক ঊর্ধ্বমুখী করে স্থাপন করা হয়। নেট ফোল্ডারে ঝিনুকটির নড়াচড়া করার তেমন সুযোগ না থাকায় ঝিনুকের দেহের ভেতরের ইমেজটি বের হয়ে আসে না।
পুকুরে ঝিনুক স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ : বাঁশ, দড়ি, ফ্লট (ঋষড়ধঃ)/ভাসা
অপারেশন পূর্ববর্তী পরিচর্যা
প্রকৃতি থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে ঝিনুকগুলো হলুদাভ, সুস্থ-সবল, ক্ষতমুক্ত এবং ৩-৩.৫ বছর বয়সের হতে হবে। বাছাইয়ের পর ঝিনুকগুলো কমপক্ষে একমাস পুকুরের তলদেশে রেখে প্রতিপালন করতে হবে। ঝিনুকগুলো অপারেশন উপযোগী করে তোলার জন্য নিম্নলিখিত মাত্রায় সার, গোবর এবং চুন প্রয়োগ করতে হবে।
সারণি১ ঃ সার ও চুন প্রয়োগের মাত্রা
এক মাস পর লালন পুকুর থেকে গবেষণাগারে এনে ঝিনুকগুলো অপারেশন উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। সুস্থ-সবল ম্যান্টলযুক্ত ঝিনুকগুলো অপারেশনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত ঝিনুকগুলো সিস্টার্নের পানিতে ৭ দিন না খাইয়ে রাখতে হবে এবং প্রতিদিন সকালে সিস্টার্নের পানি পরিবর্তন করে নতুন পানি দিতে হবে। এতে করে ঝিনুকের ভেতরের ময়লা এবং পাকস্থলীয় খাবার পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে যাবে। অষ্টম দিন সকালে অপারেশনের কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে ঝিনুকগুলো সিস্টার্ন থেকে উঠিয়ে গবেষণাগারে এনে ছিদ্রযুক্ত ট্রেতে অঙ্কীয় দিকে নিম্নমুখী করে রাখতে হবে যেন ভেতরে কোনো পানি না থাকে।
অপারেশন পদ্ধতি : অপারেশনের জন্য ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি একটি ট্রেতে ৭০% অ্যালকোহলের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। অপারেশনকারীর হাত পটাশ মিশ্রিত পানি দিয়ে ও মোমের ইমেজগুলো বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ট্রে থেকে পর্যায়ক্রমে একটি করে ঝিনুক নিয়ে অপারেশন তাকের উপর স্থাপন করে ঝিনুক খোলার যন্ত্র দিয়ে খোলস দুটি ৮ মি.মি. পরিমাণ খুলে স্ট্যুপল দিয়ে আটকে দিতে হবে। ভেতরে ময়লা থাকলে ড্রপার বোতলের সাহায্যে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। পরবর্তীতে সতর্কতার সাথে স্প্যাচুলার সাহায্যে ঝিনুকের একপাশের খোলস থেকে ম্যান্টল পর্দা সামান্য পরিমাণ সরিয়ে ইমেজটি খোলস ও ম্যান্টলের মাঝ বরাবর প্রবেশ করিয়ে খোলসের অবতল অংশে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এরপর স্প্যাচুলার সাহায্যে হালকা চাপ দিয়ে ম্যান্টলের ভেতরের বাতাস বের করে ইমেজটি সঠিক ভাবে সন্নিবেশ করতে হবে। অতঃপর সাবধানে স্ট্যুপল খুলে ঝিনুকটি ট্রেতে অঙ্কীয় দিক ঊর্ধ্বমুখী করে রাখতে হবে। অপারেশন শেষে ঝিনুকের খোলসের উপর নির্দিষ্ট সংখ্যা লিখে চিহ্নিত করে দিতে হবে।
অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা : অপারেশনের পর ঝিনুকগুলো সিস্টার্নে প্রথম ৭ দিন খাবার না দিয়ে নেট ফোল্ডারে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রতি ফোল্ডারে ৪টি করে ঝিনুক দিতে হবে। পরবর্তী ১৪ দিন বিকাল বেলা পুকুর থেকে প্লাংকটন সংগ্রহ করে সিস্টার্নে দিতে হবে। প্রতিদিন সকালবেলা সিস্টার্নের পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে। সিস্টার্নে ২১ দিন পরিচর্যা করার পর অপারেশনকৃত ইমেজগুলো নেট ফোল্ডারসহ পুকুরের পানিতে রশিতে করে ঝুলিয়ে দিতে হবে। ১৫ দিন পর পর ঝিনুকগুলো চেক করতে হবে। ঝিনুকের গায়ে এবং নেট ফোল্ডারে ময়লা থাকলে পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং পুকুরে পর্যাপ্ত প্লাংকটন আছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতি মাসে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে।
ইমেজ মুক্তার চাষ ব্যবস্থাপনা : অপারেশনকৃত ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়ার জন্য ঝিনুকগুলোকে জলাশয়ে চাষ করতে হবে। মুক্তা উৎপাদন ও গুণগত মানের জন্য চাষ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিম্নে মুক্তার চাষ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলোঃ
পুকুর প্রস্তুতি : মুক্তা চাষের পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকা বাঞ্ছনীয়। সূর্যালোকের উপস্থিতিতে মুক্তার রং ভালো হয় এবং ঝিনুকের জন্য পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয়। পুকুরের আকার ৫০-৮০ শতাংশ বা এর চেয়ে বড় হলে ভালো, তবে এর চেয়ে ছোট পুকুরেও ইমেজ মুক্তা চাষ করা যাবে। পুকুরের গভীরতা ১.৫-২.০ মিটার হলে ভালো। নির্বাচিত পুকুরের পানি সরিয়ে তলদেশ ভালোভাবে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এরপর শতকে এক কেজি হারে চুন ভালোভাবে পুকুরের মাটিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে ঝিনুকের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১২৫ গ্রাম টিএসপি, এবং ৫ কেজি গোবর পানিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রাকৃতিক খাদ্য ঃ ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ মূলত পরোক্ষ। ফুলকার মাধ্যমে এরা পানিতে বিদ্যমান এলজি, ক্ষুদ্রাকার ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটন, জৈব পদার্থ ইত্যাদি ছেঁকে খায়। তাই পুকুরে যথেষ্ঠ পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতির জন্য নিয়মমাফিক সার প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তা চাষের জন্য পানির উপযুক্ত রং হলো হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০-৩২ সে.মি.। জলাশয়ে ঝিনুকের প্রাকৃতিক খাদ্য প্রস্তুতির জন্য নিম্নক্তো ছক(সারণি-২) অনুযায়ী পাক্ষিক চুন ও সার প্রয়োগ করা উচিত।
ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিকভাবেও সার প্রয়োগ করা যায়। সূর্যালোকিত দিনে সকালে পানিতে গুলানো সার পুকুরের চারদিকে সমানভাবে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টির সময় বা মেঘলা দিনে এবং শীতকালে পানির তাপমাত্রা খুব কমে গেলে সার প্রয়োগ করা উচিত নয়।
পুকুরে মাছ মজুদকরণ ঃ একজন মাছচাষি খুব সহজেই মাছের পুকুরে ইমেজ মুক্তা চাষ করে বাড়তি আয় করতে পারে। এক্ষেত্রে, তৃণভোজী মাছ যেমন, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, এশিয়ান কার্প ইত্যাদি ইমেজ মুক্তা চাষের পুকুরে চাষ করা যেতে পারে। যে সকল মাছ ঝিনুকের সাথে খাদ্যে প্রতিযোগিতা করবে যেমন-সিলভার কার্প, সেসব মাছ মুক্তা চাষের পুকুরে মজুদ না করাই ভালো। যদি একান্ত করতেই হয় তবে তা অল্প পরিমাণে। এছাড়া মধ্যস্তরে কিংবা নিচের স্তরে যে সব মাছ বিচরণ করে খাবার খায় যেমন- রুই, মৃগেল, কালিবাউস ইত্যাদি মাছও ইমেজ মুক্তার পুকুরে চাষ করা যেতে পারে। কিন্তু মাংসাশী মাছ যেমন- ব্ল্যাক কার্প, ইত্যাদি মুক্তা চাষের পুকুরে চাষ করা যাবে না।
পানি প্রবাহ ঃ পুকুরের পানিতে সামান্য প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ঝিনুকের বৃদ্ধিসাধনে এবং মুক্তা উৎপাদনে সহায়ক হয়। তাই সম্ভব হলে প্যাডল হুইল বা হোস পাইপ ব্যবহার করে সামান্য প্রবাহের ব্যবস্থা করা যায়। মাসে একবার পুকুরের কিছু পরিমাণ পানি পরিবর্তন করলে ভালো হয়।
অপারেশনকৃত ঝিনুক মজুদকরণ ঃ ইমেজ প্রতিস্থাপনের ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলো অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যার জন্য দ্রুত সিস্টার্নে স্থানান্তর করতে হবে। এতে ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার, বৃদ্ধি, মুক্তাস্তর তৈরি দ্রুত হয়। অপারেশন পরবর্তী পরিচর্যা শেষে ঝিনুক পুকুরে মজুদ করতে হবে। সিস্টার্ন ও পুকুরে ঝিনুক সমূহের জন্য ঝিনুকের আকৃতির চেয়ে ছোট ফাসের নাইলন নেট দিয়ে প্রতিটি ৪০দ্ধ৩৫ বর্গ সে.মি. সাইজের নেট ফোল্ডার তৈরি করতে হবে। প্রতি ফোল্ডারে ৪ টি ঝিনুক রেখে ফোল্ডারগুলো রশির সাহায্যে পুকুরের পানিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এভাবে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ টি ঝিনুক মজুদ করা যেতে পারে। প্রতি রশিতে দুটি ব্যাগের দূরত্ব ৪০-৪৫ সে.মি. এবং দুটি রশির দূরত্ব ১২০-১৫০ সে.মি. হলে ভালো হয়।
ঝিনুক মজুদ পরবর্তী পুকুর ব্যবস্থাপনা ঃ ইমেজ মুক্তা চাষের জন্য পানির সঠিক গুণাগুণ বাজার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝিনুকের খাদ্য গ্রহণ, বৃদ্ধি এবং নেকার নিঃসরণের ক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানির অনুকূল তাপমাত্রায় ঝিনুক দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নেকার দ্রুত নিঃসৃত হয়ে মুক্তা গঠিত হয়। মুক্তা চাষের জন্য পানির উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৫ক্ক-৩০ক্ক সে.। তাই অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলোকে এই তাপমাত্রার ভেতর রাখার জন্য বিভিন্ন ঋতুতে পানির তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নেট ফোল্ডার ঝুলানোর গভীরতা কমাতে বা বাড়াতে হবে। শীতকালে ফোল্ডারগুলোকে ২০ সে.মি. গভীরতায় ঝুলাতে হবে। গ্রীষ্মকালে উপরিস্তরের পানির তাপমাত্রা বেশি থাকে বলে ৪০-৪৫ সে.মি. গভীরতায় ঝুলাতে হবে। পানির তাপমাত্রা খুব বেশি (৩২ক্ক সে. এর বেশি) বেড়ে গেলে পুকুরে ঝর্ণার মাধ্যমে অথবা নতুন পানি সরবরাহ করে পানির তাপমাত্রা সহনীয় করতে হবে। এছাড়া এই সংকটময় সময়ে ফোল্ডারগুলোকে তলদেশ থেকে মাত্র ১০ সে.মি. উপরে ঝুলিয়ে ঠাণ্ডা পরিবেশের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঝিনুক জলাশয়ের উদ্ভিদকণা, ক্ষুদ্রপ্রাণিকণা ইত্যাদি ফুলকার সাহায্যে ছেঁকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ইমেজ মুক্তা চাষের পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য থাকা প্রয়োজন। পুকুরে পরিমাণমতো প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মালে পানির রঙ হলুদাভ সবুজ এবং স্বচ্ছতা ৩০-৩২ সে.মি. হবে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের স্বল্পতা দেখা দিলে স্বচ্ছতা বেশি হয়। সেক্ষেত্রে দ্রুত পানিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। পূর্বে ব্যবহৃত সারের পরিমাণের অর্ধেক হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। অন্যদিকে স্বচ্ছতা ২৫ সে.মি. এর কম হলে বুঝতে হবে পুকুরটিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যাধিক। সেক্ষেত্রে নতুন স্বচ্ছ পানি সরবরাহ করতে হবে। প্রয়োজনে পুকুরের কিছু পরিমাণ পানি স্বচ্ছ পানি দিয়ে পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া পুকুরে প্রতি মাসে শতক প্রতি এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। ঝিনুক বর্ধনের জন্য ৭-৮ হচ্ছে উপযুক্ত pH, অম্লীয় (pH<6.5) এবং ক্ষারীয় (pH>8.5) উভয় ধরনের পানিই ঝিনুকের বর্ধন এবং মুক্তা তৈরির জন্য অনুকূল নয়।
পুকুরে অপারেশনকৃত ঝিনুক পর্যবেক্ষণ ঃ ইমেজ প্রতিস্থাপনের প্রথম মাসে অপারেশনকৃত ঝিনুকগুলো সাধারণত দুর্বল থাকে। তাই প্রতিস্থাপনের পর প্রথম মাসে নিয়মিত ঝিনুকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মৃত ঝিনুক কিংবা ইমেজ বের করে দেওয়া ঝিুনক সরিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়া নিয়ম করে প্রতি মাসে একবার ঝিনুকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এ সময় ঝিনুকগুলোকে পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং খোলসের মুখে আটকে থাকা শ্যাওলা দূর করে দিতে হবে।
ইমেজ মুক্তা আহরণ ঃ হেমন্তের শেষে বা শীতের শুরুতে ইমেজ মুক্তা আহরণের উপযুক্ত সময়। আহরণের এক মাস পূর্বে ঝিনুকগুলোকে পানির উপরিতলের কাছাকাছি (১০ সে.মি. গভীরতায়) ঝুলিয়ে দিতে হবে। এতে করে ঝিনুকের দ্যুতি এবং রঙ উজ্জ্বল হয়। ব্যবহার উপযোগী ইমেজ মুক্তা তৈরি হতে ৭-৮ মাস সময় লাগে। আহরণের সময় ঝিনুকটির সংযোজনী পেশি ছুরি দিয়ে কেটে ঝিনুকটির দুটি খোলস খুলে ফেলতে হবে। এরপর ম্যান্টল পর্দাটি সরিয়ে ফেললে ইমেজ মুক্তাটি দেখা যাবে। খোলসসহ মুক্তাটি প্রথমে সামান্য লবণ পানি দিয়ে ধুয়ে এরপর স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুতে হবে। সবশেষে বাতাসে ইমেজ মুক্তা শুকিয়ে নিতে হবে।
ইমেজ মুক্তা আমাদের দেশে একটি নতুন সংযোজন। চমৎকার অলংকার তৈরি ছাড়াও শৌখিন দ্রব্য তৈরি, গৃহসজ্জায় এবং আরও নানাবিধভাবে ইমেজ মুক্তা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইমেজ ম্ক্তুার উৎপাদান কৌশল সহজ এবং উৎপাদনে সময় কম লাগে। এছাড়া উৎপাদন ব্যয়ও কম। এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী। এটি একটি পরিবেশবান্ধব এবং নারীবান্ধব প্রযুক্তি। নারীরা সহজেই এই প্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। এসব দিক বিবেচনা করে দেখা যায় যে, আমাদের দেশে ইমেজ মুক্তার এক বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
ড. মোহসেনা বেগম তনু১ অরুণ চন্দ্র বর্মন২ মোহাম্মদ ফেরদৌস সিদ্দিকী৩ সোনিয়া স্কু৪ মো: নাজমুল হোসেন৫
১প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মোবা : ০১৭১১১১৫৩৩৩, ইমেইল :tanu@yahoo.com, ২,৩ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা৪,৫বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বামগই, ময়মনসিংহ-২২০১
ড. হরিদাস চন্দ্র মোহন্ত
মিষ্টিআলু একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্করা প্রধান কন্দালজাতীয় ফসল। এটি উষ্ণ ও অবউষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের ফসল হলেও বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই কম বেশি এর চাষাবাদ হয়। খাদ্য ও কৃষিসংস্থা (২০১৯) এর তথ্য মতে, বর্তমানে বিশে^র প্রায় ১১৯টি দেশে মিষ্টিআলুর চাষাবাদ হয়ে থাকে। পর্তুগিজ বণিকদের মাধ্যমে এটি ভারতবর্ষসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য আমেরিকায় উৎপত্তি হলেও বর্তমানে এর সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী দেশ চীন।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে খাদ্যের পুষ্টিমান সরবরাহ বৃদ্ধিকে একটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রঙিন শাঁসযুক্ত মিষ্টিআলু খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় একটি সম্ভাবনাময় ফসল। কেননা কৃষক এটি খুব সহজে অল্পখরচে চাষাবাদ করতে পারে। এর রোগবালাই তুলনামূলক অনেক কম। এর ভক্ষণযোগ্য মূলসিদ্ধ করে, বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন চিপস, আটা, ময়দা ইত্যাদি প্রস্তুতকরণে, কনফেকশনারি দ্রব্যাদি তৈরিতে, অ্যালকোহল শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এমনকি এর পাতা সবজি হিসেবে ব্যবহার হয় এবং গোখাদ্য তৈরিতে ও ব্যবহার যোগ্য। মিষ্টিআলুতে শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ আলুর থেকে বেশী (প্রায়>৩০%) হওয়ায় প্রক্রিয়াজাত শিল্পে এটিকে ব্যবহারের সুযোগ তুলনামূলক বেশি।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই মিষ্টিআলুর চাষ হয়। স্থানীয় জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০ টনের কম কিন্তু উচ্চফলনশীল মিষ্টিআলুর জাতের ফলন প্রায় ৩০-৪৫টন/হেক্টর। গত ২০ বছরে মিষ্টিআলুর চাষের জমির পরিমাণ ও উৎপাদন ক্রমাগত কমছে কিন্তু ২০০৪-০৫ সাল থেকে উচ্চফলনশীল জাত ব্যবহারের কারণে এর গড় ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৮-১৯ মৌসুমে ২৭১০০ হেক্টরে মোট ২,৮৪,৭০২ টন মিষ্টিআলু উৎপাদিত হয় যার একক ফলন ছিল প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০.৪৭ টন (বিবিএস, ২০১৯)।
মিষ্টিআলুতে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, খনিজ, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন-ই থাকে। বিশেষ করে কমলা ও বেগুনি শাঁসযুক্ত মিষ্টিআলুতে বিটা ক্যারোটিন ও এন্থোসায়ানিন রয়েছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগে প্রতি বছর শিশুদের ভিটামিন-এ ক্যাম্পেইন করে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। এতে দেশের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। অথচ কমলা শাঁসযুক্ত মিষ্টিআলু খেয়ে আমরা অতিসহজেই ভিটামিন এ এর অভাব পূরণ করতে পারি।
পুষ্টি গুণাগুণ
এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, রঙিন শাঁস যুক্ত মিষ্টিআলু প্রতিদিন ১২৫ গ্রাম করে খেলে একটি ৫-৬ বছরের শিশুর ভিটামিন-এ এর চাহিদা পূরণ হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের জন্য মাঝারি আকারের (১৫০-২০০ গ্রাম) একটি মিষ্টিআলুই যথেষ্ট। এর গøাইসেমিক ইনডেক্স অন্য ফসলের তুলনায় কম হওয়ায় ডায়াবেটিক আক্রান্তরা শর্করা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে মিষ্টিআলু খেতে পারেন। এছাড়াও মিষ্টিআলুতে বিদ্যমান বিটা ক্যারোটিন ও এন্থোসায়ানিন নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং এন্টি কারসিনোজেনিক উপাদান বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নিরাময়ে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। মিষ্টিআলুর ভিটামিন ই৬ রক্তনালীকে স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তায় মিষ্টিআলুর গুরুত্ব
উন্নত ও পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতের চাষ : জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখার স্বার্থে মিষ্টিআলুর চাষাবাদ ও ব্যবহার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, যা ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিষ্টিআলুর পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, খাদ্যের বহুবিধ ব্যবহার, বীজের প্রাপ্যতা, দ্রæত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধা, সংরক্ষণ সুবিধা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ সম্বন্ধীয় প্রশিক্ষণ ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে এর দ্রæত সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
শাক হিসেবে : বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টিআলুর কচি ডগা শাক বা পাকোড়া/বড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কমবেশি সব জাত-ই শাক হিসেবে ব্যবহার উপযোগী। তবে বারি মিষ্টিআলু-৪, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টিআলু-১০, বারি মিষ্টিআলু-১১ ও বারি মিষ্টিআলু-১২ জাতসমূহ খুবই সুস্বাদু ও উপাদেয় সবজি হিসেব ব্যবহার করা যেতে পারে। কচি ডগার শাকে ভিটামিন-এ ও ফলিক এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। ফলিক এসিড সমৃদ্ধ খাবার শিশুর স্বাভাবিক বুদ্ধি বিকাশে গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই উপকারী।
বসতবাড়িতে চাষ : বসতবাড়ির পাশে মিষ্টিআলুর লতা রোপণ করলে সারা বছর সবজি/শাক হিসেবে মিষ্টিআলু ব্যবহার করা যাবে। এর ফলে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে মিষ্টিআলুর লতা বর্ধন ও শাক বিক্রি করেও বাড়তি উপার্জন করা যেতে পারে।
শস্যবিন্যাস পরিবর্তনে : আমাদের দেশের আবহাওয়ায় রবি মৌসুম তথা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মিষ্টিআলুর লতা রোপণ করে ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে কন্দ উত্তোলন করা হয়। এক একক জমি থেকে মিষ্টিআলু যে পরিমাণ শর্করা, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান উৎপন্ন করে তা অন্যান্য ফসল থেকে অনেক বেশি হওয়ায় এবং এর বাজারমূল্যও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এর চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক। যে কারণে কৃষক খুব সহজেই রবি মৌসুমে মিষ্টি আলুচাষে আগ্রহী হবে। এ ছাড়া লবণাক্ত এলাকা ও চরাঞ্চলেও এটি জন্মাতে পারে।
সারণি ১ : মিষ্টিআলু উৎপাদনে আয় ও ব্যয়ের প্রাক্কলন
ব্যয়ের বিবরণ | ব্যয়(টাকা/হেক্টর) |
শ্রমিক মজুরি ২৭০ জন (৫০০/-টাকা হারে) | ১,৩৫,০০০/- |
জমি তৈরী বাবদ | ৭,০০০/- |
সারের মূল্য (গোবর, ইউরিয়া, এমওপি ও টিএসপি) | ২০,০০০/- |
বীজের কাটিং ক্রয় (প্রতি হাজার ২৫০ টাকা) | ১৪,০০০/- |
পানি সেচ বাবদ | ৬,০০০/- |
বালাইনাশক ওষধ ক্রয় | ২,০০০/- |
জমি ভাড়া (দুই ফসলি হিসাবে এক ফসলের) | ৫,০০০/- |
বিবিধ | ২,০০০/০ |
মোটব্যয় | ১,৯১,০০০/- |
মূলধনের উপর ১২% হারে ৬ মাসের সুদ | ১১,৪৬০/- |
সর্বমোট ব্যয় | ২,০২,৪৬০/- |
আয়ের বিবরণ | আয়(টাকা/হেক্টর) |
বিক্রয় থেকে আয়- মিষ্টিআলুর গড় ফলন ৩০ টন এবং কৃষকের মাঠে টন প্রতিমূল্য ২০,০০০/- হারে | ৬,০০,০০০/- |
নিটলাভ (১১-১০) | ৩,৯৭,৫৪০/- |
আয় ব্যয়ের অনুপাত (BCR) ১ ঃ ৩.১৪ (প্রতি এক টাকা ব্যয়ে ৩.১৪ টাকা লাভ)
* জমি ভাড়া ও শ্রমিকের মজুরী এলাকাভিত্তিতে কম বেশি হতে পারে।
প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে : আমাদের দেশে মিষ্টিআলুকে লাভজনক ফসল করার নিমিত্তে মিষ্টিআলুর প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে এর ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। যেহেতু মিষ্টি আলুকে উত্তোলনের পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় মাত্র ১-১.৫ মাস সংরক্ষণ করা যায়। ফলে মিষ্টিআলুর প্রাপ্যতা সারা বছর নিশ্চিত করতে হলে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য হিসেবে এর ব্যবহার জরুরি। উন্নত বিশে^ও বিশেষ করে চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশ যেমন- মোজাম্বিক, ঘানা, উগান্ডা, রোয়ান্ডাতে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য হিসেবে এটি সারা বছর ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে, রান্নার পরেও রঙিন শাঁসযুক্ত মিষ্টিআলুতে ৭০% এর বেশি বিটাক্যারোটিন অবশিষ্ট থাকে (লরি ও অন্যান্য, ২০১৫)। যে কারণে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবারের মাধ্যমে সারাবছর ভিটামিন-এ এর চাহিদা নিশ্চিত করা সম্ভব। কমলা ও বেগুনি শাঁস যুক্ত মিষ্টিআলু হতে উন্নত মানের চিপস্, ফ্রেন্স ফাই, আটা-ময়দা, কনফেকশনারি দ্রব্যাদি তথা কেক, বিস্কিট, পাউরুটি, হালুয়া, পায়েস, পরাটা, রসগোল্লা, ক্ষীর, পুরি, নিমকি ও জুস ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার খাদ্য তৈরি করা যেতে পারে।
মিষ্টিআলুর উন্নত জাতসমূহ
কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, দীর্ঘ দিন যাবৎ এ ফসলের উন্নয়নের জন্য কাজ করে আসছে। দীর্ঘ দিন গবেষণার পর এ পর্যন্ত ১৬টি উচ্চফলনশীল ও গুণাগুণ সমৃদ্ধ মিষ্টিআলুর জাত উদ্ভাবন করেছে। মিষ্টিআলু রবি মৌসুমে করা হয়ে থাকে। এ লক্ষ্যে বারি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল মিষ্টি আলুর জাত যেমন- বারি মিষ্টিআলু-২, বারি মিষ্টিআলু-৪, বারি মিষ্টিআলু-৮, বারি মিষ্টিআলু-১২, বারি মিষ্টিআলু-১৪ ও বারি মিষ্টিআলু-১৬ চাষ করা যেতে পারে। তবে জাত নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোক্তার পছন্দকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মিষ্টিআলুর প্রাপ্তিকাল
চারা রোপণের ১০০ থেকে ১২০ দিন পর কন্দমূল উত্তোলন উপযোগী হয়, তবে ১৪০ দিনের বেশি রাখলে শাঁস আঁশযুক্ত হয় এবং উইভিল পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। আমাদের দেশে মার্চ-এপ্রিল মাস মিষ্টিআলুর বাজারে প্রাপ্যতা বেশি থাকে। মাটির সাধারণ জো অবস্থায় কোদাল দ্বারা কুপিয়ে মিষ্টিআলু উত্তোলন করা হয়। উত্তম ব্যবস্থাপনায় উচ্চফলনশীল মিষ্টিআলুর জাতগুলোর ফলন ৩০-৪৫ টন/হেক্টর হয়ে থাকে।
বহুবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুষ্টি নিরাপত্তায় মিষ্টিআলু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে ভিটামিন-এ এর অভাব পূরণে। উন্নত জাতের মিষ্টিআলুর প্রতি একক জমিতে ভিটামিন-এ উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। এ ফসলটিকে দেশব্যাপী জনপ্রিয় করতে ফসল সম্পর্কে নিবিড় জ্ঞান ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। পাশাপাশি বছরব্যাপী প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘসময় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে মিষ্টিআলুর ব্যবহার বৃদ্ধি অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, গ্রামীণ ও সামাজিক উন্নয়ন এবং কৃষি উৎপাদন সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগসমূহ জাতীয়স্তরে মিষ্টিআলু খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। য়
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মোবাইল : ০১৭৮৩৩২৯৯৭৫, ই-মেইল : hmohantatere@gmail.com
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে লোনা ও স্বাদু পানিতে বিচরিত মাছের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন হয়। যার সাথে মাছের প্রজননচক্র, মাছের দেশান্তর গতিবেগ, বাঁচা ও মরার হার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ফলে মাছের মোট উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও জলজ দূষণের ফলে ইলিশ মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন, নতুন ইলিশের সংযোজন (Recruitment) পদ্ধতি এবং দেশান্তর প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে নিম্নে বর্ণিত ইলিশের মজুদের সম্ভাব্য পরিবর্তন হতে পারে-
ক. ইলিশের ঝাঁক মোহনার নিম্নাঞ্চলে স্থানান্তরের সম্ভাবনা;
খ. সাধারণ জেলেদের ইলিশ আহরণ নাগালের বাইরে চলে যাবে;
গ. অস্বভাবিক জলবায়ু এর পরিবর্তনের সাথে সাথে বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের তীব্রতা বাড়তে থাকবে যার ফলে সাধারণ জেলেদের ইলিশ আহরণ প্রক্রিয়া প্রায় অসম্ভব হবে;
ঘ. গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর অববাহিকার পানি প্রবাহ হ্রাস পেলে ইলিশের প্রজননে ব্যহত হতে পারে;
ঙ. পানি দূষণের (শিল্পবর্জ্য ও কীটনাশক) ফলে অদূর ভবিষ্যতে ইলিশের প্রজনন ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে।
নিম্নে ইলিশের স্বাদু ও লোনা পানির বার্ষিক আহরণ থেকে বলা যেতে পারে যে, ইলিশের আহরণ দিনে দিনে লোনা পানিতে বাড়ছে (চিত্র-১)। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইলিশের প্রজনন মোহনার নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে ।
ইলিশ আমাদের দেশের মাছ যা ভৌগোলিক নির্দেশক (Geographical Indicator) হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ইলিশ মাছ প্রাকৃতিকভাবে দ্রুত দেশান্তর প্রকৃতির তবে নদীগুলোর পানির দূষণ ও জলবায়ু ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের দেশান্তর প্রকৃতির গতি (Migration Route) পরিবর্তন হতে পারে । ইলিশ ডিম পাড়ে স্বাদু পানিতে এবং পরে লবণাক্ত পানিতে ফিরে যায় । অতএব দ্রুত স্থান পরিবর্তনশীল এ প্রজাতির মাছের (ইলিশ) ওপর বাংলাদেশে আরও ফলপ্রসূ গবেষণার প্রয়োজন আছে যেমন-
-ইলিশের প্রকৃত প্রজনন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় চলমান গবেষণার প্রয়োজন;
-শুধু ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধ রাখলেই সন্তোষজনক উৎপাদন সম্ভব নাও হতে পারে যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে কৃত্রিম প্রজননও অত্যাবশ্যক;
-মোহনার নিম্নাঞ্চলে কৃত্রিম হ্যাচারি ও গবেষণাগার স্থাপন;
-দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য দক্ষ বৈজ্ঞানিকদের কাজ করা;
-প্রত্যেক বছর জাতীয় সেমিনারের মাধ্যমে গবেষণার দিকনির্দেশনা প্রদান;
-ঞধংশ ঋড়ৎপব গঠন করে ইলিশ মাছের গবেষণার ওপর জোরদার করা ।
ইলিশ মাছের ডিমধারণ ক্ষমতা (Fecundity) :
ইলিশ মাছের ডিমধারণ ক্ষমতা ১.৫-২০ লাখ। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এর সাথে সাথে ইলিশের ডিম ধারণ ক্ষমতা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে যা গড়ে ১২ লাখে দাঁড়িয়েছে যা ইলিশের মোট উৎপাদন দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখ যোগ্যহারে ব্যাহত করবে (Akter, et, ২০০৭)। উল্লেখ্য যে, উভয় প্রকার (স্বাদু ও লবণাক্ত) পানিতে ইলিশের ঝাঁকের ডিম ধারণ ক্ষমতা কমছে ।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ইলিশের লিঙ্গ বৈষম্য (Sex Ratio) :
ইলিশের মজুদ ব্যবস্থপনায় লিঙ্গ বৈষম্য একটি অন্যতম বিশেষ দিক। নিম্নে সময়ের সাথে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের লিঙ্গ বৈষম্যের একটি চিত্র বিভিন্ন গবেষকের গবেষণার ফল (টেবিল-১) দেখানো হলো-
ক্রমিক নং | এলাকার নাম | পুরুষের ও মহিলা ইলিশের অনুপাত Reference |
১ | প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৬০ | Shohidullah et al.., 1999 |
২ | প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৮৬ | Anisur Rahman et al., 2015 |
৩ | প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:১.৯৪ | Anisur Rahman et al., 2017 |
৪ | প্রজনন ক্ষেত্র (নিম্নাঞ্চল) ১:২:০০ | Anisur Rahman et al., 2017 |
টেবিল-১ : জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের লিঙ্গের অনুপাত
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ইলিশের ঝাঁকের প্রজনন ক্ষেত্র মোহনায় নিম্নাঞ্চলে সরে যাচ্ছে । ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রে (নিম্নাঞ্চল) ইলিশের লিঙ্গ বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে (টেবিল-১)। বিভিন্ন গবেষকের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরুষ ইলিশের সংখ্যার চেয়ে স্ত্রী ইলিশের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পুরুষ ও স্ত্রী মাছের সংখ্যার অসংগতিপূর্ণ বৈষম্য হয়ে দীর্ঘমেয়াদে প্রজনন হার কমে যাবে যার ফলে ইলিশের মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা যেতে পারে ইলিশের অব্যাহত উৎপাদনের লক্ষ্যে ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধই যথেষ্ট নয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের কৃত্রিম প্রজননের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ।
ইলিশের প্রজনন চক্র (Breeding Cycle) :
ইলিশ মাছ প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য মোতাবেক সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মোহনা অঞ্চলে ডিম পাড়ে। বর্তমানে ইলিশের Breeding Frequency, প্রজননক্ষম ইলিশ সংরক্ষণ ও মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২২ দিনব্যাপী ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান সহায়ক হিসাবে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ইলিশের ডিম ধারণ ক্ষমতা ও অসম লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, যা দীর্ঘয়োদে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে । এ অবস্থায়, কৃত্রিম প্রজনন বাস্তবায়ন এবং ক্ষেত্র তৈরির মতো বিকল্প ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা অতিব জরুরি।
ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজনন (Artificial Breeding) :
বর্তমানে বাংলাদেশে এখনও ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন এর জন্য কোনো হ্যাচারি স্থাপনাসহ অন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি গতিশীল গবেষণালব্দ ইনস্টিটিউট যেখানে এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। বর্তমানে মৎস্য অধিদপ্তর ইলিশের গবেষণালব্দ ফল সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছে তা নিঃসন্দেহে প্রসংশার যোগ্য। প্রবন্ধকার ড. মো. শহীদুল্লাহ মিয়া ১৯৮৭-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পুকুরে ইলিশ মাছ চাষসহ ইলিশ মাছের মজুদ নিরূপণসহ ইলিশের গতিবিদ্যা গবেষণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।
ইলিশের দেশান্তর প্রকৃতি ও প্রজনন বৈশিষ্ট্য Atlantic Salmon প্রজাতি মাছের অনুরূপ। উন্নত দেশে স্যামন মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটেছে। উন্নত বিশ্বে (ইউরোপিয়ান দেশ, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আমেরিকাতে) স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমে সফল হয়েছে যদিও স্যামন মাছ ইলিশ প্রজাতির মতোই দেশান্তর প্রকৃতির Anadromous । এ মাছটিও স্বাদু ও লবণাক্ত পানিতে বিচরণ করে প্রাকৃতিকভাবে স্বাদু পানিতে ডিম পাড়ে। স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজননের ফলে এ মাছের উৎপাদনে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্যামন মাছে দ্বিতীয় বছরে পরিপক্বতা আসে এবং এরা সমুদ্র থেকে বিপরীত স্রোতে নদীতে আসে। স্যামন মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৃত্রিম উপায়ে স্রোতের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইলিশ মাছের বেলায় কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এসব বিষয় বিবেচনা করে ইলিশ মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য বাস্তবমুখী গবেষণা কার্যক্রম, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এখন অতিব জরুরি এবং এটি সময়ের দাবি।
অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ মিয়া*
*পরিচালক, কলেজ অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেস, আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয়, drshohidullah@iubat.edu # ০১৭৪৮১৯০৪৭৪
জনপ্রিয় সুগন্ধি ধানের চাষ ও বাহারি ব্যবহার
কৃষিবিদ ড. মুহ: রেজাউল ইসলাম
সুগন্ধি চাল তৈরি হয় বিশেষ জাতের ধান থেকে যা স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর। এদেশে এলাকাভিত্তিক প্রচুর সুগন্ধি ধান আবাদের প্রচলন আছে। দেশি জাতগুলোর চাল আকারে ছোট ও অনেকটা গোলাকার হয়। সুগন্ধি ধানের জাতগুলোর বেশির ভাগই আলোক সংবেদনশীল, দিনের দৈর্ঘ্য কমে গেলে হেমন্তকালে ফুল ও দানা গঠন হয়। আর এ কারণে প্রধানত আমন মৌসুমে (খরিফ-২ তে) সুগন্ধি ধানের চাষ করা হয়। এ মৌসুমে প্রায় ১০% জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ করা হয়। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে আমন ও বোরো দুই মৌসুমে এ সুগন্ধি ধান চাষ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে সুগন্ধি ধানের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দিনাজপুর জেলা। এছাড়া ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নওগাঁ এবং রাজশাহী জেলায় সুগন্ধি ধান চাষ হয়। উল্লেখ্য এ চাল বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
উত্তরাঞ্চলে উপযোগী সুগন্ধি ধানের জাতগুলো
আমাদের দেশে আমন মৌসুমে সুগন্ধি ধানের উচ্চফলনশীল জাতের মধ্যে বিআর৫, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৮০, বিনা ধান-৯ ও বিনাধান-১৩ এবং স্থানীয় জাতের মধ্যে কাটারিভোগ, কালিজিরা, চল্লিশাজিরা, চিনিগুঁড়া (জিরাকাটারী), ফিলিপাইন কাটারী, জটাকাটারী, চিনিকাটারী, চিনি আতপ, বাদশাভোগ, খাসকানী, বেগুনবিচি, দুলাভোগ, উকনী, কৃষ্ণভোগ, তুলসীমালা উল্লেখযোগ্য। ব্রি ধান৩৪ স্থানীয় সুগন্ধি জাতের ধান চিনিগুড়া বা কালিজিরার মতোই অথচ ফলন প্রায় দ্বিগুণ। কৃষকেরা এ ধানের আবাদ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ব্রিধান৭০ ও ব্রিধান ৮০ আমন মৌসুমে ব্রি কর্তৃক সর্বশেষ উচ্চফলনশীল সুগন্ধি ধান এবং আলোক অসংবেদনশীল। গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৪.৫-৫.০ মেট্রিক টন, যা কাটারিভোগ ধানের চেয়ে দ্বিগুণ। ব্রি ধান৭০ ধানের চাল দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারি ভোগের চাইতে আরও বেশি লম্বা। আর ব্রি ধান৮০ থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় জেসমিন ধানের মতো, সুগন্ধিযুক্ত এবং খেতেও সুস্বাদু। অপরদিকে বোরো মৌসুমে সুগন্ধিযুক্ত আধুনিক জাত হচ্ছে ব্র্রিধান৫০ (বাংলা মতি)। এ জাতের চালের মান বাসমতির মতোই। হেক্টর প্রতিফলন ৬ মেট্রিক টন। তবে চাল তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
মাটি ও আবহাওয়া
সব ধরনের মাটিই সুগন্ধি ধানের উপযোগী, তবে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি উত্তম। ফুল আসার সময় থেকে পরিপক্বতা পর্যন্ত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এসময় প্রয়োজন সামান্য আর্দ্রতা, মৃদু বাতাস, শীতল রাত্রি (২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং রৌদ্রজ্জ¦ল আলোকিত দিন (২৫-৩২ডিগ্রি সেলসিয়াস)।
চাষাবাদ পদ্ধতি
রোপা আমন মৌসুমে ৫-২৫ জুলাই (২১ আষাঢ়-১০ শ্রাবণ) পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। ২৫-৩০ দিনের চারা প্রতি গুছিতে ২-৩টি করে ২০ সেন্টিমিটারী১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করা হয়।
সার ব্যবস্থাপনা : সুগন্ধি ধানের জমিতে আমন মৌসুমে প্রতি বিঘা বা ৩৩ শতকে ইউরিয়া ১৮-২০ কেজি, টিএসপি ১০-১২ কেজি, এমওপি ১৩ কেজি, জিপসাম ৯ কেজি, দস্তা ১.৩ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার সমান ৩ কিস্তিতে জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে, রোপণের ২০-২৫ এবং ৪৫ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যে, স্থানীয় সুগন্ধি ধানের জাতে ইউরিয়ার পরিমাণ সাধারণত কম লাগে। তবে এলসিসিভিত্তিক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা উত্তম। শুধু রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে উফশী জাতে স্থানীয় জাতের ধানের মতো
সুগন্ধিযুক্ত হয় না। তাই জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সুগন্ধ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
রোপণের পর ৩০-৪০ দিন জমি আগাছা মুক্ত রাখা আবশ্যক। চাল শক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনে সম্পূরক সেচ দিতে হবে। সুগন্ধি ধানের জাতগুলো সাধারণত ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সেজন্য আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সুগন্ধি শীষ বের হওয়ার আগে ট্রাইসাইক্লাজল/স্ট্রবিন গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দুইবার প্রয়োগ করতে হবে। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে।
ফসল কর্তন ও ফলন
ফসল কর্তনের উপযুক্ত সময় ০১-১৫ অগ্রহায়ণ (১৫-৩০ নভেম্বর)। অধিকাংশ ধানের ছড়ায় শতকরা ৮০ ভাগ ধান পাকা অবস্থাতেই ধান কাটা হয়ে থাকে। সংরক্ষণের জন্য আর্দ্রতা ১২ ভাগের নিচে রাখতে হবে। জাত ও পরিচর্যা ভেদে হেক্টরপ্রতি ২.০-৫.৫ টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব।
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার
কাটারি ভোগ ধানের আতপ চালের পোলাও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাটারিভোগ ধানের চিড়া হয় হালকা ধবধবে সাদা ও মিষ্টিসুগন্ধ। আদিকাল থেকে সুগন্ধি চাল অভিজাত শ্রেণির আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আজও দিনাজপুরের কাটারিভোগ সুগন্ধি চাল দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে সুনাম বজায় রেখেছে। সুগন্ধি চালের পোলাও ছাড়া পিঠা-পুলি, বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, ভুনা-খিচুড়ি, পায়েশ ও ফিরনিসহ বেশ চমৎকার ও সুস্বাদু-যা জিভে জল আনে। বিয়ে, পূজা-পার্বণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের ব্যবহার অতি জনপ্রিয়। অনেক সচ্ছল পরিবারে, বনেদি ঘরে সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি (কাটারিভোগ, বাংলামতি) সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়ার রেওয়াজ অহরহ দেখা যায়। দিন দিন এ চালের যেমন ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি উৎপাদনও বাড়ছে। চাইনিজ, ইটালিয়ান, ইন্ডিয়ান হোটেল/রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল/মোটেল পর্যটন কেন্দ্রে প্রধানত সুগন্ধি চালের ভাত, পোলাও নানা পদের খাবার পরিবেশনে সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয়।
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার সম্প্রসারণে করণীয়
সুগন্ধি চালের বাহারি ব্যবহার সম্প্রসারণ কোন একক প্রতিষ্ঠানের সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর/প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে নতুন নতুন কর্মসূচির নিয়ে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। যেমন-সুগন্ধিচালে ইনস্ট্যান্ট ফাস্ট ফুড তৈরি করা যেতে পারে। আজকাল দেশ-বিদেশে নানা পদের আধাসিদ্ধ চালের সঙ্গে কিছু পরিমাণ ডাল, সবজি ও প্রক্রিয়াজাত মাংশ একত্রে মিশিয়ে ম্যালামাইন জাতীয় গ্যাস বা মগে সংরক্ষণ করে তা সিল করে বিপণন করা হয়। ফাস্ট ফুড দোকান থেকে তা কিনে উপরের মোড়ক সরিয়ে তাতে পরিমাণ মতো গরম পানি মেশানো হলে তা উপাদেয় পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। উঠতি বয়সের যুবক-যুবতী বিশেষ করে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এ খাবার অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সুগন্ধি চাল দিয়ে এ ধরনের ইনস্ট্যান্ট ফাস্ট ফুড তৈরি ও বিপণনে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিলে সুগন্ধিচাল জনপ্রিয়করণে গুরুত্বপূর্ণ এক নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। সেসাথে ফাস্ট ফুড তৈরির রেসিপি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে তা উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাজারজাতকরণে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে।
সুগন্ধি চালের ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থাকে বেগবান করতে হলে এলাকাভিত্তিক দিনব্যাপী কিছু সংখ্যক খাদ্য মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। সেখানে বিদেশি মিশনসহ বিভিন্ন তালিকাভুক্ত হোটেল, রেস্তোরাঁ ও মোটেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাওয়াতপত্র বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীরা খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ও দেশি সুগন্ধি চালের নানা গুণাগুণ সরেজমিন দেখে উদ্বুদ্ধ ও আকর্ষিত করা সম্ভব। দেশি সুগন্ধিচাল সংশ্লিষ্ট হরেক রকম খাবারের তৈরি রেসিপি ভিডিও তৈরি করে প্রচার উপযোগি দিকগুলো তা হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করে তাদের এ খাবার পরিবেশনে আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। দেশি সুগন্ধি চালের উপকারী ও আকর্ষণীয় দিকগুলো সুন্দরভাবে ভিডিও ডকুমেন্টারি মাধ্যমে প্রচারের সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চালের তৈরি দেশি সুগন্ধিচালের তৈরি নানা পদের আকর্ষণীয় খাদ্য পরিবেশিত হয়। সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যেন একই পন্থা অবলম্বন করতে সক্রিয় হয় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন গণমাধ্যম, সরকারি/বেসরকারি রেডিও, টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক সংশ্লিষ্ট সব অনুষ্ঠানে এমনকি টকশোতে দেশি সুগন্ধিচাল ও তা থেকে তৈরি খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয়ভাবে সেমিনার/ওয়ার্কশপ আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যেখানে অংশগ্রহণকারী হিসেবে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চি, ম্যানেজার, উৎপাদনকারী ও বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিবর্গ। আলোচনায় উঠে আসা সুপারিশমালার ভিত্তিতে উৎপাদনকারীরা প্যাকিং, গ্রেডিং, লেবেলিং এর মান উন্নয়ন এবং তা থেকে নিত্য নতুন সুস্বাদু খাবার তৈরি ও পরিবেশন জনপ্রিয়করণে সংশ্লিষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে সুগন্ধি চালের উৎপাদন বাড়ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ দেশি অতি উন্নতমানের সুগন্ধি চালের জাতগুলোর পরিবর্তে বিদেশি বাসমতি জাতের চাল ব্যবহার প্রচলন দেখা যায়। অথচ নিজ দেশের উৎপাদিত সুগন্ধি চাল ব্যবহার করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। য়
১আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর; ২কৃষিবিদ মো. রাকিবুল হাসান, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ব্রি, রংপুর।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, শ্রাবণের অথৈ পানিতে খালবিল, নদীনাল, পুকুর ডোবা ভরে যায়, ভাসিয়ে দেয় মাঠঘাট, প্রান্তর এমনকি আমাদের বসতবাড়ির আঙিনা। তিল তিল করে বিনিয়োগ করা কষ্টের কৃষি তলিয়ে যেতে পারে সর্বনাশা পানির নিচে। প্রকৃতি সদয় থাকলে ভাটির টানে এ পানির সিংহভাগ চলে যায় সমুদ্রে। কৃষি কাজে ফিরে আসে ব্যস্ততা। আর এ প্রসঙ্গে জেনে নেবো কৃষির বৃহত্তর ভুবনে কোন কোন কাজগুলো করতে হবে আমাদের।
আউশ
এ সময় আউশ ধান পাকে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পাকা আউশ ধান কেটে মাড়াইঝাড়াই করে শুকিয়ে নিতে হবে।
বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
বীজ ধান হিসেবে সংরক্ষণ করতে হলে লাগসই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করলে ভবিষ্যৎ ভালো বীজ পাওয়া যাবে।
আমন ধান
শ্রাবণ মাস আমন ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। চারার বয়স ৩০ থেকে ৪০ দিন হলে জমিতে রোপণ করতে হবে।
রোপা আমনের আধুনিক এবং উন্নত জাতগুলো হলো বিআর৩, বিআর৮, বিআর৫, বিআর১০, বিআর২২, বিআর২৩, বিআর২৫, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮, ব্রি ধান৩৯, বিনাশাইল, নাইজারশাইল, বিনাধান৪ এসব।
উপকূলীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উপযোগী উফশী জাতের (ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৪৪, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪, ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬২ এসব) চাষ করতে পারেন।
খরা প্রকোপ এলাকায় নাবি রোপা আমনের পরিবর্তে যথাসম্ভব আগাম রোপা আমন (ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪) চাষ করতে পারেন। সে সঙ্গে জমির এক কোণে গর্ত করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন। আমন ধানের ক্ষেতে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য জমির উর্বরতা অনুসারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণের ১২ থেকে ১৫ দিন পর প্রথমবার ইউরিয়া সার ক্ষেতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রথম উপরিপ্রয়োগের ১৫ থেকে ২০ দিন পর দ্বিতীয়বার এবং তার ১৫ থেকে ২০ দিন পর তৃতীয়বার ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে চারা লাগানোর ১০ দিনের মধ্যে প্রতি চার গুছির জন্য ১৮ গ্রামের ১টি গুটি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য চারা লাইনে রোপণ করতে হবে।
পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ধানের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা ডাল পুঁতে দিতে পারেন যাতে পাখি বসতে পারে এবং এসব পাখি পোকা ধরে খেতে পারে।
পাট
ক্ষেতের অর্ধেকের বেশি পাট গাছে ফুল আসলে পাট কাটতে হবে। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং ফলনও ভালো পাওয়া যায়।
পাট পচানোর জন্য আঁটি বেঁধে পাতা ঝড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে তারপর জাগ দিতে হবে।
ইতোমধ্যে পাট পচে গেলে তা আঁশ ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ভালো করে ধোয়ার পর ৪০ লিটার পানিতে এককেজি তেঁতুল গুলে তাতে আঁশ ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে, এতে উজ্জ্বল বর্ণের পাট পাওয়া যায়।
যেসব জায়গায় জাগ দেয়ার পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচাতে পারেন। এতে আঁশের মান ভালো হয় এবং পচন সময় কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে পাট কাটার সঙ্গে সঙ্গে ছালকরণ করতে হবে, তা না হলে পরবর্তীতে রৌদ্রে পাটগাছ শুকিয়ে গেলে ছালকরণে সমস্যা হবে।
বন্যার কারণে অনেক সময় সরাসরি পাটগাছ থেকে বীজ উৎপাদন সম্ভব হয় না। তাই পাটের ডগা বা কা- কেটে উঁচু জায়গায় লাগিয়ে তা থেকে খুব সহজেই বীজ উৎপাদন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুলা
রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে আগাম শীত আসে, সে জন্য এসব অঞ্চলে এ মাসের মধ্যে তুলার বীজ বপন করতে হবে।
শাকসবজি
বর্ষাকালে শুকনো জায়গার অভাব হলে টব, মাটির চাড়ি, কাঠের বাক্স এমনকি পলিথিন ব্যাগে সবজির চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ মাসে সবজি বাগানে করণীয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাদায় মাটি দেয়া, আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় পানি জমতে না দেয়া, মরা বা হলুদ পাতা কেটে ফেলা, প্রয়োজনে সারের উপরিপ্রয়োগ করা।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি যত বেশি হবে তার ফুল ফল ধারণক্ষমতা তত কমে যায়। সেজন্য বেশি বৃদ্ধি সমৃদ্ধ লতা গাছের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের পাতা লতা কেটে দিলে তাড়াতাড়ি ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়া জাতীয় সব সবজিতে হাত পরাগায়ন বা কৃত্রিম পরাগায়ন অধিক ফলনে দারুণভাবে সহায়তা করবে। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে। গত মাসে শিম ও লাউয়ের চারা রোপণের ব্যবস্থা না নিয়ে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আগাম জাতের শিম এবং লাউয়ের জন্য প্রায় ৩ ফুট দূরে দূরে ১ ফুট চওড়া ও ১ ফুট গভীর করে মাদা তৈরি করতে হবে। বর্ষায় পানি যেন মাদার কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সম্ভব হলে মাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে।
গাছপালা
এখন সারা দেশে গাছ রোপণের কাজ চলছে। ফলদ, বনজ এবং ঔষধি বৃক্ষজাতীয় গাছের চারা বা কলম রোপণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে একহাত চওড়া এবং একহাত গভীর গর্ত করে অর্ধেক মাটি এবং অর্ধেক জৈবসারের সঙ্গে ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। সার ও মাটির এ মিশ্রণ গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। দিন দশেক পরে গর্তে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে।
ভালো জাতের সুস্থ্য স্বাস্থ্যবান চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে এবং খুঁটির সাথে সোজা করে বেঁধে দিতে হবে।
গরু ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য রোপণ করা চারার চারপাশে বেড়া দিতে হবে।
প্রাণিসম্পদ
আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রির রোগবালাই বেড়ে যায়। তাই সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে খামার জীবাণুমুক্তকরণ, ভ্যাকসিন প্রয়োগ, বায়োসিকিউরিটি এসব কাজগুলো সঠিকভাবে করতে হবে। বায়োসিকিউরিটির জন্য খামারকর্মীদের জীবাণুমুক্ত জুতা ও এপ্রোন পরে খামারে ঢোকা, কমবয়সী বাচ্চার বেশি যতœ নেয়া, শেডে জীবাণুনাশক পানি স্প্রে করা, মুরগির বিষ্ঠা ও মৃত মুরগি খামার থেকে দূরে মাটিতে পুঁতে ফেলা, পোলট্রি শেডের ঘরের মেঝে কস্টিক সোডার পানির দ্রবণ দিয়ে ভিজিয়ে পরিষ্কার করা। আর্দ্র আবহাওয়ায় পোলট্রি ফিডগুলো অনেক সময়ই জমাট বেঁধে যায়। সেজন্য পোলট্রি ফিডগুলো মাঝে মাঝে রোদ দিতে হবে।
বর্ষাকালে হাঁস মুরগিতে আফলাটক্সিন এর প্রকোপ বাড়ে। এতে হাঁস মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এজন্য সূর্যমুখীর খৈল, সয়াবিন মিল, মেইজ গ্লুটেন মিল, সরিষার খৈল, চালের কুঁড়া এসব ব্যবহার করা ভালো। গবাদিপশুকে পানি খাওয়ানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ দূষিত পানি খাওয়ালে নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
ক্ষুরা, বাদলা, তড়কা, গলাফুলা রোগের প্রতিষেধক দিতে হবে। গোখাদ্যের জন্য রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে বা পতিত জায়গায় ডালজাতীয় শস্যের আবাদ করতে হবে। গরু, মহিষ ও ছাগল ভেড়াকে যতটা সম্ভব উঁচু জায়গায় রাখতে হবে।
গর্ভবর্তী গাভী ও বাছুরের বিশেষ যতœ নিতে হবে। বাছুরের পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এজন্য নিয়মিত দুধ ও মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি খাওয়াতে হবে।
মৎস্যসম্পদ
চারা পুকুরের মাছ ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার পরিমাণ বড় হলে মজুদ পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে গত বছর মজুদ পুকুরে ছাড়া মাছ বিক্রি করে দিতে হবে।
পানি বৃদ্ধির কারণে পুকুর থেকে মাছ যাতে বেরিয়ে না যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য পুকুরের পাড় বেঁধে উঁচু করে দিতে হবে অথবা জাল দিয়ে মাছ আটকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
পানি বেড়ে গেলে মাছের খাদ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় পুকুরে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাস আমাদের কৃষির জন্য হুমকির মাস। এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমাদের সবার সম্মিলিত, আন্তরিক ও কার্যকরী সতর্কতা এবং যথোপযুক্ত কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এ সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। কৃষিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আধুনিক কৃষি কৌশল যেমন অবলম্বন করতে হবে তেমনি সব কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। আর কৃষির যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা ১৬১২৩ এ নম্বরে যে কোনো মোবাইল অপারেটর থেকে কল করে নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা কৃষিকে নিয়ে যাবে উন্নতির শিখরে।
কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন*
*তথ্য অফিসার (কৃষি), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫
খেজুর পরিবেশবান্ধব, স্থানসাশ্রয়ী একটি বৃক্ষ প্রজাতি। এ প্রজাতি দুর্যোগ প্রতিরোধী বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে খামারির আর্থিক লাভ ও স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্ত বেশ সুপ্রাচীন। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং মৌসুমি কর্মসংস্থানে খেজুর গাছের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে বাংলাদেশের সর্বত্রই খেজুর রস, খেজুর গুড় দারিদ্র্য বিমোচনসহ বাঙালি সাংস্কৃতিতে রসঘন আমেজ লক্ষ করা যায়।
১. বৃক্ষ পরিবেশ প্রকৃতি : বাংলাদেশের মাটি ও কোমল প্রকৃতি খেজুর গাছ বেড়ে ওঠার জন্য বেশ উপযোগী। রাস্তা, বাঁধ, পুকুর পাড়, খেতের আইল এবং আবাদি জমিতে এ বৃক্ষ বেশ ভালো জন্মে। তবে নদীর তীর, আংশিক লবণাক্ত এলাকা, বরেন্দ্র এলাকাসহ চরাঞ্চলেও জন্মে। বাংলাদেশের সব জেলা বিশেষ করে বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও নাটোর অঞ্চলে খেজুর গাছ বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ করা হয়। যশোর ও ফরিদপুর দেশের সর্বাধিক খেজুর রস ও খেজুর গুড় উৎপন্ন অঞ্চল।
২. বৈজ্ঞানিক পরিচয় ও বিস্তৃৃতি : খেজুর বৃক্ষ একবীজপত্রী আবৃতবীজী উদ্ভিদ। ইংরেজি নাম Wild Date Palm, Silver Date Palm, Indian Wild Palm আঞ্চলিক নাম খাজুর, খেজুর ও খাইজুর। উদ্ভিদ তাত্ত্বিক পরিচয়Phoenix sylvestris (Roxb.) এবং অ্যারাসি (Arecaceae) বা তালগোত্রের সদস্য। এ পরিবারের একটি গণ phoenix । এই গণের অন্য কয়েকটি চেনা গাছ খুদি খেজুর (Phoenix acaulis) ও হেতাল (Phoenix paludosa) ।
৩. খেজুর বৃক্ষস্বরূপ : শাখা-প্রশাখাবিহীন একক কা-যুক্ত ব্যতিক্রমধর্মী খেজুর গাছ। কাণ্ডটি সরল ও গোলাকার। একটি কাণ্ডই একাকি বেড়ে ওঠে এমন দৃশ্য বৃক্ষের ক্ষেত্রে খুব কম দেখা যায়। গাছের ট্রাংক বেশ মজবুত ও গোলগাল। কা-ের শীর্ষভাগ যা সদা পত্র শোভিত লাবনি মাথি বেশ দৃষ্টিনন্দন। রস আহরণের জন্য খেজুর গাছ বছরে ন্যূনতম একবার কাটা হয় এবং গোলগাল রাখা প্রয়োজন হয়। শীত ঋতুতে উদ্ভিদ জগতে এ নেমে আসে এক প্রাণহীন রসহীন বিবর্ণতার ছায়া তখন খেজুর গাছ রসের বারতা নিয়ে আসে। ফাগুনে প্রকৃতিতে খেজুর ফুল ফোটে। প্রকৃতির দান এর ফুল বিন্যাস যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতঋতুতে খেজুুরমাথিতে মুচি (পুষ্পমঞ্জরি) আসে। খেজুর ফুল ভিন্নবাসী, পুষ্পমঞ্জরি দেখে পুরুষ ও স্ত্রী গাছ চিহ্নিত করা যায়। শুধু স্ত্রী গাছে ফুল ও ফল ধরে পুং গাছে নয়। পুং পুষ্পমঞ্জরি খাটো, স্ত্রী পুষ্পমঞ্জরি লম্বা ও ফুলের বর্ণ সাদা। খেজুর ফুল শক্ত মোচা থেকে বের হয়। মোচা থেকে ফুল ফোটা এক অপার মহিমা, মনে হয় কোথা থেকে কোন ফুলপরি কণ্টাকীর্ণ গাছের মাথিতে মন্ত্র দিয়ে ফুল ফুটিয়েছে। খেজুরের মুচিতে এক ধরনের সাদা উপাদান, যা পরাগরেণুর সুবাস।
৪. বহু গুণে গুণী খেজুর বৃক্ষ : খেজুরের বহুল ব্যবহার নিয়ে বর্ণনার শেষ নেই। রস দিয়ে নানা রকম পিঠা, পায়েস, গুড়, কুটির শিল্প, আয় ও কর্মসংস্থান হয়। সার্বিক বিবেচনায় খেজুর সমধিক গুরুত্ববহ একটি প্রজাতি।
খেজুর ফলের পুষ্টি উপাদান : এই উদ্ভিদ মানবদেহের জন্য উপকারী বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ। খেজুর ফল ফাইবার ও ভিটামিন সমৃদ্ধ। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনা খেজুর ফলের মধ্যে ১৮.০ গ্রাম জলীয় অংশ, মোট খনিজ পদার্থ ১.৭ গ্রাম, ৩.৯ গ্রাম আঁশ, ৩২৪ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২.২ গ্রাম আমিষ, ০.৬ গ্রাম চর্বি, ৭৭.৫ গ্রাম শর্করা, ৬৩ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ৭.৩ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ এবং অল্প পরিমাণ ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে। প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা, পুষ্টিকর এবং উপাদেয়। খেজুর রসে অ্যাসপারটিক এসিড, নাইট্রিক এসিড এবং থায়ামিন বিদ্যমান।
খেজুর রস : শীত ঋতু এলেই গ্রামীণ সংস্কৃতিতে খেজুর রসের কথা মনে পড়ে। ফোঁটা ফোঁটা সঞ্চিত রস নির্গত হবে চোং দিয়ে। হাঁড়িতে জমে রসের ফোঁটা। এভাবে একটি গাছ দৈনিক গড়ে ৫-৬ লিটার রস দিয়ে থাক। কথিত আছে ‘খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে, সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন ভরে সুবাসে’। আবার গাভীর সাথে তুলনায় বলা হয় ‘মাইট্যা গোয়াল কাঠের গাই-বাছুর ছাড়া দুধ পাই’। কাকডাকা ভোরে খেজুরের রস, মন মাতানো ঘ্রাণ শহরে বিরল। শীতের সাকালে খেজুর রস, মিষ্টি রোদ, কৃষক-কৃষাণির হাসি দারুণ প্রাণশক্তি। কবির ভাষায়, ‘এমন শীতলমিষ্টি কোথা আছে নীর? পান মাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর’। তাই এ গাছকে অনেকে শখের বসে ‘মধুবৃক্ষ’ বলে থাকে।
খেজুর রসের পায়েশ : খেজুর রস দিয়ে তৈরি নানা রকমের পায়েশ, ক্ষির খেতে খুবই মজা। খেজুরের রস ও পিঠার সাস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। রস দিয়ে হরেক রকম পিঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। খেজুর পিঠা ও রসের নানা রেসিপি শিরনি-পায়েস, ঘনরসে চিতৈ পিঠা, খেজুর গুড়-নারকেল মিশ্রণে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে।
খেজুর রস থেকে গুড় : খেজুরের গুড় তৈরি করতে হলে এক ধরনের বিশেষ জ্ঞান থাকা চাই। খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করা একটি শিল্প। রসের সাথে জ্বাল দেয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খেজুরের ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড়, মিছরি গুড়, বেশ সুস্বাদু ও সুপরিচিত। গাছে নলি দেয়ার প্রথম দিকের রস থেকে তৈরি গুড়কে নলেন গুড় বলে। পাটালি গুড়ের কদর এখনও বিদ্যমান। গুড় বিক্রির অর্থনৈতিক উপযোগিতা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে খেজুর গুড় রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাটালি গুড় ও কোচড় ভরা মুড়ি প্রচলিত ও পরিচিত দৃশ্য, খেতে ভারি মজা। দুপুরে খেজুরের ভিড় গুড় আজকালের প্রজন্মের কাছে অচেনা এ মধুর স্মৃতি। খেজুরের গুড়ের চিনি সুমিষ্ট ও সুস্বাদু। খেজুরের গুড় থেকে তৈরি বাদামি-চিনির স্বাদ ও ঘ্রাণ বেশ স¦াতন্ত্র্যম-িত।
খেজুর বৃক্ষ ও কুটির শিল্প : কুটির শিল্পে খেজুরের পাতার ব্যাপক ব্যবহার ও কদর রয়েছে। খেজুর পাতা দ্বারা তৈরি করা রকমারি হাত পাখা, লছমি, ঝাড়–, ঝুড়ি, থলে, ছিকা ও নানা রকম খেলনা এখনও অতি সমাদৃত। খেজুর পাতার পাটির কদর ঘরে ঘরে। খেজুর পাতা দিয়ে নকশি পিঠা করা হয়। কুমোড়দের শীত মৌসুমে খেজুরের রস ধারণ করার হাঁড়ি তৈরির হিড়িক বাড়ায়।
খেজুর বৃক্ষ ও ভেষজ গুণাগুণ : সর্দি-কাশি নিরাময়ে খেজুর ফল উপাদেয়। খেজুরের পাতা রোগ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে থাকে। হৃদরোগ, জ্বর ও উদরের সমস্যা সমাধানে বেশ কার্যকর। গাছের শিকড় দাঁত ও মাড়ির প্রদাহ নিবারণে ব্যবহৃত হয়। রস মুখে রুচি আনে।
খেজুর বৃক্ষ ও জ্বালানি কাঠ : খেজুর গাছ গ্রামীণ পরিবারের জ্বালানি দেয়। গৃহের নানা কাজে যেমন তক্তা, আড়া, খুঁটি তৈরি ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়। খেজুর কাঠ আঁশযুক্ত বলে এর দাহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই গ্রামগঞ্জে খেজুর লাকড়ির সমাদর রয়েছে।
খেজুর বৃক্ষ ও উপজাতি সম্প্রদায় : খেজুর রস বাংলাদেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রিয় পানীয়, বাড়তি শক্তির জোগান দেয়। শীতকাল তাদের কাছে বেশ স্মৃতিঘন। নতুন চাল আর গাঁজনকৃত খেজুর রস বিশেষ এক ধরনের আনন্দের আয়োজন, মানসিক তৃপ্তি। খেজুর গাছ খরা সহ্য করে বিধায় বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর গাছের চাষ প্রচলন বেশ লক্ষণীয়।
খেজুর বৃক্ষ ও গাছি সম্প্রদায় : ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটিতে যাবো, এই হলো খেজুর বৃক্ষকে কেন্দ্র করে তৈরি গাছি সম্প্রদায়ের বুলি। তাদের শিউলিও বলা হয়। এরা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। তাই শীতকালে গাছিদের কদর বেড়ে যায়, তারা দিনভর মহাব্যস্ত থাকেন। গাছিরা খেজুর গাছ তোলা-চাছার জন্য দা, চোং বা নলি, কাঠি, দড়ি, ভাঁড় ইত্যাদি জোগাড় করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। শীতকালে গাছিদের কর্মসংস্থান হয়। একজন গাছি দৈনিক ৫০টি গাছ কাটতে পারেন।
খেজুর রস ও সামাজিক সম্পর্ক : এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে বেড়াতে গেলেও সাথে রস বা গুড় নিয়ে যেতে দেখা যায়। খেজুরের মুচিতে এক ধরনের সাদা পাউডার জাতীয় পদার্থ থাকে, যা মুখে মাখে, শিশুরা নানা খেলায় মেতে ওঠে।
৫. খেজুর কবিতা ও প্রবচনের ফল : বৃক্ষ প্রেমিক জীবনানন্দের ভাষায় সহসাই মূর্ত হয়েছে, বসেছে বালিকা খর্জ্জুরছায়ে নীল দরিয়ার কূলে। বাংলার রূপ কবিতায় সফিনাজ নূরুন্নাহারের ভাষায় মায়ের হাতের রসের পিঠা, মধুর মতো খেজুর মিঠা। তাই মনে পড়ে মায়ের কথা, মনে পড়ে মামা বাড়ি বেড়ানোর স্মৃতিকথা। আবার খেজুর গাছ নিয়ে নানা ধরনের প্রবচন, কবিতা গাঁথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটি খেজুর গাছ পাইয়া, লোভে কাটে বাঙালে আগা থুইয়া গোড়া কাটে রস নাহি মিলে। ও তার আগডালেতে থাকে রস রসিক বিনে কে জানে। নিত্যনতুন বেরোয় রস খেলে তা ফুরায় না, প্রেমের গাছের রসের হাঁড়ি পাতল যে জনা। সাধারণ গিরস্থ চাষা জ্বাল দেতে না পায় দিশা, হাইলাদের পাইলে তারে করে মিঠাই ম-া খানা। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের কথামালা, অলি-গাঁও বলি-গাঁও জলী ধান চষে, করে গুড় পাটালি খাজুরের রসে। মামুয়ে পাড়ৈন চিরল পাতা মামীয়ে রান্ধেন ভাত, কান্দিও না গো সোনামামী মামু তোমার বাপ। খেজুর গাছ নিয়ে ঘুমপাড়ানি ছড়া, ছুট ছুট (ছোট) খাজুর গাছ, এই নিয়ে খেজুরার বার দ্যাশ (দেশ), এই খাজুর পাকিব, খেজুরার মা কাটিব, ও রসুন খালা গো, খেজুরার মায়েক বুজাও (বোঝাও) গো না কাটে না যেন। রাজশাহী অঞ্চলের লোকজ কথা, আমি ভাই একলা খেজুর গাছের বাকলা। খেজুর গাছ নড়ে চড়ে তীর ধনুকে বাড়ি পড়ে।
লোকজ জ্ঞান ও অপ্রচলিত ব্যবহার : কাঁচা খেজুরের বীজ পানের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গ্রামে নারীরা অপরিপক্ব খেজুর বিচি পানের সাথে সুপারির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে। খেজুরের আঁটি দিয়ে শৈশবের গর্তখেলার কথা আজও মনে পড়ে। খেজুরতলায় ঝরে পড়া পাকা খেজুর কুড়াতে গিয়েছি শৈশবে কত গদ গদ। খেজুর কাঁটা বন্যপ্রাণীর হাত থেকে ফসল রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। নতুন বেয়াইর সাথে খেজুর কাঁটার ব্যবহার সম্পর্কিত ছড়া বেশ মজার হাসি তামাশার খোরাক দিত। বেয়াইরে বসতে দেবো কি? খেজুর কাঁটার মরা বুনাইছি, বেয়াইর বসতে লজ্জা কি? অমন মরায় বেয়াই বসেনি? খেজুরের মাথি খাওয়া একটি গ্রামীণ সংস্কৃতি, নরম ও কোমল সুমিষ্ট খেজুর মাথি পুষ্টিজ্ঞান।
খেজুর ও সেরা স্থান : খেজুর গাছকে কেন্দ্র করে অনেক নান্দনিক নাম শহর-বন্দরে প্রচলিত যেমন খেজুরতলা, খেজুরবাগান, খেজুুরবাড়িয়া, শিবচরের খাজুর গ্রাম। ঢাকার খেজুরবাগান একটি প্রতিষ্ঠিত নাম।
খেজুর ও পাখির খাদ্যাবাস : শীতের সময় খেজুর গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রকৃতি প্রাণ পায়। খেজুর গাছ পাখির প্রিয় আবাস। পাখিরা এখানে বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে ও নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করে। খেজুর গাছে বাবুই ও চড়–ই বাসা বানায়, বাচ্চা তুলে। কাঠঠোকরা, ঘুঘু ও চড়–ই খেজুর গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়, সাদা গলা মুনিয়া খেজুর গাছের মাথায় বাসা করে। শালিক, ঘুঘু, কাক, কোকিল, ময়না, মৌটুসি নরম ফল খায়।
খেজুর গাছ কৃষি বন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি : সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এ গাছ রেললাইন ও বসতবাড়ির ফটকে বেশ দৃষ্টিনন্দন। বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর গাছ বেশ লক্ষণীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। গ্রাম বাংলার মেঠো পথের দুইপাশে তাকালে চোখে পড়বে সারি সারি খেজুর গাছ। রাস্তার দুই ধারে, আবাদি জমিতে, ক্ষেতের আইলে সারিবদ্ধভাবে খেজুর গাছ জন্মেœ যা কৃষি বন বলে পরিচিত। দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষি জমিতে বাণিজ্যিক খেজুর গাছ আবাদ একটি উত্তম পেশা বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহীতে কৃষি জমিতে খেজুর গাছ সফলতার দ্বার উন্মুক্ত করছে। এ গাছের সাথে সখ্য রয়েছে এমন সবজি প্রজাতি গাছআলু, লাউ, ধুন্দুল, লালশাক, সরিষা, বেগুন ইত্যাদি। একটি খেজুর গাছ ১০-১৫ বছরে ফল দেয়। প্রাকৃতিক অথবা চারা বা বীজ বপনের মাধ্যমে খেজুর গাছ জন্মে। বীজ থেকে চারা উৎপন্ন হয় এবং ১০-১৫ দিনে বীজ অংকুরিত হয়। প্রতি কেজিতে ১৩০০-১৫০০টি বীজ পাওয়া যায়। রস আহরণের জন্য গাছ ব্যবস্থাপনা গোছ-গাছ রাখা প্রয়োজন হয়। তাই কথায় বলা হয় খেজুর বাড়ে কোপে। খেজুর গাছের পাতা ও মাথি মাঝে মধ্যে কেটে-ছেঁটে গাছের গোল-গাল গড়ন ও বৃদ্ধি নিশ্চিত করা হয়। গাছ বছরে ন্যূনতম একবার কাটা হয়, শোভিত ও বেশ দৃষ্টিনন্দন রূপ দেয়া হয়।
৬. উৎপাদন, বাজার ও কর্মসংস্থান : প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের বাংলাদেশে ১২০০৬ হেক্টর জমিতে মোট ৮১৫৮৩ মে. টন খেজুর উৎপাদিত হয়েছে। খেজুর উৎপাদনের শীর্ষ জেলাগুলো হলোÑ যশোর, ফরিদপুর, রাজশাহী ও নাটোর। প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা ও পুষ্টিকর। একটি গাছ দৈনিক গড়ে ৫-৬ লিটার রস দেয়। একটি গাছ থেকে প্রতি মৌসুমে গড়ে ২৫-৩০ কেজি গুড় তৈরি হয়। প্রতি কেজি গুড়ের মূল্য ৫০-৬০ টাকা। ২০০ খেজুর গাছ আছে এমন পরিবার পুরো বছরের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী একবিঘা জমিতে প্রায় ১ থেকে ১৫০ গাছ রোপণ করা সম্ভব। ১টি প্রতিবেদনে দেখা যায় বাঘা উপজেলায় চাষিরা প্রতি বছর ৮-১০ কোটি টাকা আয় করেন খেজুরের রস ও গুড় বিক্রি করে। খেজুর ফল বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।
খেজুর গুড়ের বাজার : শীত মৌসুমে গুড় তৈরি বেশ বড় পেশা। সারা দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গুড় ব্যবসায়ী গুড় বিপণন ও পরিবহনের সাথে যুক্ত থাকে। এ সময় গুড় বিপণন নিয়ে রব-রব পরিস্থিতি তৈরি হয়। গ্রামীণ হাটবাজারে প্রান্তিক মানুষ নগদ কিছু অর্থ কামিয়ে নেয়। বাংলাদেশে যশোর ও ফরিদপুর অঞ্চলে সর্বাধিক খেজুর রস ও গুড় উৎপন্ন হয়। বৃহত্তর যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চল গুড় ও পাটালি করা হয়। বেনাপোল-শার্শা খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত। মাদারীপুরেও বৃহৎ বাজার বসে। কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামে বেশ রস উৎপন্ন হয়।
আরবের খেজুর : আরবের প্রধান ফল খেজুর। এ বৃক্ষ মহিমা নিয়ে সূরা আন্’আ-ম্, আয়াত-৯৯-১০০ নাজিল হয়েছে। যার অর্থÑ ‘এবং তিনি খেজুরের মোচা হতে ফলের থোকা থোকা বানাইয়াছেন, যাহা বোঝার ভরে নুইয়া পড়ে। এই গাছগুলো যখন ফলধারণ করে তখন উহাদের ফল বাহির হওয়া ও উহার পাকিয়া যাওয়ার আবস্থাটা একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাইয়া দেখিও। এই সব জিনিসের সুস্পষ্ট নিদর্শন সমূহ নিহীত রহিয়াছে তাহাদের জন্য যাহারা ঈমান আনে’। তাই আরবি খেজুরের প্রতি আমাদের দুর্বলতা প্রবল।
তবে আমাদের দেশের খেজুর এবং আরবের খেজুর ফলের মধ্যে বেশ তারতম্য রয়েছে। আমাদের খেজুর গাছ রস উৎপাদননির্ভর আর সৌদি আরবের খেজুর ফল উৎপাদননির্ভর। তাই আমাদের দেশে আরবি খেজুর তথা বেহেশতি ফল চাষের কথা বলা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে মোতালেব মিয়ার সৌদি খেজুর চাষের সাফল্যের কথা বলা যায়। তিনি সৌদি খেজুর চাষে একটা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন কঠিন সাধনা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। দেশবাসীর জন্য মোতালেব মিয়া তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন।
৭. খেজুুর ও হারানো সংস্কৃতি : কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাস রসের মাস। রস আহরণে গাছ তৈরি করার ধুম পড়ে এসময়। গাছিদের গ্রামীণ জনপদে এখন কম দেখা যায়, পেশা ছাড়ছেন অনেক গাছি সম্প্রদায়। খেজুর রস বিক্রির চিত্র এখন আর দেখা যায় না। গাছিদের স্বার্থ ও আগ্রহ ধরে রাখা দরকার। এই উদ্ভিদের উৎকর্ষ সাধন এবং সংরক্ষণের জন্য নানা ধরনের মৌলিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
উপসংহার : বৈরী জলবায়ু ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে এসব প্রজাতির ওপর প্রভাব পড়ছে। ভাটির দেশে এ উদ্ভিদ প্রজাতি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এই উদ্ভিদ অত্যধিক লবণ পরিবেশে ও দীর্ঘ খরা পরিবেশে আশানুরূপ রস দিতে পারে না। নদীর পাড়, রাস্তার প্রান্তে প্রজাতি দেখা যায় না। বসতবাড়িতে খেজুর গাছের আধিক্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে আশার কথা, বন বিভাগ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুর গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে, এই উদ্ভিদের উৎকর্ষ সাধন এবং সংরক্ষণের জন্য নানা ধরনের মৌলিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বেশি রস দেয় এ রকম প্রজাতি শনাক্তকরণ ও তা কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা দরকার। বারি জার্মপ্লাজম সেন্টার এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। নার্সারিতে খেজুর চারা উৎপাদন অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করি। দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত নার্সারিতে খেজুর চারা উৎপাদন করে চাষ বৃদ্ধি করা যায়। বাঁধ, গ্রামীণ বন, পাকা সড়ক, রেললাইনের ধারে, সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতের ধারে খেজুর চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। নান্দনিক গাছের সমন্বয়ে ব্যাণিজ্যিকভিত্তিক উদ্ভিদ উদ্যান তৈরি হতে পারে, যা মানুষকে আকর্ষণ করবে। পরিকল্পিত উপায়ে পতিত ও প্রান্তিক জমিতে গাছ রোপণ করলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে গুড় রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
ড. এস এম আতিকুল্লাহ*
*এগ্রিকালচার স্পেশালিস্ট, জাতীয় ভূমি জোনিং প্রকল্প, ৩/১ এ নীলক্ষেত, বাবুপুরা, ঢাকা-১২০৫, মোবাইল : ০১৭১২৮৮৯৯২৭
আম এদেশে চাষযোগ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বর্তমানে দেশের ২২টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে আমের চাষাবাদ। তবে জনপ্রিয় এই ফলটি দেশের সব জেলাতেই জন্মাতে ও ফলন দিতে পারে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদ- গন্ধে আম একটি অতুলনীয় ফল। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আম বাগানে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। বর্তমান সময়ে আম বাগানে বালাইনাশকের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আম চাষি নিজের অজান্তে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক বহুবার ব্যবহার করছেন। কীটনাশক স্প্রের বিষয়ে এখনই সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আম বাগানে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অল্প থেকে শুরু করে ব্যাপকও হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ ও পোকামাকড় দমন করতে ব্যর্থ হলে আমের ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ছোট আকারের ফসলের ক্ষেত্রে অন্যান্য দমন পদ্ধতি যেমন-আক্রান্ত পাতা বা গাছের অংশ ছিঁড়ে ফেলা, পোকার ডিম বা কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করা, জাল দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে নষ্ট করা সম্ভব কিন্তু আমের মতো বৃহৎ গাছে রোগ বা পোকামাকড় দমনের জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। আমের ফলন মূলত নির্ভর করে আম গাছে মুকুল বা পুষ্পমঞ্জুরির সংখ্যার ওপর। তাই আমের মুকুলে পোকা বা রোগের আক্রমণ হলে মুকুল বা ফুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে ফলে ফলধারণ ব্যাহত হতে পারে। সুতরাং মুকুলে রোগ বা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়া মাত্রই বালাইনাশকের স্প্রে করার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্প্রের মূলনীতি : যে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করতে ৪টি মূলনীতি অবশ্যই মেনে চলা উচিত। এগুলো হলো সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, সঠিক ডোজ বা মাত্রা নির্ধারণ, সঠিক সময় নির্বাচন এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ।
সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন : আমের রোগ বা ক্ষতিকর পোকা লাভজনকভাবে ও কম খরচে দমন করতে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা একটি অতীব গুরুত্বপূর্র্ণ পদক্ষেপ। ওষুধ নির্বাচনে কোনো ভুল হয়ে থাকলে স্প্রে কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে ভেস্তে যায়। এতে শ্রম, সময় ও অর্থের অপচয় ঘটে উপরন্ত আসল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। তখন কৃষক কীটনাশক ডিলারদের জিজ্ঞাসা করেন কি ওষুধ স্প্রে করতে হবে, এটা মোটেই ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সঠিক পরামর্শের জন্য স্থানীয় কৃষিকর্মী, কৃষি অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। একই গ্রুপের কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বার বার স্প্রে না করে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করা উচিত কারণ একই ওষুধ বার বার স্প্রে করলে পোকা বা রোগের জীবাণুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে।
সঠিক মাত্রা নির্ধারণ : সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে। বালাইনাশকের মাত্রা কম বা বেশি না হওয়াই উত্তম। উপযুক্ত মাত্রা না হলে রোগ বা পোকামাকড় ভালোভাবে দমন করা সম্ভব হয় না। উপরন্ত রোগের জীবাণু বা পোকার মধ্যে বালাইনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। আবার অধিক মাত্রায় বালাইনাশকের ব্যবহার অর্থের অপচয় হয় এবং ফলগাছের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই বালাইনাশকের মাত্রার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এজন্য বোতল বা প্যাকেটের গায়ে লিখিত নির্দেশনা, কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং কৃষিকর্মীর পরামর্শমতো কাজ করা উচিত।
সঠিক সময় নির্বাচন : কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। এ কথা সত্য যে কোনো কাজ সঠিক সময়ে সমাধা করতে পারলে বাড়তি শ্রম ও বাড়তি খরচের অপচয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আম গাছে মুকুল আসার পর থেকে ফলধারণ পর্যন্ত সময়টুকু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে গাফিলতি করা মোটেই ঠিক নয়। এ সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে আমগাছে ফলধারণ নাও হতে পারে। আম বাগানে মুকুল আসার আনুমানিক ১০-১৫ দিন আগে আমগাছে প্রথম স্প্রে দিতে হবে। আমের মুকুল ১০-১২ সেমি. হলেই দ্বিতীয় স্প্রে দেয়া উচিত। মুকুলের ফুল ফোটার পর কোনো অবস্থাতেই স্প্রে করা যাবে না। আমের পরাগায়ন প্রধানত বিভিন্ন প্রজাতির মাছির দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ফুল ফোটার সময় কীটনাশক স্প্রে করলে মাছি মারা যেতে পারে এবং আমের পরাগায়ন ও ফলধারণ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। গাছ থেকে ফল পাড়ার কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে গাছে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করা উচিত নয়। গাছে মুকুল বের হওয়ার আগেই অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে প্রয়োজনীয় অর্থ, শ্রমিক, স্প্রে যন্ত্রপাতি, ওষুধ ইত্যাদি মজুদ রাখতে হবে।
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ : সঠিক ওষুধ, সঠিক মাত্রা, সঠিক সময় ইত্যাদি নির্ধারণের পর সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন। স্প্রে কার্যক্রম থেকে পরিপূর্ণ ফল লাভ করতে হলে অবশ্যই সঠিক পদ্ধতিতে স্প্রে করতে হবে। ফলের মধ্যে বা ডালের মধ্যে ছিদ্রকারী পোকা অবস্থান করলে বাইরে কীটনাশক স্প্রে করলে কোনো লাভ হয় না। আমের হপার পোকা সুষ্ঠুভাবে দমন করতে হলে পাতায় স্প্রে করার সাথে সাথে গাছের গুঁড়িতেও স্প্রে করা প্রয়োজন। তাই সুষ্ঠুভাবে রোগ বা পোকা দমনের জন্য স্থানীয় কৃষি অফিস বা আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ করে পরামর্শ নেওয়া উচিত।
যে কোনো রোগ বা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একটি জিনিস চিন্তা করা দরকার তা হলো রোগ বা পোকা দমন করে কতটুকু লাভবান হওয়া যাবে। রোগ বা পোকার আক্রমণে যে পরিমাণ অর্থের ক্ষতি করবে দমনের খরচ যদি তার চেয়ে বেশি হয় তবে সে রোগ বা পোকা দমনের জন্য স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। রোগ বা পোকার আক্রমণ কম হলে এবং তা মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সে ক্ষেত্রে স্প্রে করা যুক্তিসঙ্গত নয়। অহেতুক স্প্রে করলে অর্র্থ ও শ্রমের অপচয় হয়। তবে আমের মুকুলে অ্যানথ্রাকনোজ বা পাউডারি মিলডিউ রোগের আক্রমণ দেখা না গেলেও আবহাওয়া যদি রোগের আক্রমণের জন্য অনুকূল হয় তবে প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। অনুরূপভাবে আমের মুকুলে হপার বা শোষক পোকার উপস্থিতি কম হলেও প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসাবে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। কেননা এ পোকা অনুকূল আবহাওয়ায় অতি অল্প সময়ে অনেক বংশ বৃদ্ধি করতে ও মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম।
সতর্কতা : কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক মাত্রই বিষ। তাই এদের ব্যবহারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। সতর্কতা অবলম্বনে কোনো প্রকার গাফিলতি দেখালে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই কীটনাশক ডিলার ভাইদের উচিত কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক বিক্রির সময় সেগুলো ব্যবহারে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা আমচাষি ভাইদের স্মরণ করে দেয়া। যে কোনো বালাইনাশক স্প্রে করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে-
কোনো বালাইনাশক সরাসরি হাত দিয়ে স্পর্শ করা উচিত নয়। প্রয়োজনে হাতে গ্লাবস ব্যবহার করতে হবে। যিনি বালাইনাশক স্প্রে করবেন তার সমস্ত শরীর ঢেকে রাখার জন্য এপ্রোন পরিধান করতে হবে। চোখে চশমা ও মাথায় ক্যাপ বা হেলমেট পরতে হবে। পায়ে জুতা থাকা ভালো।
কোনো বালাইনাশক মুখে দেয়া বা গন্ধ নেয়া যাবে না। স্প্রেকালীন কোনো প্রকার খাওয়া-দাওয়া বা ধূমপান করা যাবে না। স্প্রে সময়ে পুকুর বা অন্য কোনো পানির উৎস যাতে দূষিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্প্রে শেষ হলে শরীর ও জামাকাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। খাদ্যদ্রব্য ও পশুখাদ্য স্প্রে এলাকা থেকে দূরে রাখতে হবে। স্প্রে করার ২ দিনের মধ্যে গাছের নিচে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি চরতে দেয়া অনুচিত কারণ তারা ঘাস বা মৃত পোকামাকড় খেয়ে বিপদে পড়তে পারে। বাতাসের অনুকূলে স্প্রে করতে হবে অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে বাতাস পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হলে গাছের পূর্ব দিকে দাঁড়ায়ে স্প্রে করতে হবে। বালাইনাশকের খালি প্যাকেট বা বোতল অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
ব্যবহারের পর স্প্রে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
স্প্রে করার ১৫-২০ দিনের মধ্যে গাছের আম খাওয়া যাবেনা তাই আম পাড়ার ১৫-২০ দিন আগেই আম গাছে স্প্রে বন্ধ করতে হবে। সব বালাইনাশক শুষ্ক ও ঠাণ্ডা জায়গায় তালাবদ্ধ অবস্থায় এবং শিশুদের নাগালের বাইরে সংরক্ষণ করতে হবে।
আম বাগানের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনায় প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধক ব্যবস্থায় বেশি কার্যকরী। উল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপর নজর দিলে খুব সহজেই এবং কম খরচে আম বাগানের রোগ-পোকামাকড় দমন করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব হবে। পরিশেষে আমচাষির জন্য একটি পরামর্শ হলো সম্ভব হলে একই এলাকার সব আম বাগানে একই সময়ে স্প্রে করা, এটি পোকামাকড় দমনে খুবই কার্যকর ও ফলপ্রসূ।
* ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
০১. করোনাভাইরাস সর্ম্পকে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
০২. লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
০৩. পিপিই সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাক্সসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
০৪. কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।
০৫. যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে।
০৬. নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।
০৭. নদীবেষ্টিত জেলাসমূহে নৌ-এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
০৮. অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে।
০৯. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা। সারাদেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।
১০. আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সকল সরকারি কর্মকর্তাগণ যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন-এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
১১. ত্রাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।
১২. দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেন অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে।
১৩. সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
১৪. অর্থনৈতিক কর্মকাÐ যেন স্থবির না হয়, সে বিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে।
১৫. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেন পতিত না থাকে।
১৬. সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যাতে বাজার চালু থাকে।
১৭. সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
১৮. জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপন করতে হবে।
১৯. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজের সকল স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সকলকে নিয়ে কাজ করবে।
২০. সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা অফিসারের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
২১. জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুঃস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ করবেন।
২২. সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন : কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিক্সা/ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্তা/বিধবা নারী এবং হিজরা সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
২৩. প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২৪. দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সকল সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি।
২৫. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
২৬. আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় করবেন না। খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
২৭. কৃষকগণ নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এক্ষত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে।
২৮. সকল শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি-ঘর পরিস্কার রাখবেন।
২৯. শিল্প মালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন।
৩০. গণমাধ্যম কর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভ‚মিকা পালন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৩১. গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দিবেন না এবং গুজবে বিচলিত হবেন না।
(সাত বছরের সাফল্য)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সহযোগী সংস্থাগুলোকে জাতীয় নীতিমালার ভিত্তিতে গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ, গবেষণা কর্মকা- পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন, কর্মসূচি সমন্বয় এবং কৃষি গবেষণার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে। দেশের সামগ্রিক কৃষি গবেষণাকে অধিকতর গতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কার্যপরিধি বর্ধিত, সুসংহত ও জোরদার করে কাউন্সিলকে অধিকতর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কাউন্সিল খাদ্য উৎপাদন ও দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও অগ্রাধিকারের আলোকে সরকারকে পরামর্শ প্রদান করে আসছে। এছাড়া কাউন্সিল কৃষি গবেষণা সিস্টেমের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের মানবসম্পদ উন্নয়নের কাজ সম্পাদন করে থাকে।
কোর গবেষণা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন
এ সময়ে কৃষি গবেষণাসহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ৭০টি কোর গবেষণা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ১৫টি জাতসহ দক্ষিণাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলে চাষাবাদের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩ জন বিজ্ঞানীকে দেশের অভ্যন্তরে পিএইচডি অধ্যয়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে। তদুপরি দেশীয় প্রশিক্ষণ, কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে মোট ১ হাজার বিজ্ঞানী/সম্প্রসারণবিদ/ কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
ধান ও ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কর্মসূচি
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ধান ও ডাল ফসলের উন্নত প্রযুক্তি, সমন্বিত শস্য উৎপাদন ও বালাইব্যবস্থাপনা, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও বিতরণ এবং ডালের সাথে উন্নত শস্যবিন্যাস প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ধান ও ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে ওই ফসলগুলোর উৎপাদন যথাক্রমে ১৭.৫% ও ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি সাপোর্ট প্রজেক্ট (Agriculter Biotechnology Support Project)
কাউন্সিল ২০০৫ সাল থেকে এ প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সরকারের অনুমোদনক্রমে ৪টি বিটি বেগুনের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ও এগুলো সম্প্রসারণের কার্যক্রম চলছে।
এশিয়ান ফুড সিকিউরিটি প্রকল্প
এশিয়ান ফুড সিকিউরিটি (আফাসি) শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ধান ও গমের প্রতিকূল আবহাওয়ার জাত উন্নয়নসহ পরিচর্যা কলাকৌশল নির্ধারণপূর্বক বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক ধান ও গমের মাঠ প্রদর্শনী এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক ধান ও গমের বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাপসহিষ্ণু গমের জাত (বারিগম-২৫, ২৬) এবং ধানের জাতসহ (ব্রিধান-৪৭, ব্রিধান-৫৫ এবং বিনাধান-৮) বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তি দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প-১
জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প (National Agriculter Technology Project (NATP) শীর্ষক প্রকল্পটির আওতায় দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দ্বারা ১০৮টি গবেষণা কার্যক্রম (শস্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, খাদ্য পুষ্টি, আর্থসামাজিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি) মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হয়েছে। এনএটিপি-১ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার মাধ্যমে ৫০টিরও অধিক সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২৯ জন বিজ্ঞানীকে বিদেশে পিএইচডি, ১০ জনকে বিদেশে পোস্ট-ডক্টোরাল এবং ৭৯ জনকে দেশে পিএইচডি অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা কার্যক্রম
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কোম্পানি আইনের আওতায় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (KGF) গঠন করা হয়। বিএআরসি কর্তৃক কৃষি গবেষণার অগ্রাধিকার নির্ধারিত হওয়ার পর কেজিএফ বোর্ড ২০০৯ সাল থেকে দুই পর্যায়ে অদ্যাবধি ১০১টি প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করে। এ কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত মসুর ও রসুনের ৩টি নতুন জাত উদ্ভাবনসহ লবণাক্ত, খরা ও পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি নির্বাচন করা হয়েছে।
কৃষি প্রযুক্তি হস্তান্তর প্রকল্প
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রযুক্তি বিশোধন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের আওতায় শস্য, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও কৃষি বনায়ন কার্যক্রমে মোট ৫৫টি প্রযুক্তি ৪৩টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উপযুক্ত প্রযুক্তির ওপর ১৬,৭৪৪ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ, ১১,৮৪০টি মাঠ দিবস আয়োজন এবং ৭৬৭টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
নীতিনির্ধারণী ডকুমেন্ট, আইন ও গাইডলাইন প্রণয়ন
কাউন্সিল বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে জাতীয় কৃষিনীতি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল আইন ২০১২, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০২৫, কৃষি গবেষণা অগ্রাধিকার ও ভিশন ডকুমেন্ট ২০৩০, নার্সারি আইন/গাইডলাইন-২০০৭, Intellectual Property Rights (IPR) Rules এবং Biotechnology and Biosafety Regulation & Act, Crop Zoning ম্যাপসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী ডকুমেন্ট প্রণয়নসহ তথ্য ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সরকারকে সক্রিয় সহায়তা করছে।
জমির উপযোগিতাভিত্তিক ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন
মাটি, জলবায়ু ও এলাকা উপযোগী ফসল নির্বাচন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশে ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। এনএআরএস প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এসআরডিআই, বিএআরআই এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বিএআরসি কর্তৃক এ ম্যাপ তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ম্যাপ অনুসরণ করে এলাকাভিত্তিক উপযোগী ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করার কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
সার এবং সারজাতীয় দ্রব্যের মান নির্ধারণ
বিগত ২০০৭ সালে থেকে হাল নাগাদ বিএআরসি কর্তৃক জৈবসার ৭০টি; রাসায়নিক সার ২টি ও চএজ: ৮টি মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং জাতীয় সার প্রমিতকরণ কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত ও দেশে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম
কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কৃষি গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের তথ্য/উপাত্ত যেমন- গবেষণালব্ধ ফলাফল/প্রযুক্তি, অর্থ ব্যবস্থাপনা, ক্রয়, মানবসম্পদ, প্রকাশনা ইত্যাদি ডাটাবেজ স্থাপনের মাধ্যমে সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং তা সরবরাহ সেবা প্রদান করে থাকে। তথ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম কার্যকরীভাবে পরিচালনা করার মাধ্যমে ICTকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে কাউন্সিলসহ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে ICT এবং MIS Cell গঠন করা হয়েছে এবং এর বাস্তবায়নের জন্য কাউন্সিলে ডাটা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কাউন্সিলে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমের (GIS) কাজ অব্যাহত আছে।
ডিজিটাল ডিসপ্লে কেন্দ্র স্থাপন
কৃষির ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাফল্যগাথা, কৃষি উপকরণ, ফসলের জাত, উৎপাদন কলাকৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণবিদ, কৃষকসহ দেশি-বিদেশি পরিদর্শকদের মাঝে বাস্তব ধারণা দেয়ার মাধ্যমে কৃষি বিষয়ে আগ্রহ তৈরি এবং উদ্বুদ্ধকরণে বিএআরসির চত্বরে জাতীয় কৃষি প্রদর্শনী কেন্দ্র (NADC) স্থাপন করা হয়েছে, যা কৃষি বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
ফসলের জাত ছাড়করণ, বীজ উৎপাদন ও মান নিশ্চিতকরণ
বিগত ৭ বছরে এই কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৭০টিরও বেশি জাত ছাড়করণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
বৃহত্তর বরিশাল ও সিলেট জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা
দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণকল্পে কিছু এলাকার পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। লাগসই কৃষি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধি করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়ন করাই এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য।
গবেষণা-সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সমন্বয়
গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কাউন্সিলের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কৃষি কারিগরি সমন্বয় কমিটি (National Agricultural Technical Coordination Committee-NATCC গঠিত আছে। এই কমিটি বিভিন্ন কৃষি কারিগরি কমিটির (Agricultural Technical Committee) কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে।
আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা
কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সম্প্রতি আমেরিকা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ভুটান, ভিয়েতনামের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা সংস্থাসমূহ যেমন- (IRRI, CIMMYT, World Fish ইত্যাদির সাথে সহযোগিতামূলক কর্মকা- জোরদার করা হয়েছে। এ সহযোগিতার মাধ্যমে জার্মপ্লাজম এবং দক্ষতা উন্নয়ন ও কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ে প্রতিটি দেশ উপকৃত হচ্ছে।
নিরাপদ ও সুষম খাবার গ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ‘ফুড প্লেট’ তৈরি
পুষ্টি জ্ঞানের প্রচার, প্রসার ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে জন সচেতনতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিট একটি সচিত্র ‘ফুড প্লেট’ তৈরি করেছে। সুস্থ, সবল থাকতে ও অসুখ-বিসুখ হতে রক্ষা পেতে সুষম খাবার গ্রহণের অত্যাবশ্যকতা ও নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে এ ‘ফুড প্লেট’ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিতরণ ও প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং যা ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
অন্যান্য প্রকাশনা
গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য জমির স্থানীয় তথ্যের ভিত্তিতে সার সুপারিশমালা (Fertilizer Recommendation Guide-2012) প্রণীত হয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ফসল নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ‘দক্ষিণাঞ্চলের উপযোগী কৃষি প্রযুক্তি’ শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত এবং এগুলোর পরিচিতি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সমন্বয়ে ‘Plant vatieties developed by NARS institutes and Agrictural universities’ শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে প্রসারের লক্ষ্যে ‘Hand book of Agricultural Technology’ শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছে। পতিত জমির ব্যবহারের লক্ষ্যে বৃহত্তর বরিশাল ও সিলেট জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা বিষয়ে ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএআরসি কর্তৃক Mature Technologies of the NARS Institutes শীর্ষক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
*সংকলিত, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫; www.barc.gov.bd
একই পণ্য থেকে ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধ পেতে কার না ভালো লাগে! আগেকার দিনে পণ্যের বহু ব্যবহারের কৌশল জানা ছিল না। পুষ্টি এবং মুখরোচক খাবারের কথা ভেবে আজকাল বিলাসী গৃহিণীদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। এর পেছনে মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোর অবদান সবচেয়ে বেশি। এখন শহরের পাশাপাশি গ্রামেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে যে পণ্যগুলোর নাম উচ্চারিত হয়; এর মধ্যে আলু শীর্ষস্থানে। কেউ কেউ মনে করেন, আলুর পুষ্টিমান কম। আসলে এ ধারণা ভুল। কারণ পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, আলুতে ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি রয়েছে। অথচ চালে মোটেও নেই। এছাড়া ভিটামিন বি, শর্করা, আমিষ, জিংক, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং আয়রন তো আছেই। সে সাথে আছে মূল্যবান উপাদান ওমেগা-৩ এবং অ্যামিনো এসিড। অপরদিকে চর্বির পরিমাণ চালের তুলনায় অনেক কম এবং গমের পাঁচ ভাগে এক ভাগ। কিডনি রোগীর জন্য এর প্রোটিন বেশ উপকারী। আলু স্কার্ভি ও রিউমেটিক প্রতিরোধী। ডায়রিয়ার ক্ষয় পূরণে কাজ করে। পাশাপাশি শরীরের ওজন বাড়াতে সহায়তা করে। ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক চাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। আলু একমাত্র সবজি, যা সব ধরনের মাছ ও মাংস রান্নার সাথে তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তাই হাতে কাছে পাওয়া এ সবজির তৈরি খাবারগুলোর পরিচয় জেনে নেয়া দরকার।
আলুর পাকোরা উপকরণ : আলু ১টি, চালের গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, বেসন ১ কাপ, তেল ৪ টেবিল চামচ, জিরা গুঁড়া ১ চা চামচ, ধনেপাতার কুচি ২ চা চামচ, পানি আড়াই কাপ আর লবঙ্গ ও লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমেই খোসা ছাড়িয়ে আলু ছোট ফালি করে কেটে নিতে হয়। এরপর একটি পাত্রে চালের গুঁড়া এবং বেসন রেখে এর সাথে জিরা গুঁড়া ধনেপাতার কুচি, লবঙ্গ ও লবণ ভালোভাবে মিশাতে হবে। এবার ফ্রাইপ্যানে তেল দিয়ে চুলায় গরম করে তা মিশ্রিত উপকরণগুলোর সাথে মিশিয়ে অল্প পানি দিয়ে ঘনমিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর কেটে রাখা আলুর একটি ফালি মিশ্রণে ডুবিয়ে ডুবোতেলে উল্টেপাল্টে ভাজতে হয়। ভাজার কাজ ততোক্ষণ পর্যন্ত করতে হবে যখন বাদামি রঙ ধারণ হবে। এভাবেই হয়ে যাবে আলু পাকোরা।
আলুর চিপস উপকরণ : আলু ৩০০ গ্রাম এবং তেল ৩০০ মিলিলিটার।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু পরিষ্কার করে ধুয়ে পাতলা করে কেটে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে চালুনিতে রেখে পানি ঝরিয়ে ডুবোতেলে বাদামি রঙ করে ভাজতে হবে। ভাজা শেষ হলে একটি পাত্রে রেখে পরিমাণমতো লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করা যাবে।
আলুর কাটলেট উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, ডিম ১টি, পাউরুটির স্লাইস ১টি, পাউরুটির গুঁড়া ১ কাপ, পেঁয়াজ বাটা ১ কাপ, ময়দা ১ টেবিল চামচ, কাঁচামরিচ ১টি এবং ধনেপাতা, তেল ও লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : আলুগুলো সিদ্ধ করার পর খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে পিষে নিতে হয়। এবার একটি পাত্রে ময়দা, পেঁয়াজ, মরিচ কুচি, ধনেপাতা কুচি এবং লবণ দিয়ে আলু মাখিয়ে নিতে হবে। এরপর কাটলেটের পিস তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ডিম বিট করে নিতে হবে। কাটলেটের পিস ডিমে ডুবিয়ে এবং পাউরুটির গুঁড়ায় মেখে ফ্রাইপ্যানে গরম তেলে ভাজতে হবে। এরপর পরিবেশন।
আলুর লুচি উপকরণ : আলু ৬ টি, গমের আটা ২ কাপ, গরম মশলা ২ চা চামচ, এবং লবঙ্গ গুঁড়া, তেল ও লবণ পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু সিদ্ধ করে আটার সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হয়। এরপর লুচির মতো তৈরি করে সুজির মধ্যে গড়াগড়ি দিয়ে ডুবোতেলে ভাজতে হয়। এভাবেই হয়ে যাবে আলুর লুচি।
আলুর সিঙ্গাড়া উপকরণ : আলু ২৫০ গ্রাম, মাংসের কিমা ১৫০ গ্রাম, আদা ২টি (ছোট টুকরো), পাঁচফোড়ন ১ গ্রাম, পেঁয়াজ ৩০ গ্রাম, মরিচ ৩টি, ময়দা ৬০০ গ্রাম, লবণ ১০ গ্রাম, তেল ৫০ মিলিলিটার, পানি ৭০ মিলিলিটার, সেইসাথে কয়েকটি তেজপাতা।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু ছোট করে চারকোনা আকারে কেটে নিতে হয়। এরপর পেঁয়াজ কুচি, আদা, মাংসের কিমা, লবণ ও তেজপাতা সিদ্ধ করে ফ্রাইপ্যানে তেল গরম করে পাঁচফোড়ন দিয়ে আলুসহ ভালোভাবে ভাজতে হবে। আলু পুরোপুরি সিদ্ধ না হলে পানি দিয়ে আরো কিছুক্ষণ ভেজে নিতে হবে। ময়দার সাথে লবণ ও তেল মেখে আধাঘণ্টা রাখতে হবে। পরে ময়দার কাই ছোট টুকরো করে লুচির আকারে বানিয়ে ছুরি দিয়ে দুই ভাগ করতে হয়। প্রতি ভাগ লুচিপানের খিলির মতো ভাঁজ করে ভেতরে আলু ও মাংসের তরকারি ভরে নিয়ে খোলামুখে পানি লাগিয়ে মুখ বন্ধ করতে হবে। এরপর ডুবোতেলে ভেজে নিলেই মুখরোচক সিঙ্গাড়ার স্বাদ নেয়া যাবে।
আলুর পুরি উপকরণ : আলু ৩০০ গ্রাম, ময়দা ৩০০ গ্রাম, ঘি অথবা ডালডা কিংবা সয়াবিন তেল ১৫ মিলিলিটার, লবণ ৩ গ্রাম।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে চটকিয়ে নিতে হয়। এরপর ময়দা, লবণ ও সয়াবিন তেল একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এ মিশ্রণের কিছু অংশ নিয়ে বলের মতো করে প্রতিটি কেন্দ্রে চটকানো আলু ঢুকিয়ে দিতে হবে। পরে বলগুলোকে রুটির মতো বেলে চ্যাপ্টা গোলাকার পুরি তৈরি করে ডুবোতেলে ভাজতে হবে। এরপর অতিরিক্ত তেল ঝরিয়ে নিয়ে পরিবেশন করা যাবে।
আলুর চপ উপকরণ : আলু ৬০০ গ্রাম, টোস্টের গুঁড়া ৩০ গ্রাম, লবণ ৫ গ্রাম, আদা ৫ গ্রাম, রসুন ১০ গ্রাম, কাঁচামরিচ ২০ গ্রাম, গোলমরিচের গুঁড়া ৫ গ্রাম, মাংসের কিমা ১০০ গ্রাম, পেঁয়াজ ৬০ গ্রাম, পুঁদিনাপাতা ২ গ্রাম, ফেটানো ডিম ১০০ গ্রাম, লবণ ৫ গ্রাম এবং পরিমাণমতো তেল।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে ভালোভাবে চটকে নিতে হবে। মাংসের কিমার সাথে এক কাপ পানি ও তেজপাতা দিয়ে সিদ্ধ করতে হবে। ফ্রাইপ্যানে সামান্য তেল দিয়ে পেঁয়াজ ও মরিচের কুচি ভেজে, এর সাথে সিদ্ধ কিমা দিয়ে দিতে হয়। এরপর আদা বাটা ও পুঁদিনাপাতা দিয়ে কিমাকে শুকনো করে ভাজতে হবে। পরে টোস্টের গুঁড়া, ডিম ও লবণ ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। চটকানো সিদ্ধআলু চপের আকারে তৈরি করে, এর ভেতরে কিমা ঢুকিয়ে দিতে হবে। পরে ফেটানো ডিমে ডুবিয়ে টোস্টের গুঁড়াতে গড়াগড়ি দিয়ে ডুবোতেলে এমনভাবে ভাজতে হবে যেন বাদামি রঙ ধারণ করে। এরপর চুলা থেকে উঠিয়ে হালকা গরম অবস্থায় খেলে বেশ লাগবে।
আলুর চটপটি উপকরণ : আলু ৬০০ গ্রাম, মটরশুঁটি ৬০০ গ্রাম, তেঁতুল ১০০ গ্রাম, ডিম ২টি, শসা ১০০ গ্রাম, খাবার সোডা ১ চা চামচ আর জিরা, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ এবং ধনেপাতা পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : মটরশুঁটি ধুয়ে ১০-১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। ভেজানো মটরশুঁটি ভালোকরে সোডার পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে। আলু ও ডিম সিদ্ধ করে আলাদাভাবে ছোট করে কেটে নিতে হয়। জিরা ও মরিচ ভেজে গুঁড়া করে নেয়ার পাশাপাশি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা কুুচি করার কাজ সেরে ফেরতে হবে। এছাড়া তেঁতুল ধুয়ে, পরে পানিতে ভিজিয়ে রস বের করে নিতে হবে। এবার উপকরণগুলো একসাথে মিশিয়ে চুলার আগুনে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই হয়ে যাবে চটপটি। এবার তেঁতুলের রস, কাঁচামরিচ, আলুসহ অন্য মসলা দিয়ে রুচিমতো নিজে খাওয়া এবং অপরকে পরিবেশন করা।
আলুর মোগলাইপরোটা উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, আটা ৫০০ গ্রাম, সয়াবিন তেল ২৫০ মিলিলিটার, ডিম ৩টি আর পেঁয়াজ, লবণ, কাঁচামরিচ এবং ধনেপাতা পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু সিদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে, এরপর চটকিয়ে নিতে হয়। চটকানো আলুর সাথে আটা ও লবণ ভালোভাবে মিশাতে হবে। দরকার হলে পানি ব্যবহার করা প্রয়োজন। এবার ডিম, পেঁয়াজ কুচি ও ধনেপাতা দিয়ে মামলেট বানিয়ে তা ভেঙে ঝুরঝুরে করে, সেইসাথে চটকানো আলু ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। এ মিশ্রণ থেকে পরিমাণমতো নিয়ে রুটি তৈরি করে ফ্রাইপ্যানে গরম তেলে ভাজতে হবে। তাহলেই হয়ে যাবে আলুর মোগলাই পরোটা।
আলুর সবজিখিচুরি উপকরণ : আলু ৫০০ গ্রাম, চাল ১০০ গ্রাম, ডাল ১০০ গ্রাম, গাজর অথবা মিষ্টিকুমড়া ৫০০ গ্রাম, আদাবাটা ১ চা চামচ, ডিম ১টি, তেল ৩০ মিলিলিটার, লবণ ও হলুদের গুঁড়া পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : আলু এবং গাজর ধুয়ে কুচি করে কেটে নিতে হয়। এর সাথে চাল ভালোভাবে ধুয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে গরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ও মরিচের ফালি ভেজে নেয়ার কাজ সেরে ফেলতে হবে। পেঁয়াজ ও মরিচ বাদামি রঙ ধারণ করলে আলু, চাল, ডাল এবং গাজর সবগুলো তেলের মধ্যে ঢেলে, সেইসাথে আদা, হলুদ, লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়তে হবে। এতে পরিমাণমতো গরম পানি দিতে হয়, যেন সবটুকু সিদ্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধ হলে ডিম ভেঙে ফেটে দিতে হবে। কিছুক্ষণ রেখে দিলেই হয়ে যাবে আলুর সবজি খিচুরি।
এছাড়া আলুভাজি, আলুর দম, আলুর ঝোল, ভর্তা, চাটনি, লাবড়াও নিরামিষ সবার পরিচিত। এর পাশাপাশি আধুনিক রেসিপিও আছে; যেমনÑ আলুর পোস্ত, আলুর চাট, কাঠি কাবাব, দোপেঁয়াজো, টোস্ট, বার্গার, টিক্কি এবং দোলমা। আবার মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন- আলুর পায়েশ, আলুর দই, বুন্দিয়া, রসমালাই, জিলাপি, বরফি, হালুয়া, কালোজাম, পিঠা, মোরব্বা, জর্দাসহ আরো অনেক।
এক খাবার বার বার খেতে মন চায় না তবে স্বাদ পরিবর্তন করে খেলে ভালো লাগে। আর তা যদি হয় কম খরচের তাহলে তো কথাই নেই। তাই আসুন, আলুর তৈরি এসব রকমারি খাবার খেয়ে দেহে পুষ্টি বাড়াই। সে সাথে ভাতের চাপ কমাই।
নাহিদ বিন রফিক*
*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বরিশাল; মোবাইল নম্বর : ০১৭১৫৪৫২০২৬; ই-মেইল :tpnahid@gmail.com
শীতের কৃষি
গাজী মাজহারুল ইসলাম অপু*
শীতকাল নিশ্চিত মৌসুম অনেক ফসলের জন্য
অধিক ফসল ফলিয়ে আমার দেশকে করবো ধন্য।
ফুলকপি বাঁধাকপি লাউ মুলা গাজর আছে কত
টমেটো বেগুন শালগম ওলকপি শাকসবজি শিম শত শত।
শুকনা ভাব আছে বলে এ মৌসুমে সেচ দিতে হয়
সেচ না পেলে ভালো ফলন তাতে হওয়ার নয়।
জৈবসার রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় দেবে
সময় মতো যত্নআত্তিতে অধিক ফলন নেবে।
শাকজাতীয় ফসল আবাদ একের অধিক ভাই
একই জমিতে তিন-চারবার আবাদ করলে পাই।
স্বাদে গন্ধে পুষ্টিতে ভরা শীত মৌসুমের ফসল
গোলা ভরে নাও তোমরা খাটিয়ে বিশেষ কৌশল
ডাল ফসল তেল ফসল আরও কত আছে
শ্রম দিয়ে ঘাম বিনিয়োগে পাবে হাতের কাছে।
গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করো বোরো ধানে ভাই
কম খরচে বেশি লাভ এর তুলনা নাই।
আইপিএম আইসিএম প্রয়োগ করো ক্ষেতে
পরিবেশবান্ধব কৃষি দিয়ে উঠব সবাই মেতে।
অপকারি পোকামাকড় ধ্বংস কর তবে
বন্ধু পোকা বাঁচিয়ে রাখলে বেশি ফলন হবে
হাত পরাগায়ন পরিচর্যা আগাছা বাছাই করে
নিশ্চিত ফলন তুলে নাও গোলা কিংবা ঘরে
মোটেও কর না হেলাফেলা শীতের মৌসুম এলে
যত পার ফলিয়ে নাও অলস সময় ফেলে।
কৃষি দিয়ে সমৃদ্ধ করব আমাদেরই দেশ
সুখে শান্তিতে টইটুম্বুর সোনার বাংলাদেশ॥
কৃষিতে স্বাধীনতা
মো. জুন্নুন আলী প্রামাণিক**
স্বাধীনতা কৃষককে দিয়েছে মুক্ত কর্ম শক্তি,
পরাধীন নির্যাতনে নীরব কষ্ট থেকে মুক্তি।
চারিদিকে বিকশিত ফসল মাঠ স্নিগ্ধ রূপে,
আধুনিক চাষাবাদ নির্বিঘ্নে চলে নানা ধাপে।
নির্বিচার অত্যাচার মিটিয়ে গেছে আর নেই,
ঘাতকেরা পরাজয়বরণ করে জব্দ তাই।
অনাহূত অন্যায়ের ছোবল মেরে ক্ষতি করে,
হিংসার লেলিহান শিখায় শান্তি পায় পুড়ে।
উদ্ভিদের ছায়াময় শাখায় আজ পাতা নড়ে,
নির্মলতা বিস্তরণে স্বাধীন বায়ু ছোটে উড়ে।
সমৃদ্ধির জোয়ারের চলন্ত স্রোতে নব সাড়া,
ফুলফল নির্দ্বিধায় রূপের মাঝে হয় সেরা।
খাদ্যশস্য ফলানোর সোনালি আশা মনে ফোটে,
সারা দিন উৎসাহে চঞ্চল চাষি মাঠে খাটে।
স্বাধীনতা সুপথের সন্ধান দিয়ে ডাকে জোরে,
সারেসিক্ত মৃত্তিকার সবুজ বুক শস্যে ভরে।
গাছগুলো বাড়ার প্রেরণা পেয়ে শুধু বাড়ে,
বণ্যপ্রাণী বনানীর আড়ালে ভীতিশূন্য ঘরে।
বৃহত্তর ক্ষুদ্রতর খামার গড়ে মুগ্ধ চাষি,
কৃষি ক্ষেত্র উন্নয়ন সান্নিধ্যে ফল দেয় বেশি।
অনাহার অভাবের দুর্দিনগুলো গেছে সরে,
মাছে ভাতে বাঙালির সান্ত¡না জোটে স্বস্তি ফেরে।
স্বাধীনতা কৃষকের সহায় শক্তি ফিরে দেয়,
প্রযুক্তির প্রগতির ধারায় চাষি ধন্য হয়।
মৌসুম যখন শান্ত
মৌসুম যখন সহজ সরল শান্ত মেজাজে থাকে,
আকাশে বাতাসে জমিনে তখন মিষ্টি পাখিরা ডাকে।
বিচিত্র ফসলে মাঠের বুকটি শক্তি সান্ত¡না পায়,
কৃষান-কৃষানি সার্থক শ্রমের প্রাপ্তি দু’হাতে লয়।
সময় মতন বৃষ্টির জোগানে জমি সজাগ হয়,
সমস্যা থাকে না চাহিদা পূরণে সব ফসলে জয়।
শীতল বাতাস সোহাগে উড়িয়ে দিগি¦দিক ছোটে,
সবুজ হাসির শখের আবাদ পূর্ণ সকল মাঠে।
সুযোগ সুবিধা এগিয়ে চলার পথ ধরিয়ে আসে,
ফলন অধিক নিয়ম মানায় কৃষি বারটি মাসে।
চাঁদনি আকাশ রাতেরবেলায় জ্বলে আলোর মতো,
স্বচ্ছতা প্রকাশে সুনীল শূন্যের রূপ লহরী শত।
তারকাগুলোর ছড়ানো আলোক রশ্মি মাটিতে পড়ে,
অনন্ত অসীম সীমানা তখন দৃষ্টিসীমার ধারে।
স্বাগত জানার ঘাটতি থাকে না চাষি নিমগ্ন ক্ষেতে,
ওষুধ সারের অভাব হয় না সুষ্ঠু উপায়ে দিতে।
অনেক প্রকার সবজি জমিতে নিজ গতিতে বাড়ে,
দায়িত্বে বিশুদ্ধ রাখলে সেসব পুষ্টি জোগায় জোরে।
বন্যার কবলে খরার প্রকোপে বাধা বিপত্তি হলে,
উপায় পাবার অনেক সুযোগ আছে কৃষি অফিসে গেলে।
সহায় জোগাড় মৌসুমি বায়ুর সেবা যখন ভালো,
উন্নত জাতের ফসল তখন ছড়ায় সোনালি আলো॥
*গ্রাম-পূর্ব ধুপতি, ডাকঘর-ধুপতি, সদর, বরগুনা। **গ্রাম-বিদ্যাবাগিশ, ফুলবাড়ী, জেলা-কুড়িগ্রাম লঁহহঁহ১৯৬২@মসধরষ.পড়স
ফল হলো নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বাধার। অন্য কথায় ফল বলতে আমরা বুঝি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস, আপেল, আঙুর আর লেবু এবং কমলালেবুকে। কেননা, চোখের সামনে এদের প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনেবাদাড়ে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এদের পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিরামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। অতীতে ফলের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি ছিল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় সেসব ফলের অনেকই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনাদিকাল ধরে যেসব ফল এদেশে চাষ হয়ে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশি ফল। এ পর্যন্ত এ দেশে মোট ১৩০টি দেশি ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। তবে সেসব ফলও যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। বাকি ৭০টি ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, লিচু, কুল, লেবু, আনারাস, কলা ও পেঁপে এ ১০টি এ দেশের প্রধান দেশি ফল।
দেশি ফল কোনোগুলো? এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন বটে। সহজে উত্তর হলো যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভূখণ্ডে বা এ অঞ্চলে সেসব ফলকে আমরা দেশি ফল বলতে পারি। তর্কটা সেখানেই, ফল তো দেশ চেনে না। তার উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি যেখানে সেখানে সে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর আগে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। যেসব ফল অনায়াসে এ দেশে জন্মে ও ভালো ফলন দেয় সেসব ফলকে এখন আমরা দেশি ফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। দেশীয় এসব ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল একরকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো ফলে। সাধারণত এসব ফলের গাছের তেমন কোনো সার সেচ দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাও অনেক দেশি ফলের গাছকে সহজে মারতে পারে না। এ যে দেশি ফলের ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, তা কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই।
দেশি ফলের আর একটা সুবিধা হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফল গাছের মতো এসব ফল বা ফল গাছে অত বেশি রোগ পোকার আক্রমণ হয় না। তবে দেশি ফলে সবচেয়ে বেশি মেলে পুষ্টি। দেশি ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনও বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমাদের দেশে কলা, কুল, নারিকেল ছাড়া প্রায় সব ফলই জন্মে গ্রীষ্ম বর্ষার। কিন্তু দেশি অনেক ফল আছে যেগুলো অন্য মৌসুমেও জন্মে। তাই সারা বছর ধরেই বলতে গেলে ফল খাওয়ার একটা সুবিধা মেলে। শুধু পুষ্টি বা প্রাপ্যতার দিক দিয়ে নয়, এখন অনেক দেশি ফলের দাম বিদেশি ফলের চেয়ে কম নয়।
আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারিকেল ও কুল এ ৯টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত দেশি ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। অনেকেই হয়ত চিনি আরও কিছু অপ্রধান ও স্বল্প আকারে চাষকৃত ফল সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, খেজুর, তেতুঁল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙি, তরমুজ, পেয়ারা ফলকে। কিন্তু অনেকেই চিনি না লুকলুকি, ডেউয়া, ডেফল, করমচা, জংলিবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, তিনকরা, সাতকরা, আদা জামির, জামির, মনফল, অরবরই, আঁশফল, তারকা ফল, গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, ডালিম, চালতা, ডুমুর, বৈঁচি, টকআতা, পানিফল, সিঙ্গাড়াফল, জিলাপিফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটিফল, বকুল, ফলসা, চুকুর, পাদফল, চিকান, পানকি চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, বিলিম্বি, ডালিম, ক্ষুদিজাম ফলকে। এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টি মানে এমনকি স্বাদ বৈচিত্র্যে এসব ফলের কোনো তুলনা হয় না। কেননা এক এক ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে। এরই মধ্যে অনেক দেশি ফলকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই চাষের উদ্যোগ না নিলে বন থেকে বুনো ফল হিসেবেই হয়ত তা এদেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।
তবে এখন যেটা জরুরি এসব জার্মপ্লাজমকে দেশের মধ্যে টিকিয়ে রাখা। বিলুপ্ত হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগে একটি ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে, গবেষণাও চলছে সেখানে। ১৯৯১ সাল থেকে তরুণ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত বের করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২৫টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৪টি, জাম্বুরার ৫টি, লিচুর ৪টি, তেঁতুল ৩টি, কামরাঙা ৩টি, জলপাই, লটকন, আমলকী, ডুমুর, অরবরই, কদবেল, কাঁঠাল ও আমড়ার ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি জাত রয়েছে। এ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার চারা ১৯৯১ সাল থেকে VFFP CARE-SHABGE এর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে ৯৯৭টি মাতৃগাছের বাগান তৈরি করে দিয়েছে এবং ২০০২ সাল থেকে World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে ৭৯৫টি মিশ্রফলের বাগান স্থাপন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ করে YRFPProject-DAE, BRAC, PROSHIKA, CARITAS, BADC, DAE, CDCS, IDEA, CHEVRON, PARI, fh Bangldesh, NEElachol, Paragon group, MATI, CARE, FAO,UNDP I World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে অসংখ্য বংশানুক্রমিক (PEDIGREE) মাতৃগাছ কৃষকের দোরগোড়ায় সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। বংশীয় মাতৃগাছের ক্ষেত্রে এ সেন্টারটি এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত, অনন্য।
বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত লবণাক্ত মাটি, পাহাড়ি এলাকায় অম্লীয় মাটি, মঙ্গা এলাকায় বেলে মাটি ও বন্যা কবলিত উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটিতে জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক মুক্তায়িত ফলের অভিযোজন যাচাইয়ের ওপর গবেষণা করেছে। এ গবেষণাটি ড্যানিডার অর্থায়নে বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৬টি জাতের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, উত্তরাঞ্চলে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৮টি জেলার ১৫টি উপজেলার প্রত্যেকটিতে ৩০ শতাংশ জমির ওপর ১২৯৬০টি চারার সমন্বয়ে ৬০টি মিশ্রফল বাগান তৈরি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডাপটেশন ট্রায়াল করা হয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটেও গবেষণা চলছে। এ ইনস্টিটিউটেও ফলের বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত নিবন্ধন করেছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ১৫টি, কাঁঠাল ৩টি, কলা ৪টি, পেঁপে ১টি, পেয়ারা ২টি, বাতাবিলেবু ৩টি, লেবু ২টি, নারিকেল ২টি, আমড়া ১টি, আমলকী ১টি, বিলাতি গাব ১টি, সফেদা ৩টি, কুলের ৪টি, কামরাঙা ২টি, তেঁতুল ১টি, লিচু ৫টি, জামরুল ২টি, জলপাই, কদবেল, বেলের ১টি করে জাত। এসব জাতগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রসারণ হয়ে আসছে।
সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এ বৃক্ষরোপণ মৌসুমে বিলুপ্ত প্রায় অপ্রচলিত ফলের অন্তত একটি চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তা হলে হয়তো খুব অল্প সময়েই জেগে উঠতে পারে হারানো ফলের হারানো রাজ্য, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক ফল প্রজাতি। তবে তার আগে যেটা দরকার সেটা হল বিলুপ্ত প্রায় ফলগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা, যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে সেগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা। আর যেগুলো অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে আছে তাদের উপড়ে তোলার পথ খোঁজা।
শুধু সরকার দেশি ফল প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিলে তা পরিপূর্ণ হবে না, এজন্যই দরকার দেশের সব জনগণের সম্মিলিত কার্যকর অংশগ্রহণ। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই দেশের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দেশি ফলের উৎপাদন ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। সুতরাং স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর আমাদের বর্ণিল দেশীয় ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর বাড়িয়ে তুলতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে আরও মজবুত ও গতিশীল, দেশবাসী পাবে খাদ্যে পুষ্টিমানসম্পন্ন একটি ভবিষ্যৎ।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম*
ড. মো. শামছুল আলম (মিঠু)**
*উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও পরিচালক, জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি; **সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, ময়মনসিংহ
পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটের ব্যবহারিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিবেচনা করে পাটকে ‘সোনালী আঁশ’ বলে অভিহিত করা হয়। পাট ও পাট জাতীয় আঁশ ফসল সারা বিশ্বে তুলার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আঁশ ফসল হিসেবে অবস্থান করছে। আট থেকে ১০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও এ জাতীয় আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৫-৬% আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। এ ফসল নিজেই মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭.৫-৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১০-১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প যেমন প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদি কাজের সাথে জড়িত।
বাংলাদেশে প্রধানত দুই প্রকার পাট ফসল চাষ হয়। একটি তোষা ও অন্যটি দেশি বা সাদা পাট। দেশি পাটের পাতার স্বাদ তিতো এবং ফলগুলো গোলাকার এবং খাঁজকাটা। এ পাট নিচু জমিতে উৎপাদন করা যায় এবং পরিপক্ব অবস্থায় কয়েক ফুট পানির নিচে থাকতে পারে। তবে তোষা পাটের পাতার স্বাদ তিতো হয় না এবং এর ফল লম্বা ক্যাপসুলের মতো হয়, আগা চোখা। এ পাট কোনো অবস্থাতেই গোড়ায় পানি জমা সহ্য করতে পারে না তাই নিচু জমিতে এ পাট চাষ করা য়ায় না ।
সাধারণত দেশি পাট ১৫ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এবং তোষা পাট ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত বপন করার উপযুক্ত সময়। তবে জাতভেদে এ সময়ের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। যদি কোনো পাটের জাত তার উপযুক্ত সময় এর চেয়ে আগাম বপন করা হয় তবে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত ফলন কমে যায়। যখন পাটের জাত সময় মতো বপন করা হয়, তখন সাধারণত ফুল আসে আগস্ট মাস, অর্থাৎ তখন দিনের আলোর দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করে। পাট হলো একটি খাটো দিন দৈর্ঘ্য ফসল। তাই পাট ফসলও অন্যান্য স্বল্প দৈর্ঘ্য দিনের ফসলের ন্যায় ফটো পিরিয়ড (আলোক দৈর্ঘ্য) সংবেদনশীল।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, খরা বা অন্য কোনো বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো পরিবেশে পাট চাষ করলে, সেই পাট ফসলে আগাম বা অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল চলে আসে। নিচু জমিতে বপন করা পাটে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগাম বৃষ্টি/বন্যার সময় যখন চাষিরা আগাম পাট বপন করে অর্থাৎ উপযুক্ত সময়ের আগেই, তখন ওই পাট ফসলের জমিতে ১-২ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন গাছেই ফুল দেখা দেয়। বিশেষ করে এ আগাম ফুল দিনের স্বল্প আলোক দৈর্ঘ্যরে তারতম্যের জন্যই হয়ে থাকে।
আগাম ফুল আসার মূল কারণগুলো হলো-
১. পাট জাতের উপযুক্ত সময়ের পূর্বে বপন করা ।
২. লম্বা খরা, শুষ্ক বায়ু প্রবাহ, কোনো কারণে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, মাটির দুর্বল উর্বরতাশক্তি, জলাবদ্ধতা, মেঘাচ্ছন্ন-আবহাওয়া, দিনরাতের তাপমাত্রার পার্থক্য খুবই কমে যাওয়া ইত্যাদি।
আগাম ফুল পাট ফসলের ওপর প্রভাব-
১. পাটের গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
২. শাখা-প্রশাখা জন্মানো শুরু হয়।
৩. খুবই দ্রুততার সাথে ফলন ও আঁশের মান খারাপ হয়।
বাংলাদেশে মার্চের শেষে দিনের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ১২ ঘণ্টা এবং এপ্রিলের মাঝা মাঝি অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল এ দৈর্ঘ্য হয় ১২.৫ ঘণ্টার ওপরে। মার্চের শেষে দেশি এবং মধ্য সময়ে তোষা পাট জাত বপন করলে অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল আসার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। অনেক সময় মাঠের মধ্যে কিছু গাছে এদিক সেদিক আগাম ফুল দেয়া যায়। এটা আঁশ উৎপাদনের জন্য তেমন প্রভাব ফেলে না। কারণ আগাছা পরিষ্কার বা গাছ পাতলাকরণের সময় সেগুলো তুলে ফেলা হয় অথবা এ অবস্থাতেই বাড়তে দেয়া যায় মধ্য আগস্ট পর্যন্ত ফসল প্রয়োজনীয় ফুল আসা শুরু হয়। এ সময় দিনের দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করে এবং কমতে কমতে ১২.৫ থেকে ১২ ঘণ্টায় পৌঁছায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত দেশি ও তোষা (আঁশ উৎপাদনের জন্য) পাটের জাত ও প্রকৃত বপন সময় ছক-১ এ দেখান হলো।
পাটের দেশি তোষা উভয় জাতই স্বল্প দিন দৈর্ঘ্যরে ফসল। দিন দৈর্ঘ্য ১২.৫ ঘণ্টা বা তার নিচে হলেই পাট ফসলে আগাম ফুল আসবে। লম্বা দিন দৈর্ঘ্য যেমন ১২.৫ ঘণ্টা বা তার বেশি হলে ফুল আসা বিলম্বিত হয়। দিন দৈর্ঘ্য ১০-১২ ঘণ্টা হলে ৩০-৩৫ দিন বয়সের যে কোনো পাট গাছে ফুল চলে আসে। এরূপ দিন দৈর্ঘ্যর প্রভাব দেশি পাটের চেয়ে তোষা পাটে বেশি পরিলক্ষিত হয়।
পূর্বে দেখা গেছে, দেশি জাত সি-৬ এবং ডি-১৫৪ যদি মধ্য বা শেষ মার্চের পূর্বে বপন করা হতো তবে আগাম ফুল দেখা দিত এবং তোষার জাত ও-৪ যদি মধ্য এপ্রিলের পূর্বে বপন করা হতো তবে অপরিপক্ব ফুল দেখ দিত (আহমেদ, ১৯৮৯)। বাংলাদেশে মার্চের শেষ পর্যন্ত দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ ঘণ্টা থাকে এবং এটা মধ্য এপ্রিলের সময়েই বৃদ্ধি পেয়ে ১২.৫ ঘণ্টার ওপরে চলে যায়। তাই দেশি পাট মার্চের শেষ সময় থেকে এবং তোষা পাট মধ্য এপ্রিল থেকে বপন শুরু করলে এ অপরিপক্ব আগাম ফুল এর প্রভাব থাকে না। যদিও ফসলের মাঠে এদিক-সেদিক কিছু গাছে ফুল দেখা দিলেও তা আঁশ উৎপাদনে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না।
অপরিপক্ব বয়সের ফুলের জন্য দায়ী বিষয়গুলো
১. যেহেতু পাট স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্য সহিষ্ণু ফসল, তাই দেশি পাটের কিছু জাত মধ্য-মার্চের পূর্বে এবং কিছু জাত শেষ মার্চের পূর্বে বপন করলে আগাম ফুল দেয়। তেমনি তোষার ও-৪ জাতটি যদি মধ্য এপ্রিলের পূর্বে বপন করা হয় তবে গাছে ফুল আসে।
২. তোষা জাতের পাটের ফসলের শতকরা কিছু গাছ অপরিপক্ব অবস্থায় ফুল দেখা দিয়ে থাকে। তবে সেগুলো জাতের সাথে কৌলিক বিশুদ্ধতায় ভিন্ন হয়, সেগুলো পাতার চেহারা দেখে চেনা যায় আবার অনেক সময় পার্থক্য করাও কঠিন হয়। এগুলো সাধারণত লোকাল জাতের সাথে বা বীজ উৎপাদনের সময় স্বল্প দূরত্বে থাকায় ক্রস পলিনেশনের ফলে তৈরি হয়ে থাকে। এ রকম অনেক সময় প্রজনন বীজের মধ্যেও পাওয়া যায়।
৩. উচ্চ উর্বরতা ও আর্দ্রতা থাকা, মাটিতে পাট বীজ বপন করলে স্বাস্থ্যগত কারণেই গাছের জন্ম ও বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং সাথে সাথে আগাম ফুলও দেখা দেয়, যা ক্রিটিক্যাল ফটোপিরিয়ডে পরে বপন করলে দেখা যায় না।
বোর্স (১৯৭৪-৭৬) এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, দেশি ও তোষা উভয় পাটের ফুলই দিবারাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য তাপমাত্রাগুলো যেমন ৩২/২৭, ২৭/২৭, ২৪/২৪ ডি.সে. এর সাথে রাতের তাপমাত্রাখান ১৭ ডি.সে. পার্থক্য বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় প্রায় ২০ দিন আগেই ফুল চলে আসে। অথচ ৯ ঘণ্টা ফটোপিড়িয়ড এ ফুল চলে আসে যা বাংলাদেশর সাধারণ স্বল্প দৈর্ঘ্য দিন ১০ ঘণ্টার চেয়ে অনেক কম।
ওয়াসেক (১৯৮২) প্রতিবেদন করেছেন যে, পানির স্বল্পতার প্রভাব পাটের বেশি ফুল আসাকে বিলম্বিত করে, যেখানে খরা আরো বেশি প্রভাব ফেলে। আবার গোট্রিজ (১৯৬৯) বলেছেন পানির স্বল্পতা পাটে দ্রুত ফুল আসাকে প্রভাবিত করে। জোহানসেন (১৯৮৫) বলেন পাটের আঁশের ফলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হলো পাট ফসলের ফুল ধরার সময়টি। কারণ ফুল আসার সাথে সাথে পাট গাছের কাণ্ডের উপরি অংশে শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটে এবং প্রধান কাণ্ডের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। পাটের স্বল্প দিবা দৈর্ঘ্যর ফুল আসা সাধারণত নির্ভর করে দেশি পাটের জন্য প্রায় ১২ ঘণ্টা এবং তোষা পাটের জন্য ১২.৫ ঘণ্টা। তিনি আরও বলেন তাপমাত্রার বৃদ্ধি বিশেষ করে রাত্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পাট ফসলে দ্রুত ফুল আসে। বিশেষ করে রাতের তাপমাত্রা যদি ২০ ডি. সে. এর কম হয় তবে মাটি থেকে চারা গজানো এবং ছোট বয়সের পাট গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে অল্প বয়সেই ফুল আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
অনেকের মতে, বীজের বয়স পাট ফসলে ফুল আসার জন্য দায়ী। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ১-২ বছরের পুরাতন বীজ অথবা নতুন বীজ, যে কোনো বীজ যদি তার অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ভালো থাকে (৮০% এর উপরে) তবে কোনো ফুল আসে না এবং সমান বৃদ্ধি ও ফলন হয়। বিজেআরআই এর উদ্ভাবিত অনেক জাত আছে যেমন বিজেআরআই দেশি পাট-৫, ও-৯৮৯৭, বিজেআরআই তোষা পাট-৪, বিজেআরআই তোষা পাট-৫ ইত্যাদি মাঠে বপন করার পর কিছু আগাম ফুল হলেও তা আঁশের ফলনে বা গাছের বৃদ্ধিতে বা আঁশের গুণগতমানে তেমন কোনো ব্যঘাত ঘটায় না।
শুধু পাট নয় অন্য যে কোনো ফসলের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গাছের বৃদ্ধির সময় যে কোনো কারণে যদি বৃদ্ধিতে বাধার প্রভাব পরে তবে গাছ দ্রুততার সাথে প্রজনন পর্যায়ে চলে যায় এবং গাছে ফুল দেখা দেয়।
অপরিপক্ব বয়সের ফুলের প্রভাব থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায়
পাট ফসলের আঁশ উৎপাদনের সময় আগাম/অপরিপক্ব বয়সে ফুল আসা খুবই বিপদজ্জনক। কখনো কখনো এ কারণে পাটের ফলন ও আঁশের মান খারাপ হয় এবং কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় বলতে গেলে পাটের আগাম ফুলের প্রভাব দূর করতে হলে উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করতে হবে। তাছাড়া জমির দুর্বল উর্বরতা, জলাবদ্ধতা, খরা, শুষ্ক বায়ু প্রবাহ, দিবা রাত্রির তাপমাত্রার পার্থক্যের পরিমাণ বেশি হওয়া, মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ইত্যাদি। এমনকি যদি দিনের আলোক দৈর্ঘ্য তার পরিমিত মাত্রা ছাড়িয়ে য়ায়, তখনও ফুল দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা সাধারণত মে, জুন এমন কি জুলাই মাসেও হতে পারে। অতএব, প্রকৃত অর্থে পাট ফসল কে আগাম বা অপরিপক্ব বয়সের ফুল থেকে রক্ষা করতে হলে বিশুদ্ধ পাট জাতের বীজ ব্যবহার করতে হবে এবং উপযুক্ত সময় বীজ বপন করতে হবে। বৃষ্টি না হলে বা কমে হলে, বীজ বপনের পর অন্তত এক বার জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত উর্বর না হলেও মোটামুটি উর্বরতা সমৃদ্ধ জমিতে পাট ফসল চাষ করতে হবে। তবেই আমাদের দেশের পাটচাষিদের মানের আশা পূরণ হবে। উচ্চফলন ও ভালোমানের আঁশে কৃষকের মাচা ভরে উঠবে, কৃষক ভাইয়েরা অর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
কৃষিবিদ ড. মো. মাহবুবুল ইসলাম*
*মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল : +৮৮০১৫৫২৪১৬৫৩৭
প্রকৃতির সাথে কৃষির রয়েছে সুনিবিড় সম্পর্ক। ফসল উৎপাদনে আবহাওয়ার প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা যতই সমৃদ্ধ হোক না কেন প্রকৃতির কাছে এখনও আমরা নিদারুণ অসহায়। অবশ্য প্রকৃতির সাথে সেতুবন্ধনেই আমাদের কৃষক এগিয়ে যাচ্ছে। ধান ফসলও আবহাওয়ার প্রভাবে দারুণ প্রভাবিত। বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো এ হলো ধান আবাদের বিন্যাস। শুধু আবহাওয়াজনিত কারণে এ বিন্যাসগুলোর রয়েছে স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। বোরো মৌসুম ঠাণ্ডা হিম শীতলের সমন্বয়ে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে শুরু হয়। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। বোরো মৌসুমের প্রতিটা দিনেই রয়েছে দারুণ বৈচিত্র্যতা। গবেষণায় দেখা গেছে, ধান গাছ তার জীবনচক্রের মধ্যে কাইচ থোড় থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়ে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম সহ্য করতে পারে না। ওই সময় বাতাসের তাপমাত্রা যদি ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অথবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে যায়, তাহলে ধানে ব্যাপকভাবে চিটা দেখা দেয়। তাছাড়া এ সময়ে খরা, ঝড়, পোকামাকড় বা রোগবালায়ের আক্রমণ হলেও চিটা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে ধানের জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে ক্রিটিক্যাল (নিম্ন) তাপমাত্রা
গবেষণা মোতাবেক ধান গাছের জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রিটিক্যাল (নিম্ন) তাপমাত্রার একটি স্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে। ধানের জীবন চক্রের অঙ্কুরোদগম অবস্থায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চারা অবস্থায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কুশি অবস্থায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, থোড় অবস্থায় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফুল ফোটা অবস্থায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা চলে গেলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এতে ফলন অনেক কমে যায়।
ধানে চিটা হওয়ার মূল কারণ
স্বাভাবিকভাবে ধানে শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ চিটা হয়। চিটার পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হলে ধরে নিতে হবে থোড় থেকে ফুল ফোটা এবং ধান পাকার আগ পর্যন্ত ফসল কোনো না কোনো প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে, যেমন অসহনীয় ঠাণ্ডা বা গরম, খরা বা অতিবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, পোকা ও রোগবালাই। একটু বিস্তারিত বলতে গেলে
ঠাণ্ডা : রাতের তাপমাত্রা ১২-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং দিনের তাপমাত্রা ২৮-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কাইচ থোড় থেকে থোড় অবস্থা অবধি) ধান চিটা হওয়ার জন্য মোটামুটি সংকট তাপমাত্রা। তবে এ অবস্থা পাঁচ/ছয় দিন শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকলেই কেবল অতিরিক্ত চিটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাতের তাপমাত্রা সংকট মাত্রায় নেমে এলেও যদি দিনের তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে তবে চিটা হওয়ার আশংকা কমে যায়।
গরম : ধানের জন্য অসহনীয় তাপমাত্রা হলো ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি। ফুল ফোটার সময় ১-২ ঘণ্টা ওই তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।
ঝড়ো বাতাস : প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসের কারণে গাছ থেকে পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়। এতে ফুলের অঙ্গগুলো গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। আবার ঝড়ো বাতাস পরাগায়ন, গর্ভধারণ ও ধানের মধ্যে চালের বৃদ্ধি ব্যাহত করে। এতে ধানের সবুজ খোসা খয়েরি বা কালো রঙ ধারণ করে। ফলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে।
খরা : খরার কারণে শিষের শাখা বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বিকৃত ও বন্ধ্যা ধানের জন্ম দেয়ায় চিটা হয়ে যায়।
শৈত্যপ্রবাহ বা ঠাণ্ডা জনিত কারণের লক্ষণ
চারা অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ থাকলে চারা মারা যায়। কুশি অবস্থায় বাড় বাড়তি কমে যায়, গাছ হলুদ হয়ে যায়, থোড় অবস্থায় শিষ পুরোপুরি বের হতে পারে না, শিষের অগ্রভাগের ধান মরে যায় বা সম্পূর্ণ চিটা হয়ে যায়।
প্রতিরোধের উপায়
ফসল চক্রে নেমে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিহত করা কঠিন। কিন্তু বোরো ধান অগ্রহায়ণের শুরুতে বীজ বপন করলে ধানের থোড় এবং ফুল ফোটা অসহনীয় নিম্ন বা উচ্চ তাপমাত্রায় পড়ে না, ফলে ঠাণ্ডা ও গরম এমনকি ঝড়ো বাতাসজনিত ক্ষতি থেকেও রেহাই পাওয়া সম্ভব। চিটা ব্যবস্থাপনা করার প্রয়োজনীয় পরামর্শ হলো-
ব্রি ধান২৮ এর ক্ষেত্রে ১৫-৩০ নভেম্বরের মধ্যে এবং ব্রিধান ২৯ এর ক্ষেত্রে ৫-২৫ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ দীর্ঘ জীবনকাল সম্পন্ন (১৫০ দিনের ওপর) ধানের জাতগুলো নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং স্বল্প জীবনকালের (১৫০ দিনের নিচে) জাতগুলো ১৫ নভেম্বর থেকে বীজতলায় বপন করতে হবে।
বোরো মৌসুমে কেবল ব্রি ধান২৮ চাষ না করে বিআর ১, ব্রি ধান৩৫ ও ব্রি ধান৩৬ এর আবাদ করতে হবে।
বীজতলায় চারা থাকা অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ চললে চারার উচ্চতা ভেদে ৫-১০ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে। তাছাড়া স্বচ্ছ এবং পাতলা পলিথিনের ছাউনি দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ কালে দিনে ও রাতে আচ্ছাদিত রাখতে হবে।
চারা রোপণের জন্য ৩৫ থেকে ৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। কুশি অবস্থায় শৈত্যপ্রবাহ চললে জমিতে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে। তাছাড়া থোড় ও ফুল ফোটা স্তরে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা থাকলেও ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পানি রাখলে চিটার পরিমাণ হ্রাস করা যায়।
অতি আক্রমণকাতর জাতের আবাদ পরিহার করা বা অবস্থার প্রেক্ষাপটে কৃষক আবাদ অব্যাহত রাখলে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি পরিমিত ইউরিয়া ও পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্রি ধান২৮ এর গড় জীবনকাল ১৪০ দিন। মনে করি, একজন কৃষক ২৫ নভেম্বর বীজতলায় বীজ বপন করল। ৪০ দিন বয়সের চারা মাঠে রোপণ করেন (০৪ জানুয়ারি)। মূল জমিতে চারা লাগানোর পর থেকে সর্বোচ্চ কুশি স্তর পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন (১৫ ফেব্রুয়ারি)। অতঃপর ধান গাছের প্রজনন পর্যায়ের কাইচ থোড় স্তর শুরু হয়। ধান গাছে কাইচ থোড় থেকে ফুল ফোটা স্তর পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় ৩০ দিন (১৫ মার্চ)। পরবর্তীতে ধান পাকা পর্যায়ের দুধ স্তর শুরু হয়ে পরিপক্বতায় পৌঁছাতে প্রায় ৩০ দিন সময় লাগে (১৫ এপ্রিল)। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় জানুয়ারি মাস সবচেষে শীতল মাস। তাছাড়া এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি গরম থাকে। হাওর অঞ্চলে আগাম বোরো ধান আবাদ করলে অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বীজতলা এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে মূল জমিতে রোপণ করলে নিশ্চিত অতিরিক্ত ঠাণ্ডাকালীন (১৫ জানুয়ারি) প্রজনন পর্যায়ের কাইচ থোড় স্তর আক্রান্ত হয় ফলে চিটা হয়। ঠাণ্ডাজনিত কারণে চিটা হলে আমরা এটাকে কোল্ড ইনজুরি বলে থাকি। আবার অনেক কৃষক ভাইরা যদি একটু দেরিতে বোরো আবাদ করেন অর্থাৎ জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তাহলে প্রজনন পর্যায়ের কাইচ থোড় স্তরটি অতি গরমকালীন (১৫ মার্চ) গরমে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে ধানে চিটা হতে পারে।
এক কথায় বলতে গেলে, ব্রি ধান২৮, ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৫ দিনের চারা রোপণ করলে সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ব্রি ধান২৯, ২০ ডিসেম্বর হতে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪৫ দিনের চারা রোপণ করলে চিটার পরিমাণ কম হয় এবং ফলন বেশি হয়। তাই ব্রি ধান২৯ এর বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ০৫ থেকে ২৫ নভেম্বর এবং ব্রি ধান২৮ এর বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ১৫ থেকে ২৫ নভেম্বর। তাই উফশী নাবি জাতগুলো ৫ নভেম্বর এবং আগাম জাতগুলো ১৫ নভেম্বর থেকে বীজ বপন শুরু করলে ফসলের থোড়/গর্ভাবস্থা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করতে পারে, ফলে ঠাণ্ডা বা গরমের কারণে ধান চিটা মুক্ত হবে এবং ফলন বেশি হবে।
মোদ্দাকথা হলো ধানের কাইচ থোড় থেকে ফুল স্তর পর্যন্ত সময়টুকু অতিরিক্ত ঠাণ্ডা (জানুয়ারি থেকে মধ্য ফেব্রয়ারি) এবং অসহনীয় গরম (মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল) এ সময়ে ফ্রেমে যেন না পড়ে সেদিকে একটু বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের স্বাভাবিক কৃষি কাজ ও অগ্রগতিকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শৈত্যপ্রবাহ, অসহনীয় উত্তাপ, ঝড়, বন্যা, পোকামাকড়, রোগবালাইয়ের প্রাদুভাব সমূলে নির্মুল করা সম্ভব নয় তবে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। তাই কৃষকদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। জয় হোক কৃষকের।
কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ*
*আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, সিলেট
বাংলাদেশে হরেক রকম ফলের আবাদ করা হচ্ছে এখন। এর মধ্যে যেমন দেশীয় ফল রয়েছে তেমনি আবার বিদেশী ফলও রয়েছে। দেশীয় ফলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল হলো আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, কুল, পেয়ারা, বেল, জলপাই, তাল, লুকলুকি, আমলকী, জাম আর নানা রকম লেবু। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের বেশিরভাগ আসে কয়টি ফল থেকে। এদের মধ্যে কলা আর পেয়ারা ছাড়া কোনো ফলই সারা বছর পাওয়া যায় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে এসব ফলের প্রাপ্তি। বিশেষ করে বৈশাখ থেকে বড় জোর শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আমাদের এসব ফলের উৎপাদন হয়ে থাকে। যে কারণে প্রায় সারা বছরই বিদেশ থেকে প্রচুর ফল আমাদের আমদানি করতে হয়। এসব ফল আবার চড়া দামে কিনতে হয়। আমাদের দেশীয় ফলের নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে পারলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে অন্যদিকে কেবল মৌসুমে নয় অমৌসুমেও এর কোনো কোনোটা আবাদ উপযোগী হতে পারে।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের ফল গবেষণা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বেশ কিছু ফলের জাত অবশ্য গত দশ বছরে অবমুক্ত করা হয়েছে যার বেশির ভাগই দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা উত্তম জাত। ফলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করা কিংবা ফলে মিউটেশন ঘটিয়ে নতুন জাত উদ্ভাবন করার ঘটনা এ দেশে বেশ বিরল। কেবলমাত্র আমের দু’চারটি জাত উদ্ভাবন ছাড়া অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে আমাদের জাত উন্নয়ন গবেষণা বড় দুর্বল।
ফল গবেষণার কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গাছ আধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ দেহী হওয়ায় এদের মধ্যে সঙ্করায়ন করার কাজটি খানিকটা কঠিন। দুই, অধিকাংশ ফল গাছে ফল ধরতে সময় লাগে বলে ফলের জাত উদ্ভাবন করার জন্য সঙ্করায়ন পদ্ধতির দিকে গবেষকগণ কম আগ্রহী হন। আমাদের দেশে ফলের জাত উন্নয়ন গবেষণার আরো কিছু বাড়তি অসুবিধা রয়েছে। এক, ফল গবেষণার সাথে জড়িত গবেষকদের উদ্ভিদ প্রজনন ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। দুই, যাদের এ বিষয়ক জ্ঞান বেশি রয়েছে পেশাগত প্রতিযোগিতার নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তাদের এ বিষয়ক গবেষণা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ হলে এবং গোষ্ঠীগত পেশার চেয়ে জাতীয় উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে শেষোক্ত সমস্যা ঘটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর তা পারলে ফল গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জনের দ্বারও উন্মোচিত হতে পারে। আম আমাদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফল ফসল। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে আমের বৈচিত্র্যও আমাদের কম নয়। তাছাড়া আমের নানান আকৃতি ও পাকার সময় কালেও বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। এসব বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন আম জাতে বিদ্যমান উত্তম বৈশিষ্ট্য দেওয়া নেওয়া করার জন্য আমে সঙ্করায়ন করার পদ্ধতি ইতোমধ্যে আমাদের দেশে চালু হয়েছে। আম অঙ্গজ জনমক্ষম একটি ফসল বলে সঠিক দু’টি পেরেন্ট জাতের মধ্যে সঙ্করায়ন করে পাওয়া হাইব্রিড গাছের মধ্য থেকে উত্তম হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন খুব কঠিন কাজ নয়। আর একটি- দু’টি উত্তম হাইব্রিড জাত পেলে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে এর গুণাগুণ ধরে রাখা সম্ভব দিনের পর দিন।
হাইব্রিড আম যে উত্তম হতে পারে তার প্রমাণ আম্রপালি, আম জাতটি। এটি ভারতে উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড আম। এই আম জাতটির আমাদের দেশেও বিস্তার ঘটানো হয়েছে। হাইব্রিড হলেও একেও পেরেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের একাধিক জাতের সাথে সঙ্করায়ন করে নেয়া যেতে পারে। অতপর তা থেকে সৃষ্ট ভিন্ন রকম আম গাছের মধ্য থেকে উত্তম গাছকে অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে রক্ষা করা সম্ভব। আর এর মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে উত্তম আম জাত। এভাবে পাওয়া সম্ভব নানা আকার আকৃতি, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম। কাঁঠাল নিয়ে আমাদের বহুমাত্রিক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। কাঁঠালের বিভিন্ন জাতের মধ্যে গুণগত মানের দিক থেকে নানা রকম বৈচিত্র্য রয়েছে। কাঁঠালের আকার আকৃতি, এর বর্ণ এবং দেহের কাঁটার আকার আকৃতি এদের তীক্ষèতায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। কোয়ার আকার আকৃতি, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টতার দিক থেকেও কাঁঠালে বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে।
এসব ছাড়া পরিপক্বতার দিক থেকে আগাম, মাঝারি ও নাবি বৈশিষ্ট্যের জন্যও এদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলে এই বিশাল বৈচিত্র্য থেকে মানুষের চাহিদামাফিক গুণগত মানসম্পন্ন কয়েক রকমের কাঁঠালের জাত বাছাই করে এর চাষ বৃদ্ধি করার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ ও প্রয়োজন দুটোই রয়েছে। এর জন্য উত্তম জাত বাছাই এবং এর বংশ বিস্তারের জন্য চারা উৎপাদন করার বিষয়ে আমাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কাঁঠালের টিস্যু কালচার করে চারা উৎপাদনকে আরো সহজতর করতে হবে। কাঁঠাল পর পরাগী ফসল। আশপাশের গাছের পরাগ রেণু উড়ে এসে ফুলের গর্ভমু-ে পতিত হয় বলে এর বীজ থেকে উৎপাদিত কাঁঠাল গাছের কাঁঠালের গুণাগুণ অক্ষত রাখা সম্ভব হয় না। সে কারণে টিস্যু কালচার থেকে কাঁঠালের চারা উৎপাদন সম্ভব হলেও এর উৎপাদন কৌশলকে আরো সহজতর করার গবেষণা চালিয়ে যায়ার প্রয়োজন রয়েছে।
পেয়ারারও বেশ কিছু বৈচিত্র্যময় জাত রয়েছে আমাদের। পেয়ারার আকার আকৃতি এর বহিরাবরণ, এর ভেতরকার বীজের পরিমাণ, এর পেলবতা, স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আমাদের বাজারে দু-তিন রকম জাতের পেয়ারার আধিক্য রয়েছে। তবে দিন দিন বর্ণিল মাংসল পেয়ারা কেবল হ্রাস পাচ্ছে বললে ভুল হবে বরং বিলুপ্তির মুখে পড়েছে বললে সঠিক হবে। বর্ণিল পেয়ারা এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং এদের যবনিক বাড়তি আয়রনও রয়েছে। ফলে এসব পেয়ারার জাত সংগ্রহ করে ফিল্ড জিন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এখন আমরা পুষ্টির বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি বলে বর্ণিল মাংসল পেয়ারার উৎপাদন কৌশল এবং এদের ব্যাপক বংশ বিস্তার ঘটানোর কাজটি করা খুব প্রয়োজন। তাছাড়া বর্ণিল পেয়ারার সাথে আমাদের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা সাধারণ পেয়ারার সঙ্করায়ন করা যেতে পারে। এতে ভিন্ন বর্ণেরও মানের পেয়ারার জাত উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
কলা ফসলের জাত উদ্ভাবনে আমাদের গবেষণা হয়েছে সবচেয়ে কম। এর জেনোমিক গবেষণা হয়নি বললেই চলে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে নানা রকম পরিপ্লয়েড কলার জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে আন্তঃজাত সঙ্কয়ায়নের মাধ্যমে। এর ফলে কেবল যে নানা আকৃতির ও গুণমান বিশিষ্ট ফল উৎপাদিত হচ্ছে তাই নয় বরং রোগসহিষ্ণু জাতও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমাদের পাহাড়ের কোনো কোনো কলা প্রজাতি ভষণ রকম রোগ ও কীটপতঙ্গ সহনশীল। এর অন্য বৈশিষ্ট্য উত্তম না হলেও এসব বৈশিষ্ট্য আমাদের আবাদি কলা জাতে স্থানান্তর করা যেতে পারে। সারা বছর ভিন্নতর স্বাদ বিশিষ্ট কলার জাত পেতে হলে কলার প্রজনন বিষয়ক গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এক বছর দু’বছরেই ফল ধরে বলে কলা প্রজনন করাই যেতে পারে।
লেবুর ভালো বৈচিত্র্য রয়েছে আমাদের। নরসিংদী এলাকায় কলম্বো লেবু তো বিদেশেও রপ্তানি হয়। উত্তম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারলে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। লেবুতে আমাদের পাহাড়ে দু-একটি বীজহীন লেবুর সন্ধান পাওয়া গেছে। দু’ভাবে এই লেবুকে কাজে লাগানো যায়। এক, অঙ্গজ বংশবিস্তারক্ষম এই লেবু জাতের অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বীজহীন লেবুর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় যেমন পাহাড়ে তেমনি সমতল ভূমিতেও। দুই, বীজহীন লেবুর এই বৈশিষ্ট্যটি আমাদের অন্য লেবুতে স্থানান্তর করায় গবেষণা চালানো যায় অবশ্যই। এর জন্য অবশ্যই প্রজননবিদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে ফল গবেষণা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রকৃত প্রজনন বিদদেরকে কাজ করার পরিবেশ দিতে পারলে বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে বৈচিত্র্যময় সব লেবুর জাত। তাছাড়া লেবুর কিছু রোগ বালাই বা কীট পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের জন্যও গবেষণা চলতে পারে।
বেল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফল। গুণেমানে এর তুলনা হয় না। বেল ফসলের জাতের মধ্যেও আমাদের বেল যানিক জীববৈচিত্র্য এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। গাজীপুরের বেল তো এ দেশের এক বিখ্যাত সম্পদ। বিশালকৃতি, কম বীজ ও চমৎকার স্বাদ গন্ধসমৃদ্ধ এই বেলজাত আমাদের বেল উন্নয়নের পেরেন্ট স্টক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমাদের দেশে অনেক ছোট বেল জাতও রয়েছে যাদের আঁশ কম আবার স্বাদ ও গন্ধও উত্তম। যদিও অধিকাংশ স্থানীয় বেল জাতগুলোর মান সন্তোষজনক নয়। বেলের বংশ বিস্তারের জন্য টিস্যু কালচার প্রণিত প্রটোকল উদ্ভাবন করা গেলে দেশে এ বেলের ব্যাপক প্রসার ঘটানো সম্ভব। এর টিস্যু কালচার কঠিন হবে তবে গবেষণা চালিয়ে গেলে তা অসম্ভব হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমাদের পানি ফলেরও যানিক বৈচিত্র্য রয়েছে। ফলের আকারে এরা ছোট, বড় ও মাঝারি তিন রকম রয়েছে। রয়েছে এদের ফলে বীজ ঘনত্বের তারতম্যও। কোনো কোনো জাতের বীজের গন্ধ এবং স্বাদ বেশ মন কাড়ে। ভীষণ আয়রন সমৃদ্ধ এই ফল। সরাসরি বড় জাতের বংশ বিস্তার করে এবং বড় জাতের বৈশিষ্ট্য অন্য জাতে স্থানান্তর করে পানিফলের চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তালের ক্ষেত্রে আমাদের কোন গবেষণাই বাস্তবে হয়নি। তালেরও স্বাদে গন্ধে বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাল এক লম্বা সময়ের ফলন। তালগাছ পুরুষ না স্ত্রী হবে এটি জানতেও অপেক্ষা করতে হয় কত বছর। আনবিক কৌশল ব্যবহার করে আগাম তালগাছের লিঙ্গ নির্ধারণ করার গবেষণা চালানো দরকার। তাহলে স্ত্রী লিঙ্গিক চারা লাগিয়ে লাভবান হওয়ার বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
ফল ফসলের জাত উদ্ভাবন গবেষণার পাশাপাশি উদ্ভাবিত জাতসমূহের আবাদ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্ভাবিত জাতের চাষাবাদ পদ্ধতি, এদের রোগ ও পোকামাকড় দমনসহ ফলের সংগ্রহ পরবর্তী ব্যবস্থাপনাজনিত গবেষণা নতুন জাতের সফলতা অর্জন করার জন্যই আবশ্যক। তাছাড়া ফল ফসলের চারা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনও এক জরুরি বিষয়। কম দামে অল্প স্থানে উত্তম চারা উৎপাদন ফলের জাত প্রসারের জন্য এক আবশ্যক বিষয়। ফলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন ও এদের আধুনিকায়নের গবেষণা দেশে চলছে। অধিকাংশ ফল যেহেতু কোনো রকম প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই সরাসরি বপন করা হয় বলে রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে ফল চাষকে উৎসাহিত করার জন্যও গবেষণা প্রয়োজন। বিশেষ করে সমন্বিত বালাইনাশক এবং বীজ বালাইনাশক ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য গবেষণা কর্মকাণ্ডে জোর দেয়া দরকার।
ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*
*প্রফেসর জেনিটিকস অ্যান্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা
কৃষিপণ্য থেকে নিরাপদ ফ্রাইড চিপ্স তৈরির ভ্যাকুয়াম
ফ্রাইং প্রযুক্তি
১ ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী ২মো: হাফিজুল হক খান
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কৃষি উৎপাদন সমগ্র বিশে^র রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। কৃষি আমাদের গর্ব করার মতো বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কৃষক ও কৃষি পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের শ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং কৃষিবান্ধব সরকারের যথাযথ উদ্যোগ উন্নয়নের মহাসড়কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কৃষির জয়গান এখন সর্বত্র। তা সত্ত্বেও কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হওয়া, সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাণ কমানো ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ রয়ে গিয়েছে। দেশে বছরব্যাপী কৃষিপণ্যগুলোর কিছু সরাসরি খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার কিছু ফসল প্রক্রিয়াজাত করে খাবারের কাঁচামাল ও সংরক্ষণের মাধ্যমে বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য বছর জুড়ে তৈরি করা সম্ভব। যেমন- মচমচে চিপ্স অন্যতম একটি প্রস্তুতকৃত খাদ্য যা বিভিন্ন ফসল থেকে তৈরি করা হয় এবং এর চাহিদা সমগ্র পৃথিবী জুড়ে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন গণজমায়েত এ অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সাধারণত সরাসরি তেলে ভেজে সরবরাহ করছে আবার বাসায় তৈরিকৃত চিপসপণ্য মোড়কজাত করেও বিক্রয় করছে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে সাধারণত কোন কাঁচা ফল বা সবজির টুকরো বা ফালিকে তেলে কিছুক্ষণ রেখে ফ্রাই করে পণ্যটি পুরো মচমচে করা হয়। এখানে পণ্যকে ভাজার জন্য তেলকে তাপ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় যা খাবারের সরাসরি সংস্পর্শে আসে।
ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং একটি উন্নত ও বাণিজ্যিক পদ্ধতি যেখানে কম তাপমাত্রা ও চাপে ভাজা চিপস জাতীয় পণ্যের গুণগত মান বজায় থাকে এবং এটি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ বিধায় বিভিন্ন ফল ও সবজির চিপস পণ্য তৈরিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
সাধারণত যে সকল ফল বা সবজি বেশি মিষ্ট হয় বা চিনির পরিমাণ অধিক থাকে সে সকল পণ্য ১৫০-১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তারও অধিক তাপমাত্রায় তেলে ভাজা হলে ভাজা পণ্য বাদামি বর্ণ ধারণ করে। গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় যে, তেলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করার ফলে ভাজা চিপস পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত কারসিনোজেনিক উপাদান এক্রাইলামাইড উৎপন্ন হয়, যা মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ গবেষণা পরিচালনাকালে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহকৃত সহজলভ্য ভাজা আলুর চিপস রেজিস্টারকৃত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গবেষণাগারে পরীক্ষা করার পর দেখা যায় যে, আলু কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে তেলে ভাজা হলে মচমচে আলুর চিপসে ৫৬৩-১০১৮০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি এক্রালামাইড পাওয়া যায়, যা প্রতিদিন আমাদের শরীরের সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য মাত্রার ৩-৫০ গুণ বেশি (টিডিআই ২.৬ মাইক্রোগ্রাম/কেজি; একজন মানুষের গড় ওজন ৭০ কেজি হিসেবে ১৮২ মাইক্রোগ্রাম/কেজি)। উন্নত দেশে বাণিজ্যিক উপায়ে কৃষিপণ্য বিশেষ করে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল, কন্দাল ও অন্যান্য ফসল থেকে চিপ্স তৈরিতে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ইহা স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। নিরাপদ ও গুণগতমান অক্ষুণœ রেখে উৎকৃষ্টমানের মচমচে চিপ্স পণ্য তৈরিতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের ¯œ্যাক্স শিল্পে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় নিরাপদ ভাজা চিপ্স (ফ্রাইড পণ্য) তৈরি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এ পণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা দেশে যেমন রয়েছে তেমনি বিদেশে রপ্তানিতে রয়েছে। এটি একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব অন্যদিকে নিরাপদ ও উচ্চমান সম্পন্ন ভাজা চিপ্স তৈরিতে একটি আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে সারা বিশে^ সমাদৃত। এ প্রযুুক্তি ব্যবহার করে নির্ধারিত তাপমাত্রা ও নিদিষ্ট সময় অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফলমুল ও সবজি যেমন : আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, আলু, মিষ্টিআলু, গাজর, পেঁপে, মানকচু, কাসাভা ইত্যাদি থেকে বহুবিধ মচমচে ভাজা চিপ্স অনায়াসে প্রক্রিয়াজাত করা যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এর পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত স্বল্পমূল্যের ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিন ও ডি-ওয়েলিং মেশিন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রকার মচমচে চিপ্স পণ্য তৈরির মাধ্যমে নিঃসন্দেহে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। বিএআরআই উদ্ভাবিত মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমে আলু স্লাইচ বা টুকরো সরাসরি শুকানো ছাড়াই ভাজা যায়, উৎকৃষ্ট বর্ণ ধারণ করে এবং সমভাবে চিপ্স মচমচে হয়। এছাড়াও গবেষণায় দেখা যায় যে, মচমচে ভাজা আলুর চিপ্সে এক্রালামাইডের পরিমাণ প্রায় ৭৪-৮১ মাইক্রোগ্রাম/কেজি যা এক জন মানুষের শরীরের ওজন অনুযায়ী সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ। উল্লেখ্য যে, বারি ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটির মূল্য আমদানিকৃত যন্ত্রের তুলনায় বহুলাংশে সাশ্রয়ী। এটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের ব্যবহার উপযোগী। যন্ত্রটি আকারে ছোট ও সহজেই যে কোন স্থানে স্থানান্তরিত করা যায় এবং অল্প জায়গায় স্থাপন করা যায়। ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটির পরিচালনা পদ্ধতি অতি সহজতর। তৈরিকৃত ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং যন্ত্রটি স্থানীয় যেকোন ওয়ার্কশপে তৈরি করা যাবে এবং স্বল্প খরচে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়।
ডি-ওয়েলিং এর মাধ্যমে তৈরিকৃত চিপ্স থেকে ১৫ ভাগের অধিক পরিমাণে তেল নিংড়ানো যায় ফলে এটি অল্প চর্বিযুক্ত হয়। বাজারে যেসব ভাজা চিপ্স পণ্য পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ক্রেকার্স পণ্য। কিন্তু ভ্যাকুয়াম প্রযুক্তি ও প্রটোকল ব্যবহার করে প্রকৃত ফেশ-কাট (ৎবধষ ভৎবংয-পঁঃ) ফ্রাইড বা ভাজা চিপস তৈরি করা যায়। গবেষণায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে, ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিনের মাধ্যমে আলু, কলা, কাঁঠাল, গাজর, আনারস, আম, মানকচু থেকে চিপ্স তৈরিতে সাধারণত ১০০-১২০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রা প্রয়োজন হয় এবং ৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত তেলে ডুবিয়ে ভাজতে হয়। ফল বা সবজির টুকরোর পরিমাণ, পুরুত্ব ও কোষের ধরনের উপর ভিত্তি করে চিপ্স ভাজার সময় নির্ধারণ করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে মচমচে চিপ্সের উপরিভাগে অধিক পরিমাণ তেল লেগে থাকে বা দেখা যায় যা খাওয়ার সময় আমাদের শরীরের ভেতরে প্রবেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক সময় টিস্যু পেপার, কাগজ বা অন্যকোন দ্রব্যাদি ব্যবহার করে চিপ্সের উপরিভাগের লেগে থাকা তেল মুছে বা বের করে নেয়ার চেষ্টা করা হয়, যা কখনই স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। আবার প্রচলিত পদ্ধতিতে তৈরিকৃত চিপ্সের সংস্পর্শে থাকা অতিরিক্ত তেল সংরক্ষণ সময় কমায় এবং কিছুদিন পরে প্যাকেটে রাখা চিপ্সে তেলের দুর্গন্ধ (ৎধহপরফ) তৈরি করে। গবেষণায় লক্ষ্য করা হয়, ফল বা সবজির টুকরো ভাজার পরে মচমচে চিপ্স ১-২ মিনিট ডি-ওয়েলিং করলে চিপ্স থেকে প্রায় ১০ ভাগ তেল নিষ্কাশন বা বের হয়ে আসে যা পুনরায় চিপ্স তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ফয়েল প্যাকেটে মচমচে চিপ্স রেখে যথাযথভাবে নাইট্রোজেন ফ্রাশ করলে সংরক্ষণকৃত চিপ্স ৬ মাসের অধিক গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণ করা যায়। কাজেই আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। এ বিবেচনায় মুখরোচক খাদ্য পণ্য হিসেবে কৃষিজাত দ্রব্য দিয়ে তৈরিকৃত ভাজা চিপ্সকে নিরাপদ করাও সময়ের দাবি। সর্বোপরি ভাজা চিপ্সকে নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ বজায় রেখে সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য করতে ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার কোন বিকল্প নেই।
লেখক : ১ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর। মোবাইল : ০১৭১২২৭১১৬৩, ই-মেইল : ferdous613@gmail.com
এ দেশের বনে জঙ্গলে, ঝোপ ঝাড়ে, রাস্তার ধারে পান পাতার মতো পাতাবিশিষ্ট লতানো পিপুল গাছ মাঝে মধ্যে দেখা যায়। পিপুল ফলের স্বাদ ঝাল। পিপুল ফল খাওয়া যায়।
গাছটি এদেশে দুষ্প্রাপ্য নয় কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। ওষুধার্থে পিপুল গাছের পাতা কখনও ব্যবহৃত হয় না, এর মূল ও অপক্ব ফল ব্যবহার করা হয়। পিপুলের বীজ পপি বীজের মতো সূক্ষ্ম কণাবিশিষ্ট। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ে বেদে পিপুলের নাম কন বা কণা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পিপুল খুব সূক্ষ্ম হয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে বলেই এর এরূপ নাম। দ্রব্যটি সূক্ষ্ম হয়ে দেহে প্রবেশ করে রসধাতু পান করে নেয় আবার সূক্ষ্ম হয়ে বেরিয়ে যায়। তার এই পান বা শোষণ করার ধর্ম থেকে নাম রাখা হয়েছে পিপ্পল, এ থেকে পিপ্পলি, পিপলি বা পিপুল। তামিল শব্দ পিপ্পলি থেকে পিপুল নামের উদ্ভব। বৈদিক যুগে পিপুল ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত ভেষজ গাছ। বেদশাস্ত্রে প্রথম পিপুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদে পিপুলকে উঁচু স্থানও দেয়া হয়েছে ও পিপুলের ভেষজ গুণ বর্ণিত হয়েছে। চরকসংহিতার যুগে পিপুল ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত ভেষজ উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম Long pepper পিপুলের ফল লম্বা ও ঝাল বলে হয়তো এর ইংরেজি নাম হয়েছে লং পিপার।
উৎপত্তি ও বিস্তার : পিপুলের জন্মভূমি প্রাচীন ভারতবর্ষের মগধদেশ বলে দাবি করেছেন শিবকালী ভট্টাচার্য। মগধ দেশ ছিল বর্তমান বিহার প্রদেশের দক্ষিণাংশ। কোশল বা উত্তর প্রদেশও ছিল মগধের অঙ্গভূমি। এজন্য পিপুলের আর একটি নাম মাগধী। খৃস্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে ভারতবর্ষ থেকে পিপুল গ্রিসে প্রবেশ করে এবং হিপোক্রেটাস পিপুলকে মশলার চেয়ে ভেষজ হিসেবেই বেশি আলোচনা করেন। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও আসাম, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, তিমুর প্রভৃতি দেশে পিপুল বেশি জন্মে।
উদ্ভিদতাত্ত্বিক বর্ণনা : পিপুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Piper longum L.ও পরিবার Piperaceae. চার রকমের পিপুল দেখা যায়- ১. পিপলি- এর আর এক নাম মাগধী। মগধ প্রদেশে এক সময় এ পিপুল গাছ জন্মাত বলে এর এরূপ নাম। ভারতবর্ষের প্রায় সব স্থানে এই গাছ দেখা যায়। ছোট ও বড় পিপুল এ শ্রেণীর অন্তর্গত। ২. গজপিপুল- এটি আসলে প্রকৃত পিপুল নয়, চুইঝাল গাছের ফলকে বলে গজপিপুল। ৩. সিংহলী পিপুল- সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এই পিপুল জন্মে। একে জাহাজী পিপুলও বলে। ৪. বনপিপুল- অযত্ন এই পিপুল বনে আপনা আপনি জন্মে। এর গাছ আকারে ছোট, ফলও ছোট, ঝাঁঝ কম, সরু। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে যেখানে সেখানে বনে জঙ্গলে এ পিপুল গাছ দেখা যায়। পিপুল পানের মতো একটি লতানো স্বভাবের গাছ। অবলম্বন না পেলে গাছ মাটিতেই পড়ে থাকে। অবলম্বন পেলে তা বেয়ে ওপরে ওঠে। লতায় গিঁট আছে। লতার আগা কোমল, পাতা পানপাতার মতো হৃৎপিণ্ডকার। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, নিচের পিঠ হালকা সবুজ। পত্রকক্ষ থেকে পুষ্পমঞ্জরি বের হয় ও ফল ধরে। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক গাছে আলাদাভাবে ফোটে। ফুল লম্বা দণ্ডের মতো মঞ্জরিতে ফোটে। বর্ষাকালে ফুল হয়, শরৎকালে ফল ধরে। ফল ডিম্বাকার। পিপুল ফল দেখতে অনেকটা মরিচের মতো, তবে ফল অমসৃণ ও কুঁচকানো। ফল হালকা সবুজ, কমলা ও হলুদ রঙের হয়। পাকলে ফলের রঙ লাল হয়ে যায়। শিকড় ধূসর বাদামি ও লম্বালম্বিভাবে কুঁচকানো।
মাটি ও জলবায়ু : পিপুল সাধারণত সুনিষ্কাশিত লাল, দো-আঁশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটিতে ভালো জন্মে। উর্বর মাটিতে শুধু জৈব সার দিয়ে পিপুল চাষ করা যায়। বেলে দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য ভালো। যেসব অঞ্চলে উচ্চ আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বিরাজ করে সেসব অঞ্চলে পিপুল ভালো হয়। পিপুলের জন্য ৩০-৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা, ৬০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও বার্ষিক ১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত উত্তম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ১০০ থেকে ১০০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে পিপুল জন্মে থাকে। অধিক উচ্চতা ও উঁচু পাহাড়ে ফলন ভালো হয় না। গাছের ভালো বৃদ্ধির জন্য আংশিক ছায়া (২০-২৫%) উত্তম।
ব্যবহার : পিপুলের বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনও প্রধানত মশলা হিসেবে। ভেষজের চেয়ে মশলা ফসল হিসেবেই বেশি চাষ করা হয়। আচার ও চাটনি তৈরিতে পিপুল চূর্ণ মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় কোনো কোনো খাদ্য সামগ্রী রান্নায় পিপুল ব্যবহার করা হয়। ভারতের বাজারে মুদি দোকানে পিপুল চূর্ণ পাওয়া যায়। পাকিস্তানে নিহারি বা নেহারি রাঁধতে পিপুল চূর্ণ এক আবশ্যকীয় মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মশলা ছাড়া এর যথেষ্ট ভেষজ গুরুত্ব রয়েছে।
ভেষজ গুণ : চরকসংহিতার সূত্র স্থানে ৯টি বিশিষ্ট রোগে পিপুলকে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এ ৯টি রোগ হলো- কণ্ঠ রোগ, তৃষ্ণা রোগ, শিরো রোগ, হিক্কা, কাশি, শূলরোগ, শীত বা ঠাণ্ডা লাগা প্রশমন ও দীপনীয়। সে যুগে পিপুল এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যেন কৃমিরোগ ও অন্ত্ররোগ চিকিৎসায় দেবতারাই তা গ্রহণ করতেন। দেহের বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় পিপুল কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রেস্ট ক্যান্সার, আন্ত্রিক ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, মস্তিষ্কেও টিউমার, গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার প্রভৃতি রোগের বিরুদ্ধে পিপুল কার্যকর। পিপুলের মধ্যে পিপারলংগুমিনাইন নামক রাসায়নিক যৌগ থাকায় তা এসব ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও আরও যেসব রাসায়নিক উপাদান পিপুলে রয়েছে সেগুলো হলো পিপারিন, পিপলারটাইন, পিপারনোলিন, লং এমাইড, পিপারলংগিন, পিপারসাইড, পেল্লিটোরিন, বিভিন্ন এসেনশিয়াল অয়েল ইত্যাদি। শিকড়ে রয়েছে পিপারিন, স্টেরয়েডস, গ্লুকোসাইডস, পিপেলারটিন ও পিপারলংগুমিনাইন নামক রাসায়নিক উপাদান। ওষুধার্থে পিপুলের শিকড় ও ফল ব্যবহৃত হয়। সাধারণ পিপুল ফলের গুঁড়া আধা থেকে ১ গ্রাম পরিমাণ এক মাত্রা হিসেবে রোজ সেবন করা হয়। নিচে পিপুলের উল্লেখযোগ্য ভেষজ গুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-
নিদ্রাহীনতা দূর করে : রাত গভীর হচ্ছে অথচ কিছুতেই ঘুম আসছে না। এ অবস্থাটা আসলে অসহ্য। একে বলে নিদ্রহীনতা। এ অবস্থা হলে পিপুলের শরণাপন্ন হতে হবে। পিপুলের ১-৩ গ্রাম শিকড় সামান্য চিনি সহকারে ছেঁচে বা বেঁটে সেই রস ছেঁকে দিনে দুবার সকাল বিকেলে খেতে হবে। বয়স্ক লোকদের এই রস সেবনে বিশেষ উপকার হয়। চিনির বদলে আখের গুড়ও ব্যবহার করা যায়। এতে হজমও ভালো হয়।
কাশি সারে : খুসখুসে কাশি আর ঘুষঘুষে জ্বর। এটা যক্ষ্মা রোগের পূর্ব লক্ষণ। এরূপ অবস্থা হলে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে ও পরীক্ষা করাতে হবে। তবে তার আগে পিপুলচূর্ণ ২৫০ মিলিলিটার সামান্য গরম জলে গুলে সকাল-বিকেল অর্থাৎ দিনে দুইবার খেতে হবে। এভাবে ৪-৫ দিন খাওয়ার পর সেটা চলে যেতে পারে। যদি না যায়, তখন অবশ্যই যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা করাতে হবে।
জ্বর সারায় : যে জ্বরে রক্তের বল কমে যাচ্ছে, শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে, চামড়া শুষ্ক হয়ে পড়ছে, চোখ ফ্যাকাসে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলছে, অথচ জ্বর সারছে না। সেক্ষেত্রে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ ৫/১০ ফোঁটা ঘি মিশিয়ে রোজ খেলে কয়েক দিনের মধ্যে এই জীর্ণ জ্বর সেরে যাবে।
মেদ কমায় : যারা মোটা ও মেদস্বী তারা মেদ কমাতে চাইলে রোজ খাওয়ার ১০-১৫ মিনিট পর ১ কাপ হালকা গরম জলে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ গুলে তাতে আধা চা-চামচ মধু মিশিয়ে খাবেন। দিনে দুইবার খাওয়া যায়। এভাবে ১০-১৫ দিন খেলে মেদ কমবে। এ সময় কোনো চিনি বা মিষ্টি খাওয়া চলবে না ও একবেলা ভাত ও দুইবেলা রুটি খেতে হবে। এটা খাওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে কোনো শক্ত খাবার খাওয়া যাবে না, তবে তরল খাবার খাওয়া যেতে পারে।
হাঁপানির উপশম হয় : অল্প পরিশ্রমে যাদের শ্বাসকষ্ট হয়, হাঁপ ধরে তারা পিপুলচূর্ণ ২৫০ মিলিলিটার সামান্য ১ কাপ জলে গুলে খাবার গ্রহণের কিছু পরে খেতে পারেন। তা না হলে ২ গ্রাম পিপুল ফল একটু থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ২-৩ ঘণ্টা পর পর তা ৩-৪ বারে খেতে পারেন। এতে শ্বাসের কষ্ট কমবে।
কৃমি কমায় : শিশু বৃদ্ধ যারই গুঁড়া বা ঝুড়ো কৃমি হোক তাদের উচিত রোজ সকাল-বিকেল ১ কাপ বাসি জলে ২৫০ মিলিগ্রাম পিপুল চূর্ণ গুলে খাওয়া। এতে কৃমির উপদ্রব কমবে।
মাথাব্যথা কমায় : মাথা ব্যথা হলে তা সারানোর সবচেয়ে সহজ ওষুধ হলো পিপুল ফল বেঁটে মলমের মতো করে কপালে লেপে দেয়া। এতে দ্রুত মাথাব্যথা কমে। এছাড়া পিপুল, গোলমরিচ ও আদা একসাথে জলের সাথে বেঁটে ছেঁকে সেই রস রোগীকে খাওয়ানো। এতেও মাথাব্যথার উপশম হয়।
দাঁত ব্যথা সারায় : দাঁতে যন্ত্রণা হলে ১-২ গ্রাম পিপুল চূর্ণ লবণ, হলুদের গুঁড়া ও সরিষার তেলে মিশিয়ে দাঁতের ব্যথা স্থানে লাগালে তা কমে যায়।
হৃদরোগে : সমপরিমাণ পিপুল মূল ও দারচিনি একসাথে বেঁটে মিহি গুঁড়া করতে হবে। তারপর তা ঘিয়ের সাথে মিশিয়ে রোজ দুইবার খেতে হবে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য ও হৃদরোগের উপশম হয়। সমপরিমাণ শুকনো পিপুল মূল ও লেবুর গাছের শিকড়ের বাকল একসাথে বেঁটে গুঁড়া বানাতে হবে। রাতে ১ কাপ জলে অর্জুনের ছাল ভিজিয়ে রাখতে হবে। সকালে সেই অর্জুনের ক্বাথের সাথে এই চূর্ণ মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে। এতে হৃৎপিণ্ডের ব্যথা থাকলে তাও সেরে যায়।
অর্শ নিরাময় করে : অর্শ হলে আধা চা-চামচ পিপুল চূর্ণ, ভাজা জিরার গুঁড়া সামান্য লবণ ১ গ্লাস ঘোলে মিশিয়ে খালি পেটে খেতে হবে। এতে অর্শ রোগ কমে যাবে। ঘোল পাওয়া না গেলে ছাগলের দুধে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এমনকি এই মিশ্রণ জ্বাল দিয়ে ঘন করে মলমের মতো অর্শের বুটিতে লাগিয়ে দেয়া যায়।
কীট দংশনের ব্যথা কমায় : পিপুলের শিকড় বেঁটে পোকামাকড়ের কামড়ানো স্থানে লেপে দিলে দ্রুত ব্যথা কমে যায়।
সতর্কতা : দুধের শিশু, গর্ভবতী ও প্রসূতিদের পিপুল খাওয়ানো চলবে না। মাত্রারিক্ত সেবনে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে, অন্ত্র ফুলে যেতে পারে ও দেহের তাপ বেড়ে যেতে পারে।
চাষাবাদ : সাধারণত এ দেশে কেউ পিপুল চাষ করে না। নাটোরে কোনো কোনো চাষি স্বল্প আকারে চাষ করেন। শিকড় গজানো কাণ্ডের কাটিং দ্বারা সহজে পিপুলের চারা তৈরি ও চাষ করা যায়। বীজ থেকেও পিপুলের চারা হয়। লতা মাটির সাথে শুইয়ে দাবাকলম করে গিঁট থেকে শিকড় গজিয়ে নেয়া যায়। এক বছর বয়সী লতার আগার দিকের অংশ যেখানে ৫-৭টি গিঁট থাকে তা কাটিং করার জন্য ভালো। পলিব্যাগ বা বেডে চারা তৈরি করা যায়। সাধারণত লতা থেকে পিপুলের চারা তৈরি করা হয়। মার্চ-এপ্রিল মাস চারা তৈরির উপযুক্ত সময়। নতুন শিকড় ও লতায় ছাতরা পোকার আক্রমণ যাতে না হয় বা কম হয় ও প্রথম বর্ষার পরপরই যাতে চারা লাগানো যায় সেজন্য এ সময় চারা তৈরি করা যেতে পারে। পিপুল চাষ করতে চাইলে জমি ভালো করে চাষ দিয়ে ২.৫ মিটার চওড়া করে বেড বানাতে হবে। দুই বেডের মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। বেড জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা হতে পারে। পিপুল চাষের জন্য ৩ মিটার লম্বা ও ২.৫ মিটার চওড়া আকারের বেড উত্তম। বেডের মাঝে ৬০ সেন্টিমিটার পর পর সারিতে ৬০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে কাটিং লাগাতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ২ মিটার পর পর পিপুলের কাটিং লাগাতে হবে। কাটিং লাগানোর আগে রোপণ স্থানে গর্ত করে তার মাটির সাথে জৈব সার মিশিয়ে ভরতে হবে। প্রতি গর্তের মাটির সাথে ১০০ গ্রাম জৈব সার মিশিয়ে দিতে হবে। হেক্টরে ১০-১৫ টন জৈব সার দিলে ভালো হয়। গর্ত ১৫ সেন্টিমিটার গভীর হলেই চলবে। গর্তের ঠিক মাঝখানে কাটিং লাগাতে হবে। প্রতি গর্তে দুটি কাটিং লাগাতে হবে।
তীব্র রোদে পিপুল গাছের ক্ষতি হয়। তাই পিপুল ক্ষেতের মধ্যে কিছু কলাগাছ লাগিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আন্তঃফসল হিসেবে কলা থেকে বাড়তি আয় হতে পারে। ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়েও পিপুল ক্ষেতে ছায়ার ব্যবস্থা করা যায়। নারিকেল বা সুপারি বাগানের মধ্যে আন্তঃফসল হিসেবে পিপুল চাষ করা যায়। পিপুল গাছ এসব গাছ বেয়ে উঠতে পারে। মে মাসের শেষে কাটিং লাগানো সবচেয়ে ভালো যদি এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যায়। তা না হলে জুন-জুলাই কাটিং লাগানোর উত্তম সময়। লাগানোর সময় বৃষ্টি থাকলে সেচের দরকার নেই, না হলে রোপণের পরই সেচ দিতে হবে। বর্ষার পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও কাটিং রোপণ করা যায়। আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের অবস্থা বুঝে পরবর্তীতে সেচ ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যেতে হবে। দরকার হলে সপ্তাহে একবার সেচ দিতে হবে। রোপণের পর ৩ মাস পর্যন্ত আগাছা পরিষ্কার করে চারার গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। খরার সময় বা গ্রীষ্মকালে গাছের গোড়ার মাটি খড় দিয়ে ঢেকে দিলে বা মালচিং করলে উপকার হয়। এ সময় সেচ দিতে পারলে অসময়েও ফুল-ফল ধরে। বর্ষাকালে পাতায় দাগ রোগ বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ডায়থেন এম ৪৫ বা নাটিভো ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন : চারা রোপণের ৬ মাস পর থেকে গাছে ফুল আসতে শুরু করে। ফুল আসার ২ মাস পর সেসব ফল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। যখন ফলগুলো পূর্ণতা পায় অথচ পাকে না ঠিক সে অবস্থায় পিপুলের ফল সংগ্রহ করা উচিত। এ অবস্থায় ফল না তুলে রেখে দিলে দ্রুত তা পেকে যায় ও ঝাঁঝ অনেক কমে যায়। এছাড়া পিপুলের ফল পেকে গেলে সেসব ফল শুকানোর পর সহজে ভাঙা বা গুঁড়া করা যায় না। সেজন্য পাকা পিপুল ফল তোলা হয় না। একবার লাগালে সেসব গাছ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। ফলের রঙ গাঢ় সবুজ হলে তা সংগ্রহ করা উচিত। প্রথম বছর প্রতি হেক্টরে গড় ফলন পাওয়া যায় ৭৫০ কেজি শুষ্ক ফল, দ্বিতীয় বছরে ১৫০০ কেজি ও তৃতীয় বছরে ১০০০ কেজি। তবে ব্যবস্থাপনার কারণে ফলনের কম-বেশি হতে পারে। তিন বছরের পর আর গাছ রাখা উচিত নয়। এরপর নতুন করে আবার কাটিং লাগাতে হবে।গাছের গোড়ায় মোটা কা- বা শিকড় কেটে তোলা হয়। একে বলে ‘পিপুলমূল’। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম জেলায় পিপুল শুধু মূলের জন্য চাষ করা হয়। সেখানে পিপুল গাছ লাগিয়ে ১৮ মাস বয়স হলে তা থেকে শিকড় সংগ্রহ শুরু করা হয়। গাছ ১০-৩০ বছর পর্যন্ত রেখে দেয়া হয় এবং তা থেকে প্রতি বছর শিকড় সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত গাছের বয়স ১৮ মাস হলে সেসব গাছ থেকে মূল সংগ্রহ শুরু হয়। মূল ২.৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার টুকরো করে কাটা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৫০০ কেজি শুষ্ক মূল পাওয়া যায়।
ফল শুষ্ককরণ : ফল তোলার পর তা উল্টে পাল্টে রোদে ৪-৫ দিন শুকাতে হয়। ভালো করে না শুকানো পর্যন্ত তা ঘরে রাখা উচিত নয়। সাধারণত ১০ কেজি কাঁচা ফল শুকালে ১.৫ কেজি শুষ্ক ফল পাওয়া যায়। ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য শুষ্ক ফল বায়ুবদ্ধ পাত্রে মজুদ করে রাখা যায় বা বস্তা ভরে বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো যায়। পিপুল ফল শুকানো সহজ হলেও শুকানোর প্রক্রিয়াগত কারণে অনেক সময় ফল নষ্ট হয় ও অপচয়ের পরিমাণ বাড়ে। পিপুল ফল শুকানোর জন্য ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উত্তম। এতে রাসায়নিক উপাদান সর্ব্বোচ্চ থাকে। পাতলা স্তরে বিছিয়ে পিপুল ফল শুকানো উত্তম।
মৃত্যুঞ্জয় রায়*
* প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি প্রকল্প, খামারবাড়ি, ঢাকা
জীবন বাঁচাতে আমরা অনেক ধরনের খাদ্য খাই। আমাদের খাদ্য তালিকার বিরাট অংশ জুড়ে আছে হরেক রকমের বাহারি রঙিন শাকসবজি। এ শাকসবজি মানব দেহের অপরিহার্য ভিটামিন, খনিজ ও সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটসের অন্যতম উৎস ও জোগানদাতা। বিশ্বে চীন ও ভারতের পরেই বাংলাদেশ এখন তৃতীয় সবজি উৎপাদনকারী দেশ। প্রতি বছর বিশ্বের ৫০টি দেশে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষিনির্ভর উদ্যোক্তার সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একদিকে বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখতে সাহায্য করছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কৃষিতে সবজি উৎপাদন একটি বড় অর্জন। কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭৩.৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ বছরে (জুলাই-মে) সবজি রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৭১.২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
রাজধানী ঢাকায় গত ২৪-২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ৪র্থ ‘জাতীয় সবজি মেলা-১৯’। মেলায় প্রায় ১১২ জাতের সবজি নিয়ে ৭১টি স্টল ও ৫টি প্যাভিলিয়ন ছিল। মানুষের মধ্যেও সবজি মেলা নিয়ে এত সাড়া দেখা যায়নি কখনো। দেশে সবজি উৎপাদনে যে বিপ্লব ঘটেছে এবারের সবজি মেলা তারই স্বাক্ষর বহন করছে। এখানেই শেষ নয়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে সবজির উৎপাদন আগের তুলনায় পাঁচগুণ বেড়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি মৌসুমি সবজি ছাড়া প্রায় সারা বছরই সব ধরনের সবজি উৎপাদন হচ্ছে, যা আগে কখনো কল্পনাই করা যায়নি। বাংলাদেশের সার্বিক কৃষি ব্যবস্থা, প্রযুক্তির ব্যাপকতা, কৃষকের নিরলস শ্রম ও অদম্য আগ্রহ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
জীবনের প্রয়োজনে সবজি আমাদের বেশি করে খেতে হবে। বাহারি সবজি বলতে এখানে রঙিন সবজিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। রঙিন শাকসবজি হচ্ছে অ্যান্থোসায়ানিনের প্রাকৃতিক উৎস। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে অ্যান্থোসায়ানিন কি? অ্যান্থোসায়ানিন মানব স্বাস্থ্যের কি উপকার করে? নি¤েœ ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হচ্ছে।
অ্যান্থোসায়ানিন :
উদ্ভিদ দেহে ক্লোরোফিল ছাড়া অন্যান্য প্রধান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলো হলো ক্যারোটিনয়েড, ফ্লাভোনয়েড এবং বেটালিন। ফ্লাভোনয়েড হচ্ছে উদ্ভিজ্জ সেকেন্ডারি মেটাবোলাইটগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রুপ। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০প্রকার ফ্লাভোনয়েড শনাক্ত করেছেন। আর অ্যান্থোসায়ানিন হলো ‘ফ্লাভোনয়েড’ গ্রুপের এক ধরনের উদ্ভিজ্জ বায়োঅ্যাক্টিভ যৌগ, যা উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল ও মূলের বর্ণের প্রধান নিয়ামক।
১৮৩৫ সালে জার্মান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী লুড উইং মার্কাট অ্যান্থোসায়ানিনের নামকরণ করেন। এটি মূলত দুটি গ্রিক শব্দ অ্যান্থোস অর্থ ফুল এবং ক্যানস অর্থ নীল থেকে এসেছে। অ্যান্থোসায়ানিন সাধারণত কোষের সাইটোপ্লাজমে তৈরি হয়। এটি পানিতে দ্রবণীয় এবং কোষ গহ্বরে গিয়ে সঞ্চিত হয়। এটি উদ্ভিদের বিভিন্ন বর্ণ যেমন- কমলা, লাল, গোলাপি এবং নীল বর্ণের জন্য দায়ী। দৃশ্যমান উদ্ভিজ্জ রঞ্জকগুলোর মধ্যে ক্লোরোফিলের পরেই অ্যান্থোসায়ানিনের অবস্থান।
মানব দেহে অ্যান্থোসায়ানিনের প্রভাব : অ্যান্থোসায়ানিন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলছে। গত দুইদশক ধরে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফলে অ্যান্থোসায়ানিনের নিম্নের বর্ণিত প্রভাব/উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়েছে-
(১) অ্যান্থোসায়ানিন একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা মানব দেহে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
(২) অ্যান্থোসায়ানিন মানব দেহে ক্যান্সার, হৃদরোগ, নিউরোডি জেনারেটিভ ব্যাধি, বার্ধক্যজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়।
(৩) সিরামে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বৃদ্ধি, কোলস্টেরল বণ্টন, স্থূলতা হ্রাস, দৃষ্টি রোগ পুনঃস্থাপন ও লোহিত কণিকাকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
প্রকৃতিতে অ্যান্থোসায়ানিনের প্রভাব :
(১) অ্যান্থোসায়ানিন উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফলকে বর্ণিল করে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ এবং প্রাণীকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে পরাগায়ন ও প্রাকৃতিকভাবে বীজ বিস্তারে সাহায্য করে।
(২) অ্যান্থোসায়ানিন আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উদ্ভিদ কুলকে রক্ষা করে।
যে সবজিগুলোতে অ্যান্থোসায়ানিন পাওয়া যাবে : অ্যান্থোসায়ানিনের প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে রঙিন শাকসবজি। যেমন- লালশাক, লালমুলা, লালবরবটি, লাল মিষ্টিআলু, লাল গোলআলু, লালশিম ও শিমের বীজ, লাল লেটুস, লাল বাঁধাকপি, লাল ফুলকপি, কালো বেগুন এবং লাল ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম ইত্যাদি।
উন্নত বিশ্বে অ্যান্থোসায়ানিনের ব্যবহার : বিশ্বে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও আমেরিকায় বহুপূর্ব থেকেই অ্যান্থোসায়ানিনের ব্যবহার শুরু করেছে। অ্যান্থোসায়ানিনের স্বাস্থ্য গুণাগুণ বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী উচ্চ মাত্রায় অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ ট্রান্সজেনিক আপেল উদ্ভাবন করেছেন। এ ফলগুলোর গায়ে ও ভেতরে সাধারণ আপেলের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি হওয়ায় এদের বর্ণ লাল। বর্তমানে এটি ক্যাপসুল আকারে বাজারজাতকরণ শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম ২০০১ সালে নরওয়েভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘বায়োলিংক গ্রুপ’ অ্যান্থোসায়ানিন ক্যাপসুল ‘ম্যাডক্স’ প্রস্তুত করেন এবং প্রাথমিকভাবে নরওয়েতে বাজারজাতকরণ করা হয়। পরে ২০০৭ এর প্রথম দিকে আমেরিকায় বাজারজাত করণের জন্য ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে।
বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে অ্যান্থোসায়ানিন নিয়ে করণীয় :
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সবজি বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টার ও বিএডিসির বীজ উৎপাদন খামারগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে পারেন। এর মধ্যে দেশের কিছু এলাকায় অগ্রসর শিক্ষিত চাষিরা স্বল্প পরিসরে হলে ও লালমুলা, লালবরবটি, লাল বাঁধাকপি ও ফুলকপি, লাল ও হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম, কালো বেগুন ইত্যাদি উৎপাদন করে অভিজাত এলাকায় বিক্রি ও হোটেলে সরবরাহ করছে। উৎপাদনের বিরাট একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রঙিন সবজির অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদন উপযোগিতা যাচাই করার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। সাথে সাথে রঙিন সবজির উন্নত ও অধিক উৎপাদনশীল জাত উদ্ভাবন করার ব্রিডিং কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারেন। অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচলিত সবজির পরিবর্তে রঙিন সবজির আবাদ ও খাদ্য তালিকায় রঙিন সবজির অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা শুরু করা যেতে পারে।
গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা বিষয়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার সহায়তা কাজে লাগানো যেতে পারে। অন্যান্য সবজি খাওয়ার সাথে সামান্য পরিমাণ হলেও রঙিন সবজি গ্রহণে ভোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক চাহিদার আলোকে রঙিন সবজি উৎপাদন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পূর্বে বলা হয়েছে, সবজি উৎপাদন ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানোর প্রয়োজনে সবজির উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সবজির উৎপাদন হতে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতেই প্রতি বছর প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এটা কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
পুষ্টিবিদদের মতে, একজন মানুষের প্রতিদিন ২২০-২২৫ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের লোকজনের খাদ্য তালিকায় এখনো সবজির পরিমাণ মাত্র ১২৫ গ্রাম (সূত্র : এফএও, ডিএই)। অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রচলিত সবজির চেয়ে রঙিন সবজির দাম ২-৩ গুণ বেশি। কাজেই রঙিন সবজি চাষাবাদ করে কৃষকদের আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন এবং অ্যান্থোসায়ানিনের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব।
ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সগবি, বিএআরআই, নোয়াখালী, মোবাইল-০১৮২৭-৮৬৫৮৬০, ই-মেইল -psoofrdbari@gmail.com
বাউ-সালাদকচু উৎপাদন প্রযুক্তি
ড. এম এ রহিম১ ড. সুফিয়া বেগম২
বাউ-সালাদকচু (Colocasia gigantea) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি জাত। ইহা একটি অপ্রচলিত কন্দ জাতীয় উদ্ভিদ যা বাণিজ্যিকভাবে বৃষ্টিবহুল উচ্চজমি, বাড়ির বাগান, পতিত জমি ও ছাদ বাগান এবং আন্তঃফসল পদ্ধতিতে যেমন- কলা, আনারস বা অন্যান্য দীর্ঘতম ফসল এবং পাহাড়ি অঞ্চলে ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত জায়গায় চাষাবাদ হতে পারে। সালাদকচু ট্রপিক্যাল অঞ্চল যেমনÑ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে প্রচুর চাষ হয়। করম, পাতা এবং পাতার ডাঁটাগুলো শাকসবজি এবং ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন- বাংলাদেশের খাদ্য সুরক্ষা, দুর্ভিক্ষ এবং দারিদ্র্য বিমোচন মোকাবিলা করতে পারে।
জাতটি স্থানীয়ভাবে সালাদ কচু নামে পরিচিত কারণ এটি সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে এবং গলা চুলকায় না। বাউ-সালাদকচু অৎধপবধব পরিবারের ভেষজ উদ্ভিদ। এই ফসলের পাতাগুলোর আকার ঢেউ খেলানো ও ডাটা লম্বা হয়। পাতাগুলো হৃদয়ের আকারের এবং খাঁড়া প্রকৃতির, গভীর নিলাভ সবুজ ও পাতার উপরি ভাগ গ্লেসি হয়। এই প্রজাতিটি মূলত বান্দরবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক হয় কারণ এই অঞ্চলের লোকেরা দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটে খাদ্য হিসেবে ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে। আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করা যায় বলে এর উৎপাদন খরচ খুবই কম।
জমি নির্বাচন
বাংলাদেশের সর্বত্র চাষযোগ্য এবং ২৩-৩০০ সেন্টিগ্রেড, তাপমাত্রা যুক্ত অঞ্চলে চাষ করা যেতে পারে। এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না এবং সামান্য ছায়া পছন্দ করে। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করা ভালো।
জাত : সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক বাউ-সালাদ কচু জাতটি নিবন্ধিত হয়েছে। জাতটি উচ্চফলনশীল ও পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ।
চাষাবাদ পদ্ধতি : ৪-৫টা চাষ দিয়ে এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে নিতে হবে। ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ (১৫-২০ সেন্টিমিটার) গভীরতাসহ জমি চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। মাটির পিএইচ ৫.৫ থেকে ৬.৫ পর্যন্ত। উদ্ভিদ গ্লোবিউলাস/দীর্ঘায়িত করম এবং প্রচুর চারা উৎপন্ন করে। করম কাটিং এবং ছোট চারা বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বছরব্যাপী চাষাবাদ করা যায়। রোপণ দূরত্ব ৬০ী৪৫ সেমি.। অতিরিক্ত ঠান্ডা অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে রোপণ না করলেও চলে।
সার প্রয়োগ : সাধারণত জৈবসার দিলেই চলে। গোবর ১৫ টন/হেক্টর ব্যবহার করা যেতে পারে। জমি তৈরির সময় শেষ চাষের পরে গোবর সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
আন্তঃপরিচর্যা : আগাছা ১ সপ্তাহ পরপর পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে পানি সেচ ও নিষ্কাশন করতে হবে। খড়া মৌসুমে চারা লাগানো হলে প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায় পানি সেচ প্রয়োজন। দেড় থেকে দুই মাস পর চারা পাতলাকরণ করে অন্য জায়গায় লাগাতে হবে।
রোগবালাই : সালাদ কচুর তেমন কোনো রোগবালাই নাই। তবে কবুতর ও মুরগি কচিপাতা ভক্ষণ করতে পারে। তাই জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ : সারা বছরই নতুন লাগানো চারা থেকে পাতা-ডাঁটা, সবজি হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। করম আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সংগ্রহ করা যায়, যখন গাছগুলো হলুদ হয়ে যায় বা মারা যায়। হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ টন করম পাওয়া যায়। বাউ-সালাদকচু কাঁচা অবস্থায় সালাদ হিসেবে ভক্ষণযোগ্য এবং রান্না করে সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফসল সংরক্ষণ : সাধারণত মুখী কচুর মতোই কন্দমুখী বীজ, সাকার/ছোট চারা বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই জন্য ছোট কন্দ যদি ভিজা থাকে তবে হালকা রৌদ্রে শুকিয়ে ঠাণ্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রযুক্তির সুবিধা
বাউ-সালাদকচু বাংলাদেশের আদিবাসীগণ গ্রীষ্মকালীন সবজি ফসল হিসেবে চাষ করে আসছে এবং পার্বত্য অঞ্চলের পাশাপাশি সমতল ভূমি অঞ্চলে কলা ও আনারস দিয়ে আন্তঃফসল হিসেবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশে COVID-19 মহামারির সময়ে উদীয়মান খাদ্য নিরাপত্তা সংকট, পরিবেশকে রক্ষা ও জাতিকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য সরবরাহের জন্য কৃষি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে সালাদ কচুর মতো অপ্রচলিত ফসল দিয়ে বৈচিত্র্য আনা দরকার। সালাদ কচু সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং পুষ্টিকর খাদ্য, কারণ এটি মাইক্রো-পুষ্টি যেমন : ভিটামিন এ, বি, ইত্যাদি, খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, জিং এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। সালাদ কচুর মতো একটি নতুন ফসলের আবাদ করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখা যেতে পারে।
লেখক : ১প্রফেসর, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। মোবাইল : ০১৭৭২১৮৮৮৩০, ই-মেইল : marahim1956@bau.edu.bd, ২সহকারী অধ্যাপক (অব.) একেইউ ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজ। মোবাইল : ০১৭১৬৬০৭৫৬৬, ই-মেইল : sufia_beg@yahoo.com
আলু এখন আমাদের দেশে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি ফসল। স্বল্পমেয়াদি এ ফসলটির উৎপাদন আয় অন্যান্য ফসলের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের আলু আবাদের অবস্থা তথা আলুর ফলন ও উৎপাদন এলাকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আনুপাতিক হারে উভয়টিই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৪০ লাখ টন আলুর চাহিদার বিপরীতে গড়ে প্রায় ৮০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হচ্ছে। অবশ্যই এটা শুভ লক্ষণ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমাদের দরিদ্র আলু চাষিরা এর সুফল তেমন একটা পাচ্ছে না, পাচ্ছে কোল্ডস্টোর মালিক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। উৎপাদন মৌসুমে আলুর ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কিংবা ন্যায্যমূল্যের আশায় বিকল্প হিসেবে কোল্ডস্টোরে সংরক্ষণ করতে না পেরে আলুর চাষিরা অনেক সময় তা পানির দরে বিক্রি করে দেয় ফলে অনিশ্চিত লাভের কারণে অনেক আলু চাষি সম্ভাবনাময় এ ফসলটির চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পত্রিকায় দেখা গেছে, হিমাগারের সামনে আলুবহনকারী ট্রাকের দীর্ঘলাইন এবং এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর হিমাগার মালিকদের অসাধু রমরমা ব্যবসা। বর্তমান সরকার একটি কৃষিবান্ধব সরকার তাই সরকারের উচিত আলু চাষিদের তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উদ্বৃত্ত আলু বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাছাড়া আলুর নানাবিদ ব্যবহার ও শিল্পের প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যেগী হতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি : ১৯৯৮ সনে এটিডিপি (এ্যাগ্রোবেজ্ড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের প্রোগ্রাম) একটি মার্কেটিং মিশন বাংলাদেশ থেকে সিংঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ফ্রেশ আলু রপ্তানির সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং ১৯৯৯ সনে এটিডিপির উদ্যোগে প্রথম ১২৬ টন আলু উল্লিখিত দেশে রপ্তানি করা হয়। ২০০৫, ২০০৬ সনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু রপ্তানি করা হয়। ২০০৭ সনে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার টনে। ২০১১ সনে বাংলাদেশ থেকে ৭টি প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে (বাসস, ঢাকা)। সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াও বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানি শুরু করেছে। শুধুমাত্র মালয়েশিয়ায় আলুর চাহিদা রয়েছে ১০ লাখ টন, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলংকায় প্রতিটিতে চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ টন করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (EPB) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ২০১৪-১৫ সনে ২৭২ কোটি টাকার আলু বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে যার মধ্যে শুধু মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকার আলু এবং রাশিয়ায় ৭২ কোটি টাকার আলু। বিএডিসির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. শেখ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ পটোটো এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’। যা বিদেশে আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
আলু সংরক্ষণের অবস্থা : গত দুই বছরে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৮৫ লাখ টনে পৌঁছে। উৎপাদিত এ আলুর সর্বোচ্চ ২২-২৫ লাখ টন ৩২৫টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি মাসে ৩.৫ লাখ টন আলুর ব্যবহার হিসাব করলে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন আলুর প্রয়োজন হয়। বাকি ৩০-৪০ লাখ টন চাষির ঘরেই থেকে যায়।
রপ্তানিযোগ্য আলুর বৈশিষ্ট্য : আমাদের দেশে উৎপাদিত সব জাতের এবং সব আকারের আলুই আমদানিকারক দেশের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং শ্রীলংকায় গ্রানুলা জাতের আলুর কদর বেশি। সাম্প্রতিককালে মালয়েশিয়ায় ডায়মন্ট ও কার্ডিনাল জাতের আলু রপ্তানি করা হয়েছে। ১০০ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম ওজন এবং ৪০-৬০ মি.মি আকারের উজ্জ্বল রঙ ও ভাসাভাসা চোখ (shallow eyed tuber) ও অধিক সুপ্তকাল (Longer dormancy) বিশিষ্ট মসৃণ ত্বকের আলু রপ্তানির জন্য বেশি উপযোগী। আলু রপ্তানির সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস কারণ আমদানিকারকরা হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর চেয়ে ফ্রেশ আলু বেশি পছন্দ করে। আলু সংগ্রহের পর হতে কিছু দিনের মধ্যে আলুর আকারের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা (deformations) দেখা যায়, বিশেষ করে হিমায়িত আলু নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে রাখলে রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে মিষ্টতা (Sweetness) বৃদ্ধি পায় ও অন্যান্য গুণগতমানের অবনতি ঘটে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন সংগ্রহের সাথে সাথে (Harvest Period) আলু যাতে করে বিদেশে রপ্তানি করা যায় এ ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
রপ্তানিযোগ্য আলুর আবাদ : আগাম রপ্তানির জন্য এমনভাবে আলু রোপণ করা দরকার যাতে করে ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহ হতে আলু সংগ্রহ করা যায়। নভেম্বরের ১ম সপ্তাহ হতে শুরু করে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত কয়েক ধাপে রোপণ করলে ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহ হতে সংগ্রহ শুরু করে মার্চের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত আলু উঠানো যায়। এরূপ রোপণের ফলে দীর্ঘ সময় কাঁচা আলু সংরক্ষণ না করেও ফ্রেশ অবস্থায় রপ্তানি করা যায়।
আলু রপ্তানি বৃদ্ধিতে করণীয়
▪ আলু রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট চুক্তিবদ্ধ চাষি জোন (Contract growing zone) গঠন করা।
▪ রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত উপযোগী আলুর জাত ছাড়করণ ও কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা।
▪ কাঁচা আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ বোনাস বাড়িয়ে ১০-৩০% করা।
▪ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (Expert Promotion Bureau), হরর্টেক্স ফাউন্ডেশন (Hortex Foundation) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (BADC) কাঁচা আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে কারিগরি সহায়তা প্রদান।
▪ নতুন নতুন কোম্পানি যাতে আলু রপ্তানিতে উদ্যোগী হয় এজন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ড. মো. শাফায়েত হোসেন*
* উপব্যবস্থাপক (বীপ্রস), বিএডিসি, ঢাকা
ধানভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির রূপান্তরে ব্রি’র অবদান
ড. মো. শাহজাহান কবীর১ কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন২
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। উপরন্তু, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের ভিত্তি হচ্ছে কৃষি। কৃষি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়ায় দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি এবং বেশির ভাগ মানুষ তাদের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই কৃষিভিত্তিক শিল্পে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং প্রণোদনা আমাদের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে এবং সেইসাথে একটি ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে পারে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি
বাংলাদেশ কমপক্ষে ৬৮,০০০ গ্রাম দ্বারা বেষ্টিত। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ এবং শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তাই ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের কথা আসলে প্রথমেই আসে খাদ্য নিরাপত্তার কথা। আর খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধান এদেশের মানুষের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে চাল বা ভাতের নিরাপত্তাকে বুঝায়। কেননা, আমাদের প্রাত্যহিক চাহিদার শতকার ৭০-৭৫ ভাগ শর্করা, ৬০-৬৫ ভাগ প্রোটিন, ৮ ভাগ ফ্যাট, ৫.৮ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং ৯১.৬ ভাগ ফসফরাস চাল থেকে পাওয়া যায়।
আগেই বলেছি, মানুষের ক্যালরির চাহিদার বেশির ভাগ আসে ভাত থেকে। দেশে বছরে মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। এছাড়া চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে, যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। তাই বিনা দ্বিধায় বলা যায় ধানই বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং পুষ্টি নিরাপত্তার অর্জনের জন্য আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি ধান উৎপাদন প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
ধান উৎপাদন মওসুম ও পরিবেশ উপযোগী আধুনিক ধান এবং লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১ অক্টোবর ১৯৭০ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ব্রি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশবাসীর খাদ্যচাহিদা পূরণ ও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে তালমিলিয়ে ধানের ফলন, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্রত নিয়ে এ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে ব্রি এ পর্যন্ত ৭টি হাইব্রিড ও ১০১টি ইনব্রিড জাতসহ মোট ১০৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে। খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই করার জন্য বিভিন্ন ঘাতসহনশীল ও স্থানভিত্তিক (Location specific) জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গত তেরো বছরে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর প্রতিটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। যেমন- খরা, বন্যা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু, জিংকসমৃদ্ধ, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, ডায়াবেটিক রাইসসহ অধিক উচ্চফলনশীল। পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি এখন পর্যন্ত ১২টি লবণাক্ততাসহিষ্ণু, ৩টি খরাসহনশীল, ৩টি বন্যাসহনশীল, ২টি Tidal Submergence tolerant জাত ও ৩টি ঠান্ডা সহনশীল উদ্ভাবন করেছে। উচ্চতাপমাত্রা বা হিটশক ঝুঁকি এড়াতে উচ্চতাপমাত্রা সহনশীল একটি জাত ছাড়করণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ব্রি উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মোট লবণাক্ত এলাকার প্রায় ৩৫ ভাগ ধান চাষের আওতায় এসেছে এবং এ থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২%। খরাপ্রবণ এলাকায় খরাসহিঞ্চু জাতগুলো সম্প্রারণের মাধ্যমে ১২% আবাদ এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে যেখান থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০%। জলমগ্নতা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২৬% এলাকা চাষের আওতায় এসেছে যেখানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯%। উপকূলীয় এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত জোয়ার-ভাটা সহনশীল জাত (ব্রি ধান৭৬, ৭৭) সম্প্রসারণের ফলে প্রায় ৫৭০০০হে. জমি এই ধান চাষের আওতায় এসেছে। সর্বোপরি, ২০২০-২১ সালে উচ্চফলনশীল ধানের জাতসমূহ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়েছে এবং এ থেকে পাওয়া গেছে দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯১ ভাগ। ঘাতসহনশীল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের ফলে ২০১০-২১ পর্যন্ত ৬.০ লক্ষ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকা উন্নয়নে উদ্ভাবনী উদ্যোগ
ঘাত সহনশীলতা এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবনই নয় কৃষক সমবায় সংগঠনভিত্তিক যুব উদ্যোক্তা (জীবিকার মাঠ স্কুল, আইপিএম ক্লাব, আইসিএম ক্লাব, ইত্যাদি) বিকাশের মাধ্যমে জীবিকার উন্নতি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে অবদান রেখেছে ব্রি। ব্রি উদ্ভাবিত উদ্ভাবনী প্রযুক্তিসমূহ শুধুমাত্র অনুকূল নয় বরং প্রতিকূল ইকোসিস্টেমেও ক্রমাগত বর্ধিত ধান উৎপাদনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ১৯৭০-৭১ সালের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, জনসংখ্যা দ্বিগুণ বাড়লেও ধান উৎপাদন প্রায় চারগুণ হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রির অসামান্য অবদানের কারণে অতীতের তীব্র খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অবজ্ঞা করেছিলেন পঞ্চাশ বছর পরে সে দেশটি কে একই দেশের একটি নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্র ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের জন্য রোল মডেল বলে আখ্যায়িত করেছে’ (The Christian Science Monitor,17 June 2015)। একসময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি এখন শক্ত ভিত্তির উদ্বৃত্ত খাদ্যের বাংলাদেশ; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং গড় ফলনের হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম অসামান্য অর্জন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি জাতির পিতার সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনা, বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, ধান বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের নিরলস পরিশ্রম। এই অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষকপর্যায়ে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে।
উন্নত জীবিকা এবং অর্থনীতির রূপান্তর
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অভিবাসন নিরুৎসাহিত করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ধানভিত্তিক কৃষির কোনো বিকল্প নেই। বহির্বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে আমাদেরও ধান চাষে আধুনিক জাত এবং প্রযুক্তির বিস্তার ও ব্যবহার বাড়াতে পারলে দেশেই বিদেশের তুলনায় বেশি আয় করা সম্ভব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় থাকা মানুষ এখন টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের মতো উন্নত সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করে। ক্রমবর্ধমান ধান উৎপাদনের মাধ্যমে ক্ষুধা মেটানো এ ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে ব্রির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে দেশে খাদ্য আমদানি হ্রাস পাওয়ায় সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সরকার দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ে অবদান রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে।
ক্ষুধামুক্ত জাতি গঠনে ধানভিত্তিক খামার ব্যবস্থা
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবন করা হয়েছে উচ্চফলনশীল ধানের একাধিক জাত ও লাভজনক শস্যক্রম। যেমন- স্বল্প জীবনকালের খরাসহনশীল ব্রি ধান৫৬/খরা পরিহারকারী ব্রি ধান৫৭ এবং জিংকসমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২ চাষ করে বৃষ্টিনির্ভর বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বিনা সেচে ছোলা এবং মসুর চাষ করা যায় এমন একটি অধিক লাভজনক শস্যবিন্যাস তৈরি করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। এ শস্যবিন্যাস অবলম্বন করে একটি জমির উৎপাদনশীলতা ১৮-৩২ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব (আরএফএস বিভাগ, ব্রি)।
উত্তরের জেলাগুলোতে যেখানে বৃষ্টিনির্ভর স্বর্ণা জাতের প্রচলন ছিল সেখানে ব্রি উদ্ভাবিত আধুনিক আমন জাতগুলো যেমন- ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭০, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৯৩ এবং ব্রি ধান৯৪ জাতগুলো প্রবর্তন করার মাধ্